ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার এসব হওয়া মেজদার কপালে হয়ে উঠল না, সে নেহাত কপালেরই দোষ। ফিজিক্সে অত ভালো মাস্টার ডিগ্রি করে মার্চেন্ট অফিসে চাকরি করছে। আসলে বাবার পয়সার জোর ছিল না, মেজদার তাই পয়সার জন্য রোখ চেপে গিয়েছিল। দুঃখের কথা কি বলব আমাকে বাবা নিজে মাস্টারমশাই হয়ে গ্র্যাজুয়েট হবার সুযোগ দিলেন না, ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তার ফলভোগ আমি করছি, তাঁর সৌভাগ্য তাঁকে এ জিনিস দেখে যেতে হয়নি। আমার ছোড়দা যেটি ছিল, সে তো ক্ষণজন্মা। যা শুনত, অবিকল মনে রেখে দিত। ক্ষণজন্মারা থাকে না, ছোড়দাও থাকেনি। অমুর ওপর ওর বাবা মায়ের, আমাদের সবার অনেক আশা। দীপ্ত ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, হোক। অমু আমাদের ডাক্তার হবে। আমার দাদামশাই ছিলেন ধন্বন্তরী কবিরাজ। সেই ঐতিহ্য যদি অমুর মধ্যে বর্তায় আমরা খুশি হই। মেজদার অবশ্য বরাবরের ইচ্ছে অমু দীপ্তর মতো ইলেকট্রনিক্স-এর দিকেই যাক। দীপ্ততর ইঞ্জিনিয়ার হোক। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা অমুর খুবই ভালো হয়েছে। পাঁচ ছটা লেটার বাঁধা। অঙ্কর দুটো পেপারেই পুরো নম্বর। প্রশ্নপত্র পরীক্ষা করে মেজদা তো খুবই প্রসন্ন মনে হল। মা তারকেশ্বরের কাছে মানত করেছে আমি জানি। বিকেলের দিকে কোন ছেলে আর বাড়ি থাকে। অমুও বেরিয়েছিল। কোথায় আর যাবে? পাড়ার ক্লাবে, কিংবা কোনও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারতে। রাত বাড়ল অমু ফিরল না। এখানে ওখানে ফোন, খবরাখবর। কেউ কিছু বলতে পারল না। বাড়ির সামনে একটা দর্জির দোকান। তার মালিক চৈতন্য বলল, আরে অমুদাদা তো সন্তুদা আর মিন্টুর সঙ্গে রকে বসে বসে গল্প করছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি কেউ নেই।
সন্তু আর মিন্টুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। ওরা দুজনেই কিছুক্ষণ অমুর সঙ্গে গল্প করেছে তারপর প্রথমে মিন্টু পরে সন্তু চলে গেছে। সন্তু যখন গেছে তখনও অমু নাকি আমাদেরই রকে বসে।
অগত্যা পুলিশে ডায়েরি। কাগজে ছবি ছাপা, টিভিতে প্রচার। কিন্তু তিন দিন তো হয়েই গেল। মেজোবউদি শয্যা নিয়েছে। বাড়িসুষ্ঠু সবাই হানটান করছে। মেজদা নাম কা ওয়াস্তে অফিস যাচ্ছে। বড়দা দেখছি সারাক্ষণ গালে হাত, ভেতরের দালানের বেঞ্চিটাতে বসে। চোখ বসে গেছে, গালে বাসি দাড়ি। কদিনেই বড়দার টকটকে রঙে একটা ময়লা ছোপ পড়েছে। শুধু অমু বাড়ির ছেলে, সবার প্রিয় বলেই নয়। এই সেদিন পর্যন্ত ও দাদা-বউদির কাছেই পড়াশোনা করত। মাত্র মাধ্যমিকের আগের বছরেই মেজদা ওর আলাদা বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা টিউটর রেখে দিল।
চতুর্থ দিন ভোরবেলা নিচে একটা হাউমাউ হই-হই মতো গোলমাল শুনে তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি সদর দরজা খুলে বড়বউদি চেঁচামেচি করছে, দরজার সামনে অমু। চেঁচামেচিতে সবাই-ই তখন নেমে এসেছে। নিচের উঠোনে সব জড়ো হয়ে গেল দেখতে দেখতে। অমুর চেহারা এই তিন দিনেই হয়েছে কাঙালির মতো। চুল মাটিমাখা, পরনের জামাকাপড় ঝুল-ময়লা, কেমন উদভ্রান্তের মতো চাউনি। মেজোবউদি তখন খুব কাঁদছে আর বলছে, কোথায় ছিলি? কোথা থেকে এলি? শিগগিরই বল, বল, বল।
অমু দাড়িতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলল, আমার কোনো দোষ নেই। আমাকে একটা লোক ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।
—বলিস কি রে? মেজদা এগিয়ে এসে বলল।
বড়দা বলল, তোমরা জায়গাটা একটু ফাঁকা করো। ওকে আগে খাওয়া-দাওয়া করতে দাও।
সত্যিই অমু যেন টলছিল।
স্নান, খাওয়া-দাওয়া এবং লম্বা ঘুমের পর অমু যা বলল তা বড়ো অদ্ভুত। বিংশ শতাব্দীর শেষ হয়ে এসেছে। জলজ্যান্ত একটা শহরের বুকের ওপর এরকম ঘটনা ঘটতে পারে যেন বিশ্বাস হতে চায় না। পাপুল বলল, দ্যাখো দ্যাখো পিসিমণি আমার কেমন গা শিউরোচ্ছে!
অমুর গল্পটি এইরকম। ও মিন্টু আর সন্তু আমাদের বাড়ির রকে বসে গল্প করছিল, সন্তু অমু দুজনেই এইচ এস দিয়েছে। মিন্টু পরের বছর দেবে। ওদের খুব ভাব। মিন্টু আগে চলে যায়, তারপর সন্তু বলে, চল ক্লাবে যাই। অমু রাজি হয়নি। এমনিই রকে বসেছিল, ভাবছিল এখুনি ভেতরে ঢুকবে। তখন মোটামুটি সন্ধের ছায়া পড়ে গেছে। এমন সময় পেশকার লেনের ভেতর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে অমুকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। লোকটার পরনে গেরুয়া জোববা। মুখে বেশ লম্বা দাড়ি, চুলগুলো বাবরিমতো, কাঁচা পাকা, হাতে একটা গেরুয়া রঙের থলি ছিল।
মেজদা বলল, ডাকল, অমনি তুই চলে গেলি?
অমু বলল, আমি ভেবেছিলুম, ও আমাকে কোনো ঠিকানা-টিকানা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু ও আমাকে দেখেই হাতছানি মতো একটা ইশারা করে চলতে লাগল।
তুইও অমনি চলতে লাগলি?
হ্যাঁ। কিন্তু কেন আমি জানি না। লোকটা অলিগলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলেছে আমিও পেছন পেছন চলছি। মাঝে মাঝে খেয়াল হচ্ছে আমার ডানপাশে একটু বড়ো নদী, কলকারখানা চিমনি, এইভাবে আমি চলেছি। তারপরে কি হয়েছে জানি না। হঠাৎ যেন আমার খেয়াল হল আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছি। একটা লোক আমাকে নিয়ে চলেছে, তখন আমি খুব চেঁচিয়ে উঠি, লোক জড়ো হয়ে যায়। জায়গাটা একটা আধাশহর মতো। দেখি গেরুয়া-পরা লোকটা নেই। ওই লোকগুলোই বলল—জায়গাটার নাম জয়নগর, মেছুয়াপাড়া। ওরাই আমাকে পয়সা দিয়ে বাসে তুলে দিল। তারপর এই এসে পৌঁছচ্ছি।