একা-একা একঘেয়ে লাগত যদি সন্ধে থেকে মাঝরাত্তির অবধি অমন জমাট আড্ডাটা না হত। এতদিনের জীবনের আদি-মধ্য-অন্তের ভেতরে যে আদি-ঘেষা মধ্যভাগটায় আমাদের তিনজনের জানাশোনা সেইসব দিনের স্মৃতিচারণের বেশিরভাগ সময়টা কাটে। তবে তারই অনুষঙ্গে আগেকার জীবন, এখনকার জীবনযাত্রার প্রসঙ্গে এসেই পড়ে। অবনীশ আসে আগে, ডিনারের ব্যবস্থা শুরু করে দেয়। দুজনে চা নিয়ে বসি। ওদের জন্যে ভালো দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছি, তারই সদব্যবহার হয়। খাঁচার মধ্যে ঝটপটাতে থাকে মিঠু। কাঁ কাঁ, কাঁক, কাঁক।
কী বলছে বল তো!—অবনীশ পরমোৎসাহে জিজ্ঞেস করে।
আমি তোর টিয়ের ভাষা কিছুই বুঝতে পারছি না অবনী, অনেস্টলি।
আরে কী আশ্চর্য! ও বলছে বাবা, বাবা, বাবা।
আমি হেসে বলি, আমি তো শুনছি বড়োজোর নাকিসুরের কাকা, আবার টাটা ও হতে পারে।
না রে, এটাই ওর ফেমাস বাবা ডাক। প্রথম ডেকেছিল মা। সে ঠিক আছে। মা একটা এক অক্ষরের শব্দ, সবাই বলে। কিন্তু বাবা বলে যেদিন আমার কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম বুঝলি। কেননা, ডাকটা ও শুনল কোথায়? আমার ছেলেমেয়েরা যখন আসে, ডাকে ড্যাডি। বাবা কোত্থেকে পেল ও অনেক ভেবে-ভেবে বার করি একদিন ও এই টেবিলটাতে খেলে বেড়াচ্ছিল, আমি আর সীতা আমাদের বাবাদের গল্প করছিলাম। সেই থেকে পিক-আপ করেছে। বোঝ একবার, কী সাংঘাতিক বুদ্ধি!
ইতিমধ্যে তো অবনীর সেই প্রডিজি পাখি ছাড়া পেয়ে তার বাবার মাথায় চড়ে বসেছে। বাবা তাকে মাথায় নিয়েই ফ্রিজের দরজা খুলল। দেখি সেই বেদানা আর কাঠবাদামের কৌটোগুলো নিয়ে আসছে।
বুঝলি এই আমন্ড আর ডালিম—এই দুটোই ওর সবচেয়ে ফেভারিট।
যাচ্চলে! আমি মনে-মনে জিভ কাটি। দুপুরের একাকিত্ব কাটাতে পাখির দানা মেরে দিয়েছি?
তবে অবনীর মিঠুর যে কোনটা ফেভারিট নয়, বুঝলাম না। ছোট্ট একটা সোনালি কফি পটে তার জন্য চা এল, খেল, ফেলল, ছড়াল, তাতেও শানাল না, অবনীর কাপেও ঠোঁট ভিজিয়ে নিল তুরন্ত। বিস্কিটে ঠোকর মারতে লাগল। প্লেটে চুড়ো করে চিনি দিতে হল তাকে।
বুঝলি উদয়, এই পুঁচকেটাকে আর ম্যানার্স শেখাতে পারলাম না। অত্রি, জিষ্ণু এমনকি আমাদের একমাত্তর মেয়েটাও এত অসভ্য ছিল না। কারও সামনে বেসহবত হলে বাচ্চা বয়সে ওদের কত বকাঝকা করেছি। এটার বেলায় ফেল মেরে গেলাম।
আমি বলি, একটা পাখিকে পেট হিসেবে তুই কতকগুলো সাধারণ জিনিস শেখাতে পারিস, কিন্তু…
অবনী বলে উঠল, উদয় প্লিজ, মিঠুকে পাখি-পাখি পেটটেট বলিসনি, বিশেষত সীতার সামনে। ভীষণ দুঃখ পাবে। রেগে যেতেও পারে।
যা ব্বাবা! যতই ভালোবাসুক, পাখিকে পাখি বলতে পারব না?
সীতা এলে আর দেখতে হবে না। কাঁ কাঁ করে ডাকতে ডাকতে সীতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমি বলি, আমি একটু বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আসি বাবা, তোমাদের মিঠুর তো। এখন আবার হিংসে হবে, আর ঠোক্কর খেতে আমি রাজি নই।
প্লিজ উদোয়, একটু আদর খেয়ে নিক, তারপর ওর ব্যবস্থা করছি, যেয়ো না।
মিঠুর চিৎকার আর ওলটপালট, সীতার মুখ ঠুকরোনো অর্থাৎ চুমু খাওয়ার বহর দেখবার মতো। অনেকটা সেই সার্কাসের টিয়ার খেলার মতো। কাঁধ থেকে কোলে লাফিয়ে পড়ছে, তারপরেই আমাকে চমকে দিয়ে ঝটপট করতে করতে উড়ে গিয়ে বসছে মাথায়। হাত থেকে ডালিমের দানা নিয়ে কুট কুট করে খাচ্ছে। গর্বে ভরতি মিঠুর বাবা-মার মুখ। ভাবটা কেমন দেখছিস? জীবনে কখনও এমনটা দেখেছিস আর?
যাই হোক, অবশেষে সীতা মিঠুর ব্যবস্থা করে, নিজেদের শোবারঘর ও লাউঞ্জের ভেতরে তাকে পুরে দিয়ে আসে। ওখানে নাকি মিঠু অনেকটা ওড়বার জায়গা পাবে। টয়লেটে জল ভরা টব আছে, সেখানে চান করতেও পারে। আলমারির মাথায় বসে থাকতে পারে আবার কার্পেটের ওপর বসে বসে ঝিমিয়ে নিতেও পারে।
রশমিকেও নাকি ওরা ঠিক ওইরকম নিজেদের হলে বন্ধ করে রেখে দিত। সেটা অবশ্য কোনো দুষ্টুমির শাস্তি। এক ঘন্টা-দু ঘন্টার জন্যে।
অবনী বলল, রশমি খুব দুষ্টু ছিল ঠিকই, কিন্তু জিষ্ণুর কাছে ও কিছুই নয়। জিষ্ণু অবিকল সেই আবোল-তাবোলের বাপরে কী ডানপিটে ছেলে!
দুজনেই হাসতে লাগল।
আমি বললুম, তা সেই সবচেয়ে ডানপিটেই তো সবচেয়ে আগে পোয মেনেছে শুনছি।
ওর কথা আর বলো না, সীতা বলল, হাইস্কুল পাস কোরবার পোরই কলেজে জয়েন করতে না করতেই একটা ব্ল্যাক মেয়ের সঙ্গে থাকতে লাগল।
অবনী বলল, এ হে হে, এসব কথা উদয়কে বলছ কেন? কী মনে করবে বলে তো?
সীতা বলল, চব্বিশ বছর বয়েসে এখানে এসেছি উদোয়, থার্টি ইয়ার্স প্রায় হতে চোলে, হামাদের ওয়েজ আমেরিকান হোয়ে গেছে, মোনে কিছু কোরো না। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
আমি তাড়াতাড়ি ওদের আশ্বস্ত করি, আমি কিছুই মনে করিনি, আর মার্কিন সমাজ ও জীবনযাত্রার আদর্শ সম্পর্কে কিছু-কিঞ্চিৎ ধারণা তো আমাদেরও আছে রে বাবা!
সীতা বলল, ইভন দেন, উই ওয়্যার শকড। অ্যাট ফাস্ট। একটা আঠারো বছরের ছেলে তো আফটার অল!
তোমরা কিছু বলোনি? রাগারাগি করে এখানে লাভ হয় না জানি।
আরে জানব তবে তো বলব। অবনী বলে, জানানোর দরকার বলেই মনে করেনি। বিয়ে করলে জানাত। এখানেই জন্মকর্ম, এখানেই শিক্ষা, এদের মতোই অবিকল তো। এটা ওরা লুকোনোর বা বলবার মতো কিছু মনে করে না। তবে আমরা ঠিকই জানতে পেরেছিলাম। তারপর এসেছেও এখানে।