সীতা বলল, মোজা কি জানো উদোয়, মেয়েটা নিজে চাকরি করে পোড়াতে লাগল। দুটো বাচ্চা হয়ে গেল। তার নিজের কেরিয়ার বারোটা। তারপর জিষ্ণু কী বিহেভ করেছিল জানি না। দুটো বাচ্চা নিয়ে মেয়েটা, সোফিয়া, একজন ব্ল্যাককে বিয়ে কোরে চোলে গেল। জিষ্ণু কিছুদিন পোরেই একটা ট্রাভল এজেন্সি খুলল, একটা স্প্যানিশ মেয়েকে বিয়ে কোরলো। দুজনে মিলে বিজনেস ভালোই চালায়। একটা বাচ্চা।
থাকে অ্যারিজোনা স্টেটে বুঝলি উদয়, অবনীশ বলল, আসে বছরের একবার তো বটেই। নাতিটা বেড়ে হয়েছে। ওর মায়ের মতো। তবে মজা কি জানিস, সীতা কিন্তু মনে মনে সেই প্রথম দুটো নাতি-নাতনিকেই বেশি ভালোবাসে, সম্ভবত সোফিয়াকেও যদিও তারা আমাদের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না।
সীতা বলল, এগুলো একদোম বিশ্বাস কোরো না, বিয়ে হোক না হোক বাচ্চা দুটো তো আমাদেরই। বোলো? তাদের জন্য মন পুড়বে না? আর সোফি! হোতে পারে ব্ল্যাক। মেয়েটা প্রাণ দিয়ে জিষ্ণুকে তৈরি করে দিয়েছিল। তার স্যাক্রিফাইসটা হামি নিজে মেয়ে হরে কী করে ভুলতে পারি? উই হ্যাভ অ্যাকসেপ্টেড হার অ্যাজ আওয়ার ডটার-ইন-ল।
আমি কথা পালটাই। আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠেছে। আমি ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছি অবনীর পক্ষপাত বর্তমান পুত্রবধূর ওপর, সীতার সহানুভূতি পুত্রবান্ধবীটির ওপর। কেন? কোন সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব এখানে কাজ করেছে কে বলবে?
সীতাও বলে, তুমার ফেমিলির কোথা বলো উদোয়।
আমার ফ্যামিলি? সেই যথা পূর্বম তথা পরম। আমার বাবাকে ওরা চিনত খুব। তা বাবা গত হয়েছেন অনেকদিন। আমার ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতে। ভাগ্যিস একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলুম তাড়াতাড়ি, দিদিরও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই সামলে নিতে পেরেছি।
মা বেচারি অনেক কষ্ট করেছেন ক-টা বছর। তারপর দিদির ননদ শকুন্তলাকে বিয়ে করেছি। বলা যায় একটা আধা-প্রেম, আধা-অ্যারেঞ্জড গোত্রের ব্যাপার। ছেলে রণো ছোটো কিন্তু আমার চেয়েও বড়ো এক এক সময়ে মনে হয়। মেয়ে রিনির ঠাকুমা মা-বাবার ওপর টান এমনই যে সে যাতায়াত অসুবিধে হলেও যাদবপুরে হস্টেলে থাকতে চায় না এখনও পর্যন্ত। কাঁকুড়গাছিতে একটা ছোটো বাড়ি করতে পেরেছি। জমি বাবারই কেনা ছিল। জামাইবাবু অনেক সাহায্য করেছেন বাড়িটা দাঁড় করাতে। মায়ের ত্যাগের কথা না-ই বললাম। শকুন্তলা মাকে অনেক আগে থেকেই চিনত, মাও ওকে। কে জানে সেই জন্যেই কিনা, বেশ মানিয়েই তো আছে। বিশেষত আমার মাতৃদেবী একটু মাই ডিয়ার গোছের আছেন। রিনি বলে গেছো মেয়ে। রণো বলে বড়ো-ছোটো মেয়ে। রিনি এখনও ঠাকুমার কাছেই শোয়। রিনির রণোর উভয়েরই পড়াশোনার বিপুল খরচ আমাকেই চালাতে হয়। শকুন্তলা অবশ্য শাড়ির ব্যাবসা করে কিছু রোজগারপাতি করে। তবে তার হ্যাপা অনেক। এখন এইসব খবরাখবরের মধ্যে কোনটা কতটা ওদের বলব। এই প্রগতিশীল, অত্যাধুনিক সমাজে থাকে। দেশে এই ত্রিশ একত্রিশ বছরে কবার গেছে হাতে গোনা যায়। ওদের অভ্যাস, ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতা, সুখদুঃখ সবই আমাদের থেকে একেবারে আলাদা। ছেলেমেয়ে যে আমায় দেড় মাসের কড়ারে আমেরিকা পাঠিয়েছে এ কথা কি ওদের বলবার? আমার ফাজিল বড়ো-ছোটো মেয়ের মা যে তাড়াতাড়ি না ফিরলে বাপের বাড়ি যাবার ভয় দেখিয়েছেন সে কথা বলতে গিয়ে যদি হাস্যকর প্রতিপন্ন হই?
ওদের মেয়ে রশমির মোটে উনিশ বছর বয়স। আমার রিনির চেয়েও দু-বছরের ছোটো। সেই মেয়ে স্কুলের পড়া শেষ করে এখন মাউন্টেনিয়ারিং করছে। আপাতত পূর্ব আফ্রিকায়। তার জন্য কোনো খরচখরচা করতে হয় না ওদের। গিফট দেয় অবশ্য। গিফট হিসেবে ডলার-ড্রাফটও দেয়। কিন্তু এই উনিশ বছরের কিশোরী পার্বতী মা-বাবার জন্মদিনে বিবাহবার্ষিকীতে কিছু-না-কিছু গিফট পাঠাতে ভোলে না। কোথা থেকে সে নিজের খরচ চালায়, কোথা থেকে আবার উপহারের ব্যবস্থা করে ভাবতে গিয়ে আমি মুগ্ধ, অভিভূত হয়ে থাকি। আমার মেয়েও অবশ্য আমাকে উপহার দেয়। মার্চ মাস থেকে তাড়া দেবে, বাবা আমার শ তিনেক টাকা বড্ড দরকার, দাও না।
শ তিনেক? অত কেন?
বেশি হল? আমি তো মিনিমানটাই চাইলাম।
এপ্রিলের পনেরো আমাদের বিয়ের তারিখে আমরা পতি-পত্নী একটি ফ্লাওয়ার ভাস, বা একটা-দুটো বিখ্যাত বই উপহার পাই। ওই তিনশো টাকা থেকে কেনা। মোড়কের বাহারি কাগজ, আর একগোছা ফুল রণোটাই নাকি যোগ করে। ও বলে, কাগজ আর ফুল বলে তুচ্ছ করো না বাবা, আই হেট টু বাই য়ু আ গিফট উইথ ইয়োর ওন মানি। ইটস রিডিক্লাস।
আমি বলি, তা তোর কি আজকাল নিজের রোজগার হয়েছে? ড্রাগ-পেডলার হয়েছিস না কি?
শকুন্তলা বলে, দেখো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছে, পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে শোধ করবে। পাকামি না করলেই যেন নয়। মারব এক থাবড়া। তো এই আমার ছেলেমেয়ের আধুনিকতা। এখনও পর্যন্ত।
আর ওদের বড়ো ছেলে অত্রি? মাত্র আঠাশ বছর বয়সেই তার ট্যালেন্টের জোরে সে সিয়াটলের কোনো ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রির হেড। বিয়ে করেছে নিজেরই মতো পণ্ডিত আর এক শ্রীমতীকে। সে আবার গ্রিক। অত্রি এবং তার গ্রিক স্ত্রী সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে বেড়ায় গবেষণার দরকারে। বিভিন্ন সময়ে ওদের পাঠানো কার্ড ও ছবিগুলো দেখাল অবনী। ক্রিসমাস কার্ড, বার্থ ডে, ম্যারেজ অ্যানিভার্সরি, নিজেদের এবং মা-বাবার, নভেম্বরে থ্যাংকস-গিভিং-এর কার্ড, অসুখ করলে গেট ওয়েল কার্ড। অত্রি আর আদ্রিয়ানার কার্ড দিয়েই গোটা কয়েক অ্যালবাম হয়ে যায়।