যাঃ, সুনন্দা অবাক হয়ে গেছে, কী বাজনা।
ওরা কি অত জানে! খালি বাজনা, কত বাজনা। ঘুম আসলেই শোনে, চোখ মেললেই সুর মিলিয়ে যায়। ঘরের একটা জিনিসও সরাতে পারেনি।
কেন? মমতাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরেছে সুনন্দা।
কেন আর? কিছুই না জিনিস সরাতে গেলেই অমন কাঠখোট্টা ব্যবসাদারেরও মনে হয় আহা থাক। বেশ আছে, বড়ো সুন্দর আর ক-দিন যাকই না।
সুনন্দা বলল—তুই বলছিস আমার ঘর যেমন ছিল তেমনি আছে?
শুধু ঘর নয় গো। বাড়ি আসবাব যা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে।
সুনন্দা হঠাৎ উত্তেজিত পায়ে বাইরে ছুটল, ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয়!
কী দিদি!
আমি আজকের গাড়িতেই কলকাতা যাচ্ছি। আমার বাজনা প্যাক করে তুলে দেবার ব্যবস্থা করো ভাই।
বৃষ্টি ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে ঘরে ফিরছেন ঠাকুর সিদ্ধদাস। উদভ্রান্ত সুনন্দা উল্কার মতো ছুটে আসছে।
ঠাকুর ঠাকুর, আমি বাড়ি ফিরছি, বাড়ি।
স্মিতমুখে ডান হাত তুলে সিদ্ধদাস বললেন, স্বস্তি স্বস্তি।
কেউ নেই এখন। কেউ না। না তো। ভুল হল। আছেন। অবর্ণা, বর্ণময়ী আছেন। সর্বশুক্লা। তাই লক্ষ সুরের রংবাহার তাঁর পায়ের কাছে মিলিয়ে গিয়ে আরও লক্ষ সুরের আয়োজন করে। সেতার নামিয়ে আজ বীণ তুলে নিয়েছে সুনন্দা। গুরুজির শেষ তালিম ছিল বীণে। বলতেন নদী তার নাচনকোঁদন সাঙ্গ করে সমুদ্রে গিয়ে মেশে বেটি, বীণ সেই সমুন্দর সেই গহিন গাঙ। বীণ তক পঁহুছ যা। সুনন্দা তাই বীণে এসে পৌঁছেছে। মগ্ন হয়ে বাজাচ্ছে, হাতে সেই স্বপ্নশ্রুত মিড়। সুরের কাঁপনে বুকের মধ্যে এক ব্যথামিশ্রিত আনন্দ, তবুও মিড়ের সূক্ষ্ম জটিল কাজ কিছুতেই আসছে না। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, সুনন্দা অসম্পূর্ণ সুরের জাল বুনেই চলেছে, বুনেই চলেছে। খোলা দরজা, বাইরের ছায়াময় উঠোন বাগান দেখা যায়। কিন্তু সুর বন্দিনির মতো গুমরে গুমরে কাঁদছে ঘরময়। কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে মুক্তি দিচ্ছে না তাকেও, দরদর করে ঘাম নামছে, ঘাম না কি চোখের জল যা দেহের রক্তের মতোই গাঢ়, ভারী! পরিচিত জুতোর শব্দ। খোলা দরজা দিয়ে গুরুজি এসে ঢুকলেন, বললেন, সে কী? এতক্ষণেও পারছিস না বেটি। এই দ্যাখ। চট করে দেখিয়ে দিলেন গুরুজি। কয়েকটা শ্রুতি ফসকে যাচ্ছিল। স্মৃতির কোণে কোথায় লুকিয়ে বসেছিল। গুরুজি তাদের টেনে আঙুলে নামিয়ে আনলেন। সুনন্দা বাজিয়ে চলেছে। হুঁশ নেই আনন্দে। গুরুজি যে চলে যাচ্ছেন, ওঁকে যে অন্তত দুখিলি পান দেওয়া দরকার সে খেয়ালও তার নেই। যাবার সময়ে বলে গেলেন, আসন, বেটি। আসন! তুই যে আসনে ধ্যান লাগিয়েছিস, তুই ছাড়লেও সে তোকে ছাড়বে কেন? বলতে বলতে গুরুজি মসমস করে চলে গেলেন। হঠাৎ দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল। সুনন্দা যেন এতক্ষণ ঘোরে ছিল। সে বীণ নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। গুরুজি এসেছিলেন এত রাত্রে? সে কি? পান? অন্তত দু খিলি পান…কাকে পান দেবে? গুরুজি তো বাবা যাবার তিন বছর পরেই কাশীতে…।
চারদিকে চেয়ে দেখে সুনন্দা। খোলা দরজায় এসে দাঁড়ায়। নিমের পাতায় হু হু জ্যোৎস্না। কোথাও কারও চিহ্ন নেই। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল সে, তারপর তীব্র ভঙ্গিতে এসে বীণ তুলে নিল। মিড় তুলল। সেই জটিল, অবাধ্য মিড়। হ্যাঁ। ঠিকঠাক বলছে। অনেক দিনের স্বপ্নের জিনিস তুলতে পেরে এখন সুনন্দার হাতে সুরের জোয়ার। আরও মিড়, জটিলতর, আরও ব্যাপ্ত, আরও প্রাণমন কাঁদানো, সব মানুষের মধ্যেকার জাত-মানুষটাকে ছোঁবার মিড়। গুরুজি সত্যি এসেছিলেন কি আসেননি তৌল করতে সে ভুলে যায়। সে তার আসনে বসেছে, তার নিজস্ব আসন। সমুদ্র নীলের ওপর বড়ো বড়ো শুক্তি ছাপ। সাত বছর বয়স থেকে এই আসনে বসে সে কচি কচি আঙুলে আধো আধো বুলির মতো কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নাজ নখরা ফুটিয়েছে ত্রিতন্ত্রী বীণায়। ঠিক যেমনটি কেসর বাই কি রোশেনারার রেকর্ডে শুনেছে। অবর্ণা দেবীমূর্তির দিকে মুখ করে, কিন্তু নতমুখ আত্মমগ্ন হয়ে, সারারাত সুনন্দা সমুদ্রের দিকে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। পাশে শোয়ানো সেতারের তরফের তারগুলি ঝংকৃত হয় থেকে থেকে। কাচের কেসের ডালা খোলা। সেখান থেকে সরু মোটা নানান সুরে আপনা আপনি বেজে ওঠে সুরবাহার, তানপুরা।
কে আছে দাঁড়িয়ে এই সুরের পারে? তারের ওপর তর্জনীর আকুল মুদ্রায় প্রশ্ন বাজতে থাকে। কে আছে? কে আছ? ঝংকারের পর ঝংকারে উত্তর ভেসে আসে। সুর। আরও সুর। তারপরে? আরও সুর। শুধুই সুর। ধু ধু করছে সুরের কান্তার। ঠিক আকাশের মতোই। তাকে পার হবার প্রশ্ন ওঠে না। শুধু সেই সুরের ধুলি বৃন্দাবন রজের মতো সর্বাঙ্গে মাখো। সেই সুরের স্রোতে ভেসে যাও, আর সুরের আসনে স্থির হয়ে বসো। মন রে, তুই সুরদীপ হ।
ইউলিসিসের কুকুর
There, full of vermins he lay abandoned on the heaps of dung.
বড়ো বড়ো মানুষদের নামে এখন আমাদের রাস্তা-ঘাট-পার্ক-ময়দান-সদন সরোবর-স্টেডিয়াম। বেশিরভাগই উনিশ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার আমাদের গৌরব, আমাদের জনক, ঐতিহ্য, পিতৃপুরুষ। এইভাবেই তাই তর্পণ করি। পুরোনো নামের রাস্তা হয়ে যায় মহাত্মা গান্ধি রোড, রবীন্দ্র সরণি, শরৎ বসু রোড, নেতাজি সুভাষ রোড। নতুন প্রমোদ ভবন, মঞ্চ হয়, নাম দিই রবীন্দ্রসদন, নজরুলমঞ্চ, শিশিরমঞ্চ। সাদার্ন অ্যাভেনিউয়ের নামে ব্রিটিশ রাজের কোনো গন্ধ ছিল না, তবু সে রাস্তা এখন আমাদের জাতির অহংকার মেঘনাদ সাহার নামে। এই মেঘনাদ সাহা সরণির মোটামুটি মাঝখানে শরৎ বসু রোড আর কেয়াতলার মাঝামাঝি জায়গায় আমরা থাকি। লেকের দিকে মুখ। মা, দাদা, বউদি, টুটুল আর আমি। ছিমছাম শান্তির সংসার আমাদের। বাস, ট্যাক্সি, গাড়ি, অটো অনবরত ছুটে চলেছে এপার-ওপার দুটো রাস্তা দিয়েই। তবু আমরা নিরিবিলির স্বাদ পাই। কেননা, থাকি এগারো তলায়। এত ওপর থেকে লেকসমেত পুরো দক্ষিণ শহরতলিটাই মানচিত্রের মতো চোখের তলায় বিছিয়ে থাকে। এত গাছ! এত গাছ! আর এত সবুজ। এ যেন ধুলো-ধোঁয়া-আবর্জনার কলকাতাই নয়, প্রথম পৃথিবীর কোনো সবুজ নগর সভ্যতা। বাস্তবিকই এখান থেকে কলকাতাকে বড়ো সুঠাম দেখায়। গাছ-গাছালির মাঝসাঝ দিয়ে কখনও দেখা দিতে দিতে কখনও দেখা না দিতে দিতে এলিয়ে থাকে লেকের চিকচিকে চিকন বাহুলতা। লেকের ভেতরে দ্বীপ। সুন্দর অঙ্গদের মতো। শুনতে পাই লেকের জল আজকাল দূষিত হয়ে গেছে। তীরভূমির সুন্দর কোথাও বা নষ্ট হয়ে গেছে নোংরামিতে, মস্তানিতে। কিন্তু এত উঁচু থেকে সেসব বোঝা যায় না। সুন্দরটুকু আর সুঠামটুকুই চোখে ভেসে থাকে। চোখ থেকে প্রবেশ করে হৃদয়ে, মগজে। এমন একটা শান্তি ছড়াতে থাকে যে রাগ-ঝাল সব নিমেষেই হাওয়া।