ইদানীং অনিকেতবাবু দুপুরবেলা আর লাইব্রেরি যান না। নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে লেখা লেখা খেলা করেন। রুমিরা জানে তিনি একটা বিশাল বই লিখবেন। প্রবন্ধ-ট্রবন্ধ ছাড়াও। বিশাল বই যা নাকি সমাজতত্ত্বের কাজে লাগবে। এ রকম বই লিখতে পারলে আলাদা করে গ্র্যান্ট পাবেন লেখক। প্রোডাকটিভ কিছু করলে সরকার নানারকম সাহায্য দিয়ে থাকে। সন্দীপন দেশাই বলে এক ভদ্রলোক পরের পর বই লিখে যাচ্ছেন। অর্থনীতির ইতিহাস। এদেশীয় অর্থনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি। আশির কাছে বয়স হল ভদ্রলোকের। এঁর সঙ্গে অনিকেতবাবুর একসময়ে খুব আলাপ ছিল। খুব সম্প্রতি এঁকে এঁর শেষ বইটির জন্য অভিনন্দন জানিয়ে ফ্যাক্স করেছিলেন তিনি। দেশাই তার জবাব দিলেন খুব ছোট্ট এবং অপ্রাসঙ্গিক। হোপ আইল ডাই ইন মাই ওন বেড।
কিন্তু অনিকেতবাবু দরজাটা বন্ধ করে দেন দুপুরে। সন্তর্পণে জানলার পর্দাটা টেনে দ্যান। পাশের ব্লকের যে ভদ্রলোকের জানলাটা তাঁর মুখোমুখি? মনস্বী না কী যেন? বড্ড ইয়ে। কদিন আগেই গায়ে পড়ে বলেছিল, কাকাবাবু আপনার যেন কত হল? দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনার রিটায়ারমেন্টের ইয়ারটা……
অনিকেতবাবু ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে হাত ঝাঁকিয়ে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, সিনেমা যাবে নাকি মনস্বী। বেশ ভালো একটা অ্যাডভেঞ্চারের ছবি এসেছে। লুনার পার্ক। বলো তো টিকিট কাটি। তুমি আমি আয় রাতুল।
জানালার পর্দা টেনে দিয়ে একটা ভীষণ গর্হিত কাজ করতে থাকেন তিনি। দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকেন : ধবধবে চুলের এক বৃদ্ধ। বারান্দায় বেতের চেয়ার পেতে সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। সময়টা ফাল্গুন চৈত হবে। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছে, তার বাইরেটা গরম ভেতরটা ঠান্ডা হাওয়ার বৃদ্ধের এলোমেলো চুল আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হাফ পাঞ্জাবি হাওয়ায় ফুলে ঢোল। বৃদ্ধবয়সের পাতলা চামড়ার ওপর বসন্তের হাওয়ার স্পর্শ, বড়ো সুন্দর! ছোট্ট একটি ছেলে বল লাফাতে লাফাতে এল।
দাদু তুমি বল খেলতে পারবে?
না ভাই।
তাহলে কুইজ? কুইজ করব?
পারব না ভাই।
আচ্ছা তাহলে বসে আঁকো।
তাও পারব না।
তবে তুমি পারবেটা কী?
মৃদু হেসে বৃদ্ধ বলেন, মনে মনে পারি। এখনও এসবই মনে মনে পারি। চোখ বুজে ঘুম ঘুম এসে যায়। স্মৃতির ওপর এক পর্দা কাপড়। ক্ষীণভাবে অনিকেতবাবুর মনে হয়, কে? কে এই বৃদ্ধ?—তাঁর দাদু বোধহয়। আর গুন্ডা ছেলেটা? তিনি, তিনিই নিশ্চয়। একাশি বছর বয়সে তাঁর এগারো বছর বয়সের সময়ে খুব সম্ভব মারা গিয়েছিলেন দাদু। এই আরামচেয়ার, ওই ঘড়ি তাঁর। অন্য এক পল্লির অন্য এক বহুতলের তিনতলায় থাকতেন তাঁরা। আবার ঘোর এসে যায় অনিকেতবাবুর।
রুমি, সুপ্রতীক, গায়ত্রী আর তিনি। রাতুলকে নিয়ে লম্বা পাড়ি দিয়েছেন। মোটরে। সুপ্রতীক চালাচ্ছে, রুমি তার পাশে। পেছনে বাকিরা। দু-পাশে পাহাড়ি গাছ। সরল, দেওদার…এটা কোন জায়গা…দার্জিলিং? শিলং? মুসৌরি? হঠাৎ গাড়িটা ঘ্যাচ ঘ্যাচাং করে থেমে গেল। সুপ্রতীক নেমে পড়ে অনেকরকম চেষ্টা চরিত্তির করল। এমন কি রাতুলও। কিন্তু কিস্যু হল না। গাড়ি যেমন নট নড়ন চড়ন তেমনি হয়ে আছে। তখন অনিকেতবাবু নামলেন। জাস্ট পাঁচ মিনিট। হাতের সাদা রুমালটা কুচকুচে কালো হয়ে গেল অবশ্য কিন্তু গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগল। রাতুল বলছে, তোমার হাতে জাদু লিভার আছে নাকি দাদু। রুমি বলছে, বাবা না থাকলে এই বিশ্রী জায়গায় রাত হয়ে আসছে…কী ঠান্ডা।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিচ্ছে রুমি। এটা বড়ো প্রিয় দিবাস্বপ্ন অনিকেতবাবুর। কখনও ঘটেনি। কিন্তু যদি ঘটে! এমন কেন সত্যি হয় না আহা! এ ছাড়াও আরও কত ভালো ভালো দিবাস্বপ্ন আছে অনিকেতবাবুর। কোনটা রেখে কোনটা দেখবেন? দেখতে দেখতে জমাট দুপুর ঘুম এসে যায়। ফুরফুর ফুরফুর করে নাক ডাকতে থাকে। হঠাৎ নাকে ফৎ করে একটা বেয়াড়া মতো আওয়াজ হতেই তিরবেগে উঠে বসলেন অনিকেতবাবু। বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। জানালার পর্দা টানা আছে তো ঠিক? দরজাটা বন্ধ? হ্যাঁ। আছে। আছে।
অর্থনীতির ওপর প্রবন্ধ! হু। রাজনীতির ওপর লোকসংখ্যার প্রভাব। মাথার মধ্যেটা রাগে চিড়বিড়িয়ে ওঠে মাঝে মাঝে। লিখতেই যদি হয় তিনি রম্যরচনা লিখবেন। আবার ফর্মের দিক থেকে রম্য হলেও তা হবে রুদ্র রচনা। মনের যাবতীয় ক্ষোভ, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সব প্রকাশিত হবার জন্যে তাঁর মাথার মধ্যে ফাটাফাটি হুটোপাটি করে চলেছে। কিন্তু এরকম কিছু লেখা মানে নাহক নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। ঠিক আছে না-ই বা প্রকাশ করলেন, শুধু নিজের তৃপ্তির জন্যেই তিনি লিখবেন। এই সংকল্প মনের মধ্যে উঁকি দেবামাত্র রায়মহাশয় তাঁর কম্পিউটারে কাগজ ভরলেন। একটু ভাবলেন, তারপর লিখলেন
জীবন সুন্দর, পৃথিবী সুন্দর, কিন্তু মানুষ কুৎসিত, সমাজ কুৎসিততর, শাসনযন্ত্র কুৎসিততম। যৌবনও কুৎসিত। যত বয়স হইতেছে, বুঝিতেছি যৌবনও কুৎসিত। কারণ, হ্যান্ডসাম ইজ দ্যাট হ্যান্ডসাম ডাজ। যে যৌবন বৃদ্ধের আত্মত্যাগের মূল্যে ফুর্তি কিনিয়া বাঁচিয়া থাকে তাহাকে ধিক। যে যৌবন বৃদ্ধের জীবন হইতে বসন্তের অধিকার ছিনাইয়া লয় তাহাকে ধিক। যে সকল বৈজ্ঞানিক উন্নতি, প্রাযুক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিবার সামাজিক পরিকাঠামো তোমরা প্রস্তুত করিতে পার নাই, সে সকলের সঙ্গে তাল মিলাইবার চেষ্টা তোমাদের হাস্যকর। কারণ তাহা করিতে গিয়া মানুষের স্বাভাবিক অধিকারগুলি তোমরা ছিনাইয়া লইতেছ। এগুলি তোমাদের বেতালা বেসুরো আসুরিক কাণ্ড। জনসংখ্যা হু হু করিয়া বাড়িতেছে। তো আমরা কী করিব? আমাদের কাহার ঘরে একটি দুটির বেশি সন্তান আসে না। কোথায় বাড়িতেছে, কেন বাড়িতেছে খোঁজ আর লইবে কি! ভালো করিয়াই জানো সব। দারিদ্র্য, অপরাধ, অধিকার, কুশিক্ষা, প্রজাবৃদ্ধি সকলই তো পুষিতেছ? আর খাঁড়াটি তাক করিয়াছ সিনিয়র সিটিজেনের গলদেশ তাক করিয়া? যে নাকি সারাজীবন ধরিয়া তিল তিল করিয়া দিয়াছে?