কী ব্যাপার? না, তপতীর মাথায় উত্তর-চল্লিশের পাকা চুল ভেসে উঠতে শুরু করেছে।
শীতের হাওয়া শুরু হতে না হতেই দু-তিন খেপ ক্রিম এসে যায়। মাখো মাখো, মুখে হাতে, পায়ে, আঙুলের মধ্যে মধ্যে ভালো করে ঘষে,—কী ব্যাপার, না তপতীর গোড়ালি ফাটছে, হাত খসখস। গাল-গলা খসখস। এসব নিয়ে উমাপদর ভারি উদ্বেগ। তপতীর চেয়েও।
লোকে জানে রকমারি মনোহারির দোকানে উমাপদবাবুকে দেখা মানে তিনি কসমেটিকস কিনছেন। জুতোর দোকানে? তিনি স্কিন-কালারের মোজা কিনছেন। মিশন রো-এর মোড়ে?-হঠাৎ ভালো জাতের মুসাম্বি কি বেদানা দেখেছেন। জীবনদায়ী, যৌবনদায়ী এসব ফল।
ছেলে পড়ছে হায়দ্রাবাদে। বাড়ি শুনসান। কর্তা-গিন্নিতে রাঁধেন বাড়েন, থাকেন খান, বকবকম করেন আর টিভি দেখেন। পড়শিরা বলে কর্তার আপিসটাই মাঝখানে একটা বেরসিক ড্যাশ। ড্যাশটিকে হাইফেন করতে নাকি উমাপদবাবুর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু এদান্তে বড্ড কড়াকড়ি পড়েছে। ভাগ্যিস পাতাল রেল হয়েছিল তাই হুশ করে যেতে আসতে পারছেন। গিন্নির আঁচল ছেড়ে বেরোনো কি উমাপদর পক্ষে সহজ?
না, না দ্বিতীয় পক্ষ-টক্ষ নয়। সিলভার জুবিলি হয়ে গেল তপুকে ঘরে এনেছেন উমাপদ। সেই থেকেই মজে আছেন। যেমন রং, তেমনি চুলের বাহার। মুখ চোখের বিচার অত আলাদা করে কে-ই বা করতে যাচ্ছে। আসল হল টান। টানছে কিনা। তা তার পিছনে অন্য বস্তুও তো কিছু না কিছু আছেই। রসনেন্দ্রিয় হয়ে পাকস্থলির ট্রাডিশনাল পথেও তো তপতী উমার হৃদয়মন্দিরে প্রবেশ করেছেন কিনা! বাঙাল মামারবাড়ি আর ঘটি বাপেরবাড়ি হওয়ার সুবাদে দুই বাংলার পাকপ্রণালীর যা কিছু মোহিনীমায়া সবই যে তপতীর আয়ত্তে সে আভাস পূর্বেই পেয়েছি। ওদিকের কচুরশাক এদিকের লাউশাক দিয়ে পোস্ত, এদিকের মুলো ভেটকি ওদিকের কালোজিরে কাঁচালংকার বিখ্যাত ট্যালটেলে মাছের ঝোল সর্বত্রই তপতী-হস্তের অবাধ কৃতি। কাজেই, মুচকি হাসলে কী হবে! সবকিছুরই একটা কার্যকরণ থাকে।
হনহন করে চলেছেন উমাপদ খাস্তগির। হাতে ব্যাগ, ব্যাগে বাক্স, বাক্সে টিফিন, গায়ে জহর, তলায় খাদি, তলায় উলিকট। পায়ে মোজা, মোজার ওপর পাম্প, জিবে তপতী, বুকে তপতী—আপাদমস্তক তপতীতে ঠাসা হয়ে চলেছেন উমাপদ।
আস্তে দাদা, আস্তে,—পাতাল রেলের সিঁড়িতে রবিন।
কেন? ধাক্কা? পা মাড়িয়েছি?
আরে না, না আপনি মারবেন ধাক্কা? বলছি আপনার জন্যই। বয়স তো হচ্ছে।
উমাপদবাবু কাষ্ঠ হাসলেন।
প্রথমত, বয়স হচ্ছে, এ একটা ফালতু কথা। আপামর জনগণ হল গিয়ে জম্মবুড়ো। জন্মেই মরে আছে। এই বুঝি এল, এই বুঝি…। তিনি সে বান্দা নন। কত বয়স? পঞ্চাশ? পঁচানববুইয়ে অলিম্পিক করছে আজকাল, একশো পার করছে লিখতে লিখতে, লেকচার দিতে দিতে। দেশ চালাচ্ছে কারা? ছেলেছোকরারা? পাকা পাকা মাথা সব। হয় পরিপক্ক শুভ্র-সনাতন, নয়তো বেল, সব চুকেবুকে গেছে। তা এদের কাছে তো তাঁর পঞ্চাশ নস্যি? তুরতুর করে ওর এর পাশ দিয়ে গলে গলে ঠিক ন-টা পনেরোরটাতে উঠে পড়বেন তিনি। বাঁধা নিয়ম। হাতেই বাঁধা হিসেব।
ভিড় কাটিয়ে এগোতে এগোতেই এক দঙ্গল স্কুল-ছাত্রী। বাঙালি নয়। মাড়োয়ারি এরা। দুধ-ঘি-খাওয়া নধর চেহারা। স্বাস্থ্য ফেটে পড়ছে। হলুদ ব্লাউজ, নীল স্কার্ট, টানটান দু-বিনুনি একেবারে খুলির ওপর থেকে ঝুলিয়েছে কেউ কেউ, আবার ঝুঁটি বেঁধেছে ক্লিপ দিয়ে। মুঠো করে সহজেই ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। উমাপদবাবুর হাইটে কুলোবে না। কিন্তু এইভাবেই তিনি কচি লাউ, বোম্বাই বেগুনের বোঁটা ধরে ঝুলিতে পোরেন।
সুতরাং আর এগোলেন না তিনি। ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না এরা, কিচিরমিচির শালিক-ছাতারে-চড়ই-বাবুই। এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে, সামনে দিয়ে, পিছন দিয়ে মাখন-চকচক হাত ঘুরে যায়। গোল গোল হাত গাল ঝাপটা মেরে যায়। কিচ্ছুটি বলবেন না উমাপদ। করুক যা করছে, দিক না তাঁকে চেপটে, তাঁর আপত্তি নেই। ওই রবীন্দ্রসদন আসছে, হুড়মুড় করে নেমে যায় সব। চোখে-কানে দেখতে দেয় না এই মেট্রো রেল।
এইবার এগোতে থাকেন উমাপদ। একজন বয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলছেন। পাশে এক ছোকরা। সামনে সিটে একটি ফ্রক, আর আশ্চয্যি, একটি শাড়ি। ডাইনে বাঁয়ে যদ্দূর চোখ যায়, চোখ চালিয়ে-সালোয়ার-কামিজ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলেন না উমাপদ। আছে বুড়ি-থুড়ি। কিন্তু কাঁচা গায়ে শাড়ি এই একটি মাত্তরই। সালোয়ার-কামিজ ড্রেসটা দুচোখ পেড়ে দেখতে পারেন না উমাপদ! পোশাক না পাশবালিশের ওয়াড় বোঝা যায় না। ফ্রক তবু একরকম। কিছুটা খোলাখালা থাকে। তবে সব পোশাকের সেরা পোশাক হল গিয়ে শাড়ি। এই যে মেয়েটি সবুজ রঙের গোল-গলা ব্লাউজ পরেছে, উপরের দিকে ভাঁজটা কেমন চমৎকারভাবে ভেসে রয়েছে। যতই চেষ্টা করুক পুরোপুরি ঢাকাতে পারবে না। ব্লাউজের আর কোমরের মাঝখানে যে নরম, সাদা, রসালো পেটিটুকু ওর দাম লাখ টাকা। এমন পুরু অথচ ফোলা নয়, চিকন, সুস্বাদু জিনিস কুমারী মেরে ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। নাভিটি খোলা আছে কি না দেখা যাচ্ছে না। তবে অনুমান করা যায়, আছে। কোনো বিনোদিনী আজকাল নাভির ওপরে শাড়ি পরে না। উঠে দাঁড়ালে বোঝা যাবে।