আমি কি অতশত জানি!–মা চট করে উত্তর দিতে চাইবে না। আসলে তর্কাতর্কি দিয়ে আবহাওয়াটা নষ্ট করতে চাইছে না। সারাদিনের মধ্যে এই একবারই তো।
তবু?
শুনেছি, সমঝদাররা বলেন আমরা বস্তু বা ব্যক্তি আঁকি না, ভাব আঁকি। এ ছবির মেজাজ খুব রোম্যান্টিক। দেখছিস না শিবের আঙুল আর পার্বতীর আঙুল একই রকম লীলায়িত।
তাই বলে শিবের মতো একটা জবরদস্ত পুরুষমানুষকে গোঁফ দাড়ি দেবে না। কী মিতালি, তুমি কিছু বলো!
বলব?–বউদি একটু একটু হাসবে।
বলতেই তো বলছি!
পুরুষের চোখ দিয়ে বিশ্ব দেখা তো, তাই তাদের যা ভালো লাগে তেমন করেই সব আঁকাজোকা গড়াপেটা হয়।
এই এক ফেমিনিস্ট কচকচি শুরু হয় তোমার।
বলছিলাম না তো সেইজন্যে। …বউদির চোখে অভিমান, একটু দুষ্টুমিও কি!
মা বলবে, মিতালি কিন্তু কথাটা খারাপ বলেনি। ভাববার মত। টুটুল মাছটা খাচ্ছিস না? বেছে দিয়েছি তো!
টুটুল আসলে এখন ঢুলছে। সারা দিন স্কুল, সারা বিকেল খেলা, সারা সন্ধে পড়া-পড়া খেলা আর খেলা-খেলা পড়া। চোখ টেনে টেনে জেগেছিল সুষ্ঠু বাবার জন্যে। বাবা, দিদু, মায়ের সঙ্গে একসঙ্গে বোদের টেবিলে, বড়োদের মতো করে খাবে। কিন্তু ওই গরমে রাত সাড়ে নটার চানটা তার সমস্ত স্নায়ু আলগা করে দিয়েছে। ঘুম এখন আঙুল বুলোচ্ছে তার কচি শরীরে। আয় ঘুম, যায় ঘুম।
সব ভালো, সব সুন্দর এদের। দাদার এই প্রশ্নগুলো, যখন-তখন ওই খারাপ লাগা, সংশয়, আর অসন্তোষ বাদে। কেমন ভয়-ভয় করে আমার। এত বিরক্তি ওর কীসের। বাবার কথা ভেবে?
কোনোদিন হয়তো হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরেই বলবে, পুরো দেড় ঘন্টা জ্যাম একটা মিছিলের জন্যে, ভাবতে পারো! গাড়িগুলো চলছে কোনো লেন-টেনের বালাই-ই নেই। আমার বনেটে আজ প্রায় ভিড়িয়ে দিয়েছিল এক ব্যাটা ট্যাক্সি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে গোটা শহরটাই উন্মাদ হয়ে গেছে। সদ্য পালিয়ে এসেছে। কোনো পাগলাগারদের গারদ বেঁকিয়ে।
খামোকা রাগ করে নিজের ক্ষতি করছ। এটা রিয়্যালটি! মেনে নাও।বউদি বলবে।
রিয়্যালিটি নয়। অন্য অনেক সভ্য দেশ আছে পৃথিবীতে। এটাই অসভ্যতম, বর্বরতম দেশ। এগুলো এই দেশেরই রিয়্যালিটি। তোমার আর কী! বাড়িতে বসে হাওয়া খাচ্ছ।
বাঃ, আমি বুঝি টুটুলকে নিয়ে স্কুল আসাযাওয়া করি না! বাজার হাট, দোকান, ব্যাংক, পোস্টাপিস এগুলো কি উড়ে উড়ে হয়?
হুঁ। …দাদা কাগজটা তুলে নেয়।
কান পেতে শুনি দাদা ফোঁসফোঁস করছে। শুনতে পাই মায়ের বুক ঢিপঢিপ করছে। আস্তে ধীরে ওঠে মা। চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখে। তারপর পেছন দিকের কমলা পরদাটায় কান ধরে দুদিকে সরিয়ে দেয়। ছেলের রাগে মায়ের রাগ, সেই ঝাল ঝাড়ছে মা পর্দার ওপর। পরক্ষণেই বুঝতে পারি শুধু রাগ নয়। গুঢ় উদ্দেশ্য আছে এর পেছনে। কেননা, পর্দা সরাতেই ঝাঁপিয়ে আসে গ্রীষ্ম-সকালের এখনও তপ্ত না-হওয়া দক্ষিণে হাওয়া, অনেক নীচে বিস্তৃত সবুজের মধ্যে কৃষ্ণচূড়ারা ঝলমলে হাসি হাসতে থাকে। এক ঝাঁক টিয়া খিরিশ গাছটার মাথা থেকে সবুজ বিদ্যুতের মতো দাদার চোখের আড়াআড়ি উড়ে যায়। আজ ওদেরও অফিসের বেলা হয়ে গেল।
কেমন স্তিমিত হয়ে যায় দাদার মেজাজ। চুপচাপ। আমি বুঝি কৃষ্ণচূড়ার সিঁদূরে লাল চারদিকের সবুজে মাখামাখি হয়ে সোজা ঢুকে যাচ্ছে ওর বুকের ভেতরে। টিয়াগুলোর বিদ্যুৎগতি ওর রক্তে ভালোলাগার ঝড় তুলেছে, চেয়ারে মাথা কাত করে বাবু বলে ওঠেন, সত্যি মা, এখান থেকে মনেই হয় না এই বদমাশ, ঠগবাজ, অসভ্য, নোংরা দেশটাতে আছি। ইউরোপে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হাইওয়ের ধারে কাছে রেস্ট হাউসের জানলা দিয়ে তাকালে এইরকমটাই দেখা যায় হয়তো! অন্তত ফটোগুলো তো তাই বলে।
কৃষ্ণচূড়াও?–কেমন চাপা অভিমান মায়ের গলায়।
ওঃ হো হো, মাম্মি ডিয়ার, না কৃষ্ণচূড়া নেই, নেই তোমার ফেভারিট সপ্তপর্ণী। কোনো ফুল-টুল বড়ো বড়ো গাছের মাথায় দেখা যায় বলেও জানি না। ট্রপিক্যাল নয়তো। বেশির ভাগই পাতাঝরা গাছের বন। পাইন আছে, ফার, ওক, বার্চ, মেপল কতরকম। গাছেদের বিউটিও খুব কম নয়।
টুটুল কলকলিয়ে ওঠে, বাবা, ওদের টিয়া আছে? আয়রে আয় টিয়ে, নায়ে ভরা দিয়ে?
মনের দিগন্ত হাতড়ায় দাদা। চুপ করে থাকে। অন্যমনস্ক।
বউদি চায়ের কাপগুলো তুলে নিয়ে যায়। মা ছেলে কাগজের দুটো পাতা মুখের সামনে ধরে বসে থাকে। কী অত পড়ে ওরা? দূর বাবা!
টুটুল তার ট্রাইসাইকেলে চড়ে ঘর থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে ঘর ঘুরে বেড়ায়। স্থূপীকৃত খেলনা-গাড়িগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে তার ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে যায়। হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে, অ্যাক্সিডেন্ট! অ্যাক্সিডেন্ট!
বাঁকা চোখে ছেলের দিকে তাকায় দাদা। ভেতর থেকে বউদির গলা ভেসে আসে, টুটুল, চান করবে এসো। স্কুলের দেরি হয়ে যাবে-এ-এ।
হঠাৎ দাদা চেঁচিয়ে ওঠে, তিনটে রেপ! দুটো তার মধ্যে গণধর্ষণ, বুঝলে মা?
মা চুপ।
এ কী? এতগুলো অ্যাক্সিডেন্ট একেবারে শহরের মাঝ-মধ্যিখানে? ওনারা একে অন্যকে ওভারটেক করছিলেন। গেছে একটি কলেজ-তরুণী, একটা বাচ্চাছেলে আর তার মা, ছেলেকে স্কুলে দিতে যাচ্ছিল—এই তোমার মিতালি আর টুটুলের মতো।
খোকন!
মা, এটা পড়েছ? গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, এক রাজনৈতিক দল অন্য দলের সমর্থকদের। পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই। এক ঠাকুমা আর তার চার বছরের নাতি বেগুনপোড়া–ছবি দিয়েছে ঠিক তুমি আর তোমার নাতির মতন।