ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করতে করতে অঞ্জু বললো, আমি তো বেকার!
হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল ড্রাইভার, বলল, ভাগ্যিস, আপনি বেকার ছিলেন, তাই একজন মা শেষ সময়ে ছেলের হাতের জল পেলেন। আপনার ওই ঢাউস ওয়াটার-বটল—এ কি গঙ্গাজলই নিয়ে যাচ্ছিলেন?
গঙ্গাজল? ধুর। কলকাতার জল এখন খেলেই আন্ত্রিক। জানেন না? আমি সব সময়ে ফোঁটানো জল ক্যারি করি। অনেক জল খেতে হয় কি না!
ওই হল! ওই-ই আধুনিক গঙ্গাজল ভাই। ভগবানের কী বিচিত্র লীলাই না দেখলুম।
গলির মোড়ে নেমে যেতে যেতে অঞ্জু জোর করে দশটাকার দু-খানা নোট গুঁজে দিল ভদ্রলোকের হাতে।
আপনি বেকার না?
আপনারও তো লস হল অনেক।
ওই ওঁদের থেকে বেশি কী? আচ্ছা আবার দেখা হয়ে যাবে। আমার নাম বিজন সরখেল। আপনি?
অঞ্জন পোরেল।
সাড়ে বারোটা বাজছে। জানলায় কাছে উৎকণ্ঠিত মুখ।
কী ব্যাপার, অঞ্জু? এত রাত? আর বোলো না। মর্মান্তিক একটা রোড অ্যাকসিডেন্ট। আটকে পড়েছিলুম। জামা কাপড়গুলো জলে ভিজিয়ে আবার যাব।
আবার যাবি? তোর কিছু হয়নি তো?–মঞ্জু চৌকাঠে।
আমার? অঞ্জু ভাবল, তারপর বলল, যাওয়া দরকার। তুই যা হোক কিছু খাবার দে। আমি চান করে আসছি।
রাত তিনটেয় মোমিনপুর থেকে গাড়ি বেরোল। সকার সমিতি, গুরুদ্বার কারও গাড়ি পাওয়া যায়নি। টেম্পোয়ও আজকাল অনুমতি দিচ্ছে না। একটা গাড়ি মর্গ থেকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। সকাল এগারোটার আগে কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। এগারোটা মানেই বারোটা, কিংবা একটা। বহু অল্পবয়সি ছেলে চারদিকে। এদের আত্মীয়স্বজন, এ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। সেদিকে তাকিয়ে নিজের ঘড়ির দিকে চাইল অঞ্জু। পাঁচটা বাজছে। বলল, আসুন না, আমরাই নিয়ে যাই, এই তো! কতটুকু আর পথ! সে ডান পাশের সামনের খুররাতে হাত দিল।
আজও মেঘভরতি আকাশ। চুইয়ে পড়ছে সকালের আলো। একজন বয়স্ক মানুষ বললেন, মঙ্গলবার কাজ। কী যেন নাম তোমার? অঞ্জন? এসো বাবা। এসো কিন্তু।
অঞ্জু বাড়ির পথ ধরল। গতকাল এ সময়েও মাধবী বিশ্বাস ছিলেন। হয়তো চা দিচ্ছিলেন তাঁর স্বামী শিশির বিশ্বাস, ছেলে রঞ্জন বিশ্বাসকে। ডাকাডাকি করে কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন পুত্রবধু কৃষ্ণাকে। সামনের দিকের চুলগুলো পাকা। সিঁথিতে অল্প সিঁদুর। রোগা, লম্বা, বেশ টরটরে। যখন কুঁচিগুলো হাতে ধরে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। বেশ স্মার্ট! রাস্তায় চলাফেরা আজকালকার গৃহিণীদের তো বেশ অভ্যাসই আছে। তাহলে কী হল? চোখ? চোখের নজর কম হয়ে এসেছিল না কি? তার ওপর বর্ষাসন্ধ্যার ঘোলাটে আলো। ম্যাটাডরটা জ্ঞানহারা হয়ে ছটছিল। রাস্তা দিয়ে যে মানুষকেও চলতে হয় সে হুশ নেই। যন্ত্র ক্রমাগত মানুষকে চাপা দিয়ে চলেছে। সংঘর্ষ! সংঘর্ষের একমাত্র সাক্ষী, সংঘর্ষের কালে একমাত্র আশ্রয়, একটি বলিষ্ঠ বেকার যুবক শরৎ বোস রোড ধরে সোজা চলে আসছে। কে তাকে টেনে আনছে? তার তো এ রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিল না। তাহলে কেন? একি মানুষীর জন্য মনুষ্য-শাবকের ভেতরের টান?
অজস্র ভিড়। প্রচুর জুতো। সেদিনের সেই ঘরখানাকে চেনা যাচ্ছে না। শ্বেতপদ্ম, রজনিগন্ধা, উঁই। ট্রেতে করে সন্দেশ পরিবেশন করছে দুটি মেয়ে। অনেক পরিচিত, অনেক বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজন। বেশিরভাগই পরস্পরের সঙ্গে গল্পে মত্ত। জড়ো হবার একটা উপলক্ষ্য পেলেই শব্দরা উথলে ওঠে। সেতু বাঁধতে চায়। মৃত্যু? মর্মান্তিক! শেষ! কিন্তু জীবন? আহো জীবন। আহা জীবন! আমি, আমরা, তুমি, তোমরা যে পর্যন্ত আছি, আছ। আছিস? আছেন? আর থাকা দাদা। হাইপারটেনশন। ব্লাড শুগার তিনশো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বসুমল্লিকদের বাড়ি দেখা হয়েছিল না? হ্যাঁ, নাতির অন্নপ্রাশনে। সেই আর এই? এ তো আসতেই হয়। থাকি কোথায়? সিঁথি, নতুন বাড়ি করলুম যে! সিঁথি থেকে সাদার্ন অ্যাভেনিউ। বুঝুন। আপনি কি এখনও আই.সি.আই-তেই? জামাইটি তো খুব ভালো হয়েছে। লস এঞ্জেলিস। আরে বাবা আজকাল ভালো ছেলে মানেই মার্কিন দেশ। ও লিলিদি! দেখতেই পাচ্ছ না যে! সেদিন তোমার লেকচার শুনলুম। ওই তো গুরুসদয়ে। এখন সাঁই ভজনে যাস না তো কই আর? এক একটা হুজুগ আসে যেন! তা হোক, মানুষ বড়ো অসহায় রে! বুঝিস তো। একটা ভরসা চাই! কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ … দেখলি তো? নিদানকালে কিছুই কাজে আসে না। পথে পড়ে বেঘোরে যাওয়া যদি কপালে থাকে তো তাই! আহা মাধবী বড়ো ফিটফাট ছিল রে! কথায় কথায় বলত হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে বরঞ্চ আমি বিনা চিকিৎসায় থাকব! উঃ! সাবধানও ছিল খুব! কী যে হয়ে গেল! এক বিঘত দূরে বাড়ি, স্বামী, ছেলে-বউ! ভাবা যায় না। শিশিরদার দিকে যেন তাকানো যাচ্ছে না। চুলগুলো ক-দিনে আরও সাদা… বিনোদ, হ্যাঁ আমি ডাকছি। ওদিকের জানলাটা বন্ধ করে দাও না একটু। পুরুতমশাই দেশলাই জ্বালাতে পারছেন না।
অঞ্জ মুখ বাড়িয়ে দেখল মুণ্ডিত মস্তকে রঞ্জন আসনে বসে, হাতে কুশ, সামনে কোশাকুশি। পাশে সাদা লাল পাড় শাড়ি পরে সেদিনের সেই কৃষ্ণা বলে মেয়েটি। সে গোলাপ এনেছিল কতগুলো। মাধবী দেবীর ছবির তলায় নামিয়ে রাখল। ইনি? খুব সম্ভব কয়েক বছর আগেকার। তখনও সামনের চুলগুলো অতটা পাকেনি। ছবির চোখ তার দিকে সোজা তাকিয়ে হাসছে। শেষ সময়ে বড়ো তেষ্টা পায়, অঞ্জু তুই জল দিয়েছিলি। ধুলোয় পড়েছিলুম। তুই কোল দিয়েছিলি। বলুন…… বলুন পিতৃকুলের ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ। আর এই পিণ্ডটি সবার জন্য। যাঁরা জল পাননি, তাপিত, পিপাসার্ত, অথবা যাঁরা পেয়েছেন, আরও পেলে আরও তৃপ্তি। গতাসবঃ। তাঁদের কথা মনে করে, হ্যাঁ…।