ওকে আশ্বস্ত করি। আমিও মোটামুটি স্বাস্থ্য-সচেতন। একটু-আধটু যোগাসন করি, হাঁটাহাঁটিও করি। শুভদীপকে দেখে আমার ভয় ধরে গেছে।
তোমার তো চুলও চোমোক্তার আছে উদোয়। বেশ সল্ট অ্যান্ড পেপার। তুমার বন্ধুর দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। একেবারে চোকচোক গোড়ের মাঠ হয়নি?
তখন আমি সুযোগ পেয়ে বলি, তো সীতাদিদি, তোমারই বা সে ভ্রমরকৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ কেশদামের কী হল?
মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে সীতা বলল, যা খাটুনি! চুল এখানে রাখা যায় না উদোয়। অন্তত আমি পারি না। লম্বা চুল গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ে যায়।
হইহই করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে অবনীশ। পাশে সীতা। পিছনে আমি বেল্ট বাঁধা-ছাঁদা লাগেজের মতো।
শহর থেকে দূরে, পাইন-মেপল-বার্চ ঘেরা একটা চমৎকার গ্রামে থাকে ওরা। নাম শেলটন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে অনায়াসে আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে গেল সীতা। কিছুতেই আমাকে নিতে দিল না। পিছন-পিছন আমি। অবনী গ্যারাজে গাড়ি রেখে আসছে। বাড়ির বাইরেটা অবিকল ইংরেজি ফেয়ারি-টেলের বাড়িগুলোর মতো। ভেতরটাও যেন খেলাঘর। তা সিঁড়ি দিয়ে উঠে কফি রঙের কার্পেটের ওপর পা রেখেছি কি না রেখেছি—কুঁ কি ক্যাঁ কুঁ কি ক্যাঁ করে কিছু একটা কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল।
ওঃ মাই প্রিটি, মাই সুইটি মিটু ডিয়ার, মা ইজ হিয়ার—বলতে বলতে কয়েক কদম গিয়ে সীতা হাত উঁচু করে একটা খাঁচার দরজা খুলল। খাঁচাটা সোনালি রঙের। সিলিং থেকে একটা চকচকে ধাতুর বাঁকানো ডগায় ঝুলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়—কোনো গৃহসজ্জা। কিন্তু কাঁচের দরজা খুলতেই একটা সবুজ টিয়াজাতীয় পাখি বিদ্যুৎবেগে উড়ে সীতার কাঁধে গিয়ে বসল।
আমার দিকে ফিরে সীতা বলল, প্লিজ বসো, উদোয়, আগে একটু রেস্ট নিয়ে নাও তারপর তুমাকে বাড়ি দেখাব।
ততক্ষণে কয়েক সিঁড়ি টপকে টপকে উঠে এসেছে অবনীশ। পিছন থেকে সোৎসাহে বলল, ও কী বলল বল তো!
আমি বলি, বলল আগে একটু রেস্ট নিয়ে নিতে, তারপর…
অবনীশ হা হা করে হেসে বলল, সীতা নয় সীতা নয়, মিঠুর কথা বলছি।
মিঠু কে?
কী আশ্চর্য! ওই প্যারটটা।
ও আর কী বলবে? ক্যাঁ ক্যাঁ করে চেঁচাল খানিকটা।
উঁহু, আমাকে হারিয়ে দেবার বিজয়গর্ব ফুটে উঠল অবনীশের মুখে।
সীতা হেসে বলল, ও বলল হু ইজ দ্যাট, হু ইজ দ্যাট। আশ্চর্য ইনটেলিজেনট পাখি। একটা মানুষ বাচ্চার সঙ্গে কোনো তফাত নেই।
অবনীশ বলল, চন্দনা জাতীয় বুঝলি। আমি আবার ল্যাটিন নামটা মনে রাখতে পারি না। আয় এদিকে আয়।
ওকে অনুসরণ করে যাই। ওদিকে সোফায় সীতা বসে আছে। তার টি শার্ট শোভিত কাঁধে চন্দনা। হঠাৎ একটা সবুজ ঝলকানি তারপরই আমার মাথায় খটাস করে লাগল। উঃ আমি মাথাটা সরিয়ে নিই।
নটি বয়, যাও মিঠু মায়ের কাছে যাও, যাও, … অবনীশের গলায় আদেশের সুর।
সীতা বলল, হি ইজ জেলাস, বুজলে উদোয়। অবনী যে তুমাকে আদর করে নিয়ে যাচ্ছে, কাঁধে হাত রেখেছে! হিজ পা হ্যাজ টু বি ওনলি হিজ।
অবনী তাড়াতাড়ি আমার মাথাটা দেখল, রক্ত-টক্ত কিছু বেরোয়নি নাকি। তবু অবনী একটু ফার্স্ট এইড দিল। মাথার ভেতরটা ঝনঝন করছে আমার। সীতা বলল, জেনার্যালি হি ইজ ভেরি ওয়েল-বিহেভড, আসোল কথা, হিংসা হচ্ছে।
এখন মিঠু তার ডান হাতের উলটানো পাতার ওপর। এই ভঙ্গিতে মোগল বাদশাদের ছবি পাওয়া যায়। তাঁদের হাতে অবশ্য চন্দনা থাকে না, থাকে শিকরে বাজ। তা এই বা কম কী?
আমি সংক্ষেপে বলি, ওরে বাপ।
সত্যিই রে উদয়, ও একদম এসব করে না। পার্ফেক্ট ম্যানার্স একেবারে।
আমি বলি, আমি খারাপ লোক বুঝতে পেরেছে আর কি! আমাকেও ওয়ার্নিং দিল, তোদেরও সাবধান করে দিচ্ছে।
এই যাঃ, সীতা বলল, তুমি মাইন্ড করেচো। এক্সট্রিমলি সরি, উদোয় আ অ্যাম গোয়িং টু পানিশ হার।–সে পাখিটার ওপর তার বাঁ হাত চাপা দিল, তারপর তাকে তার তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে খাঁচায় পুরে দিল।
কাঁ কাঁ কাঁ, পাখিটা চিৎকার করেই যাচ্ছে।
নো মা। অ্যাম নট ইয়োর মাদার এনি মোর।
সীতা চলে এল। কী আশ্চর্য! পাখিটাও ঘাড় গুঁজে কেমন একটা ঝিমিয়ে মতো বসে রইল। ঠিক যেন একটা বাচ্চা দুষ্টুমি করে বকুনি খেয়ে মুখ গোঁজ করে, নীচু করে বসে আছে।
ততক্ষণে আমরা লিভিংরুমটার শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। লম্বা লম্বা ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড সরে গেল। কাচ দিয়ে সমস্তটা ঢাকা, তার ওদিকে একটা রীতিমতো জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ঘন কালচে সবুজ পাতা-ঝরা-গাছের অরণ্য। বাড়ি আর জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটা চওড়া নালার জল বইছে। তাতে দু-চারটে হাঁস।
অবনীশ বলল, ওই যে জঙ্গলটা দেখছিস ওটা আমাদের। ওই স্ট্রিমটাও।
আমি জীবনে এই প্রথম কোনো জঙ্গল এবং নালার মালিক দেখলাম ভাই। আমি বলি।
আরে এখানে সাবাবে অনেকেরই এমন জঙ্গল আছে। জঙ্গলই বলিস, বন বাগানই বলিস!
মানে!
ওয়াইল্ড গার্ডেন ধর। আমাকে রীতিমতো মেনটেইন করতে হয়। সময় মতো ডাল-ফাল কাটানো, নীচেটা পরিষ্কার করা। এ সবের লোক পাওয়া যায়। তবে আমাদের স্পেশ্যাল অ্যাকুইজিশন হচ্ছে ওই নালাটা, হরিণ জল খেতে আসে। চাঁদনি রাতে যা লাগে না!
হরিণও আছে তোর জঙ্গলে? তুই তাহলে হরিণযুথেরও ওনার?
না তা নয়।–ও বলল, হরিণরা রাস্তা ক্রস করে জঙ্গল পেরিয়ে অন্য জঙ্গলে চলে যায়। যাবার স্বাধীনতা তাদের আছে। আমার জঙ্গল বলে তাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমি ঘিরতে পারি না। দিস ইস আ ফ্রি কানট্রি।