কে অলকা?—ধড়মড় করে সে উঠে বসে। বারান্দা নেই, জানলায় দাঁড়ায় শান্তি।
অলি গো, অলি, আমাদের ঠাকুরবাড়ির অলি।
তাই বলো, অলকা বললে বুঝব কী করে? ওর বিয়ের জন্যে পাত্তর দেখা চলছে না?
সে তো কবে থেকেই চলছে। রূপের ধুচুনি মেয়ে। তার উপরে বিএ এমএ পাস দিয়ে বসে আছে। বিয়ে কি সোজা?
তা গীতাদি, রূপের ধুচুনি পাত্তরও তো চারিদিকে কিছু কম দেখছি না। তোমার আমার ছেলের কথা বাদ দাও। নিজের ছেলে কেউ কুচ্ছিত দেখে না। কিন্তু আমাদের বরেরাই বা কী নবকার্তিক ছিল গো? তা-ও তো তোমার মতো চোখোলো মুখোলো মেয়ে জুটেছে। আমার যে অন্তত রংটা আছে এটুকু তো স্বীকার করবে? কেউই মুকখু নই।
তা যদি বললি—ব্যাটাছেলের রূপ আর কে দেখতে যাচ্ছে।
তাহলে গুণ দেখুক। কোনোমতে রোজগার। দুটি মাছ-ভাত। কোনোমতে বছরের কাপড়চোপড়, ছেলে চাকরিতে ঢুকে গেল এতদিনেও একখানা গয়নার মুখ দেখলুম না তা যদি বলো? ছেলের বউ এলে ওই ঘরের সোনা-ই হাতে ধরে তুলে দিতে হবে ভেবে আমার এখন থেকেই বুক কাঁপছে ভাই। গতর ক্ষয়ে গেল। বাসন মাজা, ঘর পোঁছার একটা লোক আছে এই পর্যন্ত। রান্না করো, কাপড় কাচো, ইস্ত্রি করো, সাধের রকম রকম জলখাবার করে দাও, বোতাম বসাও, শার্টের কলার উলটে দাও। নিজের ব্লাউজ-সায়া, এদের পাজামা-লুঙ্গি নিজে হাতে সেলাই করো। এসো জন বসো জন—যেটুকু বজায় আছে দিদি আমার জন্যেই আছে। নিজে না খেয়েও কিছু না কিছু জমাই। ছোটো ছেলেটার আবার যেমন দামালপনা, তেমন বায়না, কে হ্যাপা পোয়ায় গো? এই আমিই তো!
গীতাদির ছেলে এখনও হায়ার পড়াশোনা করছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী স্কুলমাস্টার। উদরাস্ত কোচিং আর কোচিং। গীতাদির সিচুয়েশনও কিছু উত্তম নয়। ছেলে যে কত হাজার রকমের ট্রেনিং নিচ্ছে। ইয়া ইয়া টাকার ছোড়া বেরিয়ে যাচ্ছে। সাধের গয়না মেয়ের বিয়েতে তো সবই প্রায় গেছে। এখন ছেলের ট্রেনিং এর জন্যে স্বামী মুখে রক্ত তুলে খাটছেন, বাকিটুকুতে হাত দেওয়া কারো মনোমতো নয়। এই যা। ছেলেটার একটা কিছু হয়ে গেলে বাঁচা যায়। আরও একটি গুপ্ত ভয় তার আছে ছেলেকে নিয়ে। সেটা শান্তি জানে না। গীতাদি বললেন, যাবি নাকি?
কী করতে?
তারা-মার ভর সোজা কথা নয় শান্তি। গিয়ে দেখতে ক্ষতি কী?
রোজ হচ্ছে?
আমাদের যমুনা বলছিল, শনি-মঙ্গলবারে হয়। প্রথম প্রথম নাকি রোজ হত। এখন শনি-মঙ্গলে এসে ঠেকেছে আজ তো শুকুর হল। কাল যাওয়া যায়। যদিও আমার তর সইছে না।
তাহলে কাল বিকেলে গা-ধয়ে, এদের একটু বলে কয়ে রাখতে হবে। কতক্ষণে ছাড়া পাব তো জানি না! রুনিটাকে নিয়েই ভাবনা। সন্ধেবেলা অবিশ্যি কোচিনে যাবে। তবু…।
ও সব ম্যানেজ করো, কাল যাবই।গীতাদির ইচ্ছে ছেলে নিয়ে দুশ্চিন্তার গুপ্ত কথাটি তারা-মাকে পেশ করে।
পালপুকুর নাম হতে পারে। কিন্তু ঠিক গাঁ-গঞ্জ নয়। বিটি রোড ধরে যেতে যেতে যেতে যেতে যখন ভাবছ এ আর আসবে না, ঠিক তখনই এসে যাবে স্টপ। সামনে দিয়ে রেললাইন গেছে। সেই লেভেল ক্রসিং পার হলেই দেখবে দু-দিকে উপছে পড়ছে বাজার। আলু, পটোল, কুমড়ো, লাউ, পেঁপে, চিচিঙ্গে, ঢ্যাঁড়স সারি দিয়ে তো আছেই। ঘ্যাঁস ঘাঁস বড়ো বড়ো অন্ধে পোনা কাটছে মেছোরা, ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস মুরগির গলা কাটছে মুরগিঅলা, সরু একচিলতে দোকানে রোগা ছাল ছাড়ানো পাঁঠাও ঝুলছে। খাও কোনটা খাবে। জিলিপি ভাজছে গরম গরম, কচুরি ভাজার কটু গন্ধ উঠছে বাতাসে। বাজে ডালডা আর কেরোসিনের ঝাঁঝ। তার পাশে মস্ত মুদির দোকান। ডাল, মশলা থেকে বড়ি, পাঁপড়, আমসত্ত্ব, খেজুর, খোবানি কিছুই বাদ নেই। আর একটিমাত্রই ল্যান্ডমার্ক। একটি ফোটো স্টুডিয়ো। কাচের মধ্যে বাহার দেওয়া উত্তম-সুচিত্রার ছবি, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার ছবি, কে নেই? সববাই এখানে ওই পালপাড়ার ম্যাজিকল্যান্ড স্টুডিয়োয় এসে ফোটো তুলিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও ফ্রক ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে বসে ফোকলা দাঁতে বাচ্চা মেয়েটি হাসছে। থামে হাত দিয়ে স্টাইল মেরে শাড়ি পরা লোকাল সুন্দরীর ছবি, বিয়ের জন্য তুলতে আসা ছবির সার। ম্যাজিকল্যান্ড-এর তলায় ব্র্যাকেটে লেখাও আছে—এক ছবিতেই বিয়ে। বাস, আর কোনো ল্যান্ডমার্ক নেই। ডাইনে, বাঁয়ে সরু সরু গলি—তার ভিতরে ঢুকে আবার ডাইনে, বাঁয়ে সরু সরু গলি। এর ভেতর থেকেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় গুণে গেঁথে যে গলি চাইছ খুঁজে বার করতে পারলে তো পারলে। গুনতে ভুল হলে নিশি পাওয়ার মতো ঘোরো মাঝদুপুরে, কেউ দেখতে আসবে না খাঁ খাঁ গা-জ্বালানি রোদে।
জমির দাম সস্তা ছিল। খুব একটা বসতও গড়ে ওঠেনি। তাই এদিকে আসা। সস্তা হবে। শুনতেই বারো নম্বর রেলগেট পেরিয়ে। এক বাসে তুমি রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি, স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট পৌঁছোতে পার। পালপুকুর উত্তর চব্বিশ পরগনা, সড়কপথে, রেলপথে ঋদ্ধ। কোনো অসুবিধা নেই। কাছে-পিঠে কলকারখানা নেই, গাড়ি-ট্রাকের ধোঁয়া নেই। বাজারের এলোমেলো নোংরামিটুকু ছাড়িয়ে ডাইনে, বাঁয়ে ঘুরে যেতে পারলে নতুন বাড়ির গন্ধ, পুরোনো বাড়ির ভরসা, খোলামেলা মাঠে এবং নিষ্কলুষ আকাশ দেখতেই পারো। তবে কিনা— পপুলেশনে জেরবার এই দেশের আপামর সাধারণের নজর বড়ো নীচু, বা বলা ভালো সরু হয়ে গেছে। জমি যখন রয়েছে, বসত যখন নতুন হচ্ছে তখন রাস্তা কেন পাশাপাশি দুটো ছোটো গাড়ি পাস করার মতোও হবে না—এ প্রশ্নের জবাব নেই। কারা জমি বিক্রি করে, কারা বিল্ড করে কর্পোরেশন কতটা জমি রাস্তায় জন্যে হিসেবে রেখেছে সে অঙ্ক কবার দরকার নেই আমাদের। আমরা দেখব আমার রিকশায় উলটোদিকের রিকশার চাকা বেধে গিয়ে বিভ্রাট হল। দেখে গালাগালি দেব। গাড়িতে গেলে ওপাশ থেকে গাড়ি আসছে দেখে ও ড্রাইভারের হাত নাড়ুনিতে আমি পেছোব না আমার ড্রাইভারের খিচুনিতে ও পেছোবে, সেটা পরিস্থিতিই বলতে পারবে। বাড়িগুলি একটু উঁচু করে তৈরি করা ঠিকই। তিন চার ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হয়, কিন্তু সিলিং সেই নীচু। হাইরাইজের ফ্ল্যাট বাড়িতে যেমনটা হয়। ওই যে নীচু নজর! দোতলার বারান্দা লম্বা মানুষ হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবে।