শমী বলল, বলে যাবে তো!
বলে যাবে সিজার? তা হলেই হয়েছে। বলে-টলে যাবার কথা তার স্মরণে থাকলে তো! জুলি কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল। রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে শমীর ঘুম আসে না। চারদিক থেকে একটা নিবিড় আরাম ঘিরে ধরেছে তাকে। এই ফাঁকা ফাঁকা কলোনি, নিষ্কলঙ্ক বিশুদ্ধ বাতাস, বাতাসে গাছের গন্ধ, এ তার কিশোরী বয়সের প্রতিবেশ। গত চার বছর ধরে জুলিরা এখানে আছে। প্রথম থেকেই তাকে ডাক দিচ্ছে। এতদিনে তার আসার সময় হল। যেন মনে হচ্ছে সে এখানেই ছিল। মাঝখানটা অর্থাৎ হোস্টেল, গোয়াবাগান, এন্টালি, বিনায়ক এই সবসুদ্ধ জীবনের অংশটা স্বপ্ন। দরজায় টুকটুক করে আওয়াজ। উঠে দরজা খুলে দিল শমী। যা ভেবেছে তাই। জুলি উঠে এসেছে। ফিসফিস করে বলল-ঘুমোসনি তো! আমিও ঘুমোতে পারিনি। কতদিন পরে দু-বোনে, বল তো! তোর মেয়ে ঘুমিয়েছে?
অনেকক্ষণ। আমিই এপাশ ওপাশ করছি।
কেন রে? বালিশ-টালিশ ঠিক হয়েছে তো? তুই তো পাতলা বালিশে শুস।
বালিশটা কোনো সমস্যা নয়। আমার ঘুম হচ্ছিল না…
নতুন জায়গা বলে না কি রে?
নতুন বলে নয় রে জুলি পুরোনো বলে, শমী যথাসম্ভব ফিসফিস করে বলল।
বিছানার ওপর উঠে এসে জুলি সাবধানে লোপামুদ্রাকে সরিয়ে দিল। তারপর বোনের পাশে ঝপাং করে শুয়ে পড়ল।
তোর এ জায়গাটা পুরোনো লাগল?
দিনের আলোয় লাগেনি। এখন রাতের অন্ধকারে লাগছে…।
শমী বেশি কথা বলতে পারে না। জুলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কী করে যে তোর পুরোনো লাগছে জানি না। কোথায় সে শালের জঙ্গল? বনকাটা বসত কই? রোজই কোয়ার্টাস উঠছে নতুন নতুন…সদ্য কাটা গাছের গুঁড়ি, ডালপালার ছাঁট রাস্তার পাশে সে সব কই?
না-ই থাকল, ছোট্ট গলায় জবাব দিল শমী, অন্ধকারে আমি শালমঞ্জরীর গন্ধ পাই এ রকম ফাঁকা জায়গায় এলেই। আসিনি অনেকদিন। গন্ধটাও পাওয়া হয়ে ওঠেনি। সেইসব দিনের গন্ধ। শমী পাশ ফিরে জুলিকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। জুলি বলল, শমী, তুই কি চিরকাল ছেলেমানুষ থাকবি! শমী জুলিকে ছেড়ে সরে শুল, বলল, আমি তো ছেলেমানুষ নই! আমি তো কোনো কালেও ছেলেমানুষ ছিলাম না জুলি, চিরকাল জ্ঞানবৃদ্ধ, তৌল করে, মেপে চলি, চলি না!
জুলি তরল গলায় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই একেবারে ঠাকুমা-দিদিমা আমি জানি। এখন চুপ কর তো! লুপটা ঠিক তোর মতো হয়েছে। না রে?
শমী অবাক হয়ে বলল, লুপকে তুই আমার মতো কোথায় দেখলি? ও কি দস্যি জানিস! তা ছাড়া ও খুব মিশুক। খেলাধুলো করে। ওর চেহারাও খানিকটা ওর বাবার মতো। সবাই বলে।
সবাই বলুক। ভীষণ একটা আদল আছে। আসলে আজকাল ছেলেমেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার ধরনটা এমন হয়েছে যে ওরা খানিকটা দস্যিগিরি দলে পড়েই করে। এগুলো বাইরের ব্যাপার। ভেতরে ভেতরে ও তোর মতন।
আমার মতো হয়ে আর কাজ নেই। তুই একদিন দেখেই ওর ভেতরটা বুঝে ফেললি।
তোরা রোজ দেখিস তো! আমরা মাঝে মাঝে দেখি বলে আদলটা ঝট করে ধরতে পারি। চুলের ফেরটা ঘাড় কাত করে তাকাবার ভঙ্গিটা। দেখিস ও-ও কথা বলতে বলতে হঠাৎ তোর মতো চুপ হয়ে যায়।
তোর ছেলে কিন্তু তোরও এক কাঠি বাড়া হয়েছে রে জুলি।
যা বলেছিস। সমস্ত গ্যাজেটস-এর পার্টস খুলে ফেলে জানিস, যখন তখন কার্নিশ বেয়ে বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে, লগি দিয়ে বাথরুমের ছিটকিনি ফেলে দিচ্ছে। বাড়িতে লোক এলে তার স্কুটার নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে, যা-তা একেবারে।
পার্টস খুলে ফেলে? তার মনে ও এঞ্জিনিয়ার হবে, দেখিস।
মেকানিকও হতে পারে, জুলি মস্ত বড়ো একটা হাই তুলল।
আমরা পাহাড়ে যাচ্ছি, মা, বাবা, মাসি, আমার পাহাড়ে… স্কুটার নিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে গেল সীজার।
সিজার, সিজার সিজারের বাবা আতঙ্কিত রুষ্ট গলায় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন। কিন্তু স্কুটারের আওয়াজে বেচারার গলায় আওয়াজ একেবারে চাপা পড়ে গেল।
জুলি, তুমি কিছু বললে না।
বলবার সময় পেলে তো বলব। জুলি স্যান্ডউইচে মাখন মাখাতে মাখাতে উত্তর দিল। স্যান্ডউইচগুলো হাতে করে তৈরি করে প্রথমেই দুই ছেলেমেয়েকে দিয়েছে। দুধ ঢেলে দিয়েছে কাপে। সিজার তো খায় না, গেলে। চোঁ করে দুধ খাওয়া হয়ে গেল। তিন চার কামড়ে স্যান্টউইচ শেষ। লুপকে বলল, দেরি করছিস কেন? আর স্টাইল করে খেতে হবে না। এখনও গোঁফে দুধ লেগে যায়। আবার কড়ে আঙুল উঁচু করে কাপ ধরা হয়েছে!
জুলি একটা ধমক দিল, ওর তোর মতো সাপের গেলা নয়। দাঁত আছে তার ব্যবহার করছে। স্টাইল আবার কি? ভদ্রভাবে খাচ্ছে। তোর মতো হাউমাউ করছে এ আমাদের অনেক ভাগ্য।
লুপ কিন্তু একগাল হেসে উঠে দাঁড়িয়েছে—হাতে তখনও স্যান্ডউইচের টুকরো, আমার হয়ে গেছে। চুল নাড়িয়ে সুর করে সে বলল। বলতে বলতে দু-জনেই খোলা দরজা দিয়ে ছুট। তিনজনেই ভেবেছে ওরা বাগানে যাচ্ছে। সিজার যে সোজা গ্যারাজে গিয়ে স্কুটার বার করে ফেলবে, ভাবেনি কেউ।
জুলি বলল, এমনিতে কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু ট্যাঁকে খুঁজে মেয়েটাকেও নিয়ে গেল যে, দলমা পাহাড় কি এখানে?
শমীর চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে, আর থাকতে না পেরে বলল, কী হবে বরুণদা! পাহাড়ের পথে স্কুটারের পেছনে। লুপের তো স্কুটারে চড়ার কোনো অভ্যেসই নেই।
বরুণদার মুখে চোখে ছেলের প্রতি গভীর বিরক্তি ফুটে উঠেছে। কিন্তু উদ্বেগ খুব বেশি নেই। বললেন, ভাবনার কিছু নেই। বিপদের ভয় নেই। ও ছেলেকে এখানে সবাই চেনে। আমার আপত্তি হচ্ছে এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটাতে। নিজে প্ল্যান করেছে, বলবার জানাবার দরকার মনে করে না। মায়ের আদরের ফল। ফল ভোগ তো করতে হবেই। চোদ্দ পনেরো বছরের ধেড়ে ছেলেকে সব সময়ে আমার জোনি, আমার যিশু করে ন্যাকামি করার ফল পেতেই হবে।