পালপুকুরের পালপাড়ার এই চেরা চেরা অলিগলির গোলকধাঁধা পেরোতে পেরোতে শেষকালে গা ঠেকে যাবে যে কুঠিতে সেটিই অলকার বাপ-ঠাকুরদার ভিটে তারাকুঠি। শ্রী দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, তস্য পুত্র তারাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিকারে এখন। এর পরেই পালপুকুর এবং তার সামনে বিরাট মাঠ। পুকুরটি বাঁড়জ্যেদের, এখনও প্রোমোটারের নজর পড়েনি। সামনের মাঠ কার কে জানে। তবে বার্ষিক শারদ দুর্গাপুজো, শ্ৰীশ্ৰীকালীপুজো, বাণীবন্দনা, রবীন্দ্রজয়ন্তী…আদি উৎসব এখানেই হয়। পালপুকুর বন্ধুসংঘ, পালপুকুর পিপলস ক্লাব দুটিই মাঠের উপর শ্যেনদৃষ্টি রেখেছে, এলাকার কেউ কেউ জানে, সবাই জানে না। ছেলেপিলেরা এখানে একটু খেলাধুলো করতে পায়, এতেই সব খুশি আছে। বর্ষাকালে ঘাসে-আগাছায় ভরে যায়, খেলাধুলো হতে হতে টাক-পড়া মাথায় মাঝে মাঝে খামচা খামচা চুলের মতো ঘাসপাতা গজিয়ে থাকে।
এই তারাকুঠির বাড়িটির দিকেই মঙ্গলবার ভোর থেকে দলে দলে লোক চলেছে। বহুদূর ছড়িয়ে গেছে তারা-মার খ্যাতি। মাঠটি ভরো-ভরো। এইরকম শনিবারও। অন্য কোনো দিনে কিন্তু সব শুনসান। ছিমছাম মেয়েটি বাঁডজ্যে বাড়ির চাতাল পেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে এসে পা দেয়। পায়ের বাসি আলতার ছাপ সে সাবান ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি। কালো মেয়ে, ছিপছিপে, একটু বেশি লম্বাই বোধহয়। একসময়ে পাত্রপক্ষ বলত–তাল-ঢ্যাঙা। যা ভালোবাসার লোকের কাছে শ্যামা ছিপছিপে বা তন্বী শ্যামা তাই পাত্রপক্ষের কাছে তাল-ঢ্যাঙা রক্ষাকালী প্রতিভাত হয়। রূপের খানিকটা তো নজরের উপর নির্ভর করেই। মেয়ের মুখটি রোগা, লম্বা, হনু জাগা ছিল-পাত্রপক্ষের ভাষায় ঘোড়ামুখো। তবে এখন শাঁসে-জলে খানিকটা ভয়ে ভরাট লম্বাটে আদল এসেছে। কপাল বড়ো, ঘন ভুরু, চোখ লম্বা, সরু, মণি বাদামি, নাক টিকোলো, হাঁ মুখটি বড়ো। ছড়ানো ঠোঁট। সবচেয়ে খারাপ ছিল বোধহয় দাঁত, সামনের দাঁতগুলি বড়ো বড়ো, এবড়োখেবড়ো। আজকালের সম্পন্ন সচেতন বাড়ির বাবা-মা ছোটোতেই এমন দাঁত ঠিকঠাক করিয়ে দেন। টলস্টয় বলেছিলেন, হাসলে যাকে ভালো দেখায় না সে মেয়ে দুর্লভ, তবে যদি নিতান্তই মেলে, সে-ই প্রকৃত কুৎসিত। এ মেয়েটি সেদিক থেকে প্রকৃতই কুৎসিত। তবে সে হাসতই না। ছোটো থেকে নিজের চওড়া কপাল, বড়ো হাঁ আর অসমান দাঁতের অসুন্দর হাসি সে লক্ষ করেছিল, তাই মুখ খুলে হাসতই না। এখন হাসে। খারাপ তো দেখায় না। সবচেয়ে যা ভালো তা হল চুল। অনেক চুল মেয়েটির। এখন শ্যাম্পু করে কীসব মেখে ফুলো চুল বাগে এনেছে। হলুদ শাড়ি পরা কেশবতী মেয়েটিকে পিছন থেকে দেখলে রূপবতীই মালুম হয়। পিছনের লোক সামনে এসে নির্লজ্জের মতো মুখ দেখে তারপর নির্লজ্জতরের মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে যাই হোক, যারা অলকাকে আগে দেখেছে তারা আকাশ-পাতাল তফাত দেখে। এই মেয়েটির চিকন কালোয় হলুদ, কমলা শাড়ির আভা লেগেছে। চোখদুটির চাউনি গভীর রহস্যে স্থির। মুখে চাপা হাসি। মুখমণ্ডলে প্রসন্ন বিভা। অনেকেরই চেয়ে চেয়ে আঁখি না ফিরে। কেননা তারা দেবী না হোক দেবীর আধার দেখে। আর যারা নিতান্তই কামিনী রমণী দেখতে চায়, না জেনে না শুনে, তাদের পিছন থেকে দেখার প্রত্যাশাটা সম্মুখ দর্শনে পূর্ণ যদি না হয় তো কার কী করার আছে? অলকার? বয়েই গেল। এখন।
তখন? তখন বয়ে যেত না। বড়ো লজ্জা, বড়ো অপমান। গোঁড়া বাড়ি। ঠাকুরদা দেবপ্রসাদ ছিলেন তারা-মার ভক্ত। শেষদিকে প্রায় বিবাগী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পূজিত, নিজে হাতে গড়া তারা মূর্তি ঠাকুর ঘরে, সেখানে সকাল সন্ধে পুজো ঠাকুমার দায়। তারপরে মায়ের। পুজো মানে পুজোর জোগাড়। আসল পুজোটুকু বাবা ব্যাটাছেলে তারাপ্রসাদই করতেন। কখনও কখনও তিনি অসুস্থ হলে পুত্র শ্যামাপ্রসাদ বা শ্যামই করত। মায়ের অসুবিধা থাকলে অলকা করত পুজোর জোগাড়। অলকা বিএসসি পাস করল তারপর বাবা পড়া বন্ধ করে দিলেন, মুখে বললেন, গ্র্যাজুয়েট হয়েছে আর কী! ঠাকুরবাড়ির মেয়ে পুজো-অর্চনা করুক, রান্নাবান্না, বিয়ের জন্যে তৈরি হোক। আসল কথা অবশ্য অলকা জানে। তার মাও জানেন। শ্যামা অলকার মতো লেখাপড়ায় ভালো নয়। তার পড়ার খরচ আছে। মিনি মাগনা হয় না। সৎ ব্রাহ্মণ হলে কী হবে, তারাপ্রসাদ সামান্য চাকরি করেন। বসতবাটিটি ছাড়া আর কিছুই নেই। কাজেই মেয়ের পড়া বন্ধ। বিএড পাশ করে টিচার হওয়ার ঘোর বাসনা হয়েছিল অলকার। এমন কিছু খরচ না। না হয় টিউশনি করে সে নিজেই জোগাড় করবে। কিন্তু বাঁডজ্যেবাড়ির মেয়ে চাকরি করবে এতেও তারাপ্রসাদের ঘোর আপত্তি। হতে পারেন তাঁরা বংশানুক্রমে শক্তিপূজারী। কিন্তু বংশের মেয়ের হাতে তাঁরা কোনো প্রহরণ দেখতে চান না। সে কলম পেনসিল হলেও। বিশ্বাসও করেন না। রমণী চৌকাঠের পার কী ঘরের বার। বিশ্বাস নাই। ভালো কথা, মা তাকে রান্নাঘরে বেশি যেতে দ্যান না। উনুন তাতে কালো মেয়ের কী মূর্তি হবে কে জানে! তবে রান্নাঘর ছাড়াও ঊনকোটি কাজ আছে সংসারে। অলকা সবই করে, করেও ভাববার সময় পায়। একতলা বাড়ির ছাদের ওপর ফুলবাগান করার সময় পায়। বাড়ির পিছনে সামান্য জমি, সেখানেও ফুল ফুল আর ফুল। সবই অলকার এক হাতের করা। লাল পঞ্চমুখী, গোলাপি সপ্তমুখী। জবার গাছ বাগানে আছে অন্তত গোটা দশেক। ময়ের পুজোর ফুল। এ ছাড়া পেয়ারা গাছ এবং কদম, শিউলি, কাঠ-চাঁপা, করবী। একটি নিম গাছ, বাতাবি লেবু, গন্ধলেবুর গাছ এবং অদ্ভুত কথা এক সৃষ্টিছাড়া বটল পাম বাগানে।