একলা একলা মানে একটা গাড়ি…
সব ব্যবস্থা আছে, আমাদের ভ্যানই যাবে।
একটা প্রেসক্রিপশন মানে ব্ল্যাক-আউটটা…
ভদ্রলোকেরা স্নেহের হাসি হাসলেন, পৌঁছে যাবে, ভ্যানে আপনার সঙ্গেই পৌঁছে যাবে।
কোমরের কাছে চওড়া বেল্ট দিয়ে শয্যার সঙ্গে বাঁধা ছিলেন অনিকেতবাবু। তার থেকে অনেক তার বেরিয়েছে।
হ্যাঁ একটা কথা, হাসিমুখে একজন বললেন, আপনি যদি কাইন্ডলি একটা কাগজে সই করে দ্যান।
সামনে মেলে ধরা কাগজটার অনিকেতবাবু দেখলেন তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর কিডনি, হার্ট এসব দান করেছেন। আপত্তি কী? চোখদুটো তো আগেই দান করে রেখেছেন।
তিনি হেসে বললেন, জ্যান্ত থাকতে থাকতে আবার খুবলে নেবেন না যেন।
কথা শুনে ভদ্রলোকেরা সবাই হাসতে লাগলেন। একটা রসিকতা করেছেন বুঝে অনিকেতবাবুও হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতেই সই করে দিলেন।
ব্যস আপনি মুক্ত। বেল্টটা ধীরে ধীরে খুলতে লাগলেন একজন।
উঠতে গিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন অনিকেতবাবু। তিনি তো আর জানতেন না তাঁর হার্ট, কিডনি, সব আগেই বার করে নেওয়া হয়ে গেছে। এসব এখন কাজে লাগবে কোনো অসুস্থ কিন্তু ভোটপ্রদানক্ষম তরুণের। এতক্ষণ তাঁকে যা বাঁচিয়ে রেখেছিল তা হল তাঁর মাথার কাছে রাখা যান্ত্রিক হার্ট, যান্ত্রিক কিডনি। তাঁর মুক্তির মুহূর্তেই সেগুলোর সুইচ অফ করে দেওয়া হয়েছে। এরা নিতে পারেনি শুধু তাঁর বৃদ্ধ, অভিজ্ঞ ব্রেইনটা। নেবার কৌশল এখনও আয়ত্ত করে উঠতে পারেনি, পারবে কি না তা-ও বলা যাচ্ছে না। এমন কি পারলেও নেবে কি?
জীবনের শেষ ধবনি অনিকেতবাবু শুনতে পেলেন সন্দীপন দেশাইয়ের গলায়। সহ্যের অতীত ডেসিবেলে আওয়াজ তুলে বলছেন, হোপ আইল ডাই ইন মাই ওন বেড।
অন্য ভাই
শমী এসেছে আগে। ধৈর্য ধরতে না পেরে। মেয়েকে নিয়ে একলা। ওর স্বামী বিনায়ক কথা দিয়েছে শিগগির আসবে। দু-একদিন থেকে ওদের নিয়ে ফিরে যাবে। সময় জিনিসটা ওর কখনও হয় না। ছুটি জিনিসটাও ও কক্ষনো নাকি পায় না। আসল কথা, শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কের কারও অতিথি হয়ে থাকতে বিনায়কের ভীষণ আপত্তি। কতবার শমী বলেছে, দিদির তো নিজের সংসার। শ্বশুরবাড়ির কেউ নেই। সংকোচ কিসের? অতবড়ো বাংলো, গেলেই একখানা পুরো ঘর, বাথরুম, সামনের ব্যালকনি ছেড়ে দেবে। ব্যালকনিতে তুমি যত খুশি যোগাসন কর না, কেউ দেখতে আসবে না। অত করে বলে জুলি, যেতে দোষ কি? দিদি বেশি বড়ো নয়, শমী তাকে জুলি বলে ডাকতেই অভ্যস্ত। বিনায়কের সঙ্গে কথায় কেউ পারবে না। বলবে—কী আশ্চর্য, দিদি অমন একখানা গ্ল্যামারাস শালী, যেতে বলছে, আমি কি উপায় থাকলে যেতুম না!
শমী এর চেয়ে বেশি কথা বলতে পারে না। তার ছিপছিপে নাতিদীর্ঘ শরীরের ওপর পাতলা ঈষৎ পাণ্ডুর মুখ। গভীরভাবে বসানো চোখের বাদামি মণি হঠাৎ হঠাৎ বড়ো বড়ো পল্লব দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে সে। কোনো তর্কাতর্কির সম্ভাবনা দেখলেই এই তার প্রতিক্রিয়া। নাকের পাটা একটু কাঁপে। কপালের ওপর একটা লম্বা শিরা জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়। শমী বেশি কথা বলতে পারে না।
হঠাৎ দেখলে মনে হবে সে খুব ধাতস্থ। কাণ্ডজ্ঞানের বেড়া ভাঙবার মতো ভাবাবেগের কারবারি আদৌ নয়। কিন্তু একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে ভাবাবেগে কখনও কখনও তার গলার কাছের পেশি ত্বক সব কিছুকে প্রচণ্ড চাপ দিচ্ছে। তারপর বহু চেষ্টায় মস্ত বড়ো একটা খাদ্যপিণ্ডের মতো এবার নেমে যাচ্ছে গলনালি দিয়ে। এসব জিনিস কেউ বড়ো একটা লক্ষ করে না। শমীর স্বামী বিনায়কও না। কাজেই শমী যে কী, শমী যে কে এ প্রশ্ন অনুত্তরই থেকে যায়। আরও অনেক মেয়ে, কিছু কিছু পুরুষ অর্থাৎ আরও কিছু কিছু মানুষের মতো এ লোকযাত্রায় শমী পরিচয়হীন রয়ে গেছে। ছাইয়ের ওপর হালকা ফুলছাপ শিফন শাড়ি পরে, একটা পাতলা সুটকেস একহাতে, আর তার সযত্নলালিত বারো বছরের মেয়ে লোপামুদ্রাকে আর একহাতে নিয়ে শমী যখন প্ল্যাটফর্মে পা দিল, তার দিদি জুলি আর জামাইবাবু বরুণদা দু ধার থেকে মহা হইচই বাধিয়ে দিলেন, যাক শমী তুই শেষ পর্যন্ত আসতে পারলি তা হলে। সূর্যটা তো ঠিক দিকেই উঠেছিল রে।
দেখো চাঁদটা লক্ষ করতে হবে। চাঁদের একটা কিছু গোলমাল হয়ে থাকতে পারে।
জুলি আদর করে কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই খুব রোগা হয়ে গেছিস। বরুণদা বললেন, নিজের সঙ্গে তুলনা করলে তুমি সবাইকেই রোগা দেখবে জুলি। ওটা কোরো না।
নিজেকে বাদ দিয়ে কথা বলো না। জুলি খ্যাঁক করে উঠল, যতই হোক তোমার মতো ভুড়ি আর ডবল গাল তো আমি বাগাতে পারিনি। জানিস শমী, তোর বরুণদার ক্লাবের ওপর কী টান, কী টান। ক্লাবে গিয়ে রোজ সন্ধেবেলা কী হয় বলো তো?
শমী একটু মৃদু স্বভাবের। সে বাধা দিয়ে বলল, ওঃ জুলি, বরুণদার কী সুন্দর লালচে গাল হয়েছে, তুই শুধু ফ্যাটটাই দেখলি!
বরুণদা গালে হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, দেখো বাবা গালাগাল দিচ্ছে না তো?
লোপামুদ্রা ওরফে লুপ তখন তার তিন বছরের বড়োদাদা সীজারের সঙ্গে গল্পে মত্ত। উত্তেজিত হাত-পা নাড়ার মধ্যে থেকে স্টেফি, এডবার্গ, লেন্ডল বুলেটের মতো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। দুজনে এগিয়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে স্টেশন ছাড়িয়ে। বড়োরা কেউ এল, না এল লক্ষই নেই।
বরুণদা বলল, চলো, জুলি শমী তাড়াতাড়ি পা চালাও, সুটকেসটা আমার হাতে দাও, কী এমন মহামূল্যবান সম্পত্তি ওতে করে নিয়ে এসেছ যে তখন থেকে আঁকড়ে রয়েছ?