- বইয়ের নামঃ বিবিধ রচনা (বঙ্কিম)
- লেখকের নামঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অসম্পূর্ণ রচনা
নাটিকা
DRAMATIS PERSONÆ
রামধন-রামকৃষ্ণ-কলাবতী-দিবা-নিশা
প্রথম অঙ্ক
SCENE I
প্রতাপনগরের রাজবর্ত্ম
রামধন-রামকৃষ্ণ
রামধন। কিসের এত গোল?
[নেপথ্যে বহু লোকে “জয় জয় কলাবতী”]
ও কিসের জয়ধ্বনি?
রামকৃষ্ণ। জান না রাণী কলাবতী স্নান করিয়া যাইতেছেন।
রামধন। রাণী স্নান করিয়া যাইতেছেন, তার এত জয়ধ্বনি কেন?
[নেপথ্যে “জয় জয় রাণীজিকি জয়”]
ঐ শুন।
রামকৃষ্ণ। তুমি বিদেশী তাই অবাক্ হইতেছ। রাণী কলাবতীকে এ নগরের লোক বড় ভক্তি করে। বড়ই ভালবাসে।
রামধন। কেন রাণীর কিছু বিশেষ গুণ আছে?
রামকৃষ্ণ। তা আছে-রাণী অতিশয় দানশীলা আর বড় প্রজাবৎসলা। যার যে দুঃখ থাকে, রাণীকে জানাইতে পারিলেই-হইল-তার দুঃখ ঘুচিবে।
[নেপথ্যে “জয় জয় মা কলাবতীর জয়”]
ঐ শোন সকলেই রাণীকে মা বলিতেছে, তিনি প্রজামাত্রেরই মা’র মত। তাঁর গুণেই এখানকার প্রজারা এত সুখী।
রামধন। বটে! তবে রাজার এত সুখ্যাতি কেন?
রামকৃষ্ণ। রাণীর গুণে।
রামধন। তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যায়? তিনি কি প্রাচীনা।
রামকৃষ্ণ। না, তিনি বড় অল্পবয়স্কা তবে সকলের মা বলিয়া সকলকেই দেখা দেন। চল না আমরা মাতৃ-দর্শনে যাই।
রামধন। চল।
উভয়ে নিষ্ক্রান্ত
SCENE II
রাজার অন্তঃপুর
রাজা রাজেন্দ্র একা
রাজা। কে না জানে আকাশে মেঘ উঠে? তবে কেন এত ভাবি-মেঘ উঠে মেঘ ছাড়ে। এ মেঘও উড়িয়া যাইবে-তবে কেন এত চিন্তা করি? মনে করিয়াছিলাম এ নির্ম্মল আকাশে কখনও বুঝি মেঘ উঠিবে না, আমি মূর্খ তাই এত ভাবি। হায়! কোথা হইতে আবার এ প্রবল শত্রু দেখা দিল?
(কলাবতীর সজ্জিতা সখীদিগের প্রবেশ)
তোরা কেন গো? এত সাজগোজ যে।
দিবা। আমরা নাচব।
রাজা। খানখা নাচবে কেন গো?
নিশা। রাণী কলাবতীর হুকুম। [নৃত্য আরম্ভ]
রাজা। কেন নাচের হুকুম কেন?
দিবা। আগে নাচি। [নৃত্য]
রাজা। আগে বল্।
নিশা। আগে নাচি।
রাজা। আ মর! তোর পা যে থামে না-জোর করে নেচে যাবি নাকি-আমি দেখিব না-এই চোক বুজিলাম। [চোখ বুজিয়া]
দিবা। দেখুন মহারাজ! আপনাকে মুখ ভেঙ্গাচ্চে।
নিশা। দেখুন মহারাজ, আপনাকে কলা দেখাচ্চে।
রাজা। মরগে যা তোরা! আমি চোক চাব না।
নিশা। আচ্ছা কান তো খোলা আছে।
(করতালি দিয়া গীত)
নয়ন মুদিয়া, দেখিনু সজনী,
কানুর কুটিল রূপ।
গলেতে বাঁধিয়া পিরীতি কলসী
সাগরে দিনু যে ডুব।
রাজা। শুনবো না। [কর্ণে হস্তার্পণ]
দিবা। তবে ফুলের ঘ্রাণ নিন।
(কবরী হইতে পুষ্প লইয়া রাজার নাসিকার নিকট ধারণ)
রাজা। নিঃশ্বাস বন্ধ করিলাম।
নিশা। চক্ষু কর্ণ নাসিকা বন্ধ। রসনা বাকি আছে-চল ভাই রান্নামহলে খবর দিই।
রাজা। মুখ বুজিয়া থাকিব।
নিশা। তবে বড় মা ঠাকুরাণীকে ডেকে দিই।
রাজা। কেন সে ভয়ঙ্কর ব্যাপার কেন?
নিশা। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আপনার বাকি আছে পিঠের চামড়া।
(কলাবতীর প্রবেশ)
কলা। আ মলো, তোরা বড় বাড়ালি, দূর হ!
[সখীদ্বয় নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। দেখত কলাবতী, তোমার লোকজন আমায় কিছু মানে না, আমার উপর বড় অত্যাচার করে!
কলা। কি অত্যাচার করেছে মহারাজ? একটু হাসিয়াছে? সেটা আমারই অপরাধ। তোমার মুখে কয় দিন হাসি দেখি নাই বলিয়া আমি ওদের পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।
রাজা। আমার মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে-আমি হাসিব কি?
কলা। কি পাহাড় মহারাজ! আমায় ত কিছু বল নাই। যা ইচ্ছা করিয়া বল না-তা সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করি না। কি পাহাড় মহারাজ! পড়িলে তোমার একার ঘাড়ে পড়িবে না।
রাজা। পাহাড় আর কিছু নয়-খোদ দিল্লীশ্বর ঔরঙ্গজেব। এই ক্ষুদ্র রাজ্যের উপর নজর পড়িয়াছে, বাদশাহের যাহাতে নজর পড়ে তাহা তিনি না লইয়া ছাড়েন না।
কলা। এ সম্বাদ কোথা পাইলেন?
রাজা। আত্মীয়লোকে দূতমুখে বলিয়া পাঠাইয়াছে। বিশেষ, ঢাকায় সুবাদার অনেক সৈন্য জমা করিতেছেন। লোকে বলে প্রতাপনগরের জন্য।
কলা। কেন আমরা কি অপরাধ করিয়াছি?
রাজা। অপরাধ বিস্তর। প্রতাপনগর ধনধান্য পূর্ণ-লোক এখানে দারিদ্র্যশূন্য- আর আমরা হিন্দু! হিন্দুর ঐশ্বর্য্য বাদশাহের চক্ষুশূল।
কলা। যদি এ সম্বাদ সত্য হয়, তবে আমরাও যুদ্ধের উদ্যোগ না করি কেন?
রাজা। তুমি পাগল! দিল্লীশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ কি আমার সাধ্য! জয় কি হইবে?
কলা। না, তবে বিনা যুদ্ধে মরিব কেন?
রাজা। দেখি যদি বিনা যুদ্ধে কার্য্যোদ্ধার হয়। আমার ইচ্ছা একবার ঢাকায় যাই। আপনি সুবাদারের মন বুঝি, কোন ছলে যদি বশীভূত করিতে পারি করি।
কলা। এমন কর্ম্ম করিও না-ঔরঙ্গজেবের নায়েবকে বিশ্বাস কি? আর আসিতে দিবে না।
রাজা। সম্ভব-কিন্তু তাহাতে তাহার লাভ হইবে কি?
কলা। রাজহীন রাজ্য সহজে হস্তগত করিবে।
রাজা। আমি গেলে তুমি রাজ্যের রক্ষক থাকিবে।
কলা। ছি! স্ত্রীলোকের বাহুতে বল কিরাজা। এখানে বাহুবলের কাজ নয়। বুদ্ধিবলই ভরসা। প্রতাপনগরে বুদ্ধিবল তুমি একা।
কলা। মহারাজ, আপনাকে যাইতে দিতে আমার মন সরিতেছে না।
রাজা। থাকিলেই কোন মঙ্গল! যুদ্ধেই কোন মঙ্গল!
কলা। মারহাট্টা যুদ্ধ করিতেছে-আমরা কি মানুষ নই?
রাজা। না, আমরা মানুষ নই। শিবাজীর কাজ কি আমার দ্বারা সম্ভবে? আমি যাওয়াই স্থির করিতেছি। এখন শয়নঘরে চলিলাম।
[নিষ্ক্রান্ত]
কলাবতী। (স্বগত) বিধাতা, যদি আমায় স্ত্রীলোক করিয়াছিলে তবে আমায়- দূর হৌক সে কথায় এখন আর কাজ কি? হায়! আমি রাণী কিন্তু রাজা কই? রাজা অভাবে প্রতাপনগর রক্ষা হইবে না। হায়! রাণী হইলাম ত রাজা পাইলাম না কেন?
(দিবার প্রবেশ)
(চক্ষু মুছিয়া) কি লো দিবি?
দিবা। এই কাগজটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি। [এক পত্র দিল]
কলা। (পড়িলেন) “আমি রাজা রাজেন্দ্রের আজিও প্রবল শত্রু-প্রতাপনগর ধ্বংস করিয়া তোমাকে গ্রহণ করিব। নইলে ভালোয় ভালোয় এসো।”
এ পত্র কোথায় পাইলি?
দিবা। আজ্ঞে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি।
কলা। তোকে ফাঁসি দিব। আবশ্যক হইলে আমি হুকুম দিই, তা তুই জানিস?
দিবা-জানি-তা আমি কুড়িয়ে না পেলুম তা কোথা পেলুম?
কলা। কোথা পেলি? তুই হাতে হাতে নিয়েছিস!
দিবা। মাইরি রাণীমা, আমি হাতে হাতে নিই নে।
কলা। তবে কোথায় পেলি বল, নইলে ফাঁসি দিব।
দিবা। আমি পায়রার গলায় পেয়েছি।
কলা। সে পায়রা কোথায়?
দিবা। পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি।
কলা। কালি কলম নিয়ে আয়-জবাব লেখ্।
দিবা। কালি কলম আছে-কি লিখিব।
কলা। লেখ্, “আমি তোমার পরম শত্রু-তোমায় ধ্বংস করিয়া প্রতাপনগর রক্ষা করিব।” লেখা হইল?
দিবা। লিখেছি-পায়রার গলায় বেঁধে দিয়ে আসি?
কলা। দে গিয়ে।
দিবা। হাঁ রাণীমা এ কে মা-
কলা। চুপ! কথা মুখে আনিলে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দিব। [দিবা নিষ্ক্রান্ত]
কলা। পায়ে কাঁটা ফুটিলে কাঁটা দিয়ে বাহির করিতে হয়, বুঝি আমাকে তাহাই করিতে হইবে।