এ আক্রমণের জন্য কীর্তি রায় পূর্ব থেকে প্রস্তুত ছিলেন, কেবল প্রস্তুত ছিলেন না নরনারায়ণের সঙ্গে গঞ্জালেসের যোগদানের জন্য। রাজা রামচন্দ্র রায় এবং রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের সঙ্গে গজ্ন্জালেসের কয়েক বৎসর ধরে শত্রুতা চলে আসছে, এ অবস্থায় গঙ্জালেস যে তাঁদের পত্তনিদার নরনারায়ণ রায়ের সঙ্গে যোগ দেবে, এ কীর্তি রায়ের কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তা হলেও কীর্তি রায়ের গড় থেকেও তোপ চলল।
গঞ্জালেস সুদক্ষ নৌ বীর। তার পরিচালনে দশখানা সুলুপ চড়া ঘুরে গড়ের পাশের ছোট খালে ঢুকতে গিয়ে কীর্তি রায়ের নওয়ারার এক অংশ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হল। গড়ের কামান সেদিকে এত প্রখর যে খালের মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে বহর মারা পড়ে। গঞ্জালেস দুখানা কামান বাহী সুলুপ ছোট খালের মুখে রেখে বাকী গুলো সেখান থেকে ঘুরিয়ে এনে চড়ার পিছনে দাঁড় করালে। গঞ্জালেসের অধীনস্থ অন্যতম জলদস্যু মাইকেল রোজারিও ডি ভেগা এই ছোট বহর খালের মধ্যে ঢুকিয়ে গড়ের পশ্চিম দিক আক্রমণ করবার জন্যে আদিষ্ট হল।
অতর্কিত আক্রমণে কীর্তি রায়ের নওয়ারা শত্রু বহর কর্তৃক ছিপি আাঁটা বোতলের মতন খালের মধ্যে আটকে গেল — বার নদীতে গিয়ে যুদ্ধ দেবার ক্ষমতা তাদের আদৌ রইল না। তবুও তাদের বিক্রমে রোজারিও অনেকক্ষণ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারলে না। কীর্তি রায়ের নৌ বহর দুর্বল ছিল না, কীর্তি রায়ের গড় থেকে পর্তুগীজ জলদস্যুদের আড্ডা সন্দ্বীপ খুব দূরে নয়, কাজেই কীর্তি রায়ের নৌ বহর সুদৃঢ় করে গড়তে হয়েছিল।
বৈকালের দিকে রোজারিওর কামানের মুখে গড়ের পশ্চিম দিকটা একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। নরনারায়ণ রায় দেখলেন প্রায় ত্রিশখানা কোষা জখম অবস্থায় খালের মুখে পড়ে, কীর্তি রায়ের গড়ের কামানগুলো সব চুপ,নদীর দু’পাড় ঘিরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। উর্ধ্বে নিস্তব্ধ নীল আকাশে কেবলমাত্র এক ঝাঁক শকুনি কীর্তি রায়ের গড়ের উপর চক্রাকারে ঘুরছে — হঠাৎ বিজয়োন্মত্ত নরনারায়ণ রায়ের চোখের সম্মুখে বন্ধু পত্নীর বিদায়ের রাতের সন্ধ্যার পদ্মের মতন বিষাদভরা ম্লান মুখখানি, কাতর মিনতিপূর্ণ সেই চোখদুটি মনে পড়ল — তীব্র অনুশোচনায় তাঁর মন তখনি ভরে উঠল। তিনি করেছেন কি! এই রকম করে কি তিনি তাঁর স্নেহময়ী প্রাণদাত্রীর শেষ অনুরোধ রাখতে এসেছেন? নরনারায়ণ রায় হুকুমজারি করলেন — কীর্তি রায়ের পরিবারের এক প্রাণীরও যেন প্রাণহানি না হয়।
একটু পরেই সংবাদ এল, গড়ের মধ্যে কেউ নেই। নরনারায়ণ রায় বিস্মিত হলেন। তিনি তখনি নিজে গড়ের মধ্যে ঢুকলেন। তিনি এবং গঞ্জালেস গড়ের সমস্ত অংশ তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন — দেখলেন সত্যি কেউ নেই। পর্তুগীজ বহরের লোকেরা গড়ের মধ্যে লুঠপাট করতে গিয়ে দেখলে মূলবান দ্রব্যাদি বড় কিছু নেই। পরদিন দ্বিপ্রহর পর্যন্ত লুঠপাট চলল। কীর্তি রায়ের পরিবারের এক প্রাণীরও সন্ধন পাওয়া গেল না। অপরাহ্নে কেবলমাত্র দুখানা সুলুপ খালের মুখে পাহারা রেখে নরনারায়ণ রায় ফিরে চলে গেলেন।
এই ঘটনার দিনকয়েক পরে, পর্তুগীজ্জ জলদস্যুর দল লুঠপাট করে চলে গেলে, কীর্তি রায়ের এক কর্মচারী গড়ের মধ্যে প্রবেশ করে। আক্রমণের দিন সকালেই এ লোকটি গড় থেকে আরও অনেকের সঙ্গে পালিয়েছিল। ঘুরতে ঘুরতে একটা বড় থামের আড়ালে সে দেখতে পেলে একজন আহত মুমূর্ষ লোক তাকে ডেকে কি বলবার চেষ্টা করছে। কাছে গিয়ে সে লোকটাকে চিনলে, লোকটি কীর্তি রায়ের পরিবারের এক বিশ্বস্ত পুরনো কর্মচারী। তার মৃত্যুকালীন অস্পষ্ট বাক্যে আগন্তুক কর্মচারীটি মোটামুটি যা বুঝলে, তাতেই তার কপাল ঘেমে উঠল। সে বুঝলে কীর্তি রায় তাঁর পরিবারবর্গ এবং ধনরত্ন নিয়ে মাটির নিচের এক গুপ্তস্থানে আশ্রয় নিয়েছেন এবং এই লোকটিই একমাত্র তার সন্ধান জানে। তখনকার আমলে এই গুপ্ত গৃহগুলি প্রায় সকল বাড়িতেই থাকত এবং এর ব্যবস্থা এমন ছিল যে বাইরে থেকে কেউ এগুলো না খুলে দিলে তা থেকে বেরুবার উপায় ছিল না। কোথায় সে মাটির নিচে ঘর, তা স্পষ্ট করে বলবার আগেই আহত লোকটি মারা গেল। বহু অনুসন্ধানেও গড়ের কোন অংশে সে গুপ্ত গৃহ ছিল তা কেউ সন্ধান করতে পারলে না।
এই রকমে কীর্তি রায় ও তাঁর পরিবারবর্গ অনাহারে তিলে তিলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে গড়ের যে কোন নিভৃত ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন, তার আর কোন সন্ধানই হল না। সেই বিরাট প্রাসাদ দুর্গের পর্বতপ্রমাণ মাটি পাথরের চাপে হতভাগাদের সাদা হাড়গুলো কোন বায়ুশূন্য অন্ধকার ভূ কক্ষে তিলে তিলে গুঁড়ো হচ্ছে, কেউ তার খবর পর্যন্ত জানে না।
ঐ ছোট খালটা প্রকৃতপক্ষে সন্দ্বীপ চ্যানেলেরই একটা খাড়ি। খাড়ির ধার থেকে একটুখানি গেলে গভীর অরণ্যের ভিতর কীর্তি রায়ের গড়ের বিশাল ধ্বংসস্তুপ এখনও বর্তমান আছে দেখা যাবে। খাল থেকে কিছু দূরে অরণ্যের মধ্যে দুই সার প্রাচীন বকুল গাছ দেখা যায়, এখন এ বকুল গাছের সারের মধ্যে দুর্ভেদ্য জঙ্গল আর শূলোকাঁটার বন, তখন এখানে রাজপথ ছিল। আর খানিকটা গেলে একটা বড় দীঘি চোখে পড়বে। তারই দক্ষিণে কুচো ইঁটের জঙ্গলাবৃত স্তূপে অর্ধপ্রোথিত হাঙ্গরমুখো পাথরের কড়ি, ভাঙ্গা থামের অংশ — বারভুঁইয়াদের বাংলা থেকে, রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের বাংলা থেকে, বর্তমান যুগের আলোয় উঁকি মারছে। দীঘির যে ইষ্টক সোপানে সকাল সন্ধ্যায় তখন অতীত যুগের রাজবধূদের রাঙা পায়ের অলক্তক রাগ ফুটে উঠত, এখন সেখানে দিনের বেলায় বড় বড় বাঘের পায়ের থাবার দাগ পড়ে, গোখুরা-কেউটে সাপের দল ফণা তুলে ঘুরে বেড়ায়।