ঘটনাটা যে রোববার ঘটল, তখন দুপুরবেলা। সিরাজুলের অন্দরে বসা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণখানা সে ইতিমধ্যেই যেখানে পেরেছে চাউর করে ফেলেছে। বাড়িটিতে মানুষ তো আর কম নয়! শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে যেটের বাছা এই এতগুলি। সব যে যার তালে। বড়োমণি পুজোর ঘরে। বেরোতেই কোন না একটা দুটো বেজে যাবে। তিরিশ রকম ঠাকুর-দেবতাকে ফুল-জল দেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! বড়ো ভক্তিমানী মানুষটি বড়োমণি। এতটি বেলা পর্যন্ত সুষ্ঠু এক ঘটি চা খেয়ে ঠাকুর দেবতাদের সব জলপান দিচ্ছেন, ছোটোমণি তখন টেবিল ঢাকায় ফুল কাটছেন ফুটফুট। সূচ ঢুকছে, সূচ বেরুচ্ছে, আর কত রঙবেরঙের কারুকাজ—দোপাটি ফুল, বেড়ালছানা, শিবলিঙ্গ জড়িয়ে কালসাপ—সব সিলসিল সিলসিল করতে করতে ঢাকার ওপর আঁকা হয়ে যাচ্ছে। ছোটোবাবু তখন আড্ডাঘরে, তাস পিটছেন, ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে গুলতান খুব জমেছে। ওদিকে বড়োবাবুতে মেজোবাবুতে তক্কো চলেছে। ইনি বলছেন সাংখ্য হলেন গিয়ে আদি সংখ্যার আখ্যান-বাখ্যান, সাংখই সবচেয়ে বড়ো, উনি বলছেন, বেদান্ত হচ্ছেন সব বিদ্যের অন্ত বাপধন! কে বড়ো কে ছোটো এখন আপনি বোঝ।
পেল্লাই ভাতের হাঁড়িখানি নামিয়ে মেজোমণি বললেন, আর একটু সবুর কর সিরাজুলের, বেলাবেলি দুধটুকু জ্বাল দিয়ে নিই। একরাশ কচুর ডাঁটা কাটতে আমার সৈরভীর দুধটুকু জ্বাল দেওয়া হয়নিকো এখনও।
বসতেই তো এয়েছি তোমার ঠেয়ে, সিরাজুলের গাছের আম-জাম কোঁচড়ে নিয়ে অপেক্ষা করে। দুধ জ্বাল দিয়ে, উনুনে রাশ রাশ কয়লা ঢাললেন মেজোমণি। উনুন দুখানা কী! রাই খাই না রাবণ খাই। কয়লা দিয়ে-টিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে দাওয়ায় এসে বসলেন মেজোমণি। মেজোমণিও বসলেন সিরাজুলের মাও নিস্পলকে দেখতে থাকল। দুগগা ঠাকুরের মতো এই টানা টানা চোখ, ভুরু কান ছুঁয়েছে, এই থাক দোয়া দোয়া চুল! এতক্ষণ হাতখোঁপা করে বেঁধে রেখেছিলেন রসুইঘরে ছিলেন বলে, এখন খুলে দিতেই শাঁত করে পিঠময় ছড়িয়ে দাওয়ার ওপর বিলি কাটতে লাগল। কী রাশ! বাববাঃ! ডিবিসি বাঁধের বন্যের মতন।
হাত দিয়ে চুলের গোড়ার কাছটি খেলাতে খেলাতে মেজোমণি বললেন, আম ক-খানি তুই নিয়ে যা দিকিনি। তোর সিরাজুল খাবে। বচ্ছরকার জিনিস। একটি তো মোটে তোর গাছ, তা থেকে বিকোবি, বিলোবি, তবে আর খাবি কি বাছা। চাল তোর থলিতে আমি ভরে দিয়েছি। দেখিস কাগজের ঠোঙায় মুড়ে আলাদা করে একটুখানি কামিনী দিলুম, পায়েস করে মায়ে-পোয়ে খাস।
বেশ গল্প করছিল সিরাজুলের গেজেটবুড়ি, গাঁয়ের গল্প, গঞ্জর গপ্প, টাউন শহর থেকে যা-যা তথ্য-সংবাদ কুড়িয়ে বাড়িয়ে আনতে পেরেছে তা-ও। গল্প করছিল আর ভেবে মরছিল, এই মানুষের আবার অংখার! লোকে দেখেই বা কি আর বলেই বা কি! পাড়া বেড়াবে কি মানুষটা, মরবার সময়টুকু থাকলে তো!
হঠাৎ মেজোমণি কেমন অস্থির হয়ে বললেন, মা, শরীরটা আমার কেমন আনচান করছে, আমি একটুক ঘরে যাই।
যেতে যেতেই মেজোমণি টলতে লাগলেন, সিরাজুলের না ধরলে বোধ করি পড়েই যেতেন। পালঙ্কে কোনোমতে কাত করে দিয়ে সিরাজুলের অন্দরের অন্য দিকে ছুটল, ও বড়োমণি গো, ও ছোটোমণি গো দেখে যাও তোমাদের মেজোমণি কেমন করতেছে। বড়োমণি ঠাকুরঘরে, শুনতে পেল না। ছোটোমণি সিলোতে সিলোতে সুতোটুকু দাঁত দিয়ে কাটছিল, তা দাঁতের সুতো দাঁতেই রয়ে গেল, ছোটোমণি দৌড়ে এসে বললে—মেজদি-ই-ই। আর মেজদি; মেজদি তখন ঘোরে কি বেঘোরে।
বড়োবাবু এল ধমধম করে, মেজোবাবু এল কাছা কোঁচা সামলাতে সামলাতে, ছোটোবাবু এল বাঁটা তাস কটা হাতে ধরে, শেষকালে গুহবদ্যি এল তার চামড়ার থসথসে ব্যাগটি নিয়ে, গলায় ইস্টেথো ঝুলিয়ে। ক্রমে গাঁ গঞ্জের মানুষগুলি আড়ালে-আবডালে উঁকিঝুঁকি মারতে মারতে বড়োবাড়ির পেল্লাই বার-উঠোনে, ভেতরবাড়ির দরদালানে, দোলমঞ্চের ফাটা ফোঁটা থামগুলির আশেপাশে ভেঙে পড়ল। কী হয়েছে গো মেজোমণির? কী হল হঠাৎ মেজোমণির? আগে তো কখনও কিছু শুনিনিকো বাতিকের ব্যামো আছে বলে? কী হয়েছে না কী হয়েছে! সেই যে মেজোমণি চোখ বুজেছেন আজ নিয়ে পুরো সাতাশটি দিন কাবার হয়ে গেল, সে-মানুষের আর চোখ মেলবার নামটি নেই।
জমিদারি কবেই উঠে গেছে। তারও আগে থেকে গেছে বড়োবাড়ির ঝাড়বাতি, বোলবোলাও, লোকলশকর। বলতে লাগে না, পাঁচিলের গায়ে বড়ো বড়ো বট অশ্বথ ডুমুরের বাড়বাড়ন্ত দেখলে কথাটি আপনি বোঝে যে জন বুঝদার। যে ক বিঘে ধানজমি, পুকুর, বাগান, গোধন আছে, তল্লাটের সব মানুষ জানে তা দিয়ে বড়োবাড়ির জলখাবার টুকুনিও হয় কি না হয়। বড়োবাবু দেবভক্ত সাত্ত্বিক মানুষ, জীবনে কখনও রোজগায়ের টাকা ছুঁয়ে দেখেননি। ভাত পাতে তেতো থেকে মিষ্টান্ন অব্দি কুটি কুটি সবরকম না পেলে রোচে না। ক্ষীর কদূর ঘন হল ঢালা-উপুড় করে দেখতে হয় রোজ। কোঁচা লুটুবে একহাত। ঝাড়া বাহান্ন ইঞ্চি, কলকাঁপাড়ের দিশি কাপড় নিবারণের কুঁচিয়ে দেওয়া নইলে বড়োবাবু পরেন না। মেজোকর্তার তক্কো বাতিক। যেখানেই চাকরি করতে যান তক্কো করে সেসব খুইয়ে-টুইয়ে দুদিন পরেই বাড়ি এসে বসেন। আপিসে লোক রাখে কাজের জন্যে, খামোখা তক্কো করলে তারা শুনবে কেন বাপু? ছোট কত্তার অতসব ভাববার চিন্তোবার সময় নেই। ছেলেবেলা থেকেই নানান শখ। তাসের শখ, যাত্রা-থিয়েটারের শখ, মেডেলের শখ। কিছুর মধ্যে কিছু না ছোটো কত্তা হঠাৎ মেডেল হেঁকে বসেন। তালদিঘি, পাড়ইপুর, কন্নাট এই তিনখানা গ্রাম যে সবচেয়ে আগে বড়ো বেড় দিয়ে আসতে পারবে সে সোনার মেডেল পাবে। ছোটো কত্তার মুখ থেকে কথা বেরুনো আর রামচন্দ্রের ধনুক থেকে তির বেরুনো মোটের ওপর একই কথা। ওরে এই বাজারে সোনার মেডেল কোথায় পাব রে? পাত দিয়ে মুড়ে দিতে হলেও হাজার দু-হাজারের ধাক্কা। ওরে অমন হাঁকা হাঁকলি কেন? আর কেন। ছোটো কত্তা মাথায় নতুন গামছা চাপিয়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকে। ভাত খাবে না, ঘুমোবে না, কথা কও তার জবাব দেবে না। চোখের জলে নাকের জলে হয়ে সদর-অন্দর করতে করতে অবশেষে ছোটোমণি রসুইঘরে গিয়ে দড়াম করে আছড়ায়, আ মেজদি, কী হবে গো, মানুষটা যে শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হতে চলেছে।