ডোন্ট য়ু সি। সীতা ভয়ের গলায় বলে, আমরা তো ওর ডানা হেঁটে দিয়েছি। সামান্য একটু, এরকমই করতে হয় বুঝলে। ও বার্ড-ব্রিডারদের কাছে হ্যাচারিতে জন্মেছে, জোঙ্গল আকাশ এসোব ও জানে না, জেনেটিক্যালি হয় তো জানে, কিন্তু অ্যাকচুয়ালি জানে না। ও ভয় পাবে। হার্ট ফেল করবে। সাপখোপ কি কোনো শিকরে পাখিতে ওকে… বলতে বলতে শিউরে উঠলে সীতা। যেন ওকেই সাপখোপ কি শিকরে পাখি ধরেছে।
তখন বুঝলুম কেন অমন অস্বাভাবিক উড়ছিল মিঠু।
বললুম, তোমাদের মিঠু স্ত্রী না পুং জানি না। তবে ওর জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনও তো আছে। সে জন্যও কিন্তু ও পালাতে চাইবে। আত্মরক্ষা করতে পারুক আর না পারুক।
অবনী বলল, ওর মেট-এর চেষ্টা কি আর করিনি ভাবছিস। হি ইজ আ মেল, অনেক খুঁজেও ওর প্রজাতির ফিমেল পাইনি আমরা। অন্য প্যারট-টট দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি। তারা ওকে ঠুকরে শেষ করে দিতে চায়। তাই শেষ পর্যন্ত ও পাট চুকিয়ে দিতে হয়েছে।
মানে?
মানে আর কি! ক্যাসট্রেশন করিয়ে নিয়েছি।
ওইটুকু পাখি! তার…?
আমি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকি? মুখ দিয়ে কথা সরে না। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়। এই জন্যেই, এই জন্যেই বোধহয় এ দেশের আকাশে পাখি ওড়ে না। জঙ্গলের গভীরে যারা রয়েছে তারা রয়ে গেছে। কিন্তু বাকি সব পাখিকেই বোধহয় ওরা সন্তানসঙ্গহীন জীবনে শূন্যতা পূরণের মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে পুষে ফেলেছে। সীতা-অবিনাশ দুই অভিমানী মা-বাবা এখন মিঠুকে নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। একবার এ আদর করছে আর একবার ও আদর করছে। কত রকমের দানা বেরিয়েছে স্টক থেকে আখরোট, কাবুলিচানা, ঝুরি ভাজা। আমি তৃতীয় ব্যক্তি, আনমনে দেখছি। দেখতে-দেখতে একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটল। সোফায়-বসা আমার চারপাশে যেন ডানা ঝাপটানোর ঝড়ো আওয়াজ। পাখিহীন আমেরিকা মহাদেশের আকাশে, শুধু আমেরিকাই বা কেন, অল্পবিস্তর সারা সভ্য দুনিয়ার আকাশে আকাশে আমি অসংখ্য পাখি উড়তে দেখলুম। বার্মুডা আর টি-শার্ট, তাপ্পি দেওয়া জিনস আর পোলো নেক, সাদা ঝোলা-হাতা আর নীল সুতো ঝোলা… মোটের ওপর সবাই একই ধরনের, একই রকম উদগ্রীব উড়ান। তা-এর তাপে ডিম ফেটে ফেটে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছোটো পালকের বল, কচি কচি ডানা গজাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে বেপরোয়া। আশ্চর্য! ওরা কি ভয় পাচ্ছে আমাদের এতদিনের এই সভ্যতা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওদের খোজা করে দেবে?
আত্মজন
বাড়িতে আদ্যিকালের দেয়ালঘড়িখানায় ট্যাং ট্যাট্যাং ট্যাং করতে করতে বেলা তিনটেও বাজল, ডাক্তারবাবুরাও সব একত্তরে যেন সাঁট করে রুগির ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মুখগুলোয় সব থম ধরেছে। কেউ কারও পানে চাইতে পারছেন না সোজাসুজি। মোটা টাকার ফি গ্যাঁটস্থ হয়েছে, সারাদিন এলাহি খাওয়া দাওয়া, কিন্তু সুরাহা কিচ্ছুটি হল না। তা ছাড়াও, মানুষগুলির বিদ্যে-সিদ্যে সব যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। বড়োবাবুও সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসেছেন। শুধু মেজোবাবু এখনও ভেতরে। মুখময় খোঁচা খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি, পালঙ্কের ইদিক-উদিক দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে ঘুরে ঘুরে মরছেন।
শহর থেকে গলা-কাটা-দাম দিয়ে আনা ডাক্তারগুলি সব যে যার গাড়ি করে হুস করে বেরিয়ে গেল। বাড়ির বদ্যি গুহ ডাক্তারই শুধু জালে আটকা পড়ে বাড়ি কাতলার মতো খাবি খাচ্ছেন। বড়োবাবু তাঁর কনুইয়ের কাছটা ক্যাঁক করে ধরে আছেন। কোনোমতেই ছাড়ছেন না। নজর মাটির পানে রেখে গুহ বদ্যি মাথাটা নাড়লেন, ডাইনে-বাঁয়ে। বড়োবাবু বললেন, সে কি? কথার ভাবে মনে হল অত বড়ো মানুষটি এক্ষুনি ভ্যাঁ করে ফেলবেন। গুহ নীচু গলায় বললেন, ব্যাপার তো ভূতুড়ে কিনা বড়োবাবু! রক্তে চিনি নেইকো, হার্ট প্রেশার সব ঠিক ঠাক, ইনফেকশন নেই। আঘাত-টাঘাত কিছু না। খামোখা মানুষটার এমনিধারা অবস্থা যাকে কিনা আমাদের শাস্তরে বলে কোমা। আপনি তো দেখতেই পেলেন বড়োবাবু ওনারা সব বলছেন হাসপাতালে নিলেও সুবিধে বিশেষ কিছু হবে বলে মনে হয় না। আর, হাসপাতালের ব্যবস্থা তো এখানেই সব করেছি—গ্যাসকে গ্যাস! স্যালাইন কে স্যালাইন। চব্বিশ ঘন্টা নার্স মোতায়েন। ত্রুটি তো কিচ্ছুটি রাখেননি বড়োবাবু!
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। মেজোমণিকে শহরের বড়ো ডাক্তারেও। জবাব দিয়ে গেছে। কবরেজ, হাকিম, হোমিওপ্যাথিক, জড়িবুটি সবরকমই হচ্ছিল। এখন শেষমেশ ভারী শহরের ভারী ডাক্তার, বুকের ছবি, পেটের ছবি, হ্যান একজামিন, ত্যান একজামিন, এক কাঁড়ি করে টাকা খর্চা, তা তেনারাও সব যে যার মতো মাথা নেড়ে নেড়ে জবাব দিয়ে গেলেন।
ছোটো গ্রাম। গঞ্জর কাছেই। টাউন-শহরও দূর-দূরান্তে। তা সেই গাঁয়ের যে যেখানে আছে আজ এতোগুলিন দিন একবার করে অন্তত বড়োবাড়িতে হাজরে দিয়ে আসছে। জমিদারবাড়ি নয়, হাকিম না হুকুম না, তবু বড়োবাড়ি বড়োবাড়িই। গাঁয়ের ছেলে ছোকরার, ঝি-বউয়ের বিয়ে-বউভাতে ওই বড়োবাড়ির উঠোনেই শামিয়ানা পড়ে, পালাগান, যাত্রা, অষ্টপ্রহর সব ওইখানেই।
কিছুর মধ্যে কিছু না বড়োবাড়ির মেজোমণি অজ্ঞান হয়ে আছেন আজ মাস ফুরুতে চলল। অমন লম্বা চওড়া জগদ্ধাত্রীর মতো শরীরটি ছোট্ট হয়ে বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। সোনাহেন বর্ণ কালিঢালা। চোখমুখ সব যেন গর্তে ঢুকে আছে।