সীতা বলল, কোতো পাখি আসে ওখান থেকে। আমাদের ডেকটার তলাতেই বার্ড ফিডার রাখি। দেখবে এস, ভাগ্যে থাকলে ফ্লিনচ রবিন, ব্ল্যাক বার্ড, ব্লু জে, কার্ডিন্যাল আরও কোতো পাখি দেখতে পাবে। মাঝে মাঝে ওয়াইল্ড টার্কিও এসে যায়।
আমাদের ছাদ থাকে, বারান্দা থাকে। এদের এখানে বেশিরভাগই দেখছি বাড়ির পেছনে একটা ডেক থাকে, ঠিক জাহাজের ডেকের ছোটো সংস্করণেরই মতো। এরা সেখানে নানা রকম হার্বস চাষ করে-ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, চায়না-গ্রাস, আরও কত কী তাদের নামও ছাই আমি জানি না। সীতা-অবনীশের ডেকে একটা রং-করা বেতের বসবার ব্যবস্থা দিবারাত্র রোদ খাচ্ছে জল খাচ্ছে। জঙ্গলের দৃশ্যটা এখান থেকে বেশ ভালো দেখা যায়। একটা মাত্র ধূসর রঙের পাখি খুঁটে খুঁটে কী সব খাচ্ছিল, আমরা ঢুকে বসতেই হুশশ করে উড়ে গেল।
সীতা বলল, আশ্চর্য, ওরা তো অন্য দিন পালায় না।
আমি বলি, আমি খারাপ লোক, দেখো তোমাদের পোষা এবং না-পোষা পাখি সকলেই তোমাদের জানিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে অবনীশ অতি চমৎকার দেখতে মার্গারিটার ট্রে নিয়ে উপস্থিত। একটা ক্রিস্ট্যালের পাত্রে যথেষ্ট মেওয়া, যাকে এরা বলে ড্রাই ফুট। আমার এখন একটু হাত-পা ছড়িয়ে কোনো পানীয় নিয়ে বসবারই দরকার ছিল।
আমার শেষ কথাটা অবনীশ বোধ হয় শুনতে পেয়েছিল। বলল, পোষা-টোষা বলিসনি। মিঠুটা পোষাও নয়, পাখিও নয়, ও আমাদের পুত্র, যাকে বলে ছোটোখোকা।
সীতা বলে, আমাদের চারটা। অত্রি, জিষ্ণু, রশমি আর মিটু।
একটু গল্পগাছা করবার পর ওরা পরম উৎসাহে বাড়ি দেখাতে লাগল। প্রাসাদবিশেষ। তিন ছেলেমেয়ের তিনখানা ঘর, ওদের নিজেদের একটা বিশাল শোবার ঘর, সঙ্গে লাউঞ্জ। টয়লেটে বাথটবে জাকুজি। অতিথি-ঘরটার সঙ্গেও একটা লাউঞ্জ। আগাগোড়া ছবির মতো সাজানো। লাইব্রেরি। ডাইনিং কাম লিভিংরুম। ফর্মাল ড্রয়িংরুম। বিশাল ব্যাপার। যাদের বাড়ি তারা বিশেষ উপভোগ করতে পায় বলে মনে হয় না। আমি দু-দিনের জন্যে এসে আচ্ছা করে আরাম খেয়ে নিই। ভোরবেলা উঠে হাঁটতে হাঁটতে শেলটনের গাছে-ছাওয়া গ্রামাঞ্চলের রাস্তা বেয়ে চলে যাই যত দূর পারি। আশ্চর্য সবুজ গাছপালা সব। যেন কেউ প্রতিদিন সাবানজল দিয়ে ঝকঝকে করে মুছে যায়। রাস্তার নেড়ি-বিল্লি বলে জিনিস নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য ডিয়ার ক্রসিং নোটিস দেখে বুঝতে পারি নেড়ি হরিণ এখানে আছে বিস্তর। আর আশ্চর্য, আকাশে কোনো পাখি নেই। আমাদের তো গাছ থাকলেই সেখানে কাকে বাসা করবে। ভোর বা সন্ধে মানেই হরবোলা অর্কেস্ট্রা। এখানে সকালে পাখিদের জেগে-ওঠা নেই, বিকেলে তাদের ঝাঁকে-ঝাঁকে ঘরে ফেরা নেই। কাকের কা-কা নেই এমন অবস্থা তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আশ্চর্য নিরালা, নীরব দিন-দুপুরে হঠাৎ-হঠাৎ কেমন অপ্রাকৃত নিঃশব্দ লাগে সব। কেন এত অস্বস্তি! তার পরে আবিষ্কার করি—কাক নেই, কা-কা নেই তাই। পাখি দেখতে হলে যাও সেই ডেকে। মেহেদি আর থাইদেশীয় তুলসীর মধ্যে বসে থাকো যদি ব্লু-ফিনচ, রবিন কি ব্ল্যাকবার্ড দেখতে চাও।
কিন্তু আমরা তো আর সবাই সেলিম আলি নই, বিভূতিভূষণ বা বুদ্ধদেব গুহও নই, যে পাখির জন্য পথ চেয়ে আর কাল গুনে বসে থাকব! আসলে পাখপাখালির ডাকাডাকি আমাদের শহুরে জীবনযাত্রারও আবহসংগীত। সংগীত হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় কেমন একটা কেমন-কেমন লাগে।
আমাকে কথা দিলেও অবনীশরা সেভাবে ছুটি নিতে পারেনি। দুটো উইক এন্ডের সঙ্গে আর একটা করে দিন যোগ করে নিয়েছে। ওই দুটোর একটায় আমরা যাব হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, বস্টন এবং তার কাছাকাছি নিউ হ্যাম্পশায়ার বলে একটি পাহাড়ি জায়গায়। আর একটায় যাব নিউ ইংল্যান্ডের প্লিমাথ নায়াগ্রা।
ভোরবেলা আমার চ্যানেল মিউজিক শুনে ঘুম ভাঙে। আমি চটপট বেরিয়ে পড়ি। ফিরে দেখি ব্রেকফাস্ট রেডি। ফেনায়িত কফির গন্ধে বাড়ি ভরপুর। সীতা বেচারি অত সকালে পরোটা-ফরোটা ভেজে ফেলে এক এক দিন। অবনী আগে, সীতা একটু পরে বেরিয়ে যায়। দুজনের দুটো গাড়ি মোড়ের ওধার ঘুরে হারিয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে এসে বসি। খুব ভোরে উঠি তাই এক এক দিন আর এক ঘুম ঘুমিয়ে নিই। অলস মাথায় বই পড়ি। ভি.সি.পি-তে ক্যাসেট চাপিয়ে ভালো ভালো ছবি দেখি। একটা কি দুটো কি আড়াইটে বাজলে ফ্রিজ থেকে কিছুমিছু বার করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিই। তবে অনেক সময়ে মাঝেও একটু মুখ চালাতে ইচ্ছে করে। ফ্রিজের মধ্যে দিব্যি ছাড়ানো বেদানা-ডালিম, বাদাম আখরোট থাকে, টুকটাক চালাই। মোটকথা এরকম আলসে কুঁড়ে নিপাট নিশ্চিন্ত বাদশাহি ছুটিযাপন আমার ভাগ্যে জীবনে এই প্রথম। লাগছে মন্দ না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই বাড়ি এই জঙ্গল এই বৈভব এই হরিণ সব বোধহয় আমারই। গান শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগলে ঘুরে বেড়াই বাড়িটার মধ্যে। কত রকমের যে অলংকরণ! কাচের স্ফটিকের, কাঠের, গালার, কাপড়ের, পোড়া মাটির। আর ঘরে ঘরে ছবি, ছবি মানে ফোটো। ছবি দেখে-দেখে অত্রি-জিষ্ণু রশমিকে আমার চেনা হয়ে গেছে। শিশুকাল থেকে এখনকার বয়স পর্যন্ত অজস্র ছবি। কখনও মার সঙ্গে কখনও যাবার সঙ্গে কখনও দুজনের কোলে পিঠে, কখনও ভাইবোন তিনজন, কখনও কেউ একা, বন্ধুদের সঙ্গে, পাহাড়-নদী-অরণ্য-পথ, পথের মানুষের সঙ্গে। অজস্র অজস্র। অত্রি নাকি এখন আঠাশ তো আট বছরের অত্রিও যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি নির্ভুল চিনতে পারব। জিষ্ণু ছাবিবশ, তার নাকি আবার নিজস্ব পরিবারও আছে, রীতিমতো ফ্যামিলি ম্যান। আর রশমি একটা উনিশ বছরের কিন্তু গাল টিপলে দুধ বেরোয় গোছের বালক-বালক মেয়ে। তিনজনেই সুন্দর প্রাণবন্ত। রঙিন ছবিতে তাদের গালের লালিমা, স্বাস্থ্যের দীপ্তি ফেটে বেরোয়। জিষ্ণুই ওদের মধ্যে অবনীশের রং পেয়েছে, ঘষা তামার মতো একটা অদ্ভুত রং যেটা অবনীশের ছাত্রবেলায়ও ছিল।