ছাপা কাগজটার দিকে চেয়ে রইলেন অনিকেতবাবু। ভাষাটা যে দাদামশায়ের বেরোল। দাদামশায় কেন কে জানে এই ভাষায় চিঠিপত্র লিখতেন। তাঁর কাছে রয়েছে কয়েকটা। ভাষাটার কেমন একটা বুড়ো বুড়ো বিজ্ঞ বিজ্ঞ গন্ধ। তাঁর মধ্যে কি দাদামশায়ের ভূত ঢুকল? ঢুকুক, তাই ঢুকুক। রাজনীতির ভূত ঢোকার চেয়ে তা শতগুণে ভালো।
অস্থির হয়ে পায়চারি করতে শুরু করে দিলেন তিনি। গত পঞ্চাশ বছরে মৃত্যুর হার লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। শেষ এপিডেমিক এসেছিল এডসের। এ শহরের সমস্ত হাসপাতাল, নার্সিংহোমের ব্লাড-ব্যাংক, ইনজেকশনের ভূঁচ এডসের ভাইরাসে ভরে গিয়েছিল। সেসময়ে ইউ, এন. ও.-র শাখা ডাবলু. এইচ. ও হাসপাতালগুলো অধিগ্রহণ না করলে কয়েক কোটি মানুষ মরে যেত। কিন্তু ডাবলু, এইচ, ও, তখন থেকে শক্ত হাতে হাসপাতালগুলো পরিচালনা করে চলেছে। সংক্রামক ব্যাধি এখন প্রায় নেই-ই বলতে গেলে। দেহযন্ত্র বিকল হলে চোখ থেকে শুরু করে হার্ট, কিডনি লাং সবই পাওয়া যাচ্ছে। চোখ থেকে মজ্জা পর্যন্ত সব কিছু ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। মৃত্যুর হার তাই কমে গেছে। এদিকে জন্মের হার কমছে না। তা-ও আবার বিশেষ বিশেষ পকেটে বাড়ছে। কতকগুলি পল্লি থেকে কজন মানুষ বেরোয় হাতে গোনা যায়, আবার কতকগুলি পল্লি থেকে পিলপিল করে মানুষ বেরোয়। দারুণ সস্তা হয়ে গেছে টেলিযন্ত্র। বেশির ভাগ মানুষের সাংস্কৃতিক খাদ্য এখন হিংস্র, কামোত্তেজক এন চ্যানেল। স্কুলকলেজে ড্রপ-আউটের সংখ্যা বাড়ছে। বেকারভাতা এসে গেছে। ভোটাধিকারের বয়স ক্রমেই কমছে। আঠারো থেকে যোলো হল, এখন পনেরো।
বেলা তিনটের সময়ে অনিকেতবাবুর খিদে পেল। তিনি আভেনের হটচেম্বার থেকে বিরিয়ানি বার করে খেলেন। এই এক টং হয়েছে, সব কিছু নিউট্রিশন একত্র করে পনেরো মিনিটে স্বাস্থ্যপ্রদ এক পদ রান্না। চাইনিজ খিচুড়ি, থাই পোলাও, বিরিয়ানি আলা ফ্রাঁস। কোল্ড চেম্বার থেকে কাঁচা সালাড বার করলেন তিনি। আজকাল আর একদম কাঁচা খেতে পারছেন না। সালাড-ড্রেসিংটা মেয়নেজ মনে হচ্ছে। সেটুকু চেঁছে পুঁছে খেয়ে তিনি হাজার স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটটা পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন।
রাত্রে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন দেখে রুমি জিজ্ঞেস করল, বাবার কি শরীরটা ভালো নেই!
আজ অনেক বেলায় খেয়েছি, খিদে নেই।
তোমাকে কতবার বলেছি টাইমটা মেনটেইন করো। রেগুলারিটিই হল গিয়ে আসল-সুপ্রতীক থমথমে গলায় বলল।
গ্রাহ্য করলেন না, অনিকেতবাবু। গম্ভীরভাবে বললেন, লিখতে লিখতে খেয়াল ছিল না। এ কথায় কেমন হৃষ্ট হয়ে উঠল দুজনেই। রুমি এবং সুপ্রতীক।
রুমি বলল, খেতে ভালো না লাগে নাই খেলেন। একগ্লাস ট্রাংকুইলেট খেয়ে নেবেন শোবার আগে…
ওসব তোমরা খাও—বলে অনিকেতবাবু বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, অন্যমনস্ক হয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। আজ যেন কাউকেই গেরাহ্যি করছেন না তিনি।
এরা দুজনে অর্থপূর্ণভাবে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল শুধু।
অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারলেন না অনিকেতবাবু। কিন্তু জেদ করে কোনো ওষুধ বিধুষও খেলেন না। ট্রাংকুইলেট নামে পানীয়টাও না। মাঝরাত পার করে দু এক ঘন্টার জন্যে ঘুমটা এসেছিল, তারপরই তাঁর দাদামশায় তাঁকে জানিয়ে দিলেন টং টং টং টং।
অনিকেতবাবু উঠে মুখ ধুলেন, ধড়াচূড়া চাপালেন। একটা আলোয়ান মুড়ি দিলেন সবার ওপর। তারপর নিঃশব্দে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে, এলিভেটর চালিয়ে নীচে নেমে এলেন। রাত-দারোয়ান ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনসান মাঘের রাস্তায় একেবারে হিমমণ্ডলে ডুব দিলেন অনিকেতবাবু। শীতে আড়ষ্ট হরে থাকা পা বাড়ালেন পার্কের দিকে।
কোণটা সবে ঘুরেছেন, নিঃশব্দে একটা ঢাকা ভ্যানমতো এসে দাঁড়াল তাঁর পেছনে, নিঃশব্দে লাফিয়ে নামল দুজন আপাদমস্তক য়ুনিফর্ম-পরা লোক। একজন ডান দিকে, একজন বাঁ দিকে অনিকেতবাবুর। তিনি ভালো করে কিছু বোঝার আগেই ভ্যানের ভেতরে চালান হয়ে গেলেন। তাঁর মাথার ওপর দিয়ে একটা ঘেরাটোপ গলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কে তোমরা? কী চাও? কী চাও? তিনি বৃথাই চেঁচাতে লাগলেন। কেউ কোনো উত্তর দিল না। সামান্য পরে তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর মুখে যে ঘেরাটোপটা দেওয়া হয়েছে সেটা সাউন্ড প্রুফ। এবং তিনি ধীরে ধীরে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। এইভাবেই তাহলে ওরা অনিচ্ছুক বৃদ্ধদের বৃদ্ধাবাসে নিয়ে যায়!
যখন জ্ঞান হল, অনিকেতবাবু দেখলেন তিনি একটি চমৎকার আলোকিত ঘরে শুয়ে। তাঁর শয্যাটি মাথার দিকে এমন করে তোলা যেন তিনি আরামকেদারাতেই বসে আছেন। তাঁর চারপাশে বেশ কিছু ভদ্র ব্যক্তি দাঁড়িয়ে। দেখলে যেন মনে হয় ডাক্তার। সকলেরই হাসিমুখ। ঠিক এমন পরিবেশ অনিকেতবাবু আশা করেননি।
এখন কেমন বোধ করছেন?
ভালো—অনিকেতবাবু ক্ষীণস্বরে বললেন।
খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।
কেন?
রাস্তার মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন।
তাই?–অবাক হয়ে অনিকেতবাবু বললেন—আমি তো…আমাকে তো…
হ্যাঁ আমাদের হেলথ স্কোয়াডের ভ্যান ভাগ্যে ওখান দিয়ে যাচ্ছিল!
তাই? অনিকেতবাবু দুর্বলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তো ভাবলুম…আচ্ছা আমার ছেলে বউ সপ্রতীক আর রুমি রায়মহাশয় তেত্রিশের বি,…
আহা হা ওঁদের খবর দেওয়ার তো আর দরকার হবে না।–একজন স্মিতমুখে বললেন, আপনি তো ভালোই হয়ে গেছেন। জাস্ট একটা ব্ল্যাক আউট হয়েছিল। আমরা সব চেক-আপ করে নিয়েছি। আপনি বাড়ি যেতে পারেন।