ছাতে সাদা ফুলের জোছনায়, সুগন্ধে মাত হয়ে থাকে বাঁড়জ্যেবাড়ির ওপর বাতাস। কামিনী, বেল, জুই, কুন্দ, রজনিগন্ধা, টগর, শ্বেতকাঞ্চন, হাসনুহানা। সিমেন্টের উঁচু বেঞ্চি করা আছে, তার ওপর পরপর গাছ। বড়ো টব, ছোটো টব, দেয়ালের গায়ে ছোটো একটি খুপরি কুলুঙ্গিতে খুরপি, সারের কৌটো, কাঁচি সব মজুত থাকে। এই ছাতটিই অলকার জুড়োবার জায়গা ছিল। শীতকালে বড়ি দেওয়ার নাম করে, আচারের ভরসা নিয়ে সবাইকে সে ছাতে চলে আসত। যতক্ষণ রোদ ততক্ষণ সে টুপটুপ বড়ি দিচ্ছে, বড়ি দিয়ে আচারের শিশির ঢাকনা খুলে রোদে দিচ্ছে। মাঝারি সব কড়ির বয়ামে আমতেল, ছড়া তেঁতুল, এঁচোড় ফুলকপি-মটরশুটি তেলে দিয়ে রকম রকম আচার, আম কোরা, তেঁতুলের কাই। রকমারি। রোদ একটু সরে গেলে দেখবে কোন গাছে ঝুড়ি এসেছে, চড়ুই-শালিখ কুঁড়ির বোঁটা কেটে দিয়ে যাবে, সেগুলো সে বড়ো বড়ো কাঠির কুঁড়ি চাপা দেবে। আচার ছাতের ঘরে তুলবে। তারপর নীচে নেমে শুরু হবে রাজ্যের কাজ। রোদের ঝাঁঝ মরে এলে আবার চলল। হাতে বই, বেতের চেয়ার ছাত-ঘর থেকে টেনে নামিয়ে, চুল মেলে দিয়ে সাঁঝ না নামা পর্যন্ত পড়া। কী পড়ে অলকা? যা পায়। সঞ্চয়িতা, গীতাঞ্জলি, লাইব্রেরি থেকে আনা গল্প-উপন্যাস, ভ্রমণের বই, অদ্ভুত যত অভিজ্ঞতার গল্প, আর পড়ে পাঁজি, গীতা এবং ঠাকুরদা দেবপ্রসাদের ডায়েরি। শেষোক্ত বস্তুটি সে বইয়ের আলমারি ঝাড়তে-গোছাতে গিয়ে আবিষ্কার করে। করে এত অবাক হয়ে যায় যে প্রথমেই গলা দিয়ে আওয়াজ বার হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস ঝিমঝিমে দুপুর, বাবা অফিসে, মা ঘুমে, ভাই বাইরে—কেউ শুনতে পায়নি সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠাকুরদার ডায়েরি হেন রত্ন পাওয়া গেলে বাবা তো অবশ্যই তার রত্ন দাবি করবেন, সে ডায়েরি তার ছোঁয়া তত বারণ হয়ে যাবে। তাই সে ঝেড়েঝড়ে বাইরের সারির পিছনদিকে জিনিসটি যেমনকে তেমন। রেখেই দেয়। মাঝেমধ্যে অন্য বইয়ের ভেতর করে নিয়ে এসে পড়ে।
ডাক পড়ত। মাঝে মাঝেই। তার পাঠ-নিমগ্ন, কুসুমবেষ্টিত নির্জনতা থেকে নেমে যেতে হত। আলমারি থেকে টিসুর শাড়ি, কেন-না ফুলে থাকবে, ভরন্ত দেখাবে। মেক-আপ স্টিক তো স্রেফ এইজন্যেই কেনা। সাজগোজ শেষ করে কপালে একটি বড়ো টিপ দেবেন মা। তাতে কপাল একটু যদি ছোটো দেখায় চুলগুলো হাতখোঁপা করে হাজিরা দিতে হবে তাকে বাইরের ঘরে। সুটেবল গার্ল এর খোঁজে যেখানে দলকে দল বসে কচুরি-আলুর দম-রসগোল্লার গুষ্টির তুষ্টি করছে।
কী নাম মা?
অলকা ব্যানার্জি।
কুমারী তো? আসল কথাটি যে বন্দ্যোপাধ্যায়—বোধহয় জানা নেই।
অলকার মনে হয়, বলে, কুমারী জেনেছেন বলেই তো দেখতে এসেছেন। বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে ছেলের সম্বন্ধ করতে আসেননি নিশ্চয় অবশ্যই এত কথা সে বলে না। হাসি ঠেকিয়ে নম্র, নতভাবে জবাব দেয়–
কুমারী অলকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
হ্যাঁ গো মেয়ে, খুব নাকি পাস করেছ শুনতে পাই।
মায়ের চোখের শাসনে, প্রাইভেটে এম এ পাস করার কথাটা সে আর বলে না, বলে—এমন আর কী! বিএসসি।–কেমিস্ট্রিতে অনার্স ছিল। ফার্স্ট ক্লাস কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেছে, এত কথা সে কেনই বা বলতে যাবে।
চুলটা একটু আলগা করো তো মা!
কাঁটা তিনটি আলতো করে খুলে নিতেই পিঠে ফণা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশি রাশি কেশ। অলকার চোখে হাসি খেলে যায়।
তা ওদিক থেকে রি-অ্যাকশন আসে। বৃদ্ধাটি বলছেন,—চুল নিয়ে কি ধুয়ে খাব? —অথচ দেখতে তো ইনিই চেয়েছিলেন।
পরে খবর দেব বলে চলে গিয়ে যখন আর খবর দ্যান না এরা, বাবা-মার গায়ে কাঁটা ফুটতে পারে কিন্তু অলকার বড়ো স্বস্তি বোধ হয়। এরা তো বউমার হাতের রান্না চেয়ে-চিন্তে চেটেপুটে খেয়েও বলবে, রান্না নিয়ে কি ধুয়ে খাব?
তবে অলকা বেশি কথার মানুষ নয়। নিজের ভিতরের সোয়াস্তি সে বাইরে প্রকাশ করতে যায় না।
এভাবে দ্বিতীয় দল, তৃতীয় দল আসে। অলকাকে নিজে হাতে খাবার প্রস্তুত করতেও হয়। কিন্তু খবর আর আসে না। দেখতে দেখতে সাতাশ পার হয়ে গেল। হঠাৎ ঠাকুরঘরের চৌকাঠে বাবা খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন। কী ব্যাপার? ঠাকুরঘরে ঢুকতে পাবে না অরক্ষণীয়া কন্যা। পুজোর জিনিসপত্রে হাত দেবে না।
মা বললেন, পাগল হলে না কি? আগেকার ওসব অরক্ষণীয়া-টিয়া আছে নাকি এখনও?
না।
রাগটা করছ কার উপর? মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, কালোকুষ্টির ঝাড় তো তোমরা। দেয়ালের দিকে চেয়ে ছবিগুলো দ্যাখো না। আমার যদি কিছু ছিরিছাঁদ থেকেও থাকে, সে তোমাদের এই সংসারের পিছনে গেছে। মেয়ে যে রূপটা পাবে, কোন স্বগগো থেকে পাবে শুনি? আজকাল কত কি স্নো, ক্রিম উঠছে, পার্লার, মার্লার সেসব করার জন্যে দু-দশ টাকা ধরে দিয়েছ কোনোদিন? ওই মেয়ে বড়ি, আচার, পূজোর জোগাড়, কাপড় কাচা, বাসন মাজা সবই করছে আমার সঙ্গে সঙ্গে। ঝনাৎ করে মা চলে গেলেন।
সত্যি কথাই। জিনে থাকবে তবে তো রূপ পাবে? ছিটেফোঁটা নেই কোনো কুলে!, আয়নার দিকে চেয়ে অলকা মনে মনে বলে। দেবপ্রসাদ যেন কালীর হাতের খাঁড়াটা। একবগ্না, ঘাড় উঁচিয়ে পইতে হাতে করে এগিয়ে আসেন আর কী! ফোটোগ্রাফেও বোঝা যায় খসকা কালো রং, সব ঢেকে কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। তস্য পত্নী একেবারেই কেলে হাঁড়ি। ঠাকুমাকে ছোটোবেলায় দেখেছে, ভালোই মনে আছে তার। খুব বড়োলোকের মেয়ে ছিলেন। তাঁর অনেক গয়নাপত্তরও ছিল। হয়তো সেইসব ঘুষ দিয়েই নিরূপ কন্যার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মানুষটি ছিলেন বড়ো ভালো। বউমাকে কোনোদিন কষ্ট দেননি। নাতি-নাতনিকে অশেষ ভালোবাসতেন। তাঁকে কোনোদিন দেখতে খারাপ বলে মনে হয়নি অলকার। রূপের ছববা কী জিনিস এই এখন ইদানীংই পুরো মালুম হচ্ছে। চতুর্দিকে হোডিং, তাতে রূপসি মেনকা রম্ভারা বুকের ভাঁজ দেখিয়ে সব উলঙ্গহার ছড়িয়ে রয়েছেন, ছিঃ। এইসব কাগজ, বিজ্ঞাপন আর পত্রপত্রিকার দৌলতেই তাদের পৃথিবী জানল রূপ রূপ, বিরূপ, রূপকথার নানান আখ্যান-ব্যাখ্যান। তা নয়তো সে কি কোনোদিন নিজের মাকে অসুন্দর দেখেছে? মুখে মেচেতার ছাপ, না ফরসা কালো, মাথার চুলগুলি সামনের দিকে উঠন্ত, থলথলে গড়নের মা তার জননীই তো! আর ভাই সেই আদরকাড়া বল-খেলুনেটা! লম্বা চওড়া, একমাথা চুল এখন, কিন্তু কুচকুচে খসকা কালো, মুখময় ব্রণর দাগ এক মুরারি ওকে কি কোনোদিন কুরূপ বলে সে জেনেছে! এতদিনে জানল—বাবা মা, ঠাকুরদা ঠাকুমা, সে নিজে সবাই কুরূপ। তবু সে হয়তো এই এদেরই মধ্যে একটু খোলতাই। কে জানে হয়তো যৌবনের গুণে। তার হ্যাঁ ওই, মা বলেছে আরেকটু দেখনসই হতে সে পারত যদি ক্রিম…ট্রিমের দৌলতে আরেকটু চকচকে হওয়ার চান্স পেত, পার্লারের গুণে সরু ভুরু, একটু ভালো খাওয়া দাওয়া করে দলমলে ঢলঢলে। তা সেও তো তোমরা দিতে পারছ না। তবে রাগটা কীসের, ঝালটা কার উপর ঝাড়ছো? নিজে যে রোজগার করে নেব–তাতেও তো বাদ সাধছ!