আমার মাকে দিদিসাহেব ডাকলেন কেন?
কর্ত্রী চলে যেতে খুকিটি আবার জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নের তার শেষ নেই।
কেন? ভুল হয়েছে কিছু?
না, ভুল নয়। সবাই তো মা, বউদি এসব বলে। ও, আপনাদের বউদি নেই, না?
ওয়াজির মোল্লা কাঁধের কিনার দিয়ে চিবুক চুলকাতে চুলকাতে ভাবতে থাকে।
তাই তো? দিদিসাহেব কেন? এই ডাকগুলান মুখ দিয়ে আপসে বেরিয়ে যায়। এখন তার কার্যকরণ বাতলাও এই কৌতূহলী বালিকার কাছে। মাথায় সিন্দুর নাই। ঘোমটা নাই। খাটো চুল গুছি গুছি পিঠ ঝেপে আছে। ঝুলঝুলে দুল। গলায় ঝুটো পাথরের দেখনাই হার। হাতেই-বা কী? একটা হাতঘড়ি। একটা কাঠ না কিসের বালা। এমন ধারা শো হলে মা ডাকটা ঠিক হয় না। দিদিই ঠিক। কিন্তু এসব কথা খুকিকে বলা যাচ্ছে না। সে খানিকটা প্রশ্নের উত্তর বেমালুম উড়িয়ে এড়িয়ে বলে সাহেব মানে একটা মান, একটা সনভ্রম, বোঝেন তো?
খুকি আবারও প্রচুর হাসে। সনভ্রম? কী বললেন? সনভ্রম?
খুকি বলতে ঠিক যতটা বাচ্চা হওয়া দরকার, এই খুকি কি ততটা? উলিথুলি চুল। চক্ষু দুটি ডাগর। তাতে ভাসে কৌতুক, কুতূহল, কোশ্চেন, ছোট্টখাট্ট, সবই ঠিক। কিন্তু খুকি খুকি শো থাকলেও এঁর সোমত্ম বয়স হয়েছে। ঢলঢলে কামিজ তবু বোঝা যায়। তা ছাড়াও, চলনবলন ছোটন-দাঁড়ান, কাজকম্মের একটা গোছ ধরন সবই ওই কথাই বলে।
তুমি ইস্কুলে যাবে না?
আমি কলেজে পড়ি, সেকেন্ড ইয়ার। ওরে বাবা! সেকেন কেলাস একেবারে? তবে তো খুব ভুল হয়ে গ্যাছে। খুকিসাহেব? তা আপনি কলেজে যাবেন না?
টেস্ট হয়ে গেছে, এখন আর যেতে হয় না।
বা বা–বাহবাটা কেন দিল মোল্লা তা জানে না।
শীতের বাতাসে বেশ আঁচ লেগেছে। শুখুটে শুখুটে দিনগুলো। পুরোনো সামান সব ঘষেমেজে, বাটালি দিয়ে চেঁছে ফেলে, নতুনের সঙ্গে তাকে মানিয়ে-গুনিয়ে কাজ। দরজার এড়ো, ক্যাবিনেটের পাওট সব নতুন করে বাদাম কাঠ মাপসই করে করা। এখন আর সব মিস্তিরি জববর, গোপাল, মুন্না—সব কটিকে বিদেয় করে দিয়েছে। একটু একটু কবে সাজিয়ে তুলতে হবে এখন সব। একা একা। অভিনিবেশ চাই তো না কি? শীতের শুখে থাকতে থাকতে সারতে হবে।
যবে থেকে একলা কাজ করছে আপন মনে, খুকিটি সেই ইস্তক সেঁটে আছে। অবিশ্যি সেঁটে বলতে ঠিক সেঁটে নেই। মাঝে মাঝে একেবারে অদর্শন হয়ে যায়। তারপর ঘুরছে ফিরছে, কাছে এসে বসছে, এটা ওটা নাড়ছে চাড়ছে। আর ফুলঝুরির মতো কোশ্চেন।
আরে সববনাশ, ও ঢাকা খুলেন না, খুলেন না।
কেন?
ইস্প্রিট সব ভোঁ হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে পানি। জল।
জল? স্পিরিটে জল?
একটু আধটু ভেজালি এই লাইনে সবাই দিচ্ছে খুকি, কাকে ফেলে কাকে ধরবেন?
কী করে বুঝলেন জল আছে?
এই দ্যাখেন, নিজের মোটা মোটা খসখসে আঙুলগুলি মেলে ধরে ওয়াজির!
চামড়া কেমন কুঁকড়ে উঠেছে দেখেছেন? এই হল গিয়ে পানির নিশানি। … মনোযোগ দিয়ে দেখে খুকি।
স্পিরিট শুদ্ধ থাকলে কী হত?
পেলেন থাকত চামড়া।–স্পিরিটের মধ্যে গালা ঢালে ওয়াজির।
কী দিলেন ওগুলো?
গালা, কুসমি গালা খুকিসাহেব।
কুসমি? কুসমি কেন?
ডিমের কুসুম দেখেন তো? তলতলে কাঁচা-সোনা বর্ণ? সেইমতো হল গিয়ে বাজারের সেরা গালা। ফার্নিচারে মারলে কাঠের ওরিজন্যাল রংটিই ধরবে। এমন ঝিলিকদার হবে যে, এদিক থেকে লাইট মারলে ওদিকে পিছলে পড়বে।
তা অ্যাত্তো সব হাঁড়ি-কুঁড়ি বাটি-ঘটি নিয়ে কী করছেন?
খেলা করছি। রান্নাবাড়ি—ছোটো ছেলেরা খেলে না?
খেলাই তো!
খেলা, কিন্তুক কেমন জানেন? পরানপনের খেলা।
কেন এর মধ্যে আবার প্রাণপণের কী হল?
ও আপনি বুঝবেন না খুকিসাহেব। এ হল গিয়ে রং ফেরাবার খেলা। একেকটি খোরায় জানের একেকটি ধরে রাখছি।
দেখি দেখি কেমন আপনার জানের রং।
তো দ্যাকেন, এই রং মেহগনি, ডার্ক ব্রাউনের সঙ্গে ভুষো কালি, একটু এই অ্যাতেটুকু সিন্দুর…
সিন্দূর?
বাঃ, আপনারা সাজেন আর আপনাদের ফার্নিচার সাজবেন না। সিন্দুরে, আলতায় কাজলে, সুর্মায় সাজবেন বইকি! তারপর কাপড় পড়বেন ঝাঁ চকচক!
কী কাপড়? সিনথেটিক তো? নাইলন। … এতক্ষণে খুকি খেলাটা ধরতে পেয়েছে।
না খুকিসাহেব, ওরে কি কাপড় কয়? পরবে বেনারসি, তসর, মুগা, বিষ্ণুপুরের বালুচরি।
ওরে বাবা! কই বেনারসি, তসর এসব কই?
বানাচ্ছি। খাপি মিহিন খোলে। এমন গ্লেজ দেবে যে সিল্কের সঙ্গে তফাত করতে পারবেন না। চোখে ঝিলিক মারবে।
সবই তো দেখছি একরকম!
আরে সাহেব, সবই একরকম হলে কি আর এত ছাবাছোবার দরকার হত? এই দ্যাখেন এরে কচ্ছে ওয়ালনাট। বড়ো বড়ো হৌসে এই রং লাগায়। আই. সি. আই, আই. টি. সি., টাটা স্টিল…। ওয়ালনাটেরই কি আর একরকম? তিন-চার রকম আছে খুকি। আপনারা হয়তো দেখে কইবেন মেহগনি। যে জন জানে সে জন বুঝবে।
খুকি একটা কাঠের টুকরো তুলে নিল, বলল, বাঃ, খুব সুন্দর তো ধরিয়েছেন রংটা।
ধরাব না? আপনার মা-বাবা এসে স্যাংশন দিবেন তবে না? কাঠের পিসে সবরকমের ধরতাই দিয়ে রাখছি।
এতে কী দিয়েছেন?
কিচ্ছু না, কুসমি গালার রসের সঙ্গে এই অ্যাটুকুনি বেগনি রং।
তাতেই এই টিন্টটা এসে গেল?
তাতেই। তারপর আছে ঘষামাজা। আপনার মাথা ঘষেন না? একবার দুবার। তারপর মুখে কিরিম দাও, মোছো, আবার মাখো, আবার মোছো…এই সুন্দরীদেরও তেমনি। মাখবেন, তুলবনে, মাখবেন, তুলবেন। তবে না গ্লেজ আসবে। মুণ্ডু ঘুরবে দেখনদারের। এই তো সাইডটায় হাত দিয়ে দ্যাখেন।