জুলি বলল, আর তুমি যে একেকটা দুরন্তপনামি করে আর বাহবা-বাহ-বাহা করে ওঠো? শুধু জোনি যিশু করলেই আদর হয় না। সবেতে ও-রকম আমার ছেলে কী দারুণকীর্তি করেছে ভাব দেখালে প্রশ্রয় হয় যেটা আদরের চেয়েও খারাপ। জানিস শমী, সেদিন ভুলে চাবি না নিয়ে সদর দরজা টেনে দিয়ে বেরিয়েছে। তিনজনেই বেরিয়েছি। চাবি না নেওয়ার দোষটা ওর। তারপরে ফিরে রাত নটায় আর বাড়ি ঢুকতে পারি না। ওদিকে উনি, মানে সিজারচন্দ্র কোত্থেকে লাঠি জোগাড় করে পেছন দিকের দরজা দমাদ্দম পিটিয়ে তার ছিটকিনি খুলে ফেলেছে। সে এক কাণ্ড! আর তোর বরুণদার সে কি স্মিতমুখ, ভাবটা ছেলের মতো ছেলে তৈরি করেছি একখানা। গণ্ডগোলটা নিজে পাকিয়েছিল কিনা! এখন তুইই বল রাত নটায় ওভাবে খিড়কির দরজার ছিটকিনি খোলার কৌশলটা যদি চোর-ডাকাতের চোখে পড়ে যায়?
বরুণদা বলল, লুপের জন্য তুমি ভেবো না শমী। সিজার কিন্তু সত্যিই খুব ডিপেন্ডেবল।
দুপুর একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে জুলি বলল, খেয়ে নিই আমরা। ভীষণ খিদে পেয়েছে।
শমীর ইচ্ছে নেই—বলল, আরেকটু দেখি, ওরা খেল না।
বরুণদা আর জুলি হাসি হাসি মুখে চোখাচোখি করল, বরুণদা বললেন, একটা বেজে গেছে অথচ সিজার খায়নি এ হতে পারে না। আর সিজার খেলে লুপুও খাবে। শমী তুমি বিনা দুশ্চিন্তায় খেয়ে নাও।
খেয়ে-টেয়ে মশলা মুখে দিয়ে দু বোনে সব তোলাতুলি করছে, দুই মূর্তি ঢুকল। আওয়াজে আগেই জানান দিয়েছিল।
জুলি মারমুখী হয়ে বলল, কী ব্যাপার? পিঠে বেত ভাঙব নাকি? নিজে তো যা খুশি করছ, বোনটার যে মুখ শুকিয়ে গেছে না খেয়ে না দেয়ে। সে খেয়াল নেই?
সিজার উবাচ, না খেয়ে না দেয়ে? লুপ! বলে লুপের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল।
লুপ বলল, না মাসি আমরা নটরাজ থেকে খেয়ে এলুম। সিজারদা অনেক খাইয়েছে।
রেস্ত কোথায় পেলি? জুলি সিজারের দিকে তাকিয়েছে।
তোমার ব্যাগ। অম্লানবদনে উত্তর দিলেন সিজারবাবু।
বরুণদা বললেন, ওকে চুরি বলে, তুই চোর তা হলে?
সিজার বলল, পকেট মানি দিচ্ছ না যে! গার্লফ্রেন্ডদের কাছে আমার প্রেসটিজ থাকে না।
সিজার আঙুলে চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
শমী-জুলি চুপ। বরুণদাও। লুপ চুপিচুপি মার কানে কানে বলল, মা খুব রাগ করেছ? সীজারদা ব্রেকফাস্টের সময়েই ঠিক করল পাহাড়ে যাবে, বলবার দরকার নেই বলল। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে মা। দারুণ।
শমী যেন অনেক দূরে চলে গেছে, জবাব দিচ্ছে না, কিন্তু তার মুখে রাগের চিহ্নমাত্র নেই। সেও কি যাচ্ছে? স্কুটারে না, সে সময়ে স্কুটারের এত চল তো ছিল না। সাধারণ বাইসাইকেলে ডবল ক্যারি করছে তাকে একটি ছিপছিপে চেহারার লম্বা ছেলে। খুব কোমল মুখ। সবে গোঁফ দাড়ি গজিয়ে মুখটা জঙ্গল হয়েছে। ত্বকের লালিত্য যায়নি এখনও। চোখ দুটো স্বপ্নে ভরা। শালজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কখনও সাইকেলে, কখনও সাইকেলকে হাঁটিয়ে নিজেরা পায়ে হেঁটে, শুকনো শালপাতা দু পায়ে মাড়িয়ে মড়মড় শব্দ করতে করতে।
এই জঙ্গলটা পার হলেই একটা ছোট্ট টাকলামাকান মরুভূমি বুঝলে শমী। বালিতে পা ডুবে যাবে। মরুভূমি পার হলে তবে অজয়। অজয়ে হাঁটুজল। পার হলে কেন্দুবিল্ব। যদি কপালে থাকে, আর রাত জাগতে পারো তো আসল বাউলের গান শুনতে পাবে—ভালো করে পড়গা ইস্কুলে—এ-এ, নইলে কষ্ট পাবি শেষকালে।
জুলি বলল, গেছিস, গেছিস। মাকে না বলে গেছিস কেন রে?
দ্যাখ, মা কী ভীষণ অভিমান করেছে, লুপু আর এ রকম করিস না। জুলি দাঁড়াল না, তার অনেক কাজ। বরুণদা ঘরে চলে গেছে। এই একটা দিনই তো বিশ্রাম। নুপু মায়ের ঊরু জড়িয়ে মাটিতে বসে পড়ে বলল, মা তুমি সত্যি রাগ করেছ? সিজারদাটা যে কি? এমন করে বলে আমি না বলতে পারি না। ওর যা এনথু না! মা, সিজারদাটার মাথায় কয়েকটা স্কু ঢিলে আছে, কিন্তু একেবারে ফ্যানটা!
শমী মৃদু হেসে বলল, এখনও কিছু প্রোগ্রাম আছে না কি তোদের?
তেমন কিছু না। ওয়ার্ড-মেকিং খেলি একটু! খেলি?
এতদূর থেকে রোদে রোদে টহল দিয়ে এলি একটা বইটই নিয়ে বসলে তো হত।
দূর, টহল আবার কি। লুপ ফিক করে হেসে ফেলল।
সত্যিই ওদের বয়সে শুয়ে বসে থাকা কারোই রুটিনে লেখে না। জুলি বেড়াত সারাক্ষণ টঙস টঙস করে। শমী একটু শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু সেও পড়াশোনার সময়টুকু ছাড়া দেখো জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন গড়ে উঠেছে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কলোনি। দেখতে দেখতে উঠে যাচ্ছে সামনে পেছনে জমিশুদ্ধ সুন্দর সুন্দর কোয়ার্টার্স। লরিতে করে কাটা গাছের গুড়ি যখন তখন হু হু করে চলে যাচ্ছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। শমীদের বাড়িটা তখনও শেষ বাড়ি। তারপর থেকেই জঙ্গলের সীমানা আরম্ভ হয়েছে। শালের ঘন জঙ্গল। তার সঙ্গে প্রচুর সেগুন, মহুয়া, ছাতিম, শিরীষ গাছ। জঙ্গলে জঙ্গলে ঘোরাটাই ওর প্রধান করণীয়। তার ফাঁকে ফাঁকে খাওয়া পড়াশোনা ছোটখাটো ঘরের কাজকর্ম। বাবা সকালবেলা ইনস্টিটুটে চলে যাবেন। দুপুরবেলা কোনোদিন খেতে আসবেন। কোনোদিন টিফিন ক্যারিয়ার পৌছে দিতে হবে। বেশিরভাগ দিনই বাড়ির কম্বাইন্ড-হ্যান্ড দীনবন্ধু যায়, সে না পারলে জুলি চলে যায় সাইকেলে চড়ে। কেউ নেই আর, কেউ কোথাও নেই, একমাত্র মেজপিসিমার ছেলে রিনটিনদা ছাড়া। সে ইলেকট্রিক্যাল পড়ছে। হোস্টেলে থাকে। যখনই সময় পায় হঠাৎ হঠাৎ করে দুই বোনের কাছে চলে আসে। জঙ্গল চষা হয় আরও ভালো করে। অনেক দূর চলে গেছে ছুটির দিন সন্ধেবেলায়। সপ্তপর্ণী বৃক্ষের পেছন থেকে চাঁদ ওঠা দেখা হয়েছে। জুলি বলছে, রিনটিনদা তোর খিদে পায়নি, আমরা বেরিয়েছি তখন আড়াইটে, তিনটে হবে। দেখ তো কটা বাজে! জঙ্গলে শেয়াল ডাকছে।