মেজোমণি হেসে বলে, আচ্ছা সে আমি দেখছিখন। মেজোমণি দেখছি বলল তো হিল্লে হয়ে গেল। আর ভাবনা নেই, চিন্তা নেই। এখন যে যার ঘরে বসে শিবের মাথায় বিশ্ব-চন্দনই দাও, কি কাঁথাই সিলোও, তাসই পেটো কি বিদ্যের জাহাজ ভাসিয়ে তক্কাতক্কিই করো। যা করো বাপু নিশ্চিন্দে করো গে। মেজোমণি বলে দিয়েছে, সে আমি দেখছিখন।
বড়োবাড়ির এই হল গিয়ে বৃত্তান্ত। ননদিনিরা আসেন, যান। শহর-বাজারের মস্ত মস্ত সব জামাই। গো-গাড়ি, সাইকেল রিকশা, কি জগঝম্প মটর গাড়ির ভেঁপু বাজাতে বাজাতে এসে পড়েন। তখন বড়োবাড়িতে যেন রসুনচৌকি বসে। জামাই শালা ভাজ ননদাই নিয়ে সে বড়ো আদিখ্যেতার রোশনাই। বড়োবউয়ের ঘরে বসে হাত পা ছড়িয়ে গালগল্প করতে করতে বড়ো ননদ বলেন, পানে বেশ করে কেয়ার খয়ের দিয়ে সেজো গো মেজোবউ। মেজমণি বলে, আচ্ছা!
মেজোননদ বলে, ছেলে দুটো আমার কেন যে অমন খ্যাংরা কাঠির জ্ঞাত গোত্তর বুঝি না ভাই মেজোবউদি।
মেজোমণি বলে, ওষুধ আছে। মেজদি তুমি ঘুম যাও।
মেজদি গিয়ে ছোটোমণির ঘরে এ কেলেচ্ছা ও কেলেচ্ছা করতে করতে ঘুমিয়ে যায়।
সেজোননদ বলে, তোমার ননদাই বলছে কষে জলসা বসাও গিয়ে একদিন গাঁয়ে। গাইয়ে-বাজিয়ে বাজাবার দায় তাঁর, রাখবার দায় তোমার। উনি সারারাত ঠায় তবলায় বসে থাকবেন।
মেজোমণি বলে, বেশ তো।
ছোটো ননদ বলে, পুজোর কাপড়-চোপড়গুলি দেখে শুনে নাও গো বউদিরা। ফুল কাটাটি ছোটো বউর, দাঁত দেওয়া মেট্রোপাড়খানা বড়ো বউর, ছেয়ে-রঙটি নয় মেজো বউদি নিও।
নিজে নিজেই উলটেপালটে দেখে ননদ তেমন সরেস হল না এটি। না-ই হোক। অনেক আছে মেজোর। অনেক, অনেক।
ছেলে-পিলেরা সারাটা দিন মেজোমণির পায়ে বাজছে। মেজোমণি না খাওয়ালে ভাতের পাত শুধু ঠোকরাবে। মেজোমণি রূপকথা না বললে—দুপুর রাত পর্যন্ত চোখ সব টেনে টেনে খুলে রাখবে, বলবে, ঘুম আমাদের পায়নি গো। ঘুম পায় না। এমনি বজ্জাত সব।
ছোটো কত্তার ছেলের মুখে-ভাত হবে। কত্তারা সব মেজোর ঘরে শলা নিতে গেছেন। কোথা থেকে দই আসবে? মেজোমণি বললেন, অনন্ত ঘোষেরটাই ভালো। কোন পুকুরের মাছ উঠবে? মেজোমণি বললেন, কেন? তেলি পুকুরের! থই থই করছে এখন রুই কাতলায়! নেমন্তন্নের লিস্টি মেলাও, গুষ্টি জ্ঞাতিবর্গের কেউ যেন আবার বাদ না যায়। তদারক করো, তদবির করো।
মেজোমণি শশব্যস্তে বলেন, বড়দি, তোমার পুজো হয়েচে তো ভাতের হাঁড়িটা একটু নামিয়ো, নবাই এয়েচে, মাছের কথাটা ঠিকঠাক করে আসি গে।
বড়োমণি চোখ কপালে তুলে বলেন, এই সেদিন যে বুকের ব্যামো ধরা পড়ল রে মেজো, ভুলে গেলি? ওমা! আমি যাব কোথা।
মেজোমণি বলেন, কী সবেনাশ, তাই তো! ছোটো কোথায় গেলি? ছোটোকে ডাকো, নবাই বড্ড ব্যস্ত হচ্ছে।
ছোটো ফিসফিস করে বলে, খোকার আমার ঘুমটা সবে ধরেছে গো মেজদি। চাঁদের কপালে চাঁদ আহা! নইলে তোমার ভাতের হাঁড়ি কেন গোটা হেঁসেলখানাই নামিয়ে দিয়ে আসতুম গিয়ে।
গভীর রাত্তিরে সব ঘুমিয়ে-জুমিয়ে পড়লে মেজোকত্তা আড়ে আড়ে দেখে মেজোমণি গদির তলা থেকে চাবি বার করল, ঘরের কোণে আঁধার বরন সিন্দুকের চাবি ঘোরাল ঝনাৎ করে, সিন্দুকের ভেতর রুমঝুম, টাকায় মোহরে গাঁদি লেগেছে, সব মেজোমণির ইস্ত্রীধন। তা থেকে মেজোমণি সংসারের সার খরচ-খর্চা যেটুকু যা দরকার, অন্নপ্রাশনের মোচ্ছবের টাকা গুনে গেঁথে সব তুলে নিল। মেজোকত্তা পাশ ফিরে নিশ্চিন্দে ঘুম গেল।
এইভাবে বড়োবাড়ির বড়ো সংসার—তার দৈনন্দিন, তার পালপার্বণ, তার মোচ্ছব সব চলে। সেই মেজোমণির আজ সাতাশটা দিন জ্ঞান নেই, ঘোরের মধ্যে পড়ে। চলে?
কী করবে! বড়োকত্তা গোবিন্দ বসাক গদিওয়ালার কাছে কর্জ করে আসেন। মেজো বউ উঠলে পরে শোধা যাবে। মেজোকত্তা গদিটদি হাতড়ে চাবিটাবি কই কিছু পায় না। সিন্দুকের ডালা যেমন ভারী হয়ে বসে থাকে তেমনি। দেয়ালের তাক হাতড়ে আলমারির খোপ হাতড়ে অবিশ্যি টাকাকড়ির পুঁজি মন্দ মেলে না। মেজোকত্তা সেইগুলি দিয়ে বড়োদাদার সঙ্গে শলা করে বড়ো শহর থেকে ভারী ডাক্তার আনায়। গোটা সংসারের মুখ শুকিয়ে এতটুকু। ছেলে-পিলেগুলি সময়ে আহার না পেয়ে খিদেয় কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে, রসুইঘর ছমছম করছে, কোনোমতে দুটি ভাতে-ভাত নামিয়ে বড়োমণি ছোটোমণি এ-ওর মুখে চায়। কী হবে গো? কী হবে? কত্তাদের মুখে খাবার রুচছে না। বড়ো মেজোর তো হুঁশই নেই। এদিকে তিন তিরিক্ষে তেত্রিশ রকম পরীক্ষার পর বড়ো শহরের ভারী ডাক্তার কিনা বড়ো আশায় ছাই দিয়ে জবাব দিয়ে গেল?
তে-তল্লাটে মেজোমণির বাপের বাড়ির কেউ নেই। খবর দেবে কাকে? একটি মাত্তর মেয়েকে টাকার পুঁটুলি সুদ্ধ শ্বশুরঘর সই করে দিয়ে বাপ-মা চোখ বুজে নিশ্চিন্দি হয়েছেন। ননদিনিরা সব আসেন। চোখে আঁচল দিয়ে বড়োর ঘরে, ছোটোর ঘরে থানা দিয়ে বসে থাকেন। যদি কোনো সুখবর হয়। তা বসে থাকাই সার হয়। মন কারুর ভালো নেইকো। মেজোকত্তা একবার বলেছিল শহরের নার্সিংহোমে নিলে কি হয়? বড়োকত্তা জবাব দেন, বড়োবাড়ির ইজ্জতটুকুও তালে বড়ো শহরে রেখে এসো গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে। ছোটোকত্তা জবাব দেয়, তা ছাড়া ঠাঁই নাড়া করতে তো ডাক্তার মানাই করে গেল মেজদা, কান পেতে শোননিকো? মেজোকত্তা কাঁচুমাচু মুখে সরে যায়। আঁদাড়েপাঁদাড়ে ঘোরে, ফকিরদরবেশ, সাধুসন্ত কেউ যদি কিছু সুলুকসন্ধান দিতে পারে। আশা ছাড়তে পারছে কই?