সত্যেন একটু চমকাল, তারপর স্থির চোখে চেয়ে বলল, বলতেই পারেন।
আপনি প্রতিবাদ করবেন না? আপনার স্বপক্ষে প্রমাণ-ট্রমান…
লাভ?
দূর মশাই। আই, বি-র অফিসারটি হঠাৎ খোলা গলায় হেসে উঠলেন, আমি আপনার সঙ্গে রসিকতা করছিলাম, স্যরি। ওই প্রথম থিয়োরিটাই ঠিক। মেয়েটি দৈবাৎ আপনার গাড়িতে আসে। জাস্ট আ লিফট! মিসেস চ্যাটার্জি প্লিজ একটু চা বা কফি…গলা শুকিয়ে গেছে।
ভারী পায়ে মণিমালা চলে গেল। যেন নিজেকে টেনে টেনে।
তখন অফিসার পকেট থেকে একটা খাম বার করলেন। তবে ভেতরে একটি মাত্র ফটো। কোয়াটার সাইজ। সত্যেন, পেছনে লেখা—সত্যেন মাই লভ, মাই লাইফ। চকিতে ফটোটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেললেন অফিসার।
এ ফটো আপনি ওকে দিয়েছিলেন?
নো, নেভার।
কোনো গ্রুপ ফটো থেকে আলাদা করে স্ক্যান করে ছবিটা বানিয়েছে ও। স্টুডিয়োর নাম রয়েছে। আমরা এনকয়ারি করে তাই জেনেছি। অ্যাকচুয়ালি এই ফটোটাই আপনাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে মি. চ্যাটার্জি। আপনি গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, রুদ্রপলাশ রিসর্ট। ও ছুটতে ছুটতে এসে বলল, মি. চ্যাটার্জি না? আপনি কি কলকাতা ফিরছেন? আমাকে প্লিজ একটা লিফট দিন। আমি ট্রেন মিস করেছি অর হোয়াটেভার…এই ডায়ালগটা স্পষ্ট মনে কষতে পেরেছে রুদ্রপলাশ-এর এক কর্মী, ছবিটা ও-ই পায়, তাড়াতাড়িতে মেয়েটার ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ডু য়ু সি? এই নষ্ট মেয়েটা সামহাউ আপনাকে ভালোবেসেছিল। ছায়ার মতো অনুসরণ করত, যদি কখনও সুযোগ আসে…যদি কখনও…। সেই সুযোগই ও পেয়ে গেল রুদ্রপলাশ-এ। তো এই হচ্ছে ব্যাপার। টোট্যালি নষ্ট, বার্ট ডেডলি সিরিয়াস ইন লভ। স্ট্রেঞ্জ!
এখন এখানে কেউ নেই, কিছু নেই, অনর্থক ভিড়, আলো অথবা অন্ধকার। মাথাটা ঘোর, অথচ পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে এখন। সত্যেন। স্ট্রেঞ্জ! স্ট্রেঞ্জ! কফি আর স্ন্যাকস-এর ট্রে নিয়ে মণিমালা ঢুকে আসছে। না অফিসার—সে থেমে থেমে পরিষ্কার উচ্চারণ করল-ব্যাপারটা এই নয়। ব্যাপারটা হল আমাদের একটা অ্যাফেয়ার চলছিল। আমার কাছে ওটা ফান জাস্ট একটা ফান।…বাট…অ্যাজ য়ু সে… শি ওয়াজ ডেডলি সিরিয়াস। সো…ইউ সি…আই কিলড হার। ওর মৃত্যুর দায় আমার।
হারান-প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ
মেজদার ছেলে অমুর ছবিটা টিভি-তে এলো মঙ্গলবার। মেজোবউদি খাটের ওপর উপুড় হয়ে পড়েছিল। মেজদা কৌচে বসে। আমি ঘটনাচক্রে ওঘরে ছিলাম সে সময়টা। চেঁচিয়ে ডাকলাম বড়দাকে। বড়দা-বড়বউদি মহুল পাপুল চারজনেই ছুটে এল। দীপ্ত এখন নেই, নইলে সেও আসত। আমার ছেলে অরু এ সময়টা কোচিং এ যায়। মাকে আমি ডাকিনি, মা নিশ্চয়ই ছাদের ঠাকুরঘরে। কিন্তু কীভাবে আমার ডাকের শব্দ ও অর্থ দুই-ই মায়ের কানে পৌঁছে গেল জানি না, মা-ও দেখলাম তাড়াতাড়ি এসে ঢুকছে। তখন ঘোষণা শেষ হয়ে এসেছে। অমুর একটু। গম্ভীরগোছের, ছেলেমানুষি, আঠারো বছরের মুখখানা সেকেন্ড কয়েক টিভির পর্দায় থমকে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেজোবউদির ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। মা বলল, মেজোবউমা, ওরকম অধীর হয়ো না। ওতে অকল্যাণ হয়!
বড়োবউদি বলল, আমরা তো সবাই আছি শীলা, মাথা ঠান্ডা রাখাটাই এখন আসল।
বড়দার একটা নিঃশ্বাসের শব্দ মনে হল শুনলাম। মা বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন মহুল পাপুল। বড়দা একটু দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন বলবে বলবে করে চলে গেল। বড়োবউদিও। মেজদা সিগারেট পাকাতে পাকাতে সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল, হুঃ।
অমুর ছবিটা ভালো আসেনি। মুখের বাঁ-দিকটা আবছা। ডান দিকটা অবশ্য চোখ, ভুরু, ওর খাড়া খাড়া কান, চুলের ঢেউ, ছোট্ট পাতলা মেয়েলি ঠোঁট সবসুন্ধু নিয়ে মোটামুটি স্পষ্টই। এই ছবি দেখে আধা-পরিচিত লোক হলে হয়তো চেহারাটা দেখে চিনতে পারবে কিন্তু একেবারে অচেনা লোকের পক্ষে কতখানি চেনা সম্ভব বলা মুশকিল। আমার মনে হল এই একই ধরনের কিশোর মুখ আমি অনেক দেখেছি। অরুর মুখ, দীপ্তর মুখও মূলত একই ধাঁচের। রাস্তায় বেরোলেই এরকম পাতলা ছাঁচের সরল গম্ভীর চোখ-অলা, নরম চুল, নরম নতুন গোঁফদাড়ির কিশোর যেন অনেক দেখা যায়। মেজদাকে কথাটা বলতে গিয়েও বললাম না। কে যেন আমার বুকের ভেতর বসে নিষেধ করে দিল বলতে। সত্যিই, কথাবার্তা আমাকে অনেক বুঝে-সুজে কইতে হয়। অরুর বাবা যাবার পর আমার মুখে কুলুপ পড়েছে। কানে শুনি অনেক বেশি, চোখেও দেখি বেশি। কিন্তু অত সব দেখলে শুনলে আমার চলবে না এটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে! অরুর বাবার রেখে যাওয়া টাকার সুদে ওর লেখাপড়াটা হয়, খাই-খরচ বাবদ সামান্য কিছু দিতে পারি, কিন্তু মোটের ওপর তো আমি দাদাদের ওপর নির্ভর করেই আছি! মা আছে, এটাই মস্ত ভরসা।
তিন দিন হল অমু নিরুদ্দেশ। উচ্চমাধ্যমিকটা হতে না হতেই অমুটা জয়েন্টে বসল। আই আই টি-র এনট্রান্সটা কিছুতেই দিল না। এজন্য ওর মা ওর পায়ে মাথাটা কুটতে শুধু বাকি রেখেছে। বড়দা বতোবউদি দুজনে মিলে দীপ্তকে তো তৈরি করেছে ভালো। হাজার হোক দুজনেই মাস্টার। দীপ্তর বেরোতে আর বছর দুয়েক। ওর বাবা-মা মুখে রক্ত তুলে টাকার জোগাড় করছে। বেরোলে আর ভাবনা নেই। মেজদাই বলে, আমি আর জানব কোত্থেকে, ওর বাঁধা চাকরি, চাইকি এক্ষুণি বিদেশি স্কলারশিপ। এই পরিস্থিতিতে মেজোবউদির রোখ চেপে যাওয়া স্বাভাবিক। বংশের একটা ধারা আছে তো! ঠাকুর্দা ছিলেন পি আর এস পি এইচ ডি। বাবা হেডমাস্টার, লোকে বলত স্বয়ং নেসফীল্ডও বাবার কাছে গ্রামার শিখে যেতে পারতেন। আমার বড়দাকে ঠিক দেবদূতের মতো দেখতে। স্বভাবেও তাই। অত সরল হাসি, নম্র স্বভাব, বৈষয়িক নির্লিপ্ততা যেন ঠিক এ যুগে, এ সমাজে খাপ খায় না। বড়দাও ঠিক বাবার মতো গ্রামার-পাগল, ডিকশনারি-পাগল। তবে, বাবার যতটা সাফল্য আমরা দেখেছি, বড়দার তার কিছুই নেই। দায়িত্ব নিতে ভয় পায়, সাধারণ শিক্ষক হরেই জীবন কাটিয়ে দিল।