- বইয়ের নামঃ গল্প (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)
- লেখকের নামঃ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অন্নপ্রাশন
খোকার অবস্থা শেষ রাত হইতে ভালো নয়।
কী যে অসুখ তা-ই কী ভালো করিয়া ঠিক হইল? জন্তিপুরের সদানন্দ নাপিত এসব গ্রামে কবিরাজি করে, ভালো কবিরাজ বলিয়া পসারও আছে। সে বলিয়াছিল, সান্নিপাতিক জ্বর। মহেশ ডাক্তারের কম্পাউন্ডার একটাকা ভিজিটে রোগী দেখে, সে বলিয়াছিল, ম্যালেরিয়া। মহেশ ডাক্তারকে আনিবার মতো সংগতি থাকিলে এতদিন তাহাকে আনা হইত; কাল বৈকালে যে আনা হইয়াছিল সে নিতান্ত প্রাণের দায়ে, খোকা ক্রমশ খারাপের দিকে যাইতেছে দেখিয়া খোকার মা কান্নাকাটি করিতে লাগিল, পাড়ার সকলেই মহেশকে আনিবার পরামর্শ দিল, পরিবারের গায়ের একমাত্র সোনার অলংকার মাকড়ি জোড়াটা বাঁধা দিয়া আটটা টাকা কেশব ঘোড়ারগাড়ির ভাড়া ও ভিজিটেই ডাক্তারের পাদপদ্মে ঢালিয়াছে। তবুও তো ওষুধের দাম বাকি আছে, নিতান্ত কম্পাউন্ডারবাবু এখানে ডাকতোক পান, সেই খাতিরেই টাকা-দুই আন্দাজ ওষুধের বিলটা এক হপ্তার জন্য বাকি রাখিতে রাজি হইয়াছেন।
এই তো গেল অবস্থা!
মহেশ ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, কোনো আশা নাই। অসুখ আসলে নিউমোনিয়া, এতদিন যা-তা চিকিৎসা হইয়াছে। রাতটা যদি বা কাটে, কাল দুপুরে ‘ক্রাইসিস’ কাটাইবার সম্ভাবনা কম।
কেশব এ কথা জানিত, কিন্তু স্ত্রীকে জানায় নাই। শেষরাত্রের দিকে যখন খোকার হিক্কা আরম্ভ হইল, খোকার মা বলিল—ওগো, খোকার হিক্কা উঠেছে, একটু ডাবের জল দিলে হিক্কাটা সেরে যাবে এখন।
জল দেওয়া হইল, হেঁচকি ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, কমিবার নামটিও করে। অতটুকু কচি বালকের সে কী ভীষণ কষ্ট! এক-একবার হেঁচকি তুলিতে তার ক্ষুদ্র দুর্বল বুকখানা যেন ফাটিয়া যাইতেছে। আর তার কষ্ট দেখা যায় না, তখন
কেশবের মনে হইতেছিল, “হে ভগবান! তুমি হয় ওর রোগ সারিয়ে দাও, নয় তো ওকে নাও, তোমার চরণে স্থান দাও, কচি ছেলের এ কষ্ট চোখের ওপর আর দেখতে পারি নে।”
সূর্য উঠিবার পূর্বেই খোকা মারা গেল।
কেশবের স্ত্রী কাঁদিয়া উঠিতেই পাশের বাড়ি হইতে প্রৌঢ়া বাঁড়ুয্যে-গিন্নি ছুটিয়া আসিলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁর তিন মেয়ে আসিল। সামনের বাড়ির নববিবাহিতা বধূটিও আসিল। বধূটি বেশ, আজ মাস-দুই বিবাহ হইয়াছে, কিন্তু খোকার অসুখের সময় দু-বেলা দেখাশোনা করা, রোগীর কাছে বসিয়া খোকার মাকে স্নানাহারের অবকাশ দেওয়া, নিজের বাড়ি হইতে খাবার করিয়া আনিয়া খোকার মাকে খাওয়ানো—ছেলেমানুষ বউয়ের কাণ্ড দেখিয়া সবাই অবাক। এখন সে আসিয়া কাঁদিয়া আকুল হইল। বড়ো নরম মনটা।
দশ মাসের ছেলে মোটে। শ্মশানে লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই।
খোকাকে কাঁথা জড়াইয়া কেশব আগে আগে চলিল, তার সঙ্গে পাড়ার আরও তিন-চারজন লোক। ঘন বাঁশবাগান ও বনের মধ্যে পুঁড়ি-পথ। এত সকালে এখনও বনের মধ্যে রৌদ্র প্রবেশ করে নাই, হেমন্তের শিশিরসিক্ত লতাপাতা, ঝোপঝাপ হইতে একটা আর্দ্র অস্বাস্থ্যকর গন্ধ বাহির হইতেছে।
ওপাড়ার সতু বলিল—আর বেশিদূর গিয়ে কী হবে, কী বলো রজনি খুড়ো? এখানেই–
কেশব বলিল—আর একটু চলো বিলের ধারে—
বিলের ধারে ঘন বাঁশবনের মধ্যে গর্ত করিয়া কাঁথা-জড়ানো শিশুকে পুঁতিয়া ফেলা হইল। দশ মাসের দিব্যি ফুটফুটে শিশু, কাঁথা হইতে গোলাপ ফুলের মতো ছোট মুখখানি বাহির হইয়া আছে। মুখখানিতে ছোট্ট একটুখানি হাঁ, মনে হইতেছে যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কেশবের কোলেই ছেলে, গর্তের মধ্যে পুঁতিবার সময় সে বলিল—গা এখনও গরম রয়েছে।
রজনী খুড়ো ইহাদের মধ্যে প্রবীণ, তিনি বলিলেন—আহা-হা, ওসব ভেব না। সতু, নাও না ওর কোল থেকে, ওর কোলে কী বলে রেখে দিয়েছে?
গর্তে মাটি চাপানো হইল। কেশব অবাক নয়নে গর্তের মধ্যে যতক্ষণ দেখা যায়, চাহিয়া রহিল। ছোট্ট মুঠাবাঁধা হাত দুটি মাটি চাপা পড়িয়া অদৃশ্য হইবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা শেষ হইয়া গেল।
রজনী খুড়ো বলিলেন—চল হে বাবাজি, ওদিকে আর চেয়ো না। সংসার তবে আর বলেচে কেন? আমারও একদিন এমন দিন গিয়েছে, আমার সেই মেয়েটা জানো তো সবই। আজ আবার তোমার মনিব-বাড়ি কাজ, তোমায় তো সেখানে থাকতে হবে। দেখো তো, দিন বুঝে আজই—
কাজটা সাঙ্গ হইয়া গেল খুব সকালেই। বাড়ি যখন ইহারা ফিরিল, তখন সবে রৌদ্র উঠিয়াছে।
একটু পরে সান্যাল-বাড়ি হইতে লোক আসিল কেশবকে ডাকিতে। বলিল— আসুন মুহুরি মশায়, বাবু ডাকচেন। তিনি সব শুনেছেন, কাজকর্ম করলে মনটাকে ভুলে থাকবেন, সেই জন্যে ডেকে নিয়ে যেতে বলে দিলেন।
আজ সান্যাল বাড়ির মেজোবাবুর ছেলের অন্নপ্রাশন। সান্যালেরা গ্রামের জমিদার না-হইলেও খুব সম্পন্ন গৃহস্থ বটে। পয়সাওয়ালা ও বর্ধিষ্ণু। এ অঞ্চলে প্রতিপত্তিও খুব। তেজারতিতেও ষাট-সত্তর হাজার টাকা খাটে। পাশাপাশি আট দশখানা গ্রামে এমন চাষি প্রায় নাই, যে সান্যালদের কাছে হাত পাতে নাই।
কেশব বলিল, চল যাচ্চি, ইয়ে…বাড়িতে একটু শান্ত করে যাই! মেয়েমানুষ, বড্ড কান্নাকাটি করছে।
সান্যালেরা লোক খুব ভালো। বৃদ্ধ সান্যাল মশায় কেশবকে দেখিয়া বলিলেন, আরে এসো, এসো কেশব। আহা, শুনলাম সবই। তা কী করবে বলো। ও দেবকুমার, শাপভ্রষ্ট হয়ে এসেছিল, কী রূপ, তোমার অদৃষ্টে থাকবে কেন? যেখানকার জিনিস সেখানে চলে গিয়েছে। তা ও আর ভেব না, কাজকর্মে থাকো, তবুও অনেকটা অন্যমনস্ক থাকবে। দেখো গিয়ে বাড়ির মধ্যে, ভাতের উনুনগুলো কাটা হচ্ছে কিনা। বউমাকেও আনতে পাঠাচ্চি, তিনিও এসে দেখাশোনা করুন, কাজের বাড়ি ব্যস্ত থাকবেন।