বড়োবউদির অভিমান হবে না কেন! তা এইসব ক্ষুদ্রতা, প্রতিদিনকার নীচতা কি ভাষায় প্রকাশ করার যোগ্য? না এ কাউকে বলা যায়! অফিস ফেরত মেজদা যে বড়ো দোকানের কেক-প্যাটিস আনে, ভালো সন্দেশ আনে, দরজা বন্ধ করে স্বামী-স্ত্রী খায়, ছেলের জন্যে রেখে দ্যায়। আর বড়দা যে সামান্য একটু নতুন গুড়ের সন্দেশ আনলেও তার কুটি কুটি ভাগ হয় সবার জন্যে, আর এই জিনিস নিয়ে বড়োবউদি কান্নাকাটি করলে মা বলে, ও করছে করুক গে, বউমা, তুমি বড়ো, বোর মতো ব্যাভার করো-এ-ও তো সত্যি! দীপ্ত হোস্টেলে থাকে। কিন্তু মহুয়া পাপুয়া যে মেয়ে, সংসারের ভেতরকার সব গোঁজামিল টের পায়। টের পেয়েও চুপ করে থাকে। কখনও কখনও গম্ভীর উদাস হয়ে যায়, এ তো আমি দেখতেই পাই। সত্যিকার মানসিক ধাক্কা খাওয়ার কথা ওই দুটি মেয়ের। অমু, অরু এরা কতদূর এসব অনুভব করে আমার জানা নেই।
প্রতাপদা বললেন, ইনভেস্টিগেশন আমি চালিয়ে যাচ্ছি। তবে কোনো লাভ নেই। আমি নাইনটি নাইন পয়েন্ট নাইন পার্সেন্ট শিওর অমিত মিথ্যে বলছে, সত্যটা তোমরা স্বীকার করো চাই না করো।
প্রতাপদা বেরিয়ে গেলেন। মেজদা ফুঁসছে। আমার ছেলে মিছে কথা বলবে? মেজোবউদিও ফোঁপাচ্ছে, অমু আমার ছেলে হয়ে মিছে কথা বলবে এ আমি ভাবতেও পারছি না, কেন ভাবতে পারছে না ভগবান জানেন। আমি যা জানি তা হল এই মেজদা মেজোবউদি প্রায়ই ট্যাক্সি ভাড়া করে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি লৌকিকতা করতে যায় এবং বড়দা-বউদির নামে তাদের ছেলেমেয়েদের নামে অকথ্য সব মিথ্যে কথা লাগিয়ে আসে। আমার নামেও লাগায়। আমি নাকি ননদিনী। রায়বাঘিনী, আমার সমস্ত খরচ ওরাই বহন করে, অথচ আমি ছেলেকে চুপিচুপি আলাদা খাওয়াই। পরিবেশন করতে গেলে বড়ো মাছটা নিজের ছেলের পাতে তুলে দিই। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গেলে আমার বা বড়দার পরিবারের আজকাল যে হতচ্ছেদ্দা মিলছে তা এই কারণেই, আমি জানি। এ সব কথা কেন যে লোকে বিশ্বাস করে সেটাও আমার কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। ওরা কি দেখেনি বড়দার নিষ্পাপ চোখ, মহু পাপুর মিষ্টি ব্যবহার। নিজেদের চোখে দেখেনি বড়োবউদির ভূতের খাটুনি! দেখেছে, দেখে অনেক সময়েই বলেছে, বড়োকে একটু সবদিক দেখতে হবে বইকি! তা না হয় দেখল। কিন্তু তারপরেই যদি নালিশ করে, সংসারের চাবিকাঠিটি বড়োবউমার হাতে! কলকাঠি সব ওই নাড়ছে। তবে সেটা অন্যায় হয় না? সে গতরে করবে, বুদ্ধিতে করবে, অর্থ দিয়ে করবে, তোমাদের হাতে চাবিটি তবে থাকে কি করে?
বড়দা বলল, অসিত, প্রতাপ, যতই হোক একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার, তার কথাটা একেবারে ফেলে দিও না।
মেজদা তেড়ে উঠল, মানে, তুমি তা হলে ওকে মিথ্যেবাদী হতেই শিখিয়েছ?
বড়দা বলল, মিথ্যের প্রশ্নই উঠছে না। আমি বলছিলুম ওকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।
বলছ কি, আমার ছেলেকে পাগল বলছ? পাগল বলতে চাইছ?
শোনো অসিত, মাথা ঠান্ডা করো, মাথা গরম করার সময় এ নয়। শুধু পাগলরা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায় না। অনেক রকমের মানসিক বিপদ আছে তা ছাড়াও, তুমি ওকে ডাক্তার দেখাও। ওকে যেন এখন মিথ্যেবাদী বলে শাসন করতে যেও না।
শাসন করব না মানে? পিঠের ছাল তুলে নেব!
তার আগে শিওর হও যে ও মিথ্যে কথা বলছে! বড়দাকে কোনোদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এত কথা মেজদার সঙ্গে বলতে দেখিনি। বড়দা নিজের ঘরে গিয়ে বড়োবউদিকে বলল, উমা, টাকা বার করো, ও না যায় আমিই ডাক্তারের কাছে যাব।
বউদি বলল, না, তুমি যেতে পারবে না। টাকা আমি দেব না।
বড়দা আহত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, একথা তুমি বলতে পারলে? এই মহাবিপদের সময়ে তুমি ছোটোখাটো সাংসারিক মনোমালিন্যর কথা ভেবে হাত গুটিয়ে নিচ্ছ?
বউদির চোখ ছলছল করছে, সে বলল, সুবর্ণ, তুই সাক্ষী রইলি, যার ছেলে তার সিদ্ধান্তের ওপর হাত দিলে যে কী ভয়ানক অশান্তি হতে পারে তা জানি বলেই নিষেধ করছিলুম। কিন্তু তোর দাদা আমাকে আপাদমস্তক ভুল বুঝল। বউদি আলমারি থেকে বার করে দিল টাকা।
বড়দা বলল, আমি তো ওকে নিয়ে যাচ্ছি না উমা, ডাক্তারকে শুধু কেসটা বলব, মতামত নেব। কাউকে কিছু বলবার দরকার নেই। আমার প্রাণটা বড়ো অস্থির লাগছে।
সত্যিই বড়দা যেন ধড়ফড় করতে করতে বেরিয়ে গেল।
মেজদা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে ঠিকই করল অমুকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। সকলেই বলছে কৈশোর বড়ো খারাপ সময়। ডাক্তার দেখিয়ে নিতে ক্ষতি কী?
অমু প্রত্যেক সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে সিটিং দিতে যায়। দুবার করে। মেজদার সময় হয় না সব দিন। বেশির ভাগ দিন আমিই যাই। আমার কাজ আর কিছু না। বাইরে ওয়েটিং রুমে বসে থাকি। আধ ঘন্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় নেন ভদ্রলোক। ইনি শুধু ডাক্তারই নন, সাইকো-অ্যানালিসিসও নিজেই করেন। হয়ে গেলে অমু বেরিয়ে আসে, আমি ওকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই।
মাসখানেক পরে ডাক্তার আমার ডেকে পাঠালেন। কথাবার্তা যা হল তা এই, ডক্টর চন্দ্র . আপনি তো অমিতাংশুর পিসি!
হ্যাঁ।
নিজের?
হ্যাঁ।
আপনি কত দিন এদের বাড়িতে আছেন?
বছর দশেক।
আপনার ছেলের বয়স?
চোদ্দ।
আপনার ছেলে অমিতাংশু যে স্কুলে পড়ত সেখানে পড়ে না কেন?
এসব প্রশ্নের অর্থ কি আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বিরক্তিও লাগছিল। এটা আমার একটা গোপন ক্ষতের জায়গা। অরুকে পাড়ার স্কুলে দিয়েছি। অর্ধেক সময় ক্লাস হয় না। পাজি ছেলেদের আখড়া একটা। পাঁচিল টপকে টপকে সব পালায়। প্রতিবছর অর্ধেক ছেলে ফেল করছে, সবাই প্রোমোশন পেয়ে যাচ্ছে। এখানে আমার দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অরুকে যখন ভরতি করেছি ওর মাথাটা কাঁচা ছিল, একদম। অমুদের স্কুলটা দূরেও বটে, কড়াও বটে। মেজদা একটু ধরাধরি করলে হয়ে যেত কারণ দীপ্ত, অমু দুজনেই ওই স্কুলের ভালো ছাত্র। কিন্তু মেজদা বা বড়দা কেউই সেটা করেনি। বড়দার স্কুল কলকাতায়। সেখানে ভরতি করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু আমি আশা করেছিলাম, মেজদা না হোক বড়দা অমুদের স্কুলে অরুকে ভর্তি করবার চেষ্টা করবে। কিন্তু করল না। বড়দাও না। আমি এখন বুঝি বড়দা খুব ভালো, কিন্তু মাস্টারমশাই হিসেবে ও ভালো ছেলেদের জন্যে যতটা দরদ অনুভব করে, সাধারণ ছেলেদের জন্য ততটা নয়। তা ছাড়া আমার সন্দেহ হয় অরুর বাবার নামটা ওরা সবার কাছে বার করতে চায় না। অরুকে পড়িয়ে শুনিয়ে অবশ্য বড়দা-বউদিও তারপর তৈরি করেছে। স্কুলের সায়েন্স টিচারের কোচিংয়ে দিলে তিনি ওকে ঠিকঠাক নম্বর দেবেন না তাই দেওয়া। এত কথা ডাক্তারকে বলা যায় না। বলার মানেই বা কি? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ডক্টর চন্দ্র বললেন, প্রাসঙ্গিকতা না থাকলে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতাম না। মাই পেশেন্ট ইজ ভেরি মাচ হার্ট।