রবীনদার কাছে কবে যাচ্ছিস?
সময় করতে পারছি না রে। বাবার জন্যে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় ফি-মাসে। তিন ঘন্টা লাইন। তা ছাড়াও কত কাজ।
বেশি দেরি হয়ে গেলে তুই-ই পস্তাবি, আমার কী!
চলি রে! … তার শক্ত হাতের মুঠোয় নেপালের হাতের পাঞ্জা ধরে কষে ঝাঁকুনি দেয় অঞ্জু।
ছাত্রীদের দেড়তলার ঘরে যখন ঢোকে তখন তার মুখ দেখে তারা বলে ওঠে, কী অঞ্জুদা, রাজ্যজয় করে এলেন মনে হচ্ছে?
রাজ্যজয়ই বটে! মনে মনে ভাবে অঞ্জু। জানো না তো আর তোমাদের দুটো হায়ার সেকেন্ডারির মেয়ের এক ঝটকায় ক্লাস ফাইভে ডিমোশন হয়ে গেছে।
এভাবেই চলে অঞ্জুর, চলে যায়। তার বয়সের অন্যান্য ছেলেরা যখন হতাশায় ভুগছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন অঞ্জু নীরবে চেষ্টা করে যাচ্ছে চাকরির, আর প্রাণপণ টিউশনি। সেই সঙ্গে ব্যায়াম। ব্যায়াম-ট্যায়ামের সুবাদেও তো অনেকের চাকরি-বাকরি হয়ে যায়। অঞ্জুর তাও হল না। কোনও ব্যাপারেই সে বোধহয় প্রথম সারিতে আসতে পারেনি। প্রথম সারিতে আসতে না পারলে বিধিসম্মত, সম্মানজনক আয়ের দরজাগুলো বন্ধ থাকে। তখন কি না খেয়ে মরে যেতে হয়? তা নয়। তখন থাকে উঞ্ছবৃত্তি। যেমন এটা-ওটার দালালি, যেমন নেপালের রবীনদার চামচাগিরি, যেমন অঞ্জুর টিউশনি। টিউশনিতে সে মন্দ রোজগার করে না। নিজের খরচ তো চলে যায়ই। বাড়িতেও কিছু দিতে পারে। তবু…লোকে যখন জিজ্ঞেস করে, বলা যায় না কিছু করি। বেকার! এত বড়ো ছেলে বেকার! বাবা মাথা নুইয়ে, দাদার মুখে নির্বেদ, মঞ্জু ভুরু কুঁচকে আছে। সবাইকার হীনম্মন্যতা।
ল্যান্সডাউন দিয়ে হাঁটছে অঞ্জু। হাঁটতে হাঁটতে মনের কোণে ড্যালা পাকিয়ে আছে তার ব্যর্থতার চিন্তা। কিন্তু তার ওপর দিয়ে একটা আনন্দের ভালোলাগার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আষাঢ় মাস। দুপুর বেলা প্রচণ্ড একটা ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন গুমোটের পর। রাস্তা ভিজে, বাতাস ভিজে, ভিজে-ভিজে হাওয়া। আকাশে মেঘগুলো তখন হুড়হুড় করে ভেসে যাচ্ছে। ভীষণ একটা তাড়া পড়ে গেছে যেন। সন্ধেবেলাটা একটু কালি-কালি হয়ে আছে তাই। মেঘের ছায়া পড়েছে। পিচ রাস্তার পাতলা জমা জলের আয়নার মতো গায়ে। রাস্তায় বেশি লোক নেই। গাড়িগুলো খুব জোরে ছুটছে। এটা ঠিক নয় কিন্তু। বৃষ্টিপিছল রাস্তায় গাড়ি স্কিড করতে পারে। মানুষ আজকাল খুব বেপরোয়া হয়ে গেছে। জেনে-শুনেও কেন যে সাধারণ নিয়মগুলো মানে না!
শরৎ ব্যানার্জি রোড থেকে এক ভদ্রমহিলা বেরোলেন। হাতে ব্যাগ, এক হাতে শাড়ির কুঁচি তুলে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। ঠিক অঞ্জুর সমকোণে। তাই সে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিল। উনি রাস্তা পার হচ্ছেন। ওদিকের দোকানটায় চলে গেলেন। রাস্তায় আলোগুলো মিটমিট করছে। অঞ্জু আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। হঠাৎ একটি তীব্র কি-চ শব্দে তার চোখ চলে গেল রাস্তার মাঝবরাবর। সে কিছুক্ষণ আগেকার দেখা ভদ্রমহিলাকে শূন্যে দেখল। জামাকাপড় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটা খাপছাড়া বল শূন্যে, ভীষণ বেগে নেমে আসছে নীচের দিকে। একটা ম্যাটাডর পাশ কাটিয়ে তীব্র বেগে চলে গেল। পেছনে হেলমেট মাথায় একজন মোটরসাইকেল-আরোহী ছুটছে। ধর ধর—আশপাশের দোকান থেকে কিছু লোকও ছুটে যাচ্ছে ভ্যানটার পেছনে। অঞ্জু দৌড়ে গিয়ে ওঁকে রাস্তা থেকে তুলে নিল কোলে। মুখটা ওঁর ভেঙে যাচ্ছে। অঞ্জুর দু-হাত জামাকাপড় রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর. কে. মিশনে স্ট্রাইক চলছে—সে তাড়াতাড়ি ভেবে নেয়—ট্যাক্সি-ট্যাক্সি… শিগগির শিগগির। খালি ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছে একটা। দু একজন চলুন আমার সঙ্গে চটপট। বাস, ভিড় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কে ওঁর ঝুলতে থাকা পা দুটো ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। কে একটা ব্যাগ তুলে দিল গাড়িতে। পুলিসের ঝামেলা…কে হ্যাঁপা পোয়াবে? ওপাশের দরজা খুলে তবু একটি অল্পবয়সি ছেলে উঠে এল।…… যদি কেউ এঁকে চেনেন, বাড়িতে খবর দিয়ে দিন। এস.এস.কে.এম-এ নিয়ে যাচ্ছি…….শরৎ ব্যানার্জি থেকে বেরিয়েছিলেন……।
হু হু করে ছুটছে গাড়ি। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ। উনি যেন কী বলছেন! অঞ্জু কান নামাল, কিছু শব্দ, কিছু গোঙানি। মানুষের ভেতরে আরও অনেক কিছুর মতো একটা ধবনি ভাণ্ডারও থাকে। সেই ভাঁড়ারের দরজা ভেঙে পড়েছে। তাই ধবনিরা বেরিয়ে আসছে। অঞ্জুর কাঁধে জলের বোতল। সে একটু জল দিল মুখে। আরও জোরে, আরও জোরে ভাই! হর্ন বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে যান…অঞ্জু প্রাণপণে ঝাঁকানি থেকে তার কোলের মানুষটিকে রক্ষা করতে করতে বলল।
হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে অবশেষে। এমার্জেন্সির আলো। কে হন আপনি? কেউ। সে কী? আননোন? এ তো পুলিশ কেস হবেই। আপনি পাবেন না যেন। সিস্টার, ব্যাগটা নিন।
শুনুন ডাক্তার, ব্যাগ-ট্যাগ, পরিচয়-টরিচয় পরে হবে। আগে ওঁকে অক্সিজেন আর কী কী লাগে দিন প্লিজ। টেবিলে তুলুন। ফর গডস সেক।
তরুণ ডাক্তারটি চোখ ফিরিয়ে বলল, জানেন না তো পাবলিক আর পুলিশের হয়রানি! আগে পেপার্স ঠিক করতে হয়।
ওহ ডক্টর, উনি আমার মা, ধরুন আমারই। আপনার, আপনারও। মায়ের মুখ মনে করতে পারছেন না? কুইক, কুইক, প্লিজ, ফর গডস সেক।
স্যালাইনের বোতল। অক্সিজেন। অবাক চোখে চেয়ে তরুণ ডাক্তার, প্রৌঢ় নার্স……শি ইজ গ্যাসপিং। সরি, ইয়াং ম্যান!