দাদা বাড়ি এসেছে অফিস থেকে, অফিসে হয়ে থাকবে কিছু অপ্রিয় ঘটনা, হয়তো বা চোটপাটই! রাত হয়ে গেছে। সাড়ে নটা। টগবগ করে ফুটতে ফুটতে দাদা বেল দিচ্ছে ধরুন, বাড়ির চাবি তো দাদার পকেটেই ঘোরে। কিন্তু এসব সময়ে দাদা যেন চাবির অস্তিত্বটাই ভুলে যায়। সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে ন-টা পরের চাকরি তো! চুষে ছিবড়ে করে দেয় একেবারে। তাই বেলের ওপর অসহিষ্ণু আঙুল। আপনি দরজাটা খুলে যায়, যেন জাদু। বাবা! বাবা! বাবা! টুটুল তার মিষ্টি কচি গলায় কলকলিয়ে ওঠে। পেছনে বউদির কোমল, অথচ জিজ্ঞাসু চালচিত্র। মুখে বলছে না—কেন এত দেরি! অথচ উদবেগ লেগে আছে চোখে, উদবেগ আর উদবেগ-মুক্তি। ঝপ করে অমনি পারা নেমে যায়। প্রথম দফায়। মাঝখানের টেবিলে ব্রিফবাক্সটা নামিয়ে সোফায় বসে জুতোর ফিতে খুলতে থাকবে দাদা। ভেতরে ভেতরে হাসি হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এমন গোঁ যে এটাকে প্রকাশ করবে না। অফিসি-অশান্তির আঁচটা বউদি-টুটুলকেও পেতেই হবে। বউদি পায়। মুখের হাসিটা থিরথির করে কাঁপতে থাকে। হাসা ভালো না না-হাসা ভালো ঠিক করতে পারছে না বেচারি। কিন্তু টুটুলের ভয় পেতে বয়ে গেছে। তার মনের ভেতরের খেলার মাঠে সদাই নির্ভার ছুটোছুটি। তাই সে বাবার গালের নাগাল না পেয়ে হাঁটুর ওপর, প্যান্টের জমিতেই চুমু দেবে। এমন মিষ্টি তার আওয়াজ, আর এমন চনমনে সেই চুমুর পেছনের চোখ আর ঠোঁটের কারসাজি যে দাদা তাকে কোলে টেনে না নিয়েই পারবে না। সন্টিপুটি! সন্টিপুটি! সন্টিপুটি! দুজনে লুটোপুটি খাবে।
আমি আস্তে করে দাদার চোখ টেনে নিয়ে যাব সামনের দেয়ালে। যেন নদীর ঘাট। নীল-বেগনি-সাদা জলে চিকমিক। নীলচে সবুজ, সবজে নীল ছায়ায় নৌকো, অদূর দ্বীপ, সাঁকো, বেড়াচ্ছে মানুষজন। ছাবিবশ বাই তেত্রিশ ইঞ্চির মতো হবে, ক্লোদ মনের আঁকা। এই একই ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছিলেন নাকি দুই শিল্পীই মনে আর রেনোয়া। শান্তির দ্বিতীয় স্রোত মনের ওই নীল-সবুজ থেকেই এবার নামবে।
একটু ঠান্ডা খাবে নাকি?—কে বলল? বউদি?
ফ্রিজের দরজা খুলে যাবে। স্বপ্ন-আলোর মধ্যে থেকে ঝলক-ঝলক ঠান্ডা। গ্লাসে করে বরফ সাজিয়ে তার ওপর ঠান্ডা শরবত ঢালা হবে। হাসবে বউদি, বলবে, জলজিরা অন দা রকস। একটু একটু চুমুক দিতে দিতে শরীর শিথিল হয়ে আসবে দাদার। মনের মধ্যে ঠান্ডা বইতে থাকবে। এরপর যা একটা মজা হবে না। দাদা আর টুটুল একসঙ্গে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়বে। টুটুলটা একদম নাঙ্গা। তিড়িং তিড়িং করে উইচিংড়ের মতো লাফাবে। জলের পোকা তো ছেলেটা। এই গরমে ওকে যতবার খুশি শাওয়ারের তলায় দাঁড়াতে দাও কিছু হবে না। গ্রীষ্মের দিনে বাবার সঙ্গে এই রাত চান, তারপরে পাউডারে-পাউডারে সাদা হয়ে চারজনে খেতে বসা একটা মহা উৎসবের মতো ব্যাপার। নিত্য-নিত্য হলেও পুরোনো, একঘেয়ে হয়ে যায় না।
এইবারে আসরে নামবে মা। মায়ের এই অবতরণ এত সহজ যে বোঝাই যাবে মা-ই আপাতত এ দৃশ্যের নায়িকা। ফরসা রংটা মায়ের। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে —দ্যাখো দ্যাখো আমি ফরসা। আমি ফরসা! রোগাও না মোটাও না, খাটোও না লম্বাও না। মায়ের চুলগুলো পরিচ্ছন্ন বাঁধা থাকবে। একটি গাছিও নিজের অবস্থান ভুলবে না। বিকেলবেলায় টান টান করে পরা স্নিগ্ধ শাড়ি এখন একটু আলগা। অনুচ্চ গলায় মা ডাকবে—কী রে? তোদের হল? খাবার দিচ্ছি। চানের পরে একেবারে সাফসুতরো মেজাজ, দাদা আদুরে গলায় বলবে, মাম্মি ডিয়ার, মাম্মি ডিয়ার, কী বেঁধেছ আজ আমার জন্যে? নিজের দেড় গালটা দাদা মায়ের প্রৌঢ় শিথিল গালে ঘষবে। বউদি হাসবে। ও তো জানে এই দেড়ো গালের ঘষাতে গাল কেমন ছড়ে যায়। গালের এই ছড়ে-যাওয়াটুকু ওরা শাশুড়ি-বউয়ে ভাগাভাগি করে নিয়েছে, রাগারাগি করে না! মায়েরটা ভোরের আলোর মতো। বউয়েরটা গোধূলির লালের মতো।
রাতের খাবারটা খুব সাদামাটা। টুটুলের ভালো-মন্দের কথা ভেবে বাছাই। কেননা এই সময়টাই একমাত্র টুটুল বড়োদের সঙ্গে খায়। প্রথমে একটা স্যুপ দেবে মা। এটা বউদি স্পেশ্যাল। কোনোদিন লাল টকটকে তাজা টোম্যাটোর, কোনোদিন হালকা চিকেনের জলের মধ্যে নুডলরা জড়ামড়ি করে শুয়ে থাকে। কোনোদিন আবার বর্ণহীন তরলের ওপর কমলা, সবুজ, সাদা সবজির লেসের কারু। ফুলো ফুলো রুটি থাকে, হালকা-সেঁকা পাঁউরুটি থাকে। তা ছাড়া হয়তো একটা মাছের স্টু। সকালে দাদা শুক্তো খেয়ে যায়নি, কি পোস্ত খেয়ে যায়নি। দাদার ভাগ বাটিতে করে বসানো থাকবে। গরম, কিন্তু জিভ ঝলসায় না। রাতের গাঢ় ঘুমে ঢলবার আগে এই কুসুমকুসুম গরম খানা।
খেতে খেতে সামনের দেয়ালে চোখ পড়ে যাবেই। সেখানে লম্বাটে একটা এচিং। শিব-পার্বতীর মুখের মুগ্ধ ডৌল, লম্বা টানা যামিনী রায় চোখ, আর পার্বতীর চিবুকে শিবের, শিবের কাঁধে পার্বতীর অজন্তা-আঙুল।
দেখতে দেখতে দাদা ফট করে হয়তো বলবে, আচ্ছা মা, আমাদের আর্টে পুরুষকেও এমন মেয়েলি করে আঁকে কেন বলো তো?
এই এদের তক্কো শুরু হল। দেশের যাবতীয় জিনিস—তার শিক্ষাদীক্ষা, শিল্পকলা, সংগীত-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য—সব দাদা লেন্সের তলায় রেখে রেখে দেখবে। এটা কেন? ওটা কেন? সেটা কেন? যেন কোনো গোয়েন্দা-সংস্থা ওকে মাথায় দিব্যি দিয়ে রিপোর্ট দিতে বলেছে।