বিবর্ণ অক্ষরমালা, স্থানে স্থানে কালি ম্লান হয়ে গেছে, উদ্ধার করা দুঃসাধ্য। অনেক চেষ্টায় সেইসব বর্ণ উদ্ধার করেন একদিন তারাপ্রসাদ এবং বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান। সাধক বলছেন, ইনি ব্রহ্মের পরাশক্তি। পঞ্চ মহাশূন্যে বিরাজ করতেন, আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ ও সূর্যাকাশ। আমি তাঁকে তারা মূর্তিতে দেখেছি, গড়েছি, প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি প্রসন্না কিন্তু রক্তাভ বদনা, তাঁর জিহ্বা অগ্নিশিখার ন্যায়। চতুর্ভুজা ডান হস্তদ্বয়ে খড়গ কর্তরী ধারণ করে আছেন, বামহস্তদ্বয়ে কপালপাত্র ও পদ্মকোরক। কিন্তু মায়ের যে ধ্যান মূর্তি আমি দেখি তাতে পিঙ্গল জটা। কাল সুর্যের ন্যায় প্রখর ত্রিনয়ন। প্রজ্বলিত চিতাবহ্নি থেকে উর্থিতা হন তিনি। মহালক্ষ্মী মূর্তি দিয়ে সেই দুঃসহ ধ্যান মূর্তিকে আবৃত করলাম। কিন্তু লোকশিক্ষার জন্য মা যে-কোনো মুহূর্তে উগ্রা, উগ্রতারা, মহাউগ্রতারা হতে পারেন। বস্তুত শক্তির অষ্টরূপের এই অষ্টাঙ্গী মাতৃমূর্তি আমি দর্শন করেছি। যদি সত্য সাধক হই তো কোনো না কোনোদিন লোকপালিনী, লোকশাসনা এই মহাশক্তি আমার এই সাধনক্ষেত্রেই প্রকাশিত হবেন।… পাঠ শেষ করেই স্থাণু হয়ে থাকেন তারাপ্রসাদ। মুখময় বিন্দু বিন্দু স্বেদ।
যেদিন শনিবারের সন্ধ্যারাত্রে জ্যান্ত মা দুশ্চরিত্র লোকটির গালে প্রবল চপেটাঘাত করলেন এবং সে তাঁর পায়ে পড়ে মা মা করে কাঁদতে লাগল,
তারাপ্রসাদ ছেলেকে এবং স্ত্রীকে ডেকে পিতৃডায়েরির সেই পরম অর্থময় অংশগুলি পড়ে পড়ে শোনালেন।
শীতের বিকেল সন্ধেয় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। বৃহস্পতিবার। চারদিকে শাঁখ বাজছে। চুলে দীর্ঘ আলগা বিনুনি ঝুলিয়ে তার ফেভারিট চুনে হলুদ রংয়ের তাঁতের শাড়িটি পড়ে, গলায় সরু হার, কানে ছোটো মাকড়ি, হাতে বালা, সে বেরিয়ে আসে। পায়ের বাসি আলতা সাবান ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি। পিছনে পড়ে থাকে মন্দির, প্রণামি, সেবাইত, সে নির্বাধ বেরিয়ে পড়ে। কেউ বলে না, কোথায় যাচ্ছিস? কেউ বলে না, তাড়াতাড়ি ফিরিস।
ক্লাবে ক্যারাম খেলতে খেলতে কর্কশকান্তি তরুণের দল জানলা দিয়ে দেখতে পায়, শশব্যস্তে বেরিয়ে আসে, অলকাদি, একটু খেলা দেখে যাবে না? অলকাদি।
সে মৃদু হাসে, বলে, কাল আসব এখন, আজ যাই। রুবি বউদি, মণি বউদির বাড়ি লক্ষ্মীপুজোর নেমতন্ন আছে।
আশ্চর্য! এতগুলি আমন্ত্রিত মানুষ, অচেনা, আত্মীয়স্বজন রুবি বউদি মণি বউদির বাড়িতে। কেউ তো বলে না, এতবড়ো মেয়ে, বিয়ে হয়নি?
কেউ বলে না, কাদের বাড়ির মেয়ে? কী করে? কী পাস?
শুধু সসম্ভ্রম বিহ্বলতায় এ ওকে শুধোয়, কে? কে? কে? এ কে গো?
আসন
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। দরদাম, দলিলদস্তাবেজ, ইনকামট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স, সব। সব হয়ে যাবার পর গলদঘর্ম বাড়ি ফিরে একটু জল গরম করে নিয়ে ঠাকুর্দার আমলের বাথটাবটাতে শুয়ে শুয়ে বিকেল সাড়ে তিনটেয় একটা লম্বা। অবগাহন স্নান। আ-ই। যেন অনেক দিনের পুরোনো পাপের বোঝা নেমে গেল। ঘাড় থেকে। শুধু স্নান নয়, শুচিস্নান। সত্যিই, পিছটান বলে তো কিছু নেই। শুধু আপনি আয় কপনি। তা আপনির ইচ্ছেমতো কপনি চলবে? না কপনির। ইচ্ছেমতো আপনি! এ ক-দিনের মধ্যে এই নিয়ে বোধহয় সাতবারের বার গুরুদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে দু-হাত কপালে ঠেকাল সুনন্দা। স্থাবর সম্পত্তির বড়ো জ্বালা! বড়ো গুরুভার। হালকা হয়ে যে আকাশে পাখা মেলতে চায় ইট-কাঠ তার ঘাড়ের ওপর অনড় হয়ে বসে থাকলে সে বাঁচে কেমন করে? সবই গুরুদেবের কৃপা! বাড়িটা শেষ পর্যন্ত কিনতে রাজিই হয়ে গেল শরদ দেশাই। তিন শরিকের এক শরিকি অংশ। বাবা নিজের অংশটুকু ঢেলে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাই বাসযোগ্য ছিল এতদিন। সামনের উঠোন চৌরস করে ভেঙে খোলামেলা নিশ্বাস ফেলবার জায়গা খানিকটা। একটা আম গাছ, একটা নিম, সেগুলো ফেলেননি। নিম-আমের হাওয়া ভালো। তা ছাড়াও আমের কোঁকড়া পাতায় ফাগুন মাসে কেমন কচি তামার রং ধরে! বাকি জায়গাটুকু নানারকমের বাহারি গাছপাতা দিয়ে সাজানো। ফুল গাছ নয়, পাতাবাহার। বাবার শখের গাছ সব। না-বাগান না-উঠোন এই খোলা জায়গাটুকু পার হতে হতে দোতলার লাল টালি ছাওয়া বারান্দাখানা চোখে পড়বে। তার ওপর ছড়ানো বোগেনভিলিয়ার ফাগ আর মুক্তো রঙের ফুলঝুরি। মার্চ-এপ্রিল থেকে ফুল ফোঁটা শুরু হবে, চলবে সেই মে অবধি।
বারান্দাটা যেন বেশ বড়োসড়ো একখানা মায়ের কোল। তেমনি চওড়া, নিশ্চিন্ত। নির্ভয়। সুনন্দার নিজের মায়ের কোলটিও বেশ বড়োসড়ো ছাড়ালো দোলনার মতোই ছিল বটে। মনে থাকার বয়স পর্যন্ত সেই শীতল, গভীর কোলটিতে বসে কত দোল খেয়েছে সুনন্দা। তারপর মায়ের বোধহয় বড্ড ভারি ঠেকল। হাত-পা ঝেড়ে চলে গেলেন, ফিরেও তাকালেন না। টাকার সাইজের এক ধামি সাদা ময়দার গোল পিংপং বলের মতো লুচি সাদা আলুভাজা দিয়ে না হলে যে সুনন্দা রেওয়াজে বসতে পারে না এবং সে-জিনিস যে আর কারও হাত দিয়েই বেরোবার নয় সে-কথা মায়ের মনে থাকল না।
অনেকদিন আগলে ছিলেন বাবা। মায়ের কোল থেকে বাপের কাঁখ, সে তো কম পরিবর্তন নয়। ঈশ্বর জানেন বাবাকে মা হতে হলে স্বভাবের নিগুঢ় বাৎসল্য রসের চালটি পর্যন্ত পালটে ফেলতে হয়। তিনি কী তা পারেন? কেউ কী পুরোপুরি পারে? মায়ের জায়গাটা একটা বায়ুশূন্য গহ্বরের মতো খালি না থাকলে বুঝবে কেন সে কে ছিল। কেমন ছিল? বোঝা যে দরকার। মা হতে পারেননি, কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন, তাই বাবা আরও ভালো বাবা, আরও পরিপূর্ণ বাবা হতে পেরে গিয়েছিলেন। পাঁচজন যেমন বউ মরলেই হুল দিয়ে থাকে তেমন দিয়েছিল বই কি! তিনি চেয়েছিলেন মাথায় আধ-ঘোমটা গোলগাল ছবিটির দিকে। চোখ দুটি ভারি উদাস, কিন্তু ঠোঁটের হাসিতে ফেলে-যাওয়া সংসারের প্রতি মায়া ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। তারপর ফিরে তাকিয়েছিলেন ঘুমন্ত ফুলোফুলো মুখ, ফুলো-ঠোঁট আর বোজা চোখ দুটির দিকে। ঘুমের মধ্যে চোখের মণিদুটো পাতার তলায় কাঁপছে। আহা! বড়ো বনস্পতির বীজ। কিন্তু কত অসহায়! মাতৃকুলে যন্ত্রসংগীত পিতৃকুলে কণ্ঠসংগীত। সরু সরু আঙুলে এখনই কড়া পড়ে গেছে। ওইটুকুন-টুকুন আঙুল তার টেনে টেনে এমন নাজনখরা বার করে যে মনে হবে রোশেনারা বেগম স্বয়ং বুঝি হেরি গুনগুন করছেন।