দিন দশেক পরে প্রতাপদা এলেন। মেজদার সঙ্গে কি চুপিচুপি কথাবার্তা হল, তারপরেই শুনলাম আমাদের সবাইকেই, অর্থাৎ বড়োদের সবাইকে উনি ডাকছেন। আমি, মা, বড়দা, বড়োবউদি সবাই গেলাম। সব চুপচাপ। প্রতাপদা সিগারেট খাচ্ছিলেন, মাকে দেখে সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন।
কী ব্যাপার? কিছু পেলে? বড়দা বললেন।
রহস্যময় হাসি হেসে প্রতাপদা বললেন, পেলাম আবার পেলামও না।
খুলেই বলো না! মেজদা মাথা ঝুঁকিয়ে বসেছে।
প্রতাপদা বললেন, অমিতাংশু আদৌ কারো ডাকে সাড়া দিয়ে যায়নি, এমনি এমনিই চলে গিয়েছিল। ওসব দাড়ি-অলা গেরুয়াধারী ওর কপোলকল্পনা। মিথ্যে কথা।
মেজদা গরম হয়ে বলল, অমু মিথ্যে কথা বলছে?
বড়োবউদি বলল, তাতে ওর লাভ?
সেটাই তো ধরতে পারছি না। প্রথমে ওর বর্ণনা থেকে মনে হয়েছিল লোকটা ছদ্মবেশ পরে আছে। দাড়ি চুল সব নকল। সেটা মাথায় রেখেই অমু যেখানে গেছে বলে বর্ণনা দিয়েছে, সেখানে সেখানে খোঁজ করেছি। অমুর খোঁজ পেয়েছি অথচ লোকটার কথা কেউ বলতে পারছে না। অমুর যাত্রাপথটা আমি মোটামুটি ট্রেস করতে পেয়েছি।
পেরেছ?
পেরেছি। কিন্তু সেটা লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে। ওর বর্ণনামতো এগোতে গিয়ে দেখলাম ও মিথ্যে কথা বলছে।
উত্তেজিত হয়ো না অসিত, একটু হেসে প্রতাপদা বললেন, ছেলে তোমার একা একা কোথাও এখনও যায়নি বিশেষ কিছুই জানে না, চেনে না। বড়ো নদী, কলকারখানা এইসব অস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে ও আমাদের বোঝাতে চেয়েছে ও গঙ্গার পশ্চিম পাড় ধরে এগিয়েছে মোটামুটি। শেষকালে পৌঁছেছে জয়নগর। অথচ জয়নগরের পথ আদৌ গঙ্গার ধার দিয়ে নয়। আর সেখানে মেছুয়াপাড়া বলেও কিছু নেই। আমি যদ্র ধরতে পেরেছি, ও ঘুসুড়ি, বালি, উত্তরপাড়া হয়ে হুগলির দিকে চলে যায়। ব্যান্ডেল পর্যন্ত ও গিয়েছিল, কখনও বাসে, কখনও পায়ে হেঁটে। এখন বলো ওদিকে তোমাদের কোনও আত্মীয় বা অমিতের কোনও চেনাশোনা আছে? কিংবা জয়নগরে? যার কাছে ওর যাওয়ার ইচ্ছে থাকতে পারে!
আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। কেউ নেই। আমাদের চেনা কেউ নেই। না ব্যান্ডেলের দিকে, না জয়নগর। অমুর চেনা কেউ আছে কি না কি করে জানব? এতদিন ধারণা ছিল অমুকে আমরা চিনি, অমুর চেলাদেরও চিনি। এখন মনে হচ্ছে অমুকেও পুরো চিনি না, সেক্ষেত্রে ওর চেনা অথচ আমাদের অজানা লোক থাকতেই পারে। প্রতাপদা এবার খাটো গলায় বললেন, রাগ করবেন না, কোনও লভ অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ার!
পাগল হয়েছো? অমু করবে প্রেম? মেয়ে দেখলে এখনও শিঁটোয়!
ওইরকম ছেলেরাই বেশি প্রেমে-ট্রেমে পড়ে, অসিত।
বড়োবউদি বলল, না, না, ওসব নয়। হলে আমি জানতে পারতুম।
পরীক্ষা দিচ্ছিল না? প্রতাপদা জিজ্ঞেস করলেন, পরীক্ষা কি রকম হয়েছে? কবে রেজাল্ট?
বড়দা বলল, খুব ভালো হয়েছে। জয়েন্টে চান্স পাওয়া তো কারো হাতে নয়, তবে উচ্চমাধ্যমিক খুবই ভালো হয়েছে।
বড়োবউদি বলল, রেজাল্ট বেরোতে এখনও অনেক দেরি।
হু, প্রতাপদা গম্ভীর হয়ে গেলেন। বাড়িতে কোনো ঝগড়া বিবাদ, ছেলেপুলেদের পক্ষে ট্রমাটিক কিছু! সঙ্কোচ করলে চলবে না।
মেজদা বলে উঠল, প্রশ্নই ওঠে না। এ বাড়ি পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে ভদ্র বাড়ি। কোনও ঝগড়া-ঝাঁটি এখানে কখনো হয় না।
কথাটা সত্যি। আশেপাশের বাড়িতে যখন তখন ধুন্ধুমার ঝগড়া, বাসন ফেলাফেলি, কান্নাকাটির আওয়াজ পাই। আমাদের বাড়িতে ওসব নেই। কিন্তু আওয়াজ নেই বলে যে বিবাদও নেই, কথাটা সত্যি না। মহুল বলে, পিসিমণি আমাদের বাড়ি ঠান্ডা লড়াইয়ের বাড়ি, কি বলো? ঠিক কথা। এটা বরাবর ছিল। আমার বাবা যখন বেঁচে ছিলেন তখনও। বাবা বড়দাকে পছন্দ করতেন, ভালোবাসতেন বেশি। বড়োবউদির ওপরও তাঁর ভরসা ছিল বেশি। বিনা কারণে হয়নি ব্যাপারটা, বড়দা যেমন নির্মলচিত্ত, স্নেহপ্রবণ, বড়োবউদিও তেমন কর্মঠ আপন পর জ্ঞানশূন্য ছিল। সে সময়ে আমাদের পয়সার টানাটানি চলেছে, মেজদার চাকরি হয়নি, ছোড়দা ভুগছে, তখন বড়োবউদি ঘরে বাইরে যে পরিশ্রম করেছে। ভাবলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। এমনিতে ওর সকালবেলায় স্কুল। দুপুরেও একটা পার্ট-টাইম নিল। বাড়ি ফিরে তিনটে থেকে টুইশনি। সপ্তাহে তিন চার দিন। কোন ভোরবেলা উঠে রান্না সারছে, আমি বাপের বাড়ি থাকলে হয়তো জোগান দিচ্ছি। মা পুজো না করে নিচে নামবে না। বাবারও তখন অনেক ফরমাস ছিল। সেসব মা সামাল দিত। দু-হাতে সব কাজ সেরে, গোছগাছ করে বউদি ঝড়ের বেগে স্কুলে চলে যেত। ফিরে স্নান-খাওয়া করে আবার। সে সময়টা পাপুল হয়নি। বাবা-মা সব সময়ে বাইরে কিংবা কাজে ব্যস্ত। দীপ্ত আর মহুয়া যে কী করে মানুষ হয়েছে! যাই হোক। মায়ের ঝোঁক কিন্তু বরাবর মেজদার দিকে। ছোটোকে মা খানিকটা সমীহ করত। মেজো বরাবর রাগী, জেদি, মা তার রাগকে তেজ, জেদকে দৃঢ়তা বলে প্রশ্রয় দিয়ে গেছে। বাড়ির মধ্যে এই দুই–দুই চিরকাল অশান্তি জাগিয়ে রেখেছে। ধিকি ধিকি আগুনের মতো। বড়োবউদির মার ওপর গভীর অভিমান। বড়দাও বাবা চলে গিয়ে যেন সংসারের মধ্যে খুঁটিহীন একলাটি পড়ে গেছে। মেজবৌ শীলা কোনোদিন বড়োবউদিকে দেখতে পারে না। ওর জ্বালাটা আমি বুঝি। বড়োলোকের মেয়ে, বড়ো চাকরের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, কিন্তু একেবারে গো মুখ। সংসারে বড়োবউদির এই প্রতিষ্ঠা, বাইরে তার মানসম্মান এ জিনিস ও এখনও সইতে পারেনি। মানতে শেখেনি। অথচ বড়ো ওকে আপন বোনের মতো স্নেহ করত। স্পষ্টাস্পষ্টি দোষ ধরতে না পারলে জ্বালাটা বোধহয় আরও তীব্র হয়। আমি জানি মেজোবউদি তার জ্বালার অনেকটাই মেজদার মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছে। মেজদা আগে থেকেই বড়দার ওপর খাপ্পা ছিল, এখন তাকে একেবারে দেখতে পারে না। বড়োবউদিকে বলে মাস্টারনি। বাড়িতে কেউ খেতে এলে, জোর করে মেজোবউদিকে দিয়ে একটা পদ রাঁধায়। অতিথিকে খাওয়ার সময়ে জিজ্ঞেস করে, কোন কোন রান্নাটা ভালো হয়েছে? যদি কেউ এখনও মেজোবউদিরটা ভালো বলে তো কুট চোখে চারদিকে তাকায়, বিশ্রী হাসে। শুধু বড়োবউদি নয়, মহুয়া পাপুল পর্যন্ত এ জিনিসগুলো ধরতে পারে। পারে না খালি আমার মা। বলে, হ্যাঁ, শৌখিন রান্নায় মেজোবউমার হাত ভালো। ব্যাপারঠালা কাজ নয়তো?