সত্যি তো! কী স্মথ করে ফেলেছেন।
আরও করব খুকিসাহেব। তারপর ফেরেঞ্চ চক মাখাব। পাউডার মাখবেন সোহাগি আমার।
তেমন তেমন লাগসই উপমাগুলো ওয়াজির মোল্লা খুকির সামনে বলা উচিত মনে করে না। যত্ত চিকনচাকন হবে দেহখানি বিবির পালিশ তো তত্ত খুলবে! না কী?
তা এইটুকু শুনেই খুকির মুখ সামান্য লাল হয়। সে বলে ওঠে, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনার চা-টা হল কি না দেখে আসি।
বড়ো গেলাসের চায়ে পাঁউরুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে তৃপ্তি করে খায় ওয়াজির মোল্লা।
এ মা, বর্ডারগুলোতে কালো দিলেন কেন?
উ হুঁ হুঁ। কালো নয়। কালো বলেন না। ও হল ডার্ক মেহগানি। যত শুকোবে তত খোলতাই হবে। হাসতে থাকবে। এই যে ভেতরে? সব ওয়ালনাট ফিনিশ দিইছি। দেখে ন্যান, ধারে ধারে একটু অন্যতম রং চাই, বুজলেন? অন্যতম কিছু। আবার ধরেন আপনাদের শয়নের ঘরে একরকম, তো বসার ঘরে বিকল্প চাই। সবখানেই ওয়ালনাট মেহগনি হলে হবে না। রোজউড দেব ক্যাবিনেটটাতে, দেখবেন চোখ যেন স্তম্ভিত হয়ে থাকতে চাইবে। একেবারে বিকল্প।
খুকি অনেকক্ষণ ধরেই হাসছিল,বলল, আপনি লেখাপড়া জানেন, না?
কই আর জানলুম খুকি।
খুকির বাবা এসে ডাকেন, মিস্ত্রি।
নতুন রং করা চেয়ারে বসলাম, গ্লেজ তো উঠে গেল।
তা তো যাবেই সাহেব।
সে কী! তাহলে এত কষ্ট করে খরচা করে পালিশ করার মানে কী!
আহা এখনও তো ফিনিশ হয়নি। শেষ অস্তে ল্যাকার পালিশ চড়াব। চক্ষে ধাঁধা লেগে যাবে।
গ্লেজ?
উঠবে না সাহেব। দশটি বচ্ছর চোখ বুজে থাকতে পারবেন।
পারলেই ভালো। সাহেব গটমট করে চলে যান।
হ্যাঁ কী যেন বলছিলেন! খুকি সুযোগ পেয়ে কাছিয়ে আসে।
কী আবার!
ওই যে অন্যতম, বিকল্প …ভালো ভালো কথা বাংলা রচনা বই থেকে?
ওই সেই কথা? এই যেমন ধরুন, খুকিসাহেব আপনারা আজকালের মেয়েরা সব ম্যাচিং দ্যান না? ফলসা রঙের শাড়ি, তো সেই রঙের সায়া, সেই রঙের জামা! মনে কিছু করবেন না, সরবো চেহারা লেপেপুঁছে খেদিকুঁচি লাগে।
খুকি আর হাসি সামলাতে পারে না।
আপনি হাসছেন? আমি যখন একেকটি ফার্নিচার সাজাই, তাকে জামা পরাই, সায়া পরাই, কাপড় পরাই, তকন আমার ওই লেপাপোঁছা মনে ধরে না। একটা কিছু অন্যতম খুঁজি। কেমন জানেন? লাহা বাড়িতে কাজ করতে গেছলুম। সে কি আজকার কথা! সে এক অন্যতম কাল! তা সে বাড়ির মেয়েরা সব হুরি রূপসি। আশি নম্বর একশো নম্বর কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে ঘষে তবে তেমনতরো তেলা চামড়া হয় খুকি, তারপর খালি সবেদা দিয়ে সাদা গালার পোঁচ, সর-হলুদ বাটা আর কমলালেবুর খোসা,গ্লেজ কী! চোখ পিছলে যায়।
পিছলে যায়? আটকে থাকে না? খুকি হাসি চেপে দুষ্টু প্রশ্ন করে।
উঁহু, রজন পাইল দিলে চিটে হবে, ওইখানেই তো পালিশের সরবো কারিগরি।
আহা পালিশ নয়, ওই লাহা বাড়ির সুন্দরীদের কথা কী যেন বলছিলেন?
ও হ্যাঁ, তা ওনারা পরতেন ধবধবে সাদা খোলের কাপড়। তাতে ভোমরাকালো, কিংবা খুনখারাবি লাল রঙের পাড়। জামা পরতেন ছিটের। লালের মধ্যে হলুদ কালো সবুজ চিকিমিকি। আর সায়াটি থাকত ধোয়া গোলাপি।
এ মা! কী বিচ্ছিরি!
হাঁ হাঁ করে ওঠে ওয়াজির মোল্লা। না না। একেবারে বিকল্প। ওই যে সবটি লেপাপোঁছা, হল না, অন্যতম রঙের খোয়ব রইল, তাতেই রূপগুলি বিকল্প হয়ে উঠত। এই যে বর্ডার দিচ্ছি, একটা জমিনকে আলে আলে বেঁধে দিচ্ছি, এতে করে আপনার আপন হয়ে যাবে দ্রব্যটি। উদোম মাঠ নয়, যেটা বারোয়ারি। একটা ধরুন শস্যক্ষেত্র। কেমন? নয় কি?
খুকি এখন আর হাসছে না। অভিনিবেশ সহকারে শুনছে। একটু পরে সে উঠে গেল।
বাড়িটি চমৎকার সেজে উঠেছে। ওয়াজির মোল্লাসাহেব দেখছেন। ঘরের মধ্যে যেন চাঁদনি। এমনধারা চাঁদনিতে মানুষের প্রকৃত মুখটি এই ধরা পড়ে, তো এই পড়ে না। একঘর আলো, তা বুঝি তার কতকগুলান উঁচার দিকে মুখ। মানুষগুলিকে মনে হয় খোয়াবে দেখা হুরি পরি জিন জাদুকর। হ্যাঁ জাদুকরও আছে। মোল্লাসাহেব বড়ো আয়নায় দেখছেন, তিনি নিজেই যেন জাদুর মানুষ। ভুষো কালি আর শ্বেত গালাতে মিলেমিশে ছোটো দাড়ি। হাতের কালচে চাম ইস্পিটের অ্যাকশনে উঠে উঠে যাচ্ছে, কাজের লুঙ্গি আর গেঞ্জিটি আলাদা করে রাখলেও ছাপছোপ পুরোপুরি এড়াতে পারেননি। পেলে একটু আধটু নানা রঙের পোঁচ লেগেছে। হলঘরটি যেন সিনেমা হল। তার মধ্যে ফার্নিচারে আলো ঠিকরোয়, ভালো গোমেদ পাথরের কাটিং যেন।
দুটো হাঁড়ি ওপর ওপর বসানো। ফরসা পুরোনো কাপড়ে বেঁধে দিচ্ছেন কর্ত্রী।
মিস্ত্রিসাহেব, ছেলেমেয়ে বিবিদের দেবেন গিয়ে।
কী আছে মা এতে? … দাত্রী রমণীকে আজ মা ডাকতে ইচ্ছে যায়।
লেডিকেনি আছে। আর রসগোল্লা…ভালোবাসেন তো?
হ্যাঁ মা…চমৎকার ভালোবাসি সব।
সন্ধে হয়ে গেল আজ শেষ দিনে আপনার…আর এই শাড়িখানা…পছন্দ হয়?
আপনার পছন্দ হয়েছে মাওয়াজির চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন, দেখান।
খুব। আবার দরকার পড়লে ডাকব আপনাকে। খোদা করুন, ডাকবার দরকার না হয় মালিক। বিশ বচ্ছরের কাম ফতে করে গেছি। রাখতে যদি পারেন। পানি আর রোদ্দুর এই দুই হল পালিশের দুশমন। পাতলা কাপড় দিয়ে মোলায়েম করে মুছে দেবেন, বাস। আর পাড়া-পড়োশন, ভাই-বহেন এঁদের কাছে যদি সুপারিশ করেন তো…আজকাল তো পালিশ লোকে করায় না, সব তেল রং আর পেলাস্টিক রং, হাউহাউ চিৎকার করছে। পালিশের কদর ওই বনেদি বাবুরাই করেন। বিকল্প কিছু…।