ঘড়িটা রিনটিন রুমাল দিয়ে চট করে বেঁধে ফেলল। বলল, সময়কে একটু ভোলো, ভুলতে শেখো, খিদে তো আমারও পেয়েছে। খিদে পাওয়ার ফিলিংটা অদ্ভুত সুন্দর নয়? লেট ইট লাস্ট এ লিটল মোর। সুগন্ধ রাতটাকে সিল্কের চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে হিম আর জ্যোৎস্না মেখে বাড়ি ফেরা। বাবা টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়ছেন, কিছুই খেয়াল নেই। দীনবন্ধু বাইরে দাঁড়িয়ে। মুখ গম্ভীর। তার সব খেয়াল আছে। হিম লেগে পরদিন শমীর ঠেসে জুর! গনগনে মুখের ওপর জুলি ঝুঁকে পড়েছে ওষুধটা খা। শমী। শমী মুখ টিপে আছে। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রিনটিনদা বলছে, জ্বর হলে আমিও চট করে ওষুধ খাই না। জ্বরের ফিলিংটা আমার অসাধারণ লাগে। কী রকম দাঁত কষতে ইচ্ছে করে। কী রকম একটা ঝিমুনি ধরে। লালচে ঝিমুনি! শমী, দেখো, চোখ চেয়ে দেখলে ঘরবাড়ি জীবন সব এখন স্বপ্ন মনে হবে। আসলে জ্বরটর হলেই সত্যি বোঝা যায় জীবনটা স্বপ্ন।
জীবনটা স্বপ্ন? জুলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করছে।
জ্বরোজ্বরো গায়ে শমী মুগ্ধ হয়ে ভাবছে জীবনটা স্বপ্ন!
রিনটিন জানলার কাছে থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছে, শমীর বিছানার খুব কাছে–হ্যাঁ! ঘুমিয়ে পড়েছি, সামহোয়ার এলস দেখছি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে–আমি শমী, আমি জুলি, আমি রিনটিন, আমার কত কাজ, কত ইচ্ছা, সাধ! হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবে, বুঝতে পারব…।
কী বুঝতে পারব? আমি জুলি নই! জুলি অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করছে।
শমী উদগ্র আগ্রহে উত্তরটার জন্যে অপেক্ষা করছে। রিনটিন হেসে বলছে, জানি না, জানি না তো কী বুঝতে পারব। এখনও তো ঘুম ভাঙেনি!
যত্ত বাজে কথা। রোজ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেগুলো দেখি সেগুলো তবে কী?
স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন। তার ভেতর আরও স্বপ্ন। ভেতর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসবে স্বপ্নগুলো।
জ্বরের ঘোরে শমী শুনছে আর তলিয়ে যাচ্ছে, কোনো গভীর গহন, অন্যরকম অন্যলোকে। সমস্ত অন্তরঙ্গতা, বন্ধুতা, ভালোবাসাগুলো তো স্বপ্নই। ভেতর থেকে ভাঙতে ভাঙতে আসে। ঠিক যেমন শুনেছিল। অবিকল। নিশ্বাস ফেলে শমী পাশ ফেরে। ম্যাগাজিন হাতে করে, ছবি আর লেখার ওপর চোখ, মনের মধ্যে অন্য ছবি অন্য শব্দ। দিনের জাগরণবেলা নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। বিকেলের ঘুম ভাঙে।
লুপের বাবা এসে গেছে। জুলি বলল, এসেছ খুব ভালো কথা, আমরা হাতে চাঁদ পেয়েছি, কিন্তু ঘোড়ায় জিন দিয়ে এলে কেন? দুদিন থাকো!
বিনায়ক বলল, উপায় নেই। সময় নেই। নাই নাই নাই যে সময়। দিদি কত। কষ্ট করে একটা উইকএন্ড বার করেছি যদি জানতেন।
উইকএন্ড আবার বার করতে হয় না কি? ও তো প্রত্যেক সপ্তাহের শেষে থাকেই!
আরে? শমীকে জিজ্ঞেস করুন! কত শনিবার আমাকে হুটহাট করে টুরে চলে যেতে হয়!
শমী হাসছে। গুছিয়ে নিচ্ছে আস্তে আস্তে সব। পেছনের বাগানে শুকোচ্ছে তোয়ালে, পেটিকোট, পটির কাছটায় একটু ভিজে। শাড়িটা পাট করে নিচ্ছে। ঘরে এল। লুপ পেছন পেছন বাগানে গিয়েছিল। এখন আবার পেছন পেছন ঘরে ফিরে এসেছে। বায়না ধরেছে, ও মা, আর দুদিন পর তো এমনিই ছুটি ফুরিয়ে যেত। আর একটা দিন, জাস্ট একটা দিন থেকে গেলে কী হয়!
বাবা বলল, তোর তো দিনপঞ্জি মাসির আদরে এখন সবই ওলটপালট হয়ে গেছে রে লুপু। অভ্যেসে ফিরতেই তো ও দুটো দিন লেগে যাবে।
পকেটে হাত, ঠোঁটে সিগারেট বাবা চলে যাচ্ছে। এখন কেউ নেই। বাবা, মাসি, মেসো সব লনে নেমে গেছেন, গল্প করছেন। মাসি লুপের জন্য রং-বেরঙের একটা জাম্পার বুনেছেন, তাড়াতাড়ি করে ঘর বন্ধ করছেন এখন। একটু পরেই বেরোতে হবে। এখানে শুধু মা, মায়ের হাঁটু জড়িয়ে ধরে লুপু কাঁদছে। বুকভাঙা কান্না। যেন লুপু নয়, তার বুকের ভেতর বসে অন্য কেউ এ কান্না কাঁদছে। শমী আশ্চর্য হয়ে গেছে, আবার তো ছুটি পড়বে লুপু তখন আসব, গ্রীষ্মের ছুটিতে এসে বেশি করে থাকিস। তখন আম পাকবে, কাঁঠাল পাকবে, মাসি বলছিল শুনিসনি?
গুমরে গুমরে কাঁদছে লুপ। আম-কাঁঠালের জগৎ থেকে অনেক দূরে।
লুপু শোন, এ রকম বোকার মতো কাঁদে না।
সিজারদা যে জানে না। ও যে নেই! টুর্নামেন্ট খেলতে গেল টেলকোয়। কাল আসবে, দেখা হবে না। লুপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল।
তাতে কী হয়েছে! টুর্নামেন্ট খেলতে গেছে জানি তো। আবার পরে যখন আসবি, দেখা হবে!
আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভাঙা ভাঙা বোজা গলায় লুপ বলল।
শমী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। স্তম্ভের মত অনড়। নির্বাক। থোকা থোকা চুল লুপুর মাথায়। তার কোলের ওপর। চারদিকে ছড়িয়ে আছে লুপুর সাদা নাচ-ফ্রক লাল-কালো স্কার্ট, ব্লু জিনস, লুপুর ছোটোবেলা। টুকরো টুকরো এইসব যাত্রার আয়োজন এবং মেয়ের ছোটোবেলা সামনে রেখে শমী ফিরে যাচ্ছে তার নিজস্ব সেই অন্ধকার বারান্দায়। ওই তো জুলি কিছুদুরে ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আঙুলে শাড়ির আঁচল পাকাচ্ছে। রিনটিন বলছে, ট্রেনের সময় হয়ে এল, এবার তো আমায় যেতেই হবে। জুলি, শমীকে বলো একবার আমার দিকে ফিরতে, একটিবার আমার সঙ্গে কথা বলতে, ওকে বুঝিয়ে বলো জুলি। আমি…আমি যে আর আসব না।
শমী যে বেশি কথা বলতে পারে না। নিজের ভেতরের অনুভব বাইরে প্রকাশ করতে অসীম সংকোচ। ধূসর অন্ধকারের মধ্যে সে শুধু ধূসরতর ছায়া। বিবর্ণ। প্রাণশূন্য। জুলি ফিসফিস করে বলল, তুই কেন এলি? আমরা তো বেশ ছিলাম। রিনটিনদা তুই কেন এলি? তার গলায় অভিমান, তিরস্কার।