কোনোদিকে তাকায় না উঠে দাঁড়ায় সে। সসম্ভমে সবাই পথ করে দেয়। সে চলে যায় কোণে নিজের ঘরে। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো সময়ে মা ঘুম ভাঙিয়ে নিজে হাতে খাইয়ে যান। এবং আরও রাতে চুপিচুপি শ্যামা ভাই তার ওষুধের গুলি ঠোঁট ফাঁক করে খাইয়ে দেয়। যতই ঠাকুরবাড়ির ছেলে হোক শ্যামা আজকালকার ছেলে। বাবাকে লুকিয়ে দিদির সাধ্যমতো চিকিৎসা সে করাবেই। এবং চিকিৎসাতেই কিনা কে জানে ফল হয়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার নিজের ছাপা শাড়ি পরে অলকা রান্নাঘরে গিয়ে চা করে, রুটি তরকারি করে। পিছন থেকে মা এসে হতবাক।
ওরে তুই কেন? আমি তো আসছি।
সামান্য অবাক সামান্য বিরক্ত হয়ে সে একবার তাকায় তারপর চায়ের কাপ মায়ের হাতে তুলে দেয়। বাবা আর ভাইয়ের চা নিয়ে চলে যায় বইয়ের ঘরে যেখানে সবে সকালের কাগজ এসে পৌঁছেছে, দুজনে দু-খানা পাতা নিয়ে দু-দিকে বসে আছে। দুজনেরই মুখ কাগজে ঢাকা। শাড়ির খসখস শব্দ। তারাপ্রসাদ বললেন, বুঝলে এবার রান্নাবান্নার জন্যে দেখে শুনে একজন বামনি রাখো। এখন
অলকা বলল, বাবা চা নিন।
কাগজ হাত থেকে খসে গেল। তারাপ্রসাদ ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলেন, অবশেষে ফাঁসফেঁসে গলায় কোনোক্রমে বললেন, মা, তুই?
শ্যামাও চমকে উঠেছিল, সামলে নিয়ে বলল, আরে দিদি, তোর চা-টাও দিয়ে নিয়ে আয়। একসঙ্গে…।
অলকা শান্ত মুখে বাবার দিকে একবার তাকাল, ভাইয়ের দিকে একবার। মুখে কী মৃদুর চেয়েও মৃদুতর হাসি? হাসি না আর কিছু!
সকলের কাজকর্ম সারা হলে অলকা চিরদিনের অভ্যাসমতো সামান্য একটু পাড়া বেড়াতে বেরোয়। তার কাছাকাছি বয়সি কোনো বউ বা মেয়ে, পাড়াপড়শি, ছেলেবুড়ো, পিপলস ক্লাব বা বন্ধুসংঘর ছেলেরা যারা এখনও তেমন কোনো কাজকর্ম পায়নি, চারদিকে খুঁটির মতো ছিটিয়ে থাকে। চলতে চলতে কথা বলতে বলতে সে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যায়। শীত পড়ছে, রোদে তেমন ঝাঁঝ নেই। আকাশের রং সাদাটে। সবাই চলতে চলতে কেমন সম্ভ্রম মিশ্রিত কৌতূহলের দৃষ্টিতে চায়। সে খেয়াল করে না। বড়ো বাড়ির আধখোলা সবুজ ফটক আলতো ঠেলে সে ডাকে, রুবি বউদি, আসব?
চমকে উঠে বউদি বলে, ওম্মা অলকা! এসো এসো। পড়িমরি করে সে একখানা তোলা আসন এনে চেয়ারের উপর পেতে দেয়, বস।
হঠাৎ তুমি?–অলকা হেসে ফেলে। রুবি বউদিদের সঙ্গে তার বরাবর তুই তোকারির সম্পর্ক। প্রথমটা একটু আড়ষ্ট হয়ে কথা বলে, তারপর সহজ হয়ে যায় বউদি, তুমুল গল্প করে। এইরকমই অরুণা, মাধুরী, শীলাদের সঙ্গেও তার গল্প জমে যায় কোনো কোনো বিকেলবেলা।
কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ যেটাকে মনে করেছিল হোমিও-আরোগ্য, এবং তার বাবা মনে করেছিলেন দৈবী অন্তর্ধান, অচিরেই দেখা গেল সে জিনিসটা স্বল্পস্থায়ী। সেই বিশেষ বিশেষ বার অর্থাৎ শনি, মঙ্গলবারেই এখন মায়ের ভর হয়। কখন হবে কেউ জানে না, কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে হঠাৎ অলকা চুপ হয়ে যায়। তারপর অচেনা ভঙ্গিতে ওঠে, ঢুকে যায় ঠাকুরঘরে। বেরিয়ে আসে। পরনে লাল পাড় পাটের শাড়ি, গলায় তারা-মালা, হাত ভরতি লাল রুলি। বেরিয়ে আসে আরও অচেনা ভঙ্গিতে। তার কেমন একটা ঘোর লাগে। শাঁ শাঁ করে সে যেন এক মায়াবী পথ দিয়ে ক্রমাগত ওপরে আরও ওপরে উঠতে থাকে। চলে যায় এক আলোময় ভিন্ন জগতে যেখানকার চলাফেরা বোধ বোধগম্যতা সবই অন্যরকম। সে পাক খায় এক অস্তিত্বহীন অন্য চরাচরে। কণ্ঠ আর এই কণ্ঠ থাকে না। হাত পা চলে অন্যকোনো নির্দেশে—এর চেয়ে বেশি আর কিছু সে জানে না।—এটুকুও সে অনেক চেষ্টায় মনে করে বলে অনেকবার জিজ্ঞাসার পরে, শুধুমাত্র তার ভাইকেই। তাই শেষপর্যন্ত তারাপ্রসাদকে ডিঙিয়ে শ্যামাপ্রসাদই দেবীর সেবায়েৎ হয়ে যায় এবং পট্টবস্ত্র পরা, তারা-মালা গলায়, লাল পলা পরা হাত দুটি যখন খড়গধারী পদ্মকোরক মুদ্রা রচনা করে তার কোলের উপর এসে থামে প্রবল হুড়োহুড়ির মধ্যেও জনতা টু শব্দ করে না, সেবায়েতের চোখের নির্দেশে কিউ করে, পুজো দেয় এবং সকাতরে প্রশ্ন করে—
প্রশ্ন 1। মা আমার চাকুরে ছেলে কেমন উড়-উড়। আলগা হয়ে যাচ্ছে মা, বড়ো কষ্ট করে মানুষ করেছি।
উত্তর . তোমার ছেলের ভিনজাতের প্রেমিকা, সত্বর মেনে নাও, নইলে ছেলে হারাবে-অলৌকিক স্বর বলে।
প্রশ্ন 2। মা ভাড়াটে কিছুতেই উঠছে না, মামলা করেছি, জিত হবে তো? উত্তর . কিছুমাত্র সত্য যদি তোমার পক্ষে থাকে তবেই।
প্রশ্ন 3। মা, স্বামী ইদানীং অফিসের কাজ বলে হপ্তায় দু-দিন বাড়ি ফিরছে না, সব সময়ে দুর্ব্যবহার করে।
উত্তর . লোকটি চরিত্র হারিয়েছে। দুরারোগ্য রোগ হবে। মার পায়ের কাছে নিয়ে আসতে পারলে রক্ষা হতে পারে।
এবং প্রণামি পড়ে। প্রণামির পাহাড়। দেশবিদেশ থেকে পত্র আসে, দুঃখ আসে, প্রশ্ন আসে। জবাব যায়। আশীর্বাদ যায়। প্রসাদি ফুল ও ফল বিতরণ হয় অকাতরে। এতদিনে বাড়িটি প্রকৃতই ঠাকুরবাড়ি হয়। দোতলা ওঠে। সেখানে বসবাস। নীচে মন্দির। সেখানে অধিষ্ঠিত দেবপ্রসাদের নিজ হাতে গড়া তারামূর্তি। পেছনে মায়ের বসনভূষণ সমেত পেটিকা। সেই পেটিকার তত্ত্বাবধায়ক তারাপ্রসাদ তারই মধ্যে একদিন আবিষ্কার করেন পিতার জীর্ণ ডায়েরিটি। কপালে ঠেকিয়ে পড়েন—মায়ের অষ্টমূর্তি—তারা, নীলসরস্বতী, ভদ্রকালী এবং কামেশ্বরী। মূল মূর্তি নীলকণ্ঠ মহাদেবকে স্তন্যপানরত মহালক্ষ্মীর। এভাবেই তিনি নীলকণ্ঠের বিষ দূর করেছিলেন। শিলাময় সেই স্বয়ম্ভ মূর্তিকে নাটোরের মহারানি ঢেকে দেন লোকরঞ্জিনী লোকপালিনী মূর্তি দিয়ে।