জুলি বলল, হ্যাঁরে শমী, তাড়াতাড়ি পা চালা, নইলে স্টিয়ারিং সীজারের হাতে চলে যাবে।
শমী ভুরু কুঁচকে বলল, সে কী? ওর কি লাইসেন্স আছে নাকি! ওর বয়সের ছেলেকে কি লাইসেন্স দ্যায়?
জুলি বলল, ষোল-আঠারো ওসব সাধারণ মানুষের নিয়ম শমী। জিনিয়াসদের ক্ষেত্রে বয়সটা কোনও বাধাই নয়।
বরুণদা বললেন, তা ছাড়া গাড়ির স্টিয়ারিং তো সামান্য কথা জীবনের স্টিয়ারিংটাই আমার ছেলের হাতে চলে বাবার উপক্রম হয়েছে।
শমী হেসে ফেলল, তা হলে আর দেরি নয়, শিগগির চলুন যদি আটকাতে পারি।
বরুণদা কটাক্ষে দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আটকাবে সিজারকে? বলে হাতি ঘোড়া গেল তল, এখন মশা মাপে কত জল!
জুলি রেগে উঠল, দ্যাখো আমাকে যখন তখন হাতি, ঘোড়া, জলহস্তী, বাইসন যা খুশি বলল আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বোনকে খবরদার মশা মাছিটাছি বলতে পারবে না।
বরুণদা হাসতে হাসতে বলল, মাছির আগে যদি টুক করে একটা মউ বসিয়ে দিই? তবে? তবে গ্রাহ্য হবে তো?
শমী বলল, জুলি রাজি হসনি। মউমাছি কী রকম ভিনভিন করে দেখেছিস? ঘেন্না লাগে না ঘুরঘুর করলে? আর সুযোগ পেলেই হুল ফোঁটায়। আমাদের বারান্দার পাশে দোলনচাঁপার অত সুন্দর গাছটা কেটেই ফেলতে হল মউমাছির জ্বালায়।
বরুণদা বলল, দুই বোনই দেখছি সমান বিচক্ষণ। গাড়ি যখন জুলিদের বাড়ির গেটের ভেতর ঢুকল তখন তামাটে দিগন্তে সূর্য একটি গনগনে লাল গোলা। দু-দিকের দুটো দরজা খুলে সিজার আর লুপ আগে পিছে দৌড় দিয়েছে। শমী বলল, কী সুন্দর রে জুলি। রোজ ভোরবেলা বেড়াতে যাব।
বরুণদা বলল, খবরদার এটি কোরো না। ভীষণ ডাকাতের উপদ্রব এ অঞ্চলে, ভোরই বলো, সন্ধেই বলো, নির্জন সময়ে পায়ে হেঁটে এসব রাস্তায় বেরোনোর কথা কল্পনাও কোরো না।
শমী হতাশ গলায় বলল, কী যে বলেন বরুণদা। ওসব আপনার বাহানা। বেরোলে সাহেবের প্রেসটিজ যায় নাকি?
বরুণদা বলল, বেশ তো দিদিকে জিজ্ঞেস করো।
সত্যি রে, জুলি বলল, আমাদের থেকে দক্ষিণে কোণাকুণি ওই বাড়িটা, ওখানে চ্যাটার্জিরা থাকে, রবিবার সকালে চাবি দিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে এসে দ্যাখে স্কুটার টিভি টোস্টার—মানে যাবতীয় গ্যাজেট চুরি গেছে। সেই সঙ্গে ভালো ভালো জামাকাপড়। তা ছাড়াও শুনেছি, গ্যাং রাস্তার মাঝখানে পথ আটকে কত লোকের ঘড়ি আংটি হার সব খুলে নিয়েছে।
শমী বলল, এসব পরাই বা কেন! সিজার, লোপামুদ্রা কখন ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা খেয়াল করেনি, সিজার বলে উঠল, ডোন্ট ওয়ারি মাসি। আমি তোমাদের বেড়াতে নিয়ে যাবো। শুধু টাইমটা আমার বলে দিয়ো। গ্যাং-ট্যাং এলে কী করবি? শমী হেসে বলল।
গ্যাং? আমি নিজেই তো একটা গ্যাং। কী করবে ওরা আমি থাকতে? ফুঃ।
বরুণদা জনান্তিকে বললেন, সিজারের বাণী কিন্তু ফাঁকা আওয়াজ হয় না, বুঝেছ শমী? সাধারণত উনি এত উদার হন না। হয়েছেন যখন অফারটা নিয়ে। নাও।
টেনে বাঁধা চুল খুলতে খুলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল শমী। তামাটে রঙের মাটি। সুন্দর সুন্দর বাড়ি। ছবির মতো। সন্ধে হতেই ঝুপ করে নির্জনতা নেমে পড়ল যেন পাখা বিস্তার করে। জুলি নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে—এখানে জঙ্গল নেই, না রে?
নাঃ। জঙ্গল এখানে পাবি না। তবে এত গাছ, এত সুন্দর সাজানো, সযত্নে গড়ে তোলা পার্ক যে জঙ্গলের অভাব তুই টেরই পাবি না।
শমী ভুরু কুঁচকোল—কী যে বলিস? সাজানো পার্ক আর জঙ্গল এক হল? জঙ্গল যে অরণ্য, আদিম একেবারে প্রাথমিক, স্বতঃস্ফূর্ত, বলতে বলতে শমী হঠাৎ যেন সংকুচিত, হয়ে থেমে গেল। সে বেশি কথা বলতে পারে না। যখন বলে, বলে ফেলে, তখন এমনি করে সংকুচিত হয়।
জুলি ঈষৎ অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখে যেন ভৎসনার দৃষ্টি। বলল, শমী তোর জঙ্গল জঙ্গল বাই এখনও গেল না? সাজানো গাছপালা, বীথিকা, মানুষের হাতে পরিকল্পনা করে পোঁতা গাছ অনেক ভালো বুঝলি? জুলি নিঃশ্বাস ফেলল একটা। তারপর বলল, হ্যাঁ রে, বিনায়ক ঠিক আসবে তো?
না এলে কী? আমি একলাই তো এলাম। একলাই আবার চলে যেতে পারব।
তা নয়, মানে হ্যাঁরে শমী। তোরা একসঙ্গে বেড়াতে যাস না? এই যে তুই চলে এলি ওর দেখাশোনা কে করবে? শাশুড়ি? কিন্তু তোর মন খারাপ করবে না?
শমী হেসে ফেলল, বলল, কেন বেড়াতে যাব না, এই তো গত বছরই গোয় ঘুরে এলাম, জানিসই তো! আর শাশুড়িই তো বরাবর দেখাশোনা করে এসেছেন, এখনই হঠাৎ সেটা বদলে যাবে কেন?
জুলি স্বস্তির হাসি হাসে, বলে, যাই বলিস বাবা, বরছাড়া বিয়ের পর কোথাও যেতে কেমন কেমন লাগে। যেন মনে হয় লোকে মনে করবে দুজনে বনিবনা নেই।
তুই কি তাই-ই ভাবছিস না কি? এবার গম্ভীর হয়ে শমী জিজ্ঞেস করল।
না তা ঠিক নয়।
জুলি ভুলে যাস না তেরো বছর বিয়ে হয়ে গেছে আমার। ছোটোখাটো হলেও একটা কাজকর্ম আমি করি। বনিবনার বাইরের চেহারাটা তোদের মতো গাঢ় নাও হতে পারে।
ভেতরের চেহারাটা ঠিক থাকলেই হল জুলি হেসে বলল—যাক চল তো এখন, তোর বরুণদা চায়ের জন্য অনেকক্ষণ ধরে হাঁকডাক করছে।
চায়ের আসরে দুই ছেলেমেয়েকে দেখা গেল না। শমী ব্যস্ত হলে বরুণদা বললেন, তুমিও যেমন, সিজার নিশ্চয় লুপকে নিয়ে ক্লাবে চলে গেছে। দুজনেই খেলা পাগল, এখন ক্লাবে জুনিয়রদের টেনিস হবে।