কিন্তু যেদিন জানালা দিয়ে লম্বা সুঠাম চেহারার ব্যাকব্রাশ চুল শ্যামকান্তি যুবকটিকে দেখে তার নিজেরই খুব পছন্দ হয়ে গেল, সেদিনই হল তার আসল মুশকিল। সে দিনেই মন দিয়ে হালকা কমলা রংয়ের সরু জরিপাড় শাড়িটা সে পরেছিল। মুখটি মেজে ঘষে, চুলগুলি খুলে দিয়েছিল। কপাল ঢেকে কান ঢেকে পড়েছিল চুলের গোছা। ছোটো তার পছন্দসই টিপ ছিল কপালে। টান টান করে শাড়ি পরা ফিগারে তনুশ্রী যতদূর খোলবার খুলেছিল। ঠোঁট ভালো করে ঘষে সামান্য একটু ভেসলিন দিয়ে চকচকে করে নিয়েছিল। আর বুকের খাঁজে লুকিয়ে নিয়েছিল একমুঠো শুভ্র কু-কুসুম। মৃদু সুগন্ধে চারদিক মাত হয়ে থাকবে।
যুবকটি ভদ্রভাবে নমস্কার করে বলল, আপনি সত্যি কথা পছন্দ করেন তো?—সে কী বলবে? সত্যেরও যে তেমন কোনো অ্যাবসলিউট নেই সে তো জীবন দিয়েই জানে।
দেখুন, আমি রাইটার্সের এইচডিসি। যতই চাই আমার ভাগ্যে যে হুরিপরি জুটবে না সে আমি জানি। আমার মা যিনি এতদিন আমাকে ভাত বেঁধে খাওয়ালেন দুঃখ ধান্ধা করে বড়ো করলেন, তিনিই দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী। আমি একজন ভদ্রঘরের রাঁধুনি-কাম-নার্স-কাম আয়া খুঁজছি স্ত্রীর মধ্যে। টানাটানির ঘরে একজন এইরকম রোগীকে সেবাশুশ্রুষা করে আর যাবতীয় যা করার যদি করতে রাজি থাকেন, তাহলে আপনার রূপ আমার চলবে।
চাঁছাছোলা কথাগুলি বলে ছেলেটি তার চোখের দিকে সোজা চেয়েছিল। অলকার কী যে হল, যেন ভেতরটা দারুণ গরম হয়ে উঠছে, সে যেন আর নিজেতে নেই। সে নমস্কার করল, তারপর উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে, পেছনে ফিরে চলে এল।
কী ব্যাপার, কী হল?_যুবকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা তারাপ্রসাদও তাই। কী হল? হলটা কী?
মা তার বন্ধঘরের দরজায় ঘা দিতে দিতে ক্রমাগত কাঁপা গলায় বলতে থাকলেন, কী রে অলি? তুই কি হ্যাঁ বললি, না, না বললি? হ্যাঁ বললি, না, না বললি!
সে বন্ধ ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসেছিল, কীরকম অসাড় দেহমন নিয়ে, কোনো জবাব দেয়নি। যুবকটি শেষে বলেছিল, আমার কথা বোধহয় ওঁর পছন্দ হয়নি।
সে সারারাত দরজা খোলেনি।
না, খুলেছিল। মাঝ নিশীথে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে যথাসম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে বাগানে চলে গিয়েছিল ধীর পায়ে। সৃষ্টি ছাড়া বটল পামটির শুভ্র সুগোল কাণ্ডটি জড়িয়ে ধরেছিল। গাল বেয়ে চোখ ছুঁইয়ে, নাক চুইয়ে মনে মনে বলেছিল, বৃক্ষ যদি তুমি সত্যিকারের বৃক্ষ হও তাহলে আমাকে আশ্রয় দাও। পরদিন ওই গাছের তলাতেই তাকে পাওয়া যায়—জ্ঞানহীন। এবং কপাল ফিরতেই সে রক্ত চোখে চারপাশে তাকিয়ে বলেছিল, তোরা অপবিত্র, আমার এ পূতাঙ্গ ছুঁস না। যা স্নান করে আগে পবিত্র হয়ে আয়। আমার পেটিকায় পাটের কাপড় আছে। তারা-মালা, পলা আছে নিয়ে আয় পরি। হ্রীং শ্রীং স্ত্রীঃ ফট।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে শিহরিত তারাপ্রসাদ ও সর্বাণী চুপ। তারাপ্রসাদ ছাড়া কেউ জানেনই না মায়ের পেটিকায় কী কী বস্তু আছে। শ্যাম শুনল না, শশব্যস্তে ডাক্তার ডাকল। তানা না না করে তিনি যখন এলেন তখন চান করে ভরপেট ফলাহার করে কেশের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে মা তারা বগলামুখী নিবিড় ঘুম ঘুমোচ্ছেন। লাল চওড়া পাড় তসরের শাড়ি পরনে। হাত ভরতি লাল পলা, গলার থেকে লম্বা তারা তারা সোনার মালা লুটিয়ে আছে বুকের উপর। তারাপ্রসাদ ঘরের সামনে প্রহরায়।
উনি ঘুমোচ্ছেন, ছোঁবেন না।
শ্যাম বলল, বাবা আপনি কী পাগল হলেন? একটু দেখতে দিন।
হ্যাঁ দর্শন। একবারমাত্র দর্শন করুন, তারপর চলে যান।
সামান্য ফাঁক দরজা দিয়ে শয়ান মূর্তিটি দেখে সভয়ে ডাক্তার বললেন, অন্য সময়ে জাগলে, বুঝলে শ্যামাপ্রসাদ! ব্যাগ গুটিয়ে ভদ্রলোক পালিয়ে গেলেন।
প্রথম ক-দিন সে এইরকম গভীরভাবেই রইল। ভোরবেলায় উঠে স্নান সেরে কোরা লাল পাড় শাড়ি পরে সেজেগুঁজে ছাতে যায়, ঘুরে ঘুরে গাছগুলির উপর আশীর্বাদের হাত রাখে। আপন মনেই বীজমন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে ঘোরে। নীচে আসে রোদ কড়া হয়ে উঠলে। তখন বাবা তাকে ঠাকুরঘরে ঢুকতে বললে, সে স্থির চোখে তাকায়। নিজের কোণের ঘরটিতে চলে যায়। যথাসময়ে পবিত্রভাবে প্রস্তুত তার ভোগ আসে। খাওয়া দাওয়া সারা হলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। পড়ে, পড়ে, পড়ে। বিকেল হলে আবার বেরিয়ে পবিত্র হয়ে বাগানে যায়। এই শ্বেত কাঞ্চন গাছটি তার বিশেষ প্রিয় ওই যুথী গাছটি তার বড়ো ন্যাওটা, সে না এলে কেমন ঝিমিয়ে থাকে। অনন্য মনে সে পরিচর্যা করে গাছগুলির, তাদের মৃদু অভিমান বোঝে, আদর করে, ফুলগুলি আহ্লাদে ফেটে পড়ে। তারপর পড়ন্ত সন্ধেয় নীচে নেমে সে সোজা ঠাকুরঘরে চলে যায়, আসন পেতে পদ্মাসনে বসে।
সে জানে না কখন সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। ডানহাতে যেন খড়গ ধরা, বামহাতে কপাল, কোন সুদূরে তার চোখ নিবদ্ধ মুখে প্রশান্তি। আবার কখনও তেজ। সে জানে না কখন সে বসেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট ধবনি বেরোচ্ছে—কোনো মন্ত্র কিন্তু এদের বোধের অতীত। বোঝেন অনুমান করতে পারেন একমাত্র তারাপ্রসাদ। তিনি বিহ্বল হয়ে প্রণাম করেন বারবার। সে দেখেও না, তার খেয়ালের মধ্যেই তখন থাকে না ঠাকুরঘরে শুধু প্রণত মাথার গাঁদি লেগেছে, যখন জ্ঞান হয় দেখে তার গলায় আজানুলম্বিত রক্তজবার মালা। আশেপাশে ঝুড়িতে ফলফুল মিষ্টান্ন, শাড়ি, কয়েনে কয়েনে ছয়লাপ, যে যা পেরেছে, পাঁচটাকা, দু-টাকা এক টাকা। নোটের তাড়া। ক্রমে ক্রমে বেনারসি, সিল্ক শাড়ি, মাকে প্রদত্ত সোনার গহনা। আরও বড়ো নোট, আরও বড়ো।