ম্যানেজমেন্ট মৃদু হেসে বললেন, উই আন্ডারস্ট্যান্ড। ইউ হ্যাভ স্কোর্স অব রিলেটিভস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস দেয়ার।
গৃহিণী নিপুণভাবেই সব গুছিয়ে দিলেন। কিন্তু অবিকল, যেতে নাহি দিব-র স্টাইলে। চক্ষু ছলছল। কারণটা অবশ্য আলাদা। তিনি কেঁদেছিলেন বিশুদ্ধ পতিবিরহে। ইনি ফোঁপাচ্ছেন মজা মারতে নিজে যেতে পারছেন না বলে। বাড়ির বিচ্ছু দুটোও সমানে তালে তাল দিচ্ছে। রিনি বলল, বলছ দেড় মাস, কিন্তু ভিসা তিন মাসের। দেড় মাসের বেশি থেকেছ তো বাবা আমিও অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি কি ইংল্যান্ডে সেটল করছি। তার ভাই রণো আবার এক কাঠি বাড়া। সে বলল, আমি তো ভাবছি হায়ার সেকেন্ডারিটা হলেই জি. আর. ই, তারপরই স্টুডেন্ট ভিসা। এবং মার্কিন মুলুক। এখন সেটাই করব না এই পচা কাঁকুড়গাছিতে পচা বাবার পচা বাড়িতেই পচব, সে সিদ্ধান্তটা নির্ভর করছে বাবার সময়মতো ব্যাক করার ওপর। আমি মনে মনে বলি—বাবার কিছুর ওপরই কিছু নির্ভর করছে না। বাপধন, সেটা শর্মা জানে।
প্রসঙ্গত আমার মেয়েটি যাদবপুরে সিভল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। অঙ্কে খুব মাথা ছিল। আমার পরামর্শ ছিল অঙ্ক নিয়ে পড়া। মুচকি হেসে ইঞ্জিনিয়ার হতে চলে গেল। ছেলে শুনেছি চান্স পেলে ডাক্তারিও পড়তে পারে। আবার না পেলে ইতিহাসও পড়তে পারে। ওদের ব্যাপারস্যাপার আমি বুঝি না।
আমার মা আবার আর এক। তিনি বললেন, আমিও তাহলে বাপের বাড়ি চলে যাব। বোঝে ঠ্যালা। চুয়াত্তর বছর বয়সে মহিলা অরিজিনাল বাপ-এর বাড়ি কোথায় পাবেন তা তিনিই জানেন।
যাই হোক, এদের কাটিয়ে তো কোনো মতে ব্রিটিশ প্লেনে ওঠা গেল। এ ঘটনা এগারোই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর পাঁচ বছর আগেকার। কাজেই সহযাত্রীদের আগাপাশতলা জরিপ করার দরকার পড়েনি। ডাউনটাউন নিউ ইয়র্কে ঘোরবার সময়ে কোনো সন্দেহজনক আঁশটে গন্ধও পাইনি। বেশি কথা কি ওই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় টাওয়ারটার পনেরো তলাতেই আমার বেশিরভাগ কাজকর্ম ছিল।
প্রতিদিনই ফোনে অবনীশ আর সীতার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল। আমার হোটেলে ফেরার ওয়াস্তা। পি পি করে ফোন বাজবে।
কী রে লম্বু! ব্যাটা সেটল করিচিস?
এক্ষুনি সেটল করব কী রে?
আরে ফর দা টাইম বিয়িং। চান করিচিস? এক পাত্তর নিয়ে বসিচিস?
সময় দিলি কোথায়? এই তো ঢুকছি।
এই ঢুকছিস বলে নাঙ্গাবেলার বন্ধু ফোন করবে না?
করবে না কেন, কিন্তু চান টান, সেটল-ফেটল, এক্সপেক্ট করবে না। …
কিংবা হয়তো সত্যিই চান সেরে এক পেগ নিয়ে বসেছি, সঙ্গে সোনালি চিংড়ি ভাজা। ফোন এসে গেল, উদোয় আছে?
উদয়ের ঘরে আর কে থাকবে ম্যাডাম? বুধোয়?
আমি আর অপেক্ষার সহ্য হচ্ছে না, তাড়াতাড়ি কোরো।
এতই যদি অধৈর্য তো গ্যাঁটের ডলার খর্চা করে একটা রিটার্ন-টিকিট কিনে পাঠিয়ে দিলেই তো পারতেন দেবী! দিব্যি হলিডে করতে আসতে পারতুম! যে অফিস পাঠিয়েছে তার ফাইল বগলে সারা মাস চরকি-নাচন নাচতে হত না।
সরি উদোয়। যু আ রাইট। নেক্সট টাইম আর ভুল করছি না। যা হোক, ছাড়া পেলেই আসছ তো?
আর কোন চুলোয় যাব দেবী, এক কাজিন থাকে ক্যালিফোর্নিয়া, শ্বশুরবাড়ির দিকের এক আত্মীয় থাকেন ফ্লরিডা, তা সেসব জায়গায় যাবার কড়ি আমার নেই আজ্ঞে।
যাক, তুই সেই আগের মতোই আছিস রে লম্বু!–অবনী বোধ হয় শুনছিল, ফট করে বলে উঠল।
তুইও তো আগের মতোই আছিস। ঠিক আড়ি পেতেছিস? তোর শ্যোন চক্ষু শ্যোন কর্ণ ফাঁকি দিয়ে যে বউ একটু পরকীয় করে নেবে তার উপায়ও রাখিসনি।
দুজনেরই ইচ্ছে আমাকে নিতে নিউ ইয়র্ক আসে। একটু শহর দেখায়। কিন্তু এখানে আমার অফিসতুতো এক পূর্বতন সহকর্মী থাকেন। বিপত্নীক মানুষ, দুই ছেলের একজন কানাডার মনট্রিঅলে। আর একজন ইউ.এস.এ-তেই এইমস-এ। নিউ ইয়র্কে কেউই থাকে না। ভদ্রলোক আমাকে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে নিউ ইয়র্কের থিয়েটার, পার্ক, মিউজিয়াম, স্টাচু অফ লিবার্টি, মায় লং আইল্যান্ড পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখাবার ভার নিয়েছেন। তাঁর উৎসাহেই বা জল ঢালি কী করে? এক মানুষ, সঙ্গী পেয়ে আর ছাড়তে চান না।
সেই মি, বাগচিই আমাকে অ্যামট্রাকের নীলবরণ ট্রেনে তুলে দিলেন। আমাদের এখানে একদম গোড়ায় ইলেকট্রিক ট্রেনগুলো এইরকমই ছিল। শুধু রংটা আলাদা। হুশশশ করে মফসসলি প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই।
সবুজ-স্টেশনে দুই মূর্তি হাজির। অবনীশের মাথা প্রায় ফাঁকা। কিন্তু চেহারাটি একেবারে পেটা। পঞ্চাশোধেঁ পেটে-ফুটবল নেই সফল স্বজাতীয় আমি দেখিনি। বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে, বাঙালিদের মধ্যে হার্ট ট্রাবল বেশি, কারণ এই ফুটবলের ধাক্কা। সীতার সবচেয়ে সৌন্দর্য ছিল তার চুলে। সেই চুল দেখি কেটে ফেলেছে। তা ছাড়া একটু গায়ে সেরেছে। গাল-টালগুলো একটু বয়ঃভারী। ব্যাস।
কী করে চেহারাটা এমন ফিট রেখেছিস রে?
বন্ধু বলল, খর্চা আছে! খাটনি আছে!
আমাদের শুভদীপ য়ুনিভার্সিটি ব্লু ছিল, মনে আছে? এখন তাকে দেখলে চিনতে পারবি না। ছ-ফুট ব্যাসের একটি প্রকাণ্ড বল।
অবনীশ গর্বের হাসি হেসে আমার পিঠ চাপড়ে দিল।
তোকেও কিছু আধবুড়ো লাগছে না, তবে এইবেলা যদি সাবধান না হোস তো ফুটবল না হোক একটি টেনিস বল তোর প্রাপ্তি হবেই। শরীরটা আলগা হতে থাকবে। তার হাইটটাই এখনও তোকে বাঁচাচ্ছে।