জানলার পাশে আরামকেদারা। এই আরেকটা দাদুর আমলের জিনিস। ভাঙে না, মচকায়ও না। কুচকুচে আবলুশ কাঠের জিনিস। নরম গদি দেওয়া। সেই গদির গায়ে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে জানলার বাইরে চোখ রাখলেন তিনি। তাঁদের পনেরো তলা, পাশের ব্লকটা সতেরো তলা। সতেরো তলা টপকে আকাশরেখা দেখতে পেলেন অনিকেত। দেখতেই থাকলেন। দেখতেই থাকলেন। কী সুন্দর। কী অপূর্ব সুন্দর! কী চমৎকার এই জীবন ব্যাপারটা। আর কিছু না। শুধু সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে থাকাটাই একটা…কী দুর্লভ সৌভাগ্য?
পাশের ব্লকটাতে ওরা ছাদ-বাগান করেছে। একটা করবী গাছ। সরু সরু বাঁকা কুকরির মতো পাতার মধ্যে থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল ফুটে থাকে। সবুজে লালে নবীন। এখন, এই শীতেও সবুজ জাগিয়ে রেখেছে গাছটা। একটু খুঁজলে দেখা যাবে দুটো ব্লকের মাঝখানের জমিতে গজিয়ে ওঠা তিনটে বটল পাম। দুধ সাদা গা। ওপর থেকে সেসব দেখা যায় না। কিন্তু স্মৃতিতে ভাসে মাথায় সবুজ পালক। গাছেরা কখনও বুড়ো হয় না। ওরা যতদিন খুশি আকাশ দেখে, মাটি থেকে খাদ্য নেয়, বাতাস থেকে শ্বাস নেয়, এবং অতি মূল্যবান অক্সিজেন পৃথিবীকে দিতে থাকে। দেয় বলেই না গাছপালার এতো দাম, এতো আদর। এই যে সব গগনচুম্বী বাড়ি। তাদের প্রতি গুচ্ছে নির্দিষ্ট সংখ্যক বৃক্ষ আছে। আছে ঝোপ জাতীয় গাছ। ঝকঝকে তকতকে। ছোটো চারা যখন পোঁতা হয় তখন চারদিকে বেড়া দেওয়া হয় ভক্তিভরে। গাছ সবসময়ে জীবন দিচ্ছে, তাই গাছ দেবতা। দিতে হবে সবসময়ে কিছু-না-কিছু দিয়ে যেতে হবে। বি প্রোডাকটিভ, অনিকেত! বি প্রোডাকটিভ। বুকের ভেতরে ব্যাটাচ্ছেলে এস, সি, ডি-টা আবার বলছে। চমকে প্রায় আরামকেদারার আশ্রয় থেকেও পড়ে যাচ্ছিলেন অনিকেতবাবু।
তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। মোটা নোটবই। লাইব্রেরি থেকে আনা রেফারেন্স। বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা। ভেতরে মার্কার দিয়ে সব ওলটানো আছে। বিশ্ব রাজনীতির ওপর জনসংখ্যার প্রভাব নিয়ে একটা তথ্যবহুল প্রবন্ধ লিখছেন তিনি। লিখছেন মানে ছেলে-বউয়ের কাছে বলেছেন যে লিখবেন। আসলে কলম চিবোচ্ছেন। ভালো লাগছে না মোটেই।
পঞ্চান্ন বছর বয়সে অবসর নেবার পর ঠিক পনেরোটা বছর কেটে গেছে। গোড়ায় গোড়ায় অনিকেতবাবু খুব উৎসাহের সঙ্গে লেখাজোকা ধরেছিলেন। বিজ্ঞাপনসংস্থার সঙ্গে কাজ কারবার করতে হত, তাই চেনাশোনা ছিল কিছু কিছু। লেখার অভ্যেস। আইডিয়া নিয়ে নাড়াচাড়া করার অভ্যেস এগুলোও ছিল। নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। ছাপত। রোজগারও হত। আত্মতৃপ্তিও হত। পেনশন তো পাঁচ বছর অন্তর শতকরা দশভাগ করে কমে যায়, কাজেই এই উপরি আরে নাতির জন্য দামি খেলনা, রুমির জন্য একটা ভালো পারফিউম কি সুপ্রতীকের জন্য একটা শৌখিন সিগারেট লাইটার—এই জাতীয় উপহার কিনে বাড়ির হাওয়ায় খুশির ঝলক এনে দেওয়া হত। এমন ছোটাছুটি করে দোকান বাজার করতেন, হইহই করে আড্ডা মারতেন ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে, দুপুরবেলাও কাজে-কর্মে বেরিয়ে থাকতেন যে, ছেলে-বউ-নাতি প্রতিবেশীরা কেউই বুঝতে পারত না তাঁর বয়স হচ্ছে। মাঝে মাঝে সুপ্রতীকের বন্ধু অবুদ বলত, কাকাবাবু আপনার চুলগুলো কাঁচাপাকা না হলে কেউ বুঝতেই পারত না আপনি অবসর নিয়েছেন। আপনি আমাদের থেকেও জোয়ান।
তা সে যাই বলুক, বললেই তো আর তিনি জোয়ান হয়ে যাচ্ছেন না। কঠিন সত্য হল এই: তিনি অবসরপ্রাপ্ত, দেশের সাম্প্রতিকতম নিয়ম অনুযায়ী পঞ্চান্ন বছরেই। তাঁর রাজনৈতিক অধিকার নেই, অর্থাৎ তিনি ভোট দিতে পারেন না, কোনো আদালতে বিচারও চাইতে পারেন না। তিনি ঠিক নাগরিক যাকে বলে তা নন পুরোপুরি। যেটুকুও বা নাগরিকত্ব আছে ক্রমশই খোয়াচ্ছেন, খোয়াতে থাকবেন। এখন যে-কোনোদিন, বুড়ো অকর্মণ্য বলে বোঝা গেলেই সরকারি বৃদ্ধনিবাসের টিকিটটি তাঁকে কেউ ধরিয়ে দেবে। ছেলে বউই দেবে, ওরা যেমন প্র্যাকটিক্যাল! আর ওরা না দিলেও প্রতিবেশী আছে, বন্ধুবান্ধবের ছেলেপুলে আছে, পুলিশ আছে। নেই কে?
কিন্তু আজকাল অনিকেতবাবুর এই দৌড়ঝাঁপ আর ভালো লাগছে না। রাতুলটা যতদিন ছোটো ছিল, ভালো জমত। কিন্তু দেখতে দেখতে সেও এখন সতেরো আঠারো বছরের হয়ে গেল। তারও বাইরের জগৎ হয়েছে, গোপনীয়তা হয়েছে। তার নিজের জগতের মধ্যে আর চট করে প্রবেশ করা যায় না। করার চেষ্টা করলেই বুঝতে পারেন সুর বাজছে না।
কী রে রাতু, কী পড়বি ঠিক করলি? মেডিসিন?
কোন মেডিসিন?–রাতুল মুখ তুলে জিজ্ঞেস করে। ছোট্ট রাতুল তাঁর চিকিৎসা করতে খুব ভালোবাসত। ড্রপার দিয়ে ইঞ্জেকশন দিত। পিপারমিন্টের ট্যাবলেট খেতে দিত। অকেজো প্লায়ার্স বুকে পিঠে বসিয়ে হার্ট বিট দেখত।
কোন মেডিসিন মানে?–অনিকেতবাবু ওর কথা বুঝতে পারেন না।
মিলিটারি না সিভল না পুলিশ?
আজকাল এইসব আলাদা বিভাগ হয়েছে বুঝি?।
ততক্ষণে রাতুল তাঁর চোখের সামনে থেকে হাওয়া হয়ে গেছে। যাবার সময়ে ছুড়ে দিয়ে গেছে সে কমটেক পড়বে।
কিংবা!
কী রে দাদু আজকাল কার সঙ্গে স্টেডি যাচ্ছিস? খুব মাই-ডিয়ার দাদু হতে চেষ্টা করেন তিনি।
দিয়া, চই আর দাভিনা।
তিনজনের সঙ্গে?—অনিকেত কেমন ভোম্বল মতো হয়ে যান।
হ্যাঁ!–রাতুলের অবাক উত্তর। ওসব তুমি বুঝবে না দাদু।