মালতীর প্রসব হবার দুমাস পূর্বে তার স্বামী কলেরায় মারা গেল। প্রসব হতে গিয়ে মালতীও মারা গেল। জ্যোতিষীর কথা ফলেছিল–মালতীর মেয়েই হয়েছিল। সে এখন তার মামার বাড়ী সোনারপুরে মানুষ হচ্ছে। তাঁরা তার নাম রেখেছেন “খেঁদি!”
চোখ গেল
সাধারণের চোখে হয়ত সে সুশ্রী ছিল না।
আমিও তাহাকে যে খুব সুন্দরী মনে করিতাম তাহা নহে–কিন্তু তাহাকে ভালবাসিতাম। তাহার চোখ দুটিতে যে কি ছিল তাহা জানি না। তেমন স্বপ্নময় সুন্দর চোখ জীবনে কখনও দেখি নাই। দুষ্টু বলিয়াও তাহার অখ্যাতি ছিল।
সেই কুরূপা এবং চঞ্চলা মিনি আমার চিত্ত-হরণ করিয়াছিল! তাহার চোখ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইয়াছিলাম।
মনে আছে তাহাকে একদিন নিভৃতে আদর কইয়া বলিয়াছিলাম–“ইচ্ছে করে তোমার চোখ দুটো কেডে রাখি।”
“কেন?”
“ওই দুটোই ত আমাকে পাগল করেছে। আমি সব চেয়ে ওই দুটোকেই ভালবাসি।”
এত ভালবাসিতাম–কিন্তু তবু তাহাক পাই নাই।
অজ্ঞাত অপরিচিত আর একজন আসিয়া বাজনা বাজাইয়া সমারোহ করিয়া তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল।
প্রাণে বড্ড বাজিল।
কিন্তু সে বেদনা হয়ত মুছিয়া যাইত যদি সঙ্গে সঙ্গে আর একটা মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটিত।
মিনি যখন বাপের বাড়ী আসিল, দেখি, তাহার দুটি চক্ষুই অন্ধ। কারণ শোনা গেল যে চোখে গোলাপ জল দিতে গিয়া সে ভুলক্রমে আর একটা ঔষধ দিয়া ফেলিয়াছে।
আমার সঙ্গে আড়ালে একদিন দেখা হইয়াছিল।
বলিলাম–“অসাবধানতার জন্যে অমন দুটি চোখ গেল!”
সে উত্তর দিল–“কেন যে গেল তা যদি না বুঝতে পেরে থাক তাহলে না জানাই ভাল!”
দুধের দাম
ট্রেন আসিয়াছিল। কয়েকটি সুবেশা, সুতন্বী, সুরূপা যুবতী স্টেশনে আসিয়াছিলেন। তাঁহাদেরই আশেপাশে জনকয়েক বাঙালী ছোকরাও, কেহ অন্যমনস্কভাবে, কেহ বা জ্ঞাতসারে ঘোরাফেরা করিতেছিল। ভিড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধা যে একজনের হোলড-অলের স্ট্র্যাপে পা আটকাইয়া পড়িয়া গেলেন, তাহা কেহ লক্ষ্য করিল না। করিবার কথাও নয়, বিদেশাগত শিভ্যালরি জিনিসটা যুবতীদের কেন্দ্র করিয়াই বিকশিত হয়। সকলে অবশ্য যুবতীদিগকে লইয়া প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ব্যস্ত ছিল না। যাঁহার হোলড-অলের স্ট্র্যাপে পা আটকাইয়া বুড়ী পড়িয়া গেলেন, তিনি শিক্ষিত ভদ্রলোক, কাছেই ছিলেন তিনি বুড়ীকে স-ধমক উপদেশ দিলেন একটা।
‘পথ দেখে চলতে পার না? আর-একটু হলে আমার স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে যেত যে!’
বুড়ীর ডান পা-টা বেশ মচকাইয়া গিয়াছিল। তবু তিনি খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া প্লাটফর্মময় ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে একটা স্থান সংগ্রহ করিতেই হইবো অসম্ভব। ট্রেন বেশীক্ষণ থামিবেও না। হুড়মুড় করিয়া শেষে তিনি একটা সেকেলে ইন্টার ক্লাসে উঠিয়া পড়িলেন। যথারীতি সকলেই হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল। বর্তমানে অবশ্য ইন্টার ক্লাসের নাম বদলাইয়া সেকেন্ড ক্লাস হইয়াছে।
একজন বাঙালী ভদ্রলোক ইচ্ছা করিলে একটু সরিয়া বসিয়া জায়গা করিয়া দিতে পারিতেন, তিনি জিনিসপত্র সমেত বেশ একটু ছড়াইয়া বসিয়া ছিলেন কিন্তু তিনি সরিয়া বসিলেন না, উপদেশ দিলেন—
‘উঠলে ত, এখন বসবে কোথায় বাছা!’
‘আমি নিচে তোমাদের পায়ের কাছে বসব বাবা। দুটো স্টেশন মাত্র, তারপরই নেমে যাব। বেশীক্ষণ অসুবিধা করব না তোমাদের।’
বুড়ী তাঁহার পায়ের কাছেই তাঁহার জুতাজোড়া সরাইয়া দিয়া বসিয়া পড়িলেনা অসুবিধা তেমন কিছু হইল না, কারণ বৃদ্ধা ছোটখাটো আয়তনের মানুষ, গুটিসুটি হইয়া বসিয়া ছিলেন। একটু পরেই কিন্তু তিনি অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন। যে পায়ে স্ট্র্যাপটা আটকাইয়া গিয়াছিল সেই পা-টা বেশ ব্যথা করিতে লাগিলা চাহিয়া দেখিলেন, পা ফুলিয়া উঠিয়াছে। তাঁহার ভাবনা হইল নামিবেন কী করিয়া। আর দুই স্টেশন পরেই শুধু নামিতে হইবে না, আর-একটা ট্রেনে উঠিতেও হইবে। অথচ পা নাড়িতে পারিতেছেন না, দাঁড়ানই যাইবে না যে। ট্রেনের কামরায় অনেক বাঙালী রহিয়াছেন, অনেকে তাঁহার পুত্রের বয়সী, অনেকে পৌত্রের। কিন্তু ইহারা যে তাঁহাকে সাহায্য করিবেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা হইতে তাহা তিনি আশা করিতে পারিলেন না। তবু। হয়তো হঁহাদেরই সাহায্য ভিক্ষা করিতে হইবে। উপায় কি!
বৃদ্ধা যে-স্টেশনে নামিবেন, সে-স্টেশন একটু পরেই আসিয়া পড়িল। প্যাসেঞ্জাররা হুড়মুড় করিয়া সবাই নামিতে লাগিলেন, বুড়ীর দিকে কেহ ফিরিয়াও চাহিলেন না।
‘আমাকে একটু নাবিয়ে দাও না বাবা, উঠে দাঁড়াতে পাচ্ছি না আমি।’
বুড়ীর এই করুণ অনুরোধ সকলেরই কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। কিন্তু অধিকাংশই ভান করিলেন যেন কিছু শুনিতে পান নাই।
একজন বলিলেন, ‘ভিখারী মাগীর আস্পর্ধা দেখেছেন? যাচ্ছে ত উইদাউট টিকিটে, তার উপর আবার—
তিনি বৃদ্ধাকে ভিখারিণীই মনে করিয়াছিলেন। বৃদ্ধা কিন্তু ভিখারিণী নন, তাঁহার টিকিটও ছিল। সেকেন্ড ক্লাসেরই টিকিট ছিল।
আর একজন বিজ্ঞ মন্তব্য করিলেন, ‘এই সব হেল্পলেস বুড়ীকে রাস্তায় একা ছেড়ে দিয়েছে, এর স্বামী ছেলে নেই না কি, আশ্চর্য কাণ্ড!
সিগারেটে টান দিতে দিতে তিনিও নামিয়া গেলেন। গাড়িতে যাঁহারা রহিলেন, তাঁহাদের মধ্যে জন-দুই টিফিন-কেরিয়ার খুলিয়া আহারে মন দিয়াছিলেন, বুড়ীর কথা তাঁহাদেরও কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করা তাঁহারা সমীচীন মনে করিলেন না।