বোধহয় সত্যি আসিনি জুলি, স্বপ্নে এসেছিলাম … তোরা একবার বল আমি শমীকে নিয়ে যেতে আবার আসব…
না। জুলি চাপা ক্রুব্ধ গলায় বলল, যা, তুই যা প্লিজ।
রিনটিনের পায়ের শব্দ কোনদিনই হয় না। নিঃশব্দে সে কখন চলে গেছে।
এখন মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শমীর গলা দিয়ে মস্ত বড়ো একটা পিণ্ড নামছে। গলার পেশি, ত্বক সব কিছুকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে। মা বলল, লুপ এখনই এত অধীর হলে চলবে কী করে? এইটুকুতেই যদি ভেঙে পড়ো। তা হলে এর পর?
কান্নাভেজা মুখ তুলল লুপ। মায়ের গলা নির্লিপ্ত, উদাসীন, যেন অনেক দূর থেকে বলছে। মা কখনও লুপকে তুমি বলে না! দুঃখ? অধীর? এর পর? আরও আছে? এর পর আরও আছে?
যাও, মুখ ধুয়ে এসো।
অন্য গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়েছে লুপুর মুখে। জুলি মাথায় হাত বুলিয়ে ভিজে গালে চুমু খেয়ে বলল, মন খারাপ করছিস কেন? আবার আসবি মাসির কাছে। অনেক দিন থাকবি।
শমী মনে মনে বলল, না জুলি না, আর আসব না, আর ও থাকবে না। আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। ওই সিঁদুরে আগুন আমাকে পার হতেই হবে।
ট্রেনে উঠে বিনায়ক ডবল সিটে গুছিয়ে বসল মেয়েকে নিয়ে। মৃদু আলো জ্বলছে—ও কী রে লুপু! তোর মুখখানা যে কেঁদে কেঁদে ফুলে গেছে মা। এত কেঁদেছিস কেন?
লুপ কিছু বলছে না। বিনায়ক বলল, কী ব্যাপার শমী? কীসের কষ্ট ওর? অত কেঁদেছে। জাস্ট মাসিদের জন্য মন কেমন! কিছু বলছে না যে! বাবার মুখে উদ্বেগ। ট্রেনের শব্দ। গতিবেগ বাড়ছে। বাইরে অন্ধকার লম্বা দৌড়ে নেমেছে। শমী তার ঈষৎ ভাঙা অথচ কেমন এক রকম মিষ্টি গলায় যেন আপন মনে বলল, জানলে তো বলবে! ও যে জানেই না।
অপত্য
ব্যায়াম সমিতি থেকে ফেরবার পথটা অর্থাৎ শর্ট-কার্টটা একেবারে কাদা-জলা হয়ে আছে। অনুষ্টুপদা বলে রাবড়ি-কাদা। এই কাদার সঙ্গে রাবড়ির নাম জড়িয়ে থাকলে রাবড়িতে ঘেন্না ধরা বিচিত্র না। অবশ্য, রাবড়ি যেন কতই জুটছে! চটিজোড়া খুলে নিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে নিতে থাকল অঞ্জু। সে জানে কাদায় বা জলে এভাবে খালি পায়ে নামা আর প্রাণটাকে নামিয়ে দেওয়া মোটের ওপর একই কথা। ওই কাদায় মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে কাচের ফালি, পেরেক, ধারালো যে কোনো জিনিসের টুকরো। পায়ে ফুটলেই আই.ডি.হসপিট্যাল, বেলিয়াঘাটা। সেখান থেকে ফেরার কোনো গ্যারান্টি নেই। তবে, পঁচিশ বছর বয়সের একটা বি.কম বেকার ছেলের ফেরাও যা, না ফেরাও তা। দাদা আছে গড়িয়াহাটার মোড়ে একটা দোকানের সেলসম্যান। ছোটো বোনটাও এক ডাক্তারের চেম্বারে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ জুটিয়ে নিয়েছে। একমাত্র অঞ্জুরই দু-পাঁচটা টিউশনি ছাড়া কিছু হল না। এদিকে ব্যায়াম সমিতিতে মুগুর ভেঁজে, প্যারালাল বারে উলটে পালটে খিদেটি আছে সাধা। মুগকলাই, ছোলা, সয়াবিন, রাজমা সবই পেটের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। যখন রান্নাঘরের একপাশে বাবা চেয়ারে আর তিন ভাই-বোন মেঝেতে খেতে বসে, দেয়ালগুলো যেন মুখ বাঁকিয়ে বলতে থাকে, কম্মের হোত টিপি! খালি থালা থালা ভাত মারতে আছিস!
কে বলে দেয়াল থেকে? অঞ্জুর সতেরো বছর বয়সে মৃত মা না কি! দরিদ্র সংসারে দিবারাত্র খেটে খেটে মায়ের মেজাজ খুবই তিরিক্ষি ছিল। তার ওপর ছিল মাথার যন্ত্রণার রোগ। হলে, মাথায় কষে ছেঁড়া শাড়ির পাড় বেঁধে শুয়ে থাকত। কিন্তু মা অঞ্জুকে বড্ড ভালোবাসত। বোন যদি এ নিয়ে নালিশ করত, মা বলত, দ্যাখ মঞ্জু, পেটের সব সন্তানকেও সমানভাবে ভালোবাসা চাট্টিখানি কথা নয়, নিজে মা হলে বুঝবি। যে সন্তান সবচেয়ে হাসিমুখ, মায়ের দুঃখ বোঝে, যার ওপর ভরসা করা যায়, সে একটু বেশি পাবেই। তবে সেটুকু উথলোনো দুধ। আর কারও ভাগ থেকে কেড়ে কুড়ে নেওয়া নয়। অঞ্জু চিরদিনই হাসিখুশি, আড্ডাবাজ, গুমোট কাটিয়ে দিতে ওস্তাদ, মায়ের ফরমাশ সামান্যই সব, তবু সেই সামান্যটুকু মেটাবার কথা কখখনও ভুলত না অঞ্জ। সরু করে কুচোনো একটু কাঁচা সুপুরি চিবিয়ে বোধহয় মায়ের একটু নেশামতে হত। সুপুরির জোগান আসত অঞ্জুর হাত দিয়ে। কাছাকাছি ঠাকুরের আশ্রমে যেতে ভালোবাসতো মা। অঞ্জু ওসব ঠাকুর-টাকুর কস্মিনকালেও পছন্দ করে না। তবু যেত মাকে নিয়ে। সেই মাকে জীবনে যেই একবার মাত্র সে এন.সি.সি.-র সঙ্গে ট্রেনিং-এ গেল ঠিক সেবারই মারা যেতে হল? স্ট্রোক! তাকে খবর দেওয়া গেল না। সে যখন ফিরল শ্রাদ্ধ-শান্তি সুষ্ঠু মিটে গেছে, মায়ের ছবিতে রজনিগন্ধার মালা শুকনো! ছোটো ছেলে, প্রিয় ছেলের কাছ থেকে, মার কি শেষ সময়ে একটু জলও যাচা ছিল না? মানুষটা যে ছিল এবং এক সময়ে তার না থাকা নিয়ে এই বাড়িতে মানুষগুলির আচার-আচরণ পোশাক আশাকে কিছু সাময়িক পরিবর্তন হয়েছিল সেসব কিছু তখন বোঝবার উপায় পর্যন্ত নেই। শুধু দাদা আরও গম্ভীর, বোন আরও ক্লান্ত, বাবার আরও বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে যাওয়া। হতভম্ব অঞ্জু বাড়ি ঢুকতে বাবা শুকনো মৃত চোখে চেয়ে বলল, যাক, তোমাদের সংসারে, একটা মুখ কমল। সংসারটা যে কী করে তাঁর হয়ে তাঁর ছেলেদের হয়ে গেল তা অঞ্জু বোঝে না। সে তো তখন বাচ্চা, দাদা সুন্ধু চব্বিশ পেরোয় নি। কিন্তু যবে থেকে চোখ খারাপের অজুহাতে বাবার কাজটা গেছে তবে থেকেই বাবা সুযোগ পেলেই তোমাদের সংসার কথাটা বলতেন। এখন বাবার চোখে গ্লকোমা, পায়ের নার্ভ শুকিয়ে আসছে। শিরদাঁড়ায় লাম্বার স্পন্ডিলাইটিস! যথাসাধ্য চিকিৎসা করানো হয়! কিন্তু সেই একটা কথা আছে না, তোমার যথাসাধ্যটাও যথেষ্ট নয়! এ হল সেই।