…ইশশ কী বলছে শুনেছ…গোধরা হলে গুজরাতও হবে। এদের হাতে আমরা রাজদণ্ড দিয়েছি।…সত্যেন হরিবল…চা বাগান দেখাচ্ছে… এ লোকগুলো স্রেফ না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে! অনাহার না অসুখ এই নিয়ে তদন্ত কমিটি… সত্যেন এর পরেও আমরা দ্বিতীয় গাড়ি কিনি। আমাদের ছেলে নিজস্ব সেলফোনের বায়না ধরে!
কী অদ্ভুত কো-ইনসিডেন্স সত্যেন, তুমিও ওই দু-দিন ওখানেই ছিলে। দ্যাখোনি ওকে?
না।
আশ্চর্য তো!
আশ্চর্যের কী আছে? গিয়েছিলাম পার্টির সঙ্গে ডিপ্লোম্যাটিক মারপ্যাঁচ কষতে। গেস্ট হাউজে কে এল, কে এল না নজর রাখতে নয়। ঘর থেকে বেরোইনি পর্যন্ত। তার ওপর গ গাড়ির ভাবনাটা…
কিন্তু… কিন্তু পুলিশ যদি দুটোকে যোগ করে? যদি বলে…। মণিমালার চোখ। দুটো বড়ো বড়ো হয়ে যাচ্ছে।
বালিশের ওপর মুখ উপুড়, সত্যেন থরথর করে কাঁপছে। পুলিশ যোগ করবে কি না জানা নেই। কিন্তু মণি, মণিমালা যোগ করছে।
ফান, ওনলি ফান, বিশ্বাস করো মনি, লিজ গ্লো আমার কেউ না। আমিও তার কেউ না। খেলার সঙ্গী, বাস। আমি লোকলজ্জা থেকে বাঁচতে, আমার সংসার বাঁচাতে নিজের পায়ের ছাপ মুছে মুছে এসেছি। আসতে কি পারতাম, যদি তিনি আমাকে না বাঁচাতেন? কী হত, যদি আমি ওইরকম অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে না যেতাম। দুঃসংবাদ তোমাদের কাছে পৌঁছত, সঙ্গে নিহত একটি মেয়ের নাম জড়িয়ে থাকত, উভয়ের পরিচয় বার হত, তার পর সবাই সব বুঝত, তুমি বুঝে যেতে। তিনি বাঁচালেন বলেই আমি বাঁচবার জন্যে আর যা-যা করার করলাম। নইলে কী? মৃত্যু, তার চেয়েও বেশি দুশ্চরিত্র দুর্নাম, তার চেয়েও বেশি নিকটতম মানুষটির কাছে বিশ্বাসঘাতক…কিন্তু আমাকে সেসব দেখতে শুনতে ভোগ করতে হত না।
ফোন।
আমি মিসেস চ্যাটার্জি বলছি।—মণিমালা ধরেছে।
উনি ক-দিন অসুস্থ, ছুটিতে আছেন, ঘুমোচ্ছেন।
সামান্য কতকগুলো রুটিন এনকোয়ারি ম্যাডাম, হ্যাঁ ওই মেয়েটি সম্পর্ক, বেশি বিরক্ত করব না আসছি।
সত্যেন ঘুমোয়নি। সে কখনও পুরোপুরি ঘুমোয় না। ঘোরে থাকে।
শুনছ। দ্বিধাগ্রস্ত কন্দ্র স্বর মণিমালার-লালবাজার থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসছে।
আসুক।
তুমি একটু রেডি হয়ে নাও।
ঠিকই তো আছি।
চুলে একটু চিরুনি, কেমন বিধবস্ত লাগছে।
দু হাত মাথার মধ্যে চালিয়ে নিল সত্যেন—ঠিক আছে। ঠিকই…
ঘরটি অবাস্তব। যেমন স্বপ্নে দেখা যায়। অচেনা, আধোচেনা বস্তু সব। ওগুলোর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ কেউ ভেতর থেকে বলে যাচ্ছে—আছে, আছে।
স্টেডি, আপনি টলে যাচ্ছেন…।
ওঁর প্রেশার ভীষণ নেমে গেছে তো! ঘুমোচ্ছিলেন।
স্যরি টু ডিসটার্ব য়ু। জাস্ট কয়েকটা প্রশ্ন। মিসেস চ্যাটার্জি আপনি যেতে পারেন।
সত্যেন হাত বাড়িয়ে মণিমালার হাত ধরল, বলল—উনি থাকবেন।
অ্যাজ য়ু প্লিজ…আচ্ছা মি. চ্যাটার্জি আপনি মেয়েটিকে কতদিন চিনতেন?
অনেক দিন। তা বছর পাঁচ-ছয় তো বটেই!
কী সুত্রে চেনা, বলবেন?
সতর্ক গলা। সত্যেন বলল, বিদেশ থেকে ক্লায়েন্ট এলে আমাদের কাছ থেকে লোকাল কোনো পি. এ. চান। এই মেয়েটি সে রকম ফ্রি-লানস পি. এ. ছিল।
কতবার এভাবে ও আপনাদের কাজ করেছে?
একটু ভাবতে দিন…হ্যাঁ, চার-পাঁচবার হবে!
আপনি শিওর যে ও শুধু পি. এ.-র কাজই করত!
হঠাৎ মণিমালা বলে উঠল, আপনি ও করত বলছেন কেন? উনি করতেন বলতে কী অসুবিধে! একজন মহিলা তো!
সামান্য, খুব সামান্য একটু ব্যঙ্গের হাসি ভদ্রলোকের মুখে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।—মি. চ্যাটার্জি, আপনি আমার কথার উত্তর দিন।
দেখুন, আমার কাজ হল কোম্পানির তরফ থেকে অ্যাভেলেবল কোনো পি. এ. পাঠানো। তারপর আমি কী বলতে পারি!
পারেন, কিন্তু বলবেন না। এই ভ্রাম্যমান ক্লায়েন্টদের সবরকম চাহিদার দিকে আপনাদের লক্ষ রাখতে হয়, হয় না?
সত্যেন চুপ করে রইল।
এতবার আপনি মেয়েটিকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন, অথচ তাকে দু-দুটো জায়গায় দেখেও চিনতে পারলেন না?
দেখুন, ফার্স্ট থিং অ্যাপয়েন্ট করা আমাদের কাজ না। ওটা সাবর্ডিনেটরাই করে দিতে পারেন। তবে পার্টির সঙ্গে কথাবার্তার সময়ে মেয়েটি যখন পি. এ. হিসেবে উপস্থিত থেকেছে, নিশ্চয়ই দেখেছি। তবে ওসব জায়গায় আমি গেছি জরুরি কাজে। নিশ্চয় খেয়াল করিনি।
মেয়েটি কলকাতায় ফিরতে আপনার ও আপনার ইন্ডিকার সাহায্য নেয়নি বলছেন! মি, চ্যাটার্জি আপনার চুরি যাওয়া গাড়িটা নীল ইন্ডিকা, সেকেন্ড জানুয়ারি দুর্ঘটনার গাড়িটাও নীলই ছিল, সম্ভবত ইন্ডিকাও। শান্তিনিকেতনেও আপনাকে ওই গাড়িতে দেখা গেছে। আপনার গাড়ি চুরির গল্পটা স্যরি, বানানো। এখন যদি বলি মহিলাটি আপনার সঙ্গেই ফিরছিলেন পথে মারত্মক দুর্ঘটনা ঘটে, আপনি সামহাউ বেঁচে যান। তারপর এর কী ব্যাখ্যা হতে পারে ভেবে সমস্তটাই চেপে গেছেন।
বলুন!
যদি বলি মেয়েটি কাকতালীয়ভাবে আপনার সঙ্গে ফিরছিলেন না, এঁর সঙ্গে আপনি অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন, ফেরবার পথে দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা!
বলতেই পারেন।
আপনি এর প্রতিবাদ করবেন না? বিপক্ষে প্রমাণ দেখাতে চেষ্টা করবেন না?
লাভ?
যদি বলি, ওটা একটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, সুপরিকল্পিত মার্ডার! আপনি ক্রমশই মেয়েটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিলেন, ছাড়া পেতে চাইছিলেন, পারিবারিক শান্তি মানসম্মান বিপন্ন হবার ভয় পাচ্ছিলেন, সুযোগ খুঁজছিলেন, গাঁ গাঁ করে লরিটাকে ছুটে আসতে দেখে আপনি ওস্তাদ ড্রাইভার নিজের দিকে দরজা খুলে লাফ মারেন। গাড়িটা আপনার অস্বস্তি, আপনার লজ্জা সমেত গুড়িয়ে যায়!