সন্ন্যাসী শান্তকণ্ঠে বলিলেন, বাস। এই অহংকারটুকু ওই নির্বাপিত হোমকুণ্ডে আহুতি দিয়া চলিয়া যাও। দেবতায় তোমার ভক্তির অহংকার। সাত্ত্বিক জীবনযাপনের অহংকার। এইমাত্র। ভাবিয়া-চিন্তিয়া দিযে, ঘর মন্ত্রসিদ্ধ। দিলাম বলিলেই দেওয়া হইবে না। দান পূর্ণ হইলে হোমকুণ্ড আবার জ্বলিবে।
বলিয়া সন্ন্যাসী একমনে মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। দণ্ডকাল পরে চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন সম্মুখের আসন শূন্য। হোমকুণ্ড জ্বলে নাই।
ধীরে ধীরে প্রবেশ করিলেন বড়োব। লাল পাড় শুদ্ধ বস্ত্রের প্রান্ত কণ্ঠে জড়াইয়া অবগুণ্ঠনবতী ভক্তি ভরে প্রণাম করিলে সন্ন্যাসী বলিলেন, অধিক সময় লইব না মা, দক্ষিণ হস্তে কোশা হইতে বিল্বপত্র তুলিয়া বাম হস্তের মুষ্টিতে স্থাপন করো। ঈর্ষার বিষে মেজোবধূর দেহ নীলবর্ণ হইয়াছে। কেহ জানিবে না মা, তোমার এই গোপন ঈর্ষাটুকু হোমকুণ্ডে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া যাও, তাহা হইলেই উনি আরাম হইবেন। বিপত্রে ঈর্ষা আকর্ষণ করো। দেখিও মা, মন্ত্রসিদ্ধ ঘর, দিব বলিলেই দেওয়া না-ও হইতে পারে।
সন্ন্যাসী জানিতেও পারিলেন না, কখন বড়োবধূ নির্গত হইয়া গিয়াছেন। আসনে মেজোকর্তা, যজ্ঞকুণ্ডে সামান্যতম ধূমও আর নেই। মেজোকর্তা গদগদ কণ্ঠে বলিলেন, আদেশ করুন প্রভো।
সন্ন্যাসী মৃদুস্বরে কহিলেন, দারাপুত্র পরিবারসম্পন্ন গৃহস্থ মানুষের কোনো দায়িত্ব অস্বীকার করিলে চলে না বৎস। আচমন করিয়া বসো। উদাসীনতা হোমকুণ্ডে বিসর্জন দিয়া একটি কাষ্ঠখণ্ড দায়িত্ব স্বীকারের প্রতীক স্বরূপ যজ্ঞকুণ্ড হইতে তুলিয়া লইয়া পীড়িতা পত্নীর বক্ষে স্থাপন করো গে। উনি রক্ষা পাইবেন।
মেজোকর্তা কিছুক্ষণ প্রাণপণে কাষ্ঠখণ্ড তুলিবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে শুষ্ক মুখে, ঘর্মাক্ত কলেবরে বাহির হইয়া গেলেন। মনে হইল এইবার সন্ন্যাসীর ধৈর্যচ্যুতি হইতেছে। মুখমণ্ডলে প্রশান্ত শিবভাব অন্তর্হিত হইয়াছে, ধীরে ধীরে যেন চক্ষে, গণ্ডদ্বয়ে, ওষ্ঠাধরে রুদ্রভাব প্রকাশ পাইতেছে। সেই মেঘগম্ভীর মুখমণ্ডল দেখিয়া ভয়ে ছোটোকর্তা ও ছোটোবধূর প্রাণ উড়িয়া গেল। সন্ন্যাসীর আদেশে তাঁহারা একত্রে প্রবেশ করিয়াছিলেন। বজ্রকণ্ঠে সন্ন্যাসী বলিলেন, স্বার্থপরতা ত্যাগ করিতে পারিবে? মন্ত্রমুগ্ধ সর্পের ন্যায় দুলিতে দুলিতে দম্পতি বলিল, না। দীপ্ত চক্ষে সন্ন্যাসী বলিলেন, তবে দূর হইয়া যাও।
আসন ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হোমঘরের কপাট খুলিয়া দাঁড়াইলেন। যেন মূর্তিধারী কালভৈরব। দীপ্ত চক্ষু, কণ্ঠে বজ্র—বলিলেন, আর তিন দণ্ড কালমাত্র বাকি আছে ইহার মধ্যে মাতার প্রাণ রক্ষা করিতে হইলে তোরা কেউ শীঘ্র কিছু দে। ননদিনিদের কাহাকেও বলিলেন, লোভ দে, কাহাকেও বলিলেন, মিথ্যায়
মুগ্ধ হইয়া আছিস, মোহটুকু দে, কাহাকেও বলিলেন, একদেশদর্শিতা বিসর্জন দে সন্ন্যাসীর মন্ত্রের ক্রিয়ায় সকলে সত্যবদ্ধ। কেহই প্রার্থিত বস্তু দিতে পারিল না।
অবশেষে সন্ন্যাসী বালক-বালিকাদিগের প্রতি চাহিয়া মৃদু, কোমল কণ্ঠে বলিলেন, ওঁ তৎসৎ। বৎস, তোরা শুচি নিষ্কলঙ্ক অকপট, তোরাই তাঁহার শেষ আশ্রয়। বল, বাছারা মেজোমাতাকে ভালোবাসিস?
হ্যাঁ। সমবেত কণ্ঠে উত্তর আসিল।
কেন?
মেজোমণি পুতুল কিনিয়া দেয়, লাটিম কিনিয়া দেয়?
বল কিনিয়া দেয়, মেজোমণি খাবার করে, গল্প বলে।
যদি তিনি আর কিছু কিনিয়া না দেন, আহার্য প্রস্তুত না করেন, যদি রূপকথা আর না বলিতে পারেন?
বালক-বালিকার দল মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইল। সন্ন্যাসী খড়মের শব্দ তুলিয়া বাহির হইয়া গেলেন। প্রথমে দরদালান, তাহার পর বাহির প্রাঙ্গণ, তাহার পর বিরাট মানুষটিকে আর দেখা গেল না।
৩.
হোমঘরে চন্দন কাঠ, গব্যঘৃত, ধুনো গুগগুলের গন্ধ কেমন তীব্র কটু হয়ে উঠেছে। বড়োবাবু রোষকষায়িত লোচনে বললেন, ভণ্ডামিগুলো টান মেরে ফেলে দে। নিবারণ, বিশু কে কোথায় আছিস।
সিরাজুলের বুক চাপড়াতে এসে বলল, সবেবানাশ হয়ে গেল গো। মেজোমণিমা আমার আর নেই যে গো! টিমটিম করে পিদ্দিমটি জ্বলছিল, আগলে বাগলে রেখেছিনু, তা মাকে আর ধরে রাখা গেলনি।
মেজোমণির ঘরে দীপ জ্বলেনি। বডোকর্তা বললেন, মেজো, চাবি দে।
মেজো বললেন, চাবি নেই।
ছোটোকর্তা বললে, ইয়ার্কি মেরো না দাদা। চাবিটা দিয়ে ফেলল। চাবি হলে সব হবে।
বড়োমণি বললেন, চাবি হলে সব হবে?
ছোটোমণি বললেন, সব হবে।
ননদিনিরা বললেন, হবে, হবে, সব হবে।
গদির তলায় হাত দিয়ে মেজোকৰ্তা অবাক হয়ে দেখলেন—ওমা এই তো চাবি। শেষ-সম্বলটুকু দাদার হাতে তুলে দিতে দিতে মেজোকর্তা ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
চাবি একবার ঘোরাতেই সিন্দুকের ডালা ফাঁক হয়ে গেল। অভ্যন্তর শূন্য। মেজোমণির স্ত্রীধন মেজোমণির দেহান্তের সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ধান করেছে।
আবেশ
বাঁড়জ্যেদের বাড়ির অলকার উপর তারা-মার ভর হয়েছে শুনেছ গো?–ও শান্তি!
শান্তি সারাদিনের কাজকর্ম সেরে একটু দুপুর-ঘুমের জোগাড় করছিল। তার স্বামী পোস্টঅফিসে কাজ করে, ছেলে সেক্রেটারিয়েটে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে। নিশ্চিন্দির চাকরি। খেয়েদেয়ে স্বামী দুটি পান, ছেলে চারটি সুপারি-কুচি মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ছোটো ছেলে তারও পরে। তারপর শান্তির কাজ শুরু। একটা না কি? আড়াইটে নাগাদ সে একটু নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পায়। পাশের বাড়ির গীতাদি বারান্দা থেকে বুক অব্দি ঝুঁকিয়ে ডেকে যাচ্ছে তো ডেকেই যাচ্ছে।