আশ্চর্য! কি বলছেন উনি? আমি বললাম, দেখুন আমার স্বামীর রেখে যাওয়া সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে আমাকে চলতে হয় অনেকটাই। অমুর স্কুলে পড়াবার আর্থিক সাধ্য আমার নেই। আমার ছেলে ভরতির সময়ে তত চৌখসও ছিল না। অ্যাডমিশন টেস্টে পারেনি। এ প্রশ্ন উঠছে কেন আমি বুঝতে পারছি না।
ডক্টর চন্দ্র হেসে বললেন, দেখুন পিসিমণি, আমার পেশেন্ট বহুদিন ধরে লক্ষ করেছে বাড়ির সব ছেলেমেয়ে বড়োদের কাছ থেকে এক ব্যবহার পাচ্ছে না। আপনার ছেলের স্কুল ভরতি নিয়ে নিশ্চয় বাড়িতে যথেষ্ট কথা কাটাকাটি হয়েছে। আমার পেশেন্ট মনে করে আপনার ছেলেকে এবং আপনাকেও অবহেলা করা হচ্ছে, এটা একটা পয়েন্ট। কিন্তু শুধু তাই-ই নয়, অনেকরকম পারিবারিক অবিচার, স্কুলের অবিচার, সামাজিক অবিচার ওর মনের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে বলে মনে হচ্ছে।
তো কি? ও কি তাই জন্যেই পালিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে।
মে বি, হী ওয়াজ ট্রাইং টু গেট অ্যাওয়ে ফ্রম দ্য ফ্যামিলি, ফ্রম দ্যা সোসাইটি। বাট হী ইজ টেলিং আস টুথ হোয়েন হী সেজ হী ওয়াজ সর্ট অফ ডিউপড় বাই এ ম্যান। পিসিমণি ওই লোকটি সত্যিই। তবে সে লোকজন জড়ো হতে পালিয়ে গিয়েছিল কি না, অমিতাংশু অ্যাট অল ঘুসুড়ির পথে গিয়েছিল না বামুনগাছির পোল হয়ে কোনা জগদীশপুরের দিকে যায় সেটা এখনও বুঝতে পারিনি। বাই দা ওয়ে, আপনারা কি জানেন অমিতাংশু খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে?
না তো! তবে বউদি বলে ম্যাপ-ট্যাপ খুব ভাল আঁকে। বউদির ইচ্ছে ছিল ও জোগ্রাফি পড়ে। কাটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করে।
কে বউদি? পেশেন্টের মা?
না, ওর জ্যাঠাইমা, বড়োমা বলে।
হুঁ। ডক্টর চন্দ্র চুপ করে গেলেন, তারপরে বললেন, অমিতাংশু আমাকে একটা ছবি এঁকে দিয়েছে, ফ্রি হ্যান্ড এঁকেছে, কিন্তু একেবারে নিখুঁত। ওই লোকটির ছবি।
কে লোক?
যে ওকে ডেকেছিল।
ড্রয়ার থেকে সাদা একটা কাগজ বার করে আমার সামনে রাখলেন ডক্টর চন্দ্র। এবং আমি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। ছবিটা এগারো বছর আগে নিরুদ্দিষ্ট আমার স্বামীর। ওর একটা ছবি আমার ঘরে আছে। ধুলোময়লা পড়ে মলিন চেহারা। বছরে একদিন হয়তো হাত পড়ে তাতে। মালা কখনও পড়ে না। যদিও আমার বিশ্বাস ও আর নেই, তবু মালা পরাতে হাত কেঁপে যায়। তা ছাড়া যে মানুষ তার স্ত্রী এবং শিশুপুত্রকে পুরো সংসারের সামনে একলা অসহায় ফেলে রেখে নিজের যন্ত্রণা, নিজের অভিমানকে বড়ো করে দেখে পালিয়ে যেতে পারে তার ফটোর কি মালা পরা সাজে? অবিকল সেই ছবিটি এঁকেছে অমু। মাথায় কাঁচা পাকা চুল, কাঁচা পাকা দাড়ি। কিন্তু ভেতরের মুখটি চিনতে অন্তত আমার কোনো ভুল হয়নি। ও কি তবে বেঁচে আছে? সত্যিই আমাদের বাড়ির কাছে এসেছিল? অমুকে ডেকে আমার কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল? তা হলে তা না করে ওকে ওভাবে ডেকে নিয়ে যাবার অর্থ কি? ওভাবে পালিয়ে যাবারই বা অর্থ কি? ওর কি মাথার ঠিক নেই?
ডাক্তার আমার মুখের ভাব দেখছিলেন, বললেন, চেনেন? আমার দিকে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন, জলটা খেয়ে নিন। তারপরে উত্তরটা শুনব।
খানিকটা কবুল করতেই, বললেন, গোপন করবেন না। ডাক্তার আর উকিলকে কিছু গোপন করতে নেই, জানেন না?
গোপন করার আর আছেটা কী? তবে সেসব কথা এখন আমার মনে করতেও কষ্ট হয়। অফিসে টাকা তছরুপের দায়ে সাসপেন্ড হলেন। মস্ত দায়িত্বশীল পদে কাজ। পেমেন্টের জন্য বিল সই হতে আসে অজস্র, প্রতিদিন। রুটিন কাজ। গোছা গোছা ফলস বিল সই করিয়ে নিয়ে গেছে। অধস্তন অফিসারদের এতো বিশ্বাস করতেন যে তাঁর নিজের সইয়ের জায়গাটি পর পর খুলে ধরলে বিলে তাদের সই আছে কি না দেখে নেবার দরকারও মনে করতেন না। কখনও কখনও এরা তাড়াতাড়ির নাম করে ব্ল্যাঙ্ক চেকও নাকি সই করিয়ে নিয়েছে। এসব আমি পরে শুনেছি। মুখের কথাই ছিল বিশ্বাস করে ঠকব তা-ও ভালো। কেস যখন সাব জুডিস তখন কোথাও আমাদের মুখ দেখাবার উপায় ছিল না। রকম-সকম দেখে ওর রোখ চেপে গেল, বলল, কারা করেছে এখন আমার কাছে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তাদের আমি ধরাবই। অফিস থেকে কোনো সাহায্য পাবার উপায় নেই। একজন অনুগত পিওনের সাহায্যে প্রত্যেকটি অফিসারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করল, অমানুষিক পরিশ্রম আর বুদ্ধি খরচ করে।
এই পর্যন্ত শোনার পর ডক্টর চন্দ্র বললেন, ও হো মনে পড়েছে, সে তো সেনসেশন্যাল কেস। আসামি ধরা পড়েনি। পি কে দত্ত বেনিফিট অফ ডাউটে মুক্তি পেলেন। আচ্ছা। সেই কেস।
আমি বললাম, আসামি ধরা পড়েছিল। প্রতীক দত্ত বেনিফিট অফ ডাউটে মুক্তি পাননি। বেকসুর খালাস পান। তাঁর অধস্তন তিনজন অফিসার এক সাপ্লায়ারের সঙ্গে মিলে বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে টাকা মারছিল। তাদের শেষ পর্যন্ত প্রতীক দত্তই ধরিয়ে দেন। প্রত্যেকের সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু ডক্টর চন্দ্র, আপনি যেমন কেসটার সম্পর্কে ভুল তথ্য জানেন, বিশ্বসুন্ধু লোকও তেমনি জানে। কেন জানেন? খবরের কাগজের গাফিলতি। যতদিন একটা পদস্থ, মানী লোককে টেনে মাটিতে নামাবার সুযোগ ছিল, তার নাম কলঙ্কিত করবার সুযোগ ছিল ততদিন রগরগে সংবাদগুলো তেল মশলা ঢেলে পরিবেশন করেছে। তার পরের কথা আর কিছু লেখেনি। কিছু না। কাজেই আপনার মতো সবাই অর্ধসত্য জানে।