সামনে দিয়ে শটাশট অন্ধকার পাতাল চলে যাচ্ছে। সুতল, তলাতল, রসাতল। সেইদিকেই ঠায় চেয়ে আছেন উমাপদ। ছোকরা ঝুঁকে পড়ে ফুটকি-ফোড়ন কাটছে। চেনাশোনা বোধহয়। কলেজ-টলেজ? প্রেম নাকি? আজকাল আবার এদের ফঞ্চুড়ি দেখে এসব বোঝা যায় না ফ্রকে-শাড়িতে-প্যান্টে দিব্যি জমেছে। উমাপদবাবুও হাত টান টান করে জমে গেছেন। শাড়ির পাশে ফাইল। এসপ্লানেড এলেই উঠে যাবে। বয়স্কা মহিলার তাক ওদিকেই। তিনি তা হতে দেবেন না। টুক করে বড়ি নামিয়ে দেবেন।
আ মলো! উঠে পড়ল যে! এটা তিনি আন্দাজ করতে পারেননি। ফ্রক বসে। শাড়ি উঠে যাচ্ছে। বয়স্ক মহিলা বসছেন। ছোকরা অমায়িক। মুহূর্তে এসপ্লানেডমুখী কিউয়ে শামিল হয়ে গেলেন উমাপদবাবু। কখন যে চলতে শুরু করেছেন, কখন যে নেমে পড়েছেন বুঝতেই পারেননি। সামনেই মেয়েটির ধড়। বেশ ধড়ফড়ে, জ্যান্ত-জিয়ল।
কখনো ঠিক পাশে, কখনো ঠিক পিছনে, কখনো দু মানুষ পিছনে, তুরতুর খুরখুর চলেছেন উমাপদ। সামনে লকলক করছে সবুজ লাউডগা আঁচল, বিনুনিটিরও বেশ গোছ আছে। এক গোছে এক কেজি, বেশি তো কম হবে না। খুলিটি বেশ ঢাকা তো! শাঁসে জলে মাখা। ফঙ্গবেনে জিনিস নয়।
বেরোবার ঘুরনচাকের কাছে এসে টনক নড়ল। কাজ সেরে নিলেন। ঝট করে রাগত মুখ ফেরাল শাড়ি। উমাপদ তখন দু মানুষ পিছনে, সামনে ঢ্যাঙার পিছনে একেবারে ঢাকা পড়ে গেছেন। কিছু না, একটা কৌতূহল ছিল, মিটে গেল। আধপর্ব মতো ডেপথ। উপর ভাসা জিনিস নয়। মানে নাভিটি। এইবার উমাপদ ফিরে আবার পর-ট্রেনে উঠবেন। উটকো কিছু না ঘটলে নিশ্চিন্তে আপিস যাবেন।
ওদিকে উমাপদকে খাইয়েদাইয়ে সাজিয়েগুজিয়ে দুগগা-দুগগা করে রওনা করিয়ে তপতী আস্তে সুস্থে চান করেন। তাঁর সর-ময়দায় সামান্য কাঁচা হলুদ মেশানো থাকে। একটা সোনার জেল্লা আসে চামড়ায়। নিখুঁত হিসেব। সর-ময়দা শুকোবে। তারপর ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে-দিয়ে স্পঞ্জ রগড়ে সব তুলবেন। রিঠে ভিজছে রাত থেকে। সেই জল মাথায় পড়বে, ফুরফুরে রেশমি হয়ে থাকবে চুল। এসব করতে সারতে টাইম লেগে যায়। তারপর চান-টান সেরে ধোয়া ছাপা শাড়ি আলগা করে পরে তপতী খেতে বসেন। একলার ঘরে একলার টেবিলে খাওয়া। সে যে কী তরিবত আর কী পরিতৃপ্তি তা একমাত্র তপতীই জানেন। সোনামুগের ডাল দিয়ে চামরমণি চালের ভাত মাখো, আধা নরম কড়া ঢ্যাঁড়স ভাজা দিয়ে খাও। ডাল মেখেও খাও, গন্ধ মেখেও খাও। চক্ষু বুজে কষের দাঁত দিয়ে কাঁকড়ার দাঁড়া ভাঙো। চুষে চুষে ভেতরের ঘি টানতে থাকো, টানতে টানতে কুঁদ হয়ে যাও, তারপর টকটক জিবের আওয়াজ করে চাটনি বা অম্বল। চেটেপুটে শব্দ করে, এক চেয়ারে গা আর এক চেয়ারে পা এলিয়ে বসে, আয়েশ করে খাও। খেয়ে-দেয়ে মুখ কুলকুচো করে একটি দাঁতখড়কে নাও, ঠিকঠাক জায়গা খুঁচিয়ে কাঁকড়ার খোলামকুচি ঢ্যাঁড়সের বিচি, খেজুরের খোসা এসব বের করে আনো। যত খুশি মুখ ভ্যাটকাও, দাঁত ছরকুটে করো, কেউ দেখতে আসবে না। বলতে কী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এই সময়টায় তপতী ইচ্ছে করেই বেশ খানিকটা মুখ ভেংচিয়ে নেন। যেন সামনে কোনো বাঁদর-টাঁদর আছে। নিরাপদ দূরত্বে অবশ্য। মাঝে জাল। তা নয়তো তপতীর ভেংচি-ভিরকুট্টির বাহার দেখে বাঁদরটা নির্ঘাত বিপজ্জনকভাবে খিচিয়ে খিমচিয়ে দিত। সুন্দর সুসংস্কৃত মুখখানায় কত রকম কাটাকুটি খেলা যায় সেটা দেখা, এবং নিজেকে দেখানোই যেন তপতীর উদ্দেশ্য।
বেল বাজে, সেলস গার্ল এসেছে। আবার বেল বাজে। কাজের লোক এসেছে।
পাখার তলায় বসে চুলটাকে একটু শুকিয়ে নেন এবার। ভিজে চুলে শুলে মাথা ধরা কেউ আটকাতে পারবে না। মাথা ধরলে চোখে কালি, চোখে কালি পড়লে উমা ব্যস্ত হবেন। পত্রিকার ডাঁই থেকে চোখে কালির নিদান খুঁজতে সন্ধে কাবার। সুতরাং চুল শুকোলে তবেই পছন্দসই কয়েকখানা পত্রপত্রিকা নিয়ে তপতী বিছানাসই হবেন। যত না পড়েন তারচেয়ে বেশি দেখেন তপতী। প্রথমে দেখেন। সাজ। তারপর দেখেন রূপ। তারপর দেখেন গল্প। তারপর ফিরে আসেন সাজসজ্জায়। কত লেহেঙ্গা চোলি, কত বীরবউলি, বডিসুট, বাউটি, শেরওয়ানি, জিনস, কত জিম-যন্ত্র, কত ব্রেসিয়ার, কত হোসিয়ারি। দেখতে দেখতে চোখ ফেরে না। শেষে যখন বিউটি-ঘুমে ঢলে ঢলে পড়তে থাকেন বুকের ওপর উপুড় হয়ে থাকে পাতজোড়া এক নবনায়ক। পত্রিকা আঁকড়ে পাশ ফেরেন তপতী। এইবার উটকো কিছু না ঘটলে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন।