শাড়িটা প্যাকেট থেকে খুলে বার করেন মোল্লাসাহেব। ছাপের কাপড়। নানান রঙের হোরিখেলা। বিবি পরবেন ভালো। মোল্লাসাহেবের তত মনোমতো হয় না। কিন্তু তিনি বলেন, সুন্দর, চমৎকার। হেসে উঠছে কাপড়, আপনার এই বাড়ির মতো। সালাম, সালাম। কাঁধে ঝোলাঝুলি নিয়ে নীচে নেমে যান মোল্লাসাহেব।
ও ওয়াজিদ আলি শা সাহেব…একটু দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান। হাঁফাতে হাঁফাতে ছোট্ট জমি দিয়ে ছুটে আসে খুকিসাহেব।
ঘাসের জমিতে সবুজ টিলটিল করছে। বেগুনি আভা সাঁঝের গায়ে। মিহি কাঞ্চন রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে খুকি। চওড়া জাম রঙের পাড়। ভেতরে জরির সুতো, কালো সুতো চমকাচ্ছে। আর জামাতে বেশ খলখলে হাসকুটে কালো, কালো না মেহগনি, বুঝি খুকিও ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে। কোনো উৎসবে যাবে বোধহয়।
অন্যতম হয়েছে? …
হাসি দাড়ি বেয়ে টাপুর টুপুর ঝরে।
হয়েছে, হয়েছে।
আর বিকল্প?
চতুর্দিকে হাতড়ান মোল্লাসাহেব। বিকল্পটি কি ঠিক হল? বিকল্প বলে কি তিনি সবসময় এক কথাই বোঝাতে চান? বিকল্প মানে এখন, এখানে অবিকল্প। সেরকমটি? হয়েছে কি?
খুকি রিনরিন করে হাসে। বোঝার চোখে তাকায়।
বিকল্পটা ঠিক হল না, না শা সাহেব?
হল না কি?—হাঁ হাঁ করে ওঠেন ওয়াজির মোল্লা—এখন এক্কেবারে বেগমসাহেবা। হানডেড পার্সেন। দুজনেই ষড়যন্ত্রীর মতো হাসতে থাকেন। একটা যে রঙ্গ হয়ে গেল সেটা উভয়েই বুঝেছে। শিল্পীর চোখে বিকল্প অর্থাৎ অবিকল্প?
তাও কি সম্ভব?
আচ্ছা চলি বেগমসাহেবা…
আবার আসবেন ওয়াজিদ আলি শা সাহেব…
ওয়াজির মোল্লা কিছু দূর চলে গিয়েছিলেন। ঘুরে দাঁড়ান।
ওয়াজিদ নয় কিন্তুক। ওয়াজির…ওয়াজির মোল্লা। খিদিরপুরে বাস নয়, কাজকাম করি ওখানে, নাহারবাবুদের ফ্যাকটরিতে। সাকিন নপাড়া বাগনান, সাউথ ইস্টার্ন রেলোয়ে।
নিজস্ব শিল্পভাবনার অবিকল্প নিশানখানা কাঁধের ওপর প্রশান্ত গর্বে তুলে ধরে নতুন পাড়ার দিকে রওয়ানা দেন ওয়াজির মোল্লা। কোনো ইতিহাস, পুরাণ কিংবদন্তির সঙ্গে অন্বিত হতে চান না। কিছুতেই।
আকাশে পাখিরা
কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবনীশ আর সীতার সঙ্গে বহুকাল পরে দেখা হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট, ওরা বলে কানেটিকাট স্টেটে। বাঙালি ছেলে অবনীশ আর আমেদাবাদের মেয়ে সীতার প্রেম আমাদের মধ্যে বেশ জল্পনাকল্পনার বিষয় ছিল। আন্তঃপ্রদেশীয় বিয়ে! অবনীশের বাড়ি শেষ পর্যন্ত মানবে কি না, সীতার বাড়ি থেকে আপত্তি উঠবে কি না, ওরা দুজনে শেষ অবধি অ্যাফেয়ারটা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না? তা, সত্যিই কোনো পক্ষ বাদ সেধেছিলেন কি না জানি না। অবনীশ চটপট মার্কিন দেশে একটা ফেলোশিপ জোগাড় করে চলে গেল। বছরখানেক পরে গেল সীতা। ও বরাবরই দুর্ধর্ষ ছাত্রী ছিল। সব দিক থেকেই চৌখশ। প্রথমে গেল কলম্বিয়া, কী সব ম্যানেজমেন্ট-টেন্ট করল। তারপর দু-জনেই এই কানেটিকাট। ওখানেই ওদের বিয়ে, ওখানেই ওদের স্থিতি। এই তিরিশ বছরে একবারও আসেনি। কিংবা হয়তো এসেছে আমি জানি না। এলে আমাকে জানাবে না এটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে ঠিকই। কিন্তু এতগুলো বছর ধরে নতুন বছরের কার্ড আর পুজোর সময়ে সংক্ষিপ্ত চিঠি বাদে যাদের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন, এ ধরনের খেলাপ তাদের মধ্যে হতেই পারে। তা সত্ত্বেও আমি যখন বিশেষ কাজে নিউইয়র্ক যাবার একটা সুযোগ পেলুম, তখন আমার প্রথম। কাজই হল ওদের একটা বিস্তারিত চিঠি লেখা, পরিবর্তিত ফোন নম্বর সহ। ঠিক তেরো দিন পরে ওদের ফোনটা পাই।
কী রে লম্বু, আমাদের মনে পড়ল তাহলে?
তাহলে তুই বাড়ি আছিস?, আমি বলি।
কেন? রাত এগারোটায় বাড়ি থাকব না কেন?
আমি হাসি—অবনীরা শুনেছি বাড়ি থাকে না!
একটু সময়! তারপয়েই অবনীশের মার্কামারা হাহা হাসি। যেটাকে আমরা হাহাকার বলতুম। যাক, হাসিটা যখন এক আছে, মানুষটাও খুব বদলাবে না। এই সময়ে বোধহয় অবনীশের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল সীতা।
উদোয়, তুমার তো ওপন টিকেট। আমাদের এখানে অন্তত মাসখানিক থাকবে কিন্তু।
সীতার ভাঙা বাংলা আমরা বরাবরই উপভোগ করেছি। মজার এবং মিষ্টি, দুটোই। জানি না বাঙালিরা যখন অন্য ভাষা এমনি ভাঙা ভাঙা বলেন, তখন সেই ভাষাভাষীরা সেটা আমাদের মতো সানন্দে উপভোগ করেন কি না। আমরা নিজেরা কিন্তু খুবই অপ্রস্তুত হই। লজ্জা পাই। সীতা দিব্যি স্মার্টলি তুমার, অ্যাকন, কেন কি, হামরা চালিয়ে গেল।
আরও কিছুক্ষণ ওদের উচ্ছসিত আলাপ চলল। মাঝখানে এতগুলো বছর কেটে গেছে বলে মনে হল না। আমার এক মেয়ে, এক ছেলে শুনে ওরা জানাল ওদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। টেলিফোনের তারের মধ্যে দিয়ে যেন উৎসাহের ঝড় বয়ে গেল কিছুক্ষণ।
অবনীশ বলল, চলে আয়। আমরা পথ চেয়ে বসে আছি। তোকে সময় দিতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমি একটু-আধটু ছুটি ম্যানেজ করতে পারব। সীতাটারই একটু মুশকিল…।
কথা শেষ হল না, সীতা বলে উঠল, অবনী কীকর্ম একলা ষাঁড় থেকে যাচ্ছে দেখেছ? আমি মোটেই অসুবিধে করব না। আমরা তিনজনে খুব ঘুমব।
বুঝতেই পারছেন এ ঘুম সে ঘুম নয়। এ হল ঘোরানোর উদাত্ত প্রতিশ্রুতি। সুতরাং অফিস ম্যানেজমেন্টের কাছে দরবার করি। আপনাদের কাজ ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা করে দেব কথা দিচ্ছি। কিন্তু পত্রপাঠ আমাকে ফিরতে বলবেন না। প্লিজ!!