অঞ্জু আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। শ্রাদ্ধবাসর থেকে সবার অলক্ষ্যে সে পথে নেমে এসেছে। একটা মন্ত্রের ঘোর, একটা দৃষ্টির সম্মোহন তাকে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাচ্ছে। আদিগঙ্গা।
মাতৃশ্রাদ্ধ করবেন? অপঘাত? তা মস্তক মুণ্ডন করেননি কেন? অশৌচান্ত কোন পুরুতে করাল? আমি পারব না মশায়। ওই দিকে দেখুন গেঁজেল ঠাকুর রয়েছে। ওই যে থামে ঠেস দিয়ে! ওর কাছে যান। ও রাজি হয়ে যাবে। যত তো অশাস্ত্রীয় কাণ্ড…।
কয়েকবার ডাকবার পর গেঁজেল ঠাকুর লাল চোখ মেলে বলল, বেশ বাবা, বেশ বেশ। মাতৃশ্রাদ্ধ করবে, কিছু নেই? আরে বাবা স্বয়ং পৃথিবী মাতা এত থাকতেও নিঃস্ব। কিছু নেই তাতে লজ্জা কী? প্রকৃত বস্তু হচ্ছে অন্ন, জল আর শ্রদ্ধা। আর সব ভেবে নিলেই হবে। সবই বাহ্য। অন্ন আর জলের সূক্ষ্ম অংশ আত্মা নেন। তা বাপু, ক-টি টাকা দাও, অন্নজলটুকুর জোগাড় করি।
চান করে এসো।
করেছি।
নব বস্ত্র পরো।
পরেছি।
তা একরকম ঠিকই বলেছ বাবা। একই বস্ত্র দেখার গুণে প্রতিদিন নতুন হয়ে ওঠে বই কি! সময়কে যদি পল-অনুপলের মালিক বলে দেখ, বস্তুকে যদি প্রতি নিমেষে লয় পেতে আবার জন্মাতে দেখ, তো নূতনে পুরাতনে কোনো ভেদ নাই। গঙ্গোদক একটু মাথায় দিয়ে বসো তবে। … নাম বলো মায়ের! মাধবী দেবী? বাঃ! গোত্র? মনু? এরকম কোনো গোত্রনাম তো শুনি নাই বৎস! পিতৃপুরুষের নাম বলো। পিতামহ?
মানব।
পদবি নাই? নিরুপাধিক? বেশ বেশ। তা, তৎপূর্বে? প্রপিতামহ?
মানব।
তৎপূর্বে?
ইনিও মানব? বা বা বা।
মাতৃকূলের নামগুলি জানা আছে বৎস? মাতামহ?
মানব।
নিরুপাধিক? প্রমাতামহ?
মানব।
তৎপূর্বে? বৃদ্ধ প্রমাতামহ? ইনিও মানবই হবেন নিশ্চয়! চমৎকার। তবে বলো বৎস—বিষ্ণুর ওম মনুগোত্রস্য প্রেতস্য মন্মাতুর মাধবীদেব্যা…..পিতামহস্য মানবদেবস্যে… মাতামহস্য মনুগোত্রস্য মানবদেবস্য অক্ষয়স্বৰ্গকামঃ এতদ অন্নজলং শ্রীবিষ্ণুদৈবত যথাসম্ভব গোত্ৰনাম্নে ব্রাহ্মণায় অহং দদানি।
অবস্থান
ওয়াজিদ? ওয়াজিদ আলি শা? খিদিরপুরে থাকেন বললেন না? কেমন উৎসাহিত উত্তেজিত গলায় বলল খুকিটা। ছুট্টে গিয়ে আজকালের সব টেপটাপ হয়েছে, সেই একখান চালিয়ে দিল, বাবুল মেরা নৈহার ছুট হি জায়, ঘুরে ঘুরে মিহিন। সানাইয়ের সুরে বাজতে লাগল টেপটা।
ভালো লাগছে? আপনার ভালো লাগছে এই গান? জ্বলজ্বলে চোখে খুকি বলে।
কী করবে? মাথাটা তালে তালে নেড়ে দেয় সে। ভালো আসলে লাগছে না ততটা। কিন্তু অত উৎসাহের আগুনে ফুস করে জল ঢালা যায় কি?
খুশি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে।
আপনার পূর্বপুরুষের লেখা গান। জানেন তো? নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি শা। ঠিক আপনার নাম। একেবারে হুবহু।
এত উৎসাহ, উত্তেজনা, গান-ফানের কিছুই বোঝে না সে।
ওয়াজিদ নয় খুকি, আমার নাম ওয়াজির, ওয়াজির…। আলি নয়, শা নয়, মোল্লা—থেমে থেমে বলে সে। গলার আওয়াজটা বড়ে গোলামের মতো না হলেও বেশ জোয়ারিদার।
মোল্লা? ওরে বাবা খুকি যেন চমকে ওঠে।
কেন? ওরে বাবা কেন?
সে আমি বলছি না জেদি ঘাড় দোলায় খুকি।
আমি বুজতে পেরেছি ওয়াজির মোল্লা দাড়ির ফাঁকে হাসে।
বুঝতে পেরেছেন তো? খুকির গলায় সোয়াস্তি। বস্তুত দুজনেই হাসে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ষড়যন্ত্রীর হাসি।
কিন্তু আপনাকে ওয়াজিদ আলি শা সাহেব বলেই ডাকব। কেমন?
এটা কিন্তুক বুজলুম না খুকিসাহেব। … ওয়াজির মোল্লা মন দিয়ে পাকা পুডিং, রজন জ্বাল দেয়। নুটি ঠিক করে মার্কিনের টুকরোর মধ্যে ঝুরো তুলো ভরে।
খুকিসাহেব?—খুকিটি ভীষণ হাসি হাসতে থাকে। লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ছে একেবারে।
এত হাসি! ওয়াজির মোল্লা তার পালিশের নুটি নিয়ে প্রস্তুত। এত কিছু মজাদারি আছে নাকি কথাটায়! নাকি সিরেফ জওয়ানি। যৌবনই এমন বাঁধভাঙা হাসি হাসায়।
খুকির বাবা একটুকুন আগে অফিস চলে গেছেন। এবার মা যাচ্ছেন। নাম্বা নাম্বা ইস্ট্রাপের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুটখুট করে ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়ার মতো, না না ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া হতে যাবেন কেন? কত বড়োমানুষ! এতগুলিন সামানে ল্যাকর পালিশ দিবেন। ব্যাপরে। সেন্টের গন্ধে ভেসে যাচ্ছে চাদ্দিক। চকচক কচ্ছে চামড়া। কত ল্যাকর কত জলুসের জান! ছ্যাকরা গাড়ির ঘোড়া কেন হতে যান! ইনি হলেন গিয়ে ভালো জাতের রেসের ঘুড়ি। যেমনটি কুইনের পার্কের পাশে ঘোড়দৌড়ের বাজির মাঠে দেখা যায়! অতটা নাম্বাই-চওড়াই নেই। তা না-ই থাকল।
উনি বললেন, অত কী বকবক করছিস খুকি। কাজটা হবে কখন?
আমার হাত কামাই নেই দিদিসাহেব।–নুটি চালাতে চালাতে মোল্লা বলে।
তা হোক, খুকি, বড্ড বিরক্ত করছ!
না মা। ইনি একজন বিশেষ মানুষ। হিস্ট্রির লোক। এঁর নাম জানো? ওয়াজিদ, ওয়াজিদ আলি শাহ। খিদিরপুরে থাকেন।
তা-ই-ই? ভীষণ অবাক আবিষ্কারের দৃষ্টিতে কর্ত্রী তাকালেন। চেহারাটাও দেখেছিস!
খুকি আবার হাসতে থাকে! তুমি তো আমজাদের চেহারার কথা ভেবে বলছ। আসল মানুষটা তো নয়! তোমার যা হিস্ট্রির সেনস।
আহা, আমরা লেম্যান তো ওইভাবেই জেনেছি! এ মিলটাও কি কম আশ্চর্যের!
ওয়াজির মোল্লা জানে না, কেন এই আশ্চর্য, কেনই-বা আবিষ্কার। কীসের মিল। কেন মিল। ভুল নাম নিয়ে কেনই বা এত কচলাকচলি। তবে সে আর শুধরে দেয় না। কী দরকার! রুজি যাদের কাছে, একটু-আধটু ভুলভাল বলে তারা যদি খুশি থাকে, থাক।