রবিবারের সকালবেলা। এইবারে আমরা বেরোব। গত সপ্তাহান্তে দেখে এসেছি নিউ হ্যাম্পশায়ারে অপূর্ব উইনিপেসাকি লেক, বোটিং-ও হল। নামটা কী সুন্দর। এইসব রেড ইন্ডিয়ান নামে ভরতি মহাদেশটা। সাসকাচুয়ান, কেন্টাকি, কানেটিকাট, মিসিসিপি, মিসৌরি, ক্যানসাস, উইসকনসিন মিনেসোটা। দুদিন বেশি ছুটি নিয়েছিল ওরা। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হু হু করে পেরিয়ে, বস্টনের পাশে হার্ভার্ড থেকে পৌঁছে গেলাম নিউ ইংল্যান্ডের প্লিমাথ-এ। সেখানে আমেরিকায় প্রথম ব্রিটিশ পদার্পণের স্মৃতিসমূহ ঠিক তেমনই করে সাজানো আছে। আজ যাচ্ছি সোজা বাফেলো শহর। সেখানে থেকে নায়াগ্রায় মার্কিন দিকের চেহারাটা দেখা যায়।
গ্যারাজের দিকের দরজা দিয়ে আমরা বেরোই। গাড়িতে মালপত্র সব ভোলা হয়ে গেছে। আমি, সীতা বেরিয়ে এসেছি। শেষ ব্যক্তি বেরোবে অবনী। হঠাৎ ফরফর ফরফর শব্দ। একটা সবুজ ঝিলিক, তারপরেই সীতার আর্ত চিৎকার, মিটু! মিটু! মিটু! ব্লু-জিনস আর কুঁচি-দেওয়া হলুদ শার্ট পরে সীতা দৌড়াচ্ছে, ক্রমেই গতি বাড়ছে তার। অবনীর মুখে গভীর আতঙ্কের অভিব্যক্তি। আমি হতভম্ব।
দু-তিন দিনের সফরে গেলে ওরা মিঠুকে ওদের শোবার ঘরে বন্ধ করে রেখে যায়। ওই স্যুইটটা মিঠুর ভারি পছন্দ। ওখানে রাখলে নাকি ও মনে করে ওকে ভি.আই.পি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ভারে ভারে ডালিম, কমলার কোয়া, বাদাম আরও কী সব ভিটামিন-মিশ্রিত বার্ড-ফিড রাখা থাকে, বাথটবে জল। যত খুশি চান করবে মিঠু। আর একটা ছোটো ভারী পাত্রে খাবার জল। এ ক-দিন ইচ্ছে করলে মিঠু তার বাবা-মার বিছানায়ও নৃত্য করতে পারে। এখন আজ ওরা দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে, না টেনেছে ঠিকই কিন্তু ল্যাচ আলগা হয়ে গেছে, তারপর খুলে আধখোলা মতো হয়ে গেছে দরজা। ভগবান জানেন। মোট কথা মিঠু কোন ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে। গ্যারাজের দরজা দিয়ে আনাগোনাগুলো লক্ষ করেছে এবং ফাঁক পেয়েই ফুড়ুৎ করে পালিয়েছে।
বাড়িটা ডানদিক দিয়ে বেড়ে হরিণের নালা পার হয়ে পিছনের জঙ্গলের দিকে যাই আমরা। সবুজে সবুজে সব বিরাট ওক, মেপল, বার্চ অ্যাশ জঙ্গল আঁধার করে দাঁড়িয়ে আছে।
অবনী বলল, কোন দিকে গেছে খেয়াল করেছ?
এদিকেই এদিকেই-কাতর উচ্চকিত স্বর সীতার।
মিটু, মিটু, মা ইজ হিয়ার, কাম ব্যাক, কাম ব্যাক মাই সুইট।–কম্পমান অক্লান্ত স্বরে ডেকে যেতে থাকে সে।
অবনী দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়, চিনি আর আঙুর নিয়ে আসে। কালো আঙুর মিঠুর বিশেষ প্রিয়। হাতে আঙুরের থোকা দোলাতে থাকে সে। সীতা হাত ভরতি চিনি নিয়ে ঊর্ধ্বমুখী।
মি–ঠু, লুক অ্যাট দ্য গ্রেপস, কাম ডাউন মিঠু।
মিঠু। মিঠু!
হঠাৎ দেখি সীতার দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে।
কাঁদছ কেন সীতা।–আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, যদি ওই বন আর আকাশের স্বাদ ও পায় তত ভালোই তো, ওটাই কিন্তু এর আসল জায়গা, ওখান থেকে কখনও ফিরে আসে? বর্ন ফ্রি-র সেই সিংহটার কথা মনে করো।
হঠাৎ চোখ ভরতি জল নিয়ে পিছন ফিরে আমার বুকে দুম দুম করে কিল মারতে লাগল সীতা, হাউ ক্যান য়ু বি সো ক্রুয়েল, ওহ হাউ ক্যান য়ু বি সো ক্রুয়েল।
অবনী তাড়াতাড়ি এসে তাকে থামায়। বলে, ও ঠিক ফিরে আসবে, যাবে কোথায়? এমন কোরো না সীতা, ধৈর্য ধরো।
মি-ঠু—আবার ডাকে অবনী। তার কপালে ভাঁজ। গলার স্বরে মরিয়া রাগ।
অনেক উঁচুতে গাছের পাতার ঘন সবুজ থেকে একটা হালকা সবুজ বিন্দু হঠাৎ আলাদা হয়ে যায়। আমরা সবাই দেখতে পাই। কেমন গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে উড়ছে। মিঠু। এক গাছ থেকে আর এক গাছে। সীতা হিস্টিরিক গলায় বলল, ও ভোয় পেরেছে। কখনও জোঙ্গল দেখেনি। অত উঁচুতে ও গেল কী করে? অবনী কিছু। করো, কিছু একটা করো প্লি-জ।
মুখের দুপাশে হাত রেখে তীব্র স্বরে শিস দিয়ে ওঠে অবনী। মিঠু ঝাঁপ খেয়ে নীচের ডালে নেমে আসে।
মিটু-উ-উ, মায়ের কোলে এসো… দু-হাত বাড়িয়ে বলে সীতা।
আর একটা এলোমেলো ঝাঁপ শূন্যে। মিঠু আরও নীচের ডালে এসে বসেছে।
হাত উঁচু করে আঙুর দোলায় অবনী। চিনিসুদ্ধ হাত অঞ্জলি করে ওপর দিকে তুলে ধরে সীতা। মুখে অনর্গল আদরের ডাক। গলা ভেঙে গেছে, মুখের চামড়ায় গভীর কষ্টের খাল, সীতা চিৎকার করে, মিটু, মি-টুস মাম কলস ডিয়ার, কাম ব্যাক টু মা, লুক হিয়ার, আই হ্যাভ সুগার ফর য়ু, মি-টু।
গ্যারাজের মাথায় এসে বসেছে মিঠু। ঢালু করোগেটের ওপর পায়ের কুড়মুড় খচমচ মতো শব্দ তুলে গুটগুট করে হেঁটে হেঁটে আসছে।
অবনী বলে, টেক কেয়ার বেবি। হাঁ, ঠিক হয়েছে হাঁটি হাঁটি পাপা, হাঁটি হাঁটি পা পা।
ঠোঁট বাড়িয়ে আঙুরের থোকা কামড়ে ঝুলে পড়ল মিঠু। অন্য হাত দিয়ে তাকে ধরে ফেলল অবনী।
লিভিংরুমের সোফাগুলোতে হাত-পা ছড়িয়ে এখন বসেছি তিনজনে। বাববাঃ। একখানা কাণ্ড হল বটে।
সীতা লজ্জিত, অনুতপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আয়্যাম স্যরি উদোয়। আই ওয়াজ নট ইন মাই সেনসেজ। প্লিজ।
আমি হাসি, ইটস অল রাইট। কিছু মনে করার প্রশ্নই নেই। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু সীতা মনে করো যদি আবার একদিন এরকম হয়। হতেই পারে। বোঝাই যাচ্ছে ও সব সময়ে তক্কে তক্কে থাকে। ফাঁক পেলেই আবার পালাবে। আফটার অল ওর ওই ডানা দুটো তো ওড়বার জন্যেই, কবিত্ব করে বলতে গেলে আকাশের নীল ডাকে হারিয়ে যাবার জন্যে। যদি ওকে ভালোবাসো, ওর ছোট্ট জীবনের এই কৃতিত্বে, সার্থকতায় তোমরা খুশি হবে না?