- বইয়ের নামঃ বিবিধ রচনা (বঙ্কিম)
- লেখকের নামঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অসম্পূর্ণ রচনা
নাটিকা
DRAMATIS PERSONÆ
রামধন-রামকৃষ্ণ-কলাবতী-দিবা-নিশা
প্রথম অঙ্ক
SCENE I
প্রতাপনগরের রাজবর্ত্ম
রামধন-রামকৃষ্ণ
রামধন। কিসের এত গোল?
[নেপথ্যে বহু লোকে “জয় জয় কলাবতী”]
ও কিসের জয়ধ্বনি?
রামকৃষ্ণ। জান না রাণী কলাবতী স্নান করিয়া যাইতেছেন।
রামধন। রাণী স্নান করিয়া যাইতেছেন, তার এত জয়ধ্বনি কেন?
[নেপথ্যে “জয় জয় রাণীজিকি জয়”]
ঐ শুন।
রামকৃষ্ণ। তুমি বিদেশী তাই অবাক্ হইতেছ। রাণী কলাবতীকে এ নগরের লোক বড় ভক্তি করে। বড়ই ভালবাসে।
রামধন। কেন রাণীর কিছু বিশেষ গুণ আছে?
রামকৃষ্ণ। তা আছে-রাণী অতিশয় দানশীলা আর বড় প্রজাবৎসলা। যার যে দুঃখ থাকে, রাণীকে জানাইতে পারিলেই-হইল-তার দুঃখ ঘুচিবে।
[নেপথ্যে “জয় জয় মা কলাবতীর জয়”]
ঐ শোন সকলেই রাণীকে মা বলিতেছে, তিনি প্রজামাত্রেরই মা’র মত। তাঁর গুণেই এখানকার প্রজারা এত সুখী।
রামধন। বটে! তবে রাজার এত সুখ্যাতি কেন?
রামকৃষ্ণ। রাণীর গুণে।
রামধন। তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যায়? তিনি কি প্রাচীনা।
রামকৃষ্ণ। না, তিনি বড় অল্পবয়স্কা তবে সকলের মা বলিয়া সকলকেই দেখা দেন। চল না আমরা মাতৃ-দর্শনে যাই।
রামধন। চল।
উভয়ে নিষ্ক্রান্ত
SCENE II
রাজার অন্তঃপুর
রাজা রাজেন্দ্র একা
রাজা। কে না জানে আকাশে মেঘ উঠে? তবে কেন এত ভাবি-মেঘ উঠে মেঘ ছাড়ে। এ মেঘও উড়িয়া যাইবে-তবে কেন এত চিন্তা করি? মনে করিয়াছিলাম এ নির্ম্মল আকাশে কখনও বুঝি মেঘ উঠিবে না, আমি মূর্খ তাই এত ভাবি। হায়! কোথা হইতে আবার এ প্রবল শত্রু দেখা দিল?
(কলাবতীর সজ্জিতা সখীদিগের প্রবেশ)
তোরা কেন গো? এত সাজগোজ যে।
দিবা। আমরা নাচব।
রাজা। খানখা নাচবে কেন গো?
নিশা। রাণী কলাবতীর হুকুম। [নৃত্য আরম্ভ]
রাজা। কেন নাচের হুকুম কেন?
দিবা। আগে নাচি। [নৃত্য]
রাজা। আগে বল্।
নিশা। আগে নাচি।
রাজা। আ মর! তোর পা যে থামে না-জোর করে নেচে যাবি নাকি-আমি দেখিব না-এই চোক বুজিলাম। [চোখ বুজিয়া]
দিবা। দেখুন মহারাজ! আপনাকে মুখ ভেঙ্গাচ্চে।
নিশা। দেখুন মহারাজ, আপনাকে কলা দেখাচ্চে।
রাজা। মরগে যা তোরা! আমি চোক চাব না।
নিশা। আচ্ছা কান তো খোলা আছে।
(করতালি দিয়া গীত)
নয়ন মুদিয়া, দেখিনু সজনী,
কানুর কুটিল রূপ।
গলেতে বাঁধিয়া পিরীতি কলসী
সাগরে দিনু যে ডুব।
রাজা। শুনবো না। [কর্ণে হস্তার্পণ]
দিবা। তবে ফুলের ঘ্রাণ নিন।
(কবরী হইতে পুষ্প লইয়া রাজার নাসিকার নিকট ধারণ)
রাজা। নিঃশ্বাস বন্ধ করিলাম।
নিশা। চক্ষু কর্ণ নাসিকা বন্ধ। রসনা বাকি আছে-চল ভাই রান্নামহলে খবর দিই।
রাজা। মুখ বুজিয়া থাকিব।
নিশা। তবে বড় মা ঠাকুরাণীকে ডেকে দিই।
রাজা। কেন সে ভয়ঙ্কর ব্যাপার কেন?
নিশা। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আপনার বাকি আছে পিঠের চামড়া।
(কলাবতীর প্রবেশ)
কলা। আ মলো, তোরা বড় বাড়ালি, দূর হ!
[সখীদ্বয় নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। দেখত কলাবতী, তোমার লোকজন আমায় কিছু মানে না, আমার উপর বড় অত্যাচার করে!
কলা। কি অত্যাচার করেছে মহারাজ? একটু হাসিয়াছে? সেটা আমারই অপরাধ। তোমার মুখে কয় দিন হাসি দেখি নাই বলিয়া আমি ওদের পাঠাইয়া দিয়াছিলাম।
রাজা। আমার মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে-আমি হাসিব কি?
কলা। কি পাহাড় মহারাজ! আমায় ত কিছু বল নাই। যা ইচ্ছা করিয়া বল না-তা সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করি না। কি পাহাড় মহারাজ! পড়িলে তোমার একার ঘাড়ে পড়িবে না।
রাজা। পাহাড় আর কিছু নয়-খোদ দিল্লীশ্বর ঔরঙ্গজেব। এই ক্ষুদ্র রাজ্যের উপর নজর পড়িয়াছে, বাদশাহের যাহাতে নজর পড়ে তাহা তিনি না লইয়া ছাড়েন না।
কলা। এ সম্বাদ কোথা পাইলেন?
রাজা। আত্মীয়লোকে দূতমুখে বলিয়া পাঠাইয়াছে। বিশেষ, ঢাকায় সুবাদার অনেক সৈন্য জমা করিতেছেন। লোকে বলে প্রতাপনগরের জন্য।
কলা। কেন আমরা কি অপরাধ করিয়াছি?
রাজা। অপরাধ বিস্তর। প্রতাপনগর ধনধান্য পূর্ণ-লোক এখানে দারিদ্র্যশূন্য- আর আমরা হিন্দু! হিন্দুর ঐশ্বর্য্য বাদশাহের চক্ষুশূল।
কলা। যদি এ সম্বাদ সত্য হয়, তবে আমরাও যুদ্ধের উদ্যোগ না করি কেন?
রাজা। তুমি পাগল! দিল্লীশ্বরের সঙ্গে যুদ্ধ কি আমার সাধ্য! জয় কি হইবে?
কলা। না, তবে বিনা যুদ্ধে মরিব কেন?
রাজা। দেখি যদি বিনা যুদ্ধে কার্য্যোদ্ধার হয়। আমার ইচ্ছা একবার ঢাকায় যাই। আপনি সুবাদারের মন বুঝি, কোন ছলে যদি বশীভূত করিতে পারি করি।
কলা। এমন কর্ম্ম করিও না-ঔরঙ্গজেবের নায়েবকে বিশ্বাস কি? আর আসিতে দিবে না।
রাজা। সম্ভব-কিন্তু তাহাতে তাহার লাভ হইবে কি?
কলা। রাজহীন রাজ্য সহজে হস্তগত করিবে।
রাজা। আমি গেলে তুমি রাজ্যের রক্ষক থাকিবে।
কলা। ছি! স্ত্রীলোকের বাহুতে বল কিরাজা। এখানে বাহুবলের কাজ নয়। বুদ্ধিবলই ভরসা। প্রতাপনগরে বুদ্ধিবল তুমি একা।
কলা। মহারাজ, আপনাকে যাইতে দিতে আমার মন সরিতেছে না।
রাজা। থাকিলেই কোন মঙ্গল! যুদ্ধেই কোন মঙ্গল!
কলা। মারহাট্টা যুদ্ধ করিতেছে-আমরা কি মানুষ নই?
রাজা। না, আমরা মানুষ নই। শিবাজীর কাজ কি আমার দ্বারা সম্ভবে? আমি যাওয়াই স্থির করিতেছি। এখন শয়নঘরে চলিলাম।
[নিষ্ক্রান্ত]
কলাবতী। (স্বগত) বিধাতা, যদি আমায় স্ত্রীলোক করিয়াছিলে তবে আমায়- দূর হৌক সে কথায় এখন আর কাজ কি? হায়! আমি রাণী কিন্তু রাজা কই? রাজা অভাবে প্রতাপনগর রক্ষা হইবে না। হায়! রাণী হইলাম ত রাজা পাইলাম না কেন?
(দিবার প্রবেশ)
(চক্ষু মুছিয়া) কি লো দিবি?
দিবা। এই কাগজটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি। [এক পত্র দিল]
কলা। (পড়িলেন) “আমি রাজা রাজেন্দ্রের আজিও প্রবল শত্রু-প্রতাপনগর ধ্বংস করিয়া তোমাকে গ্রহণ করিব। নইলে ভালোয় ভালোয় এসো।”
এ পত্র কোথায় পাইলি?
দিবা। আজ্ঞে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি।
কলা। তোকে ফাঁসি দিব। আবশ্যক হইলে আমি হুকুম দিই, তা তুই জানিস?
দিবা-জানি-তা আমি কুড়িয়ে না পেলুম তা কোথা পেলুম?
কলা। কোথা পেলি? তুই হাতে হাতে নিয়েছিস!
দিবা। মাইরি রাণীমা, আমি হাতে হাতে নিই নে।
কলা। তবে কোথায় পেলি বল, নইলে ফাঁসি দিব।
দিবা। আমি পায়রার গলায় পেয়েছি।
কলা। সে পায়রা কোথায়?
দিবা। পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি।
কলা। কালি কলম নিয়ে আয়-জবাব লেখ্।
দিবা। কালি কলম আছে-কি লিখিব।
কলা। লেখ্, “আমি তোমার পরম শত্রু-তোমায় ধ্বংস করিয়া প্রতাপনগর রক্ষা করিব।” লেখা হইল?
দিবা। লিখেছি-পায়রার গলায় বেঁধে দিয়ে আসি?
কলা। দে গিয়ে।
দিবা। হাঁ রাণীমা এ কে মা-
কলা। চুপ! কথা মুখে আনিলে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দিব। [দিবা নিষ্ক্রান্ত]
কলা। পায়ে কাঁটা ফুটিলে কাঁটা দিয়ে বাহির করিতে হয়, বুঝি আমাকে তাহাই করিতে হইবে।
SCENE III
রাজার অন্তঃপুর
দিবা-নিশা
দিবা। রাজা ঢাকায় চলিল কেন ভাই?
নিশা। তোর জন্য ঢাকাই কাপড় আন্তে।
দিবা। আমি ত এমন হুকুম দিই নে, আমার যে ঢাকাই কাপড় আছে।
নিশা। তবে তোর বর আন্তে।
দিবা। কেন এ দেশে কি বর পাওয়া যায় না?
নিশা। এ দেশে তেমন দাড়ি পাওয়া যায় না-তোমাকে একটা নেড়ে বর এনে দেবে।
দিবা। তা তার জন্য আর রাজার নিজে যাবার দরকার কি? আমায় বললে আমি একটা খুঁজে পেতে নিতুম। না হয় গোবিন্দ বখশীকে একটা পরচুলো দাড়ি পরিয়ে ঘরে নিয়ে আসতুম।
নিশা। আচ্ছা, বখশী মশাইকে বলে রাখ্ব।
দিবা। দূর হ পাপিষ্ট-তোর কাছে কোন কথাই বলবার যো নাই। তা যাক্- সত্য সত্য রাজা ঢাকায় চলল কেন?
নিশা। কি জানি কেন-রাজা রাজড়ার মন তুমি আমি কি বুঝ্ব।
দিবা। তা, রাজা কি ফিরিবে না কি?
নিশা। সে কি কথা? অমন কথা মুখে আনতে আছে! দিবা। রাণী কলাবতী অত কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে কেন?
নিশা। স্বামী বিদেশে গেলে একটু কাঁদ্তে হয়।
দিবা। দূর! স্বামী ছেড়ে স্বামীর বাবার জন্য আমি কাঁদি নে।
নিশা। তোর সাত পুরুষের ভিতর স্বামী নাই, তুই আবার কাঁদবি কার জন্য? বরং রাজার জন্য একটু কাঁদিস ত কাঁদ।
দিবা। না ভাই তা পারিব না। বরং মনের দুঃখে বসে বসে লুচি মণ্ডা খাই গে চল।
নিশা। তাও মন্দ নয়।
দ্বিতীয়াঙ্ক
SCENE I
সুবাদার-রাজা
রাজা। আমার কি অপরাধ? কি জন্য দিল্লীশ্বর আমার উপর পীড়ন করিতে উদ্যত?
সুবা। আপনি মুসলমানের দ্বেষক। বাদশাহ মুসলমানের ধর্ম্মরক্ষক। সুতরাং বাদশাহ-
রাজা। আমি কিসের মুসলমানের দ্বেষক? আমার রাজ্যে হিন্দু মুসলমান তুল্য-
সুবা। প্রতাপনগরে একটি মসজীদ নাই-মুসলমানে নমাজ করিতে পায় না।
রাজা। আমি মসজীদ প্রস্তুত করিয়া দিব।
সুবা। প্রতাপনগরে একটি কাজি নাই-মুসলমানের বিচার কি হিন্দুর কাছে হয়?
রাজা। আমি কাজি নিযুক্ত করিব।
সুবা। মহারাজ-আপনি যদি বাদশাহের এরূপ বশ্যতাপন্ন হন, তবে বাদশাহ কেন আপনাকে রাজ্যচ্যুত করিবেন? কিন্তু আসল কথা এখনও বাকি আছে- প্রতাপনগরে মুসলমানে জবাই করিতে পায় না-তার কি হইবে?
রাজা। গোরু ভিন্ন অন্য জবাইয়ে আপত্তি করিব না।
সুবা। কিন্তু গোরুই আসল কথা।
রাজা। হিন্দু হইয়া গোহত্যা করিতে দিব কি প্রকারে?
সুবা। তবে হিন্দুয়ানি ত্যাগ করুন।
রাজা। ধর্ম্মত্যাগ করিব? ইহকাল পরকাল খোয়াইব? এ কথাও কানে শুনিতে হইল।
সুবা। ইহকাল নষ্ট হইবে না। আপনি ইসলামের ধর্ম্ম গ্রহণ করিলে বরং ইহকালে সুখী হইবেন। রাজ্য বজায় থাকিবে এবং আরও বাড়াইয়া দিব। আর পরকালও যাইবে না। ইসলামই সত্য ধর্ম্ম-দেখুন কত বড় বড় হিন্দু এখন মুসলমান হইতেছে। তাহারা কি না বুঝিয়া ধর্ম্মত্যাগ করিতেছে? বরং আপনার যদি সন্দেহ থাকে, তবে আমি ভাল ভাল মোল্লামুফ্তি আপনার কাছে পাঠাইয়া দিতেছি। তাহাদের সঙ্গে বিচার করুন-বিচারে যদি ইসলাম সত্য ধর্ম্ম বলিয়া বোধ হয়, তবে গ্রহণ করিবেন ত?
রাজা। ইচ্ছা হয় মোল্লা মুফ্তি পাঠাইবেন। কিন্তু কিছু ফলোদয় সম্ভাবনা নাই। সম্প্রতি আমি যাহা নিবেদন করিলাম, অনুগ্রহ করিয়া বাদশাহের নিকট জানাইবেন। গোহত্যা ভিন্ন আর সকলেই আমি সম্মত-বার্ষিক কর দিতেও সম্মত। আজ আমি বিদায় হইব-যে হুকুম হয় অনুগ্রহ করিয়া জানাইবেন।
সুবা। কোথা যাইবেন?
রাজা। অনেক দিন আসিয়াছি, স্বদেশে যাইব।
সুবা। সে কি? আপনার শুভাগমনের সম্বাদ আমি দিল্লীতে এত্তেলা করিয়াছি। সেখান হইতে খেলওয়াত আসিবে-তাহা না গ্রহণ করিয়া কি যাওয়া হয়।
রাজা। বড় অনুগৃহীত হইতেছি কিন্তু আমার অবর্ত্তমানে রাজ্য বিশৃঙ্খল হইতেছে।
সুবা। নাচার-আপনাকে অবশ্য অপেক্ষা করিতে হইতেছে। আপনার ফৌজ সকল বিদায় দিন।
রাজা। সে কি আমাকে কয়েদ রাখিতে চাহেন?
সুবা। ও সব কথা কেন? তবে দিনকত আপনাকে এখানে থাকিতে হইবে। দিল্লীর হুকুম না আসিলে ছেড়ে দিতে পারিব না।
রাজা। (স্বগত) হায়! কলাবতী তুমি যা বলিয়াছিলে তাহাই হইল। (সুবাদারকে) যাহা হুকুম হয় তাহাই তামিল করিব।
সুবা। তছলীম। [সুবাদার নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। কয়েদই ত হইলাম। প্রমথ-প্রমথ
(প্রমথের প্রবেশ)
আমার আজকাল ফিরিয়া যাওয়া হইতেছে না, তুমি প্রতাপনগরে এই সম্বাদ লইয়া যাও।
প্রমথ। যাইব কি প্রকারে? সকল পথে পাহারা-আমাদের কয়েদ করিয়াছে।
রাজা। আমার শিপাহী সব কোথা?
প্রমথ। নবাবের লোকে তাহাদের হাতিয়ার কাড়িয়া লইয়াছে-তাহাদিগকে প্রতাপনগরে ফিরিয়া যাইবার হুকুম হইয়াছে।
রাজা। ভাল, তাহারাই গিয়া সম্বাদ দিবে।
প্রমথ। দিলেই বা কি হইবে।
SCENE II
কলাবতী-নিশা
কলা। আজ একুশ দিন হইল মহারাজ ঢাকায় গিয়াছেন, আজও কই কোন সম্বাদ ত পাইলাম না।
নিশা। হাঁ রাণীমা, রাজরাণীতেও কি এমনি কর্র্যে দিন গণে?
কলা। কই আমি দিন গণিলাম?
নিশা। কাঁদ কেন মা, আমি ত এমন কিছু বলি নাই।
কলা। নিশা, তুই একবার শহরের ভিতর একটা শিয়ানা লোক পাঠাইতে পারিস্-অবশ্য কেহ কোন সম্বাদ শুনিয়াছে, কেন না ঢাকায় ঢের লোক যায় আসে। আমি এত লোক পাঠাইলাম, কেহ ত ফিরিল না। বোধ হয়, মন্দ সম্বাদই আসিয়াছে-লোকে সাহস করিয়া আমার সাক্ষাতে বলিতে পারিতেছে না।
নিশা। আপনাকে ব্যস্ত দেখিয়া আমি আপনার বুদ্ধিতেই শহরে অনুসন্ধান করিতে লোক পাঠাইয়া দিলাম-কিন্তু-
কলা। কিন্তু কি?
নিশা। লোকে বলে যে মহারাজকে সুবাদার আটক করেছে-অমন কর কেন মা! এই জন্য ত বলি নাই। একটু শোও আমি বাতাস করি। উড়ো কথায় বিশ্বাস কি?
কলা। বিশ্বাস সম্পূর্ণ। আমি আগেই বলিয়াছিলাম যে গেলে তাঁকে আটক করিবে। নিশি! এখন আমার দশা কি হইবে! (রোদন)
নিশা। কাঁদিলে কি হবে মা। আমাদের সকলেরই ত এক দশা হইবে। আমরাও নিরাশ্রয় হইলাম-এখন মুসলমানের হাতে জাতি মান প্রাণ সব যাবে।
কলা। কি বলিলি সবার এক দশা? তোদের যে রাজা মাত্র-আমার যে স্বামী। তুই কি জানিস স্বামী কি ধন!
নিশা। তা বটে। রাজ্য যায় তবু প্রাণটা থাকিলে আমরা বজায় থাকিব। ভাল মা, এক কাজ কর না কেন? রাজার কাছে কেন লোক পাঠাও না যে সুবাদারকে রাজ্য ছাড়িয়া দিয়া আসুন-আমরা না হয় তাঁকে গহনা পত্র বিক্রয় করিয়া খাওয়াইব। কাঁদ কেন মা এ কথায়?
কলা। তুই কেন আমায় অপমান করিস্? কি! আমার স্বামীকে আমি রাজ্যত্যাগ করিয়া প্রাণ বাঁচাইতে বলিব! নিশা-তোদের ভয় হইয়া থাকে তোরা চলিয়া যা-আমার স্বামী রাজা-তিনি রাজার কাজ করিবেন।-কিসের গোল ঐ?
[নেপথ্যে বহু লোক “জয় মা কলাবতীর জয়”]
আজিকার দিনে কে বলে কলাবতীর জয়?
(দিবার প্রবেশ)
দিবা। মহারাণী! নগরের সকল প্রজা আসিয়া রাজবাড়ী ঘেরিল।
কলা। কি হয়েছে?
দিবা। সকলে বলিতেছে ঢাকার সুবাদার রাজাকে কয়েদ করিয়াছে।
কলা। তার পর প্রজারা কি বলে। [নেপথ্যে “মহারাণী কলাবতীর জয়”] ওরা কি চায় দিবা?
দিবা। আপনি স্বকর্ণে শুনুন।
কলা। প্রজারা আমার পুত্র, আমার [নিকট] অবারিতদ্বার। প্রধানদিগকে আমার কাছে ডাকিয়া আন।
(দিবার প্রস্থান। কতিপয় নগরবাসীর সহিত পুনঃপ্রবেশ)
প্রজাবর্গ। জয় কলাবতীর জয়।
কলা। কি চাও বাবা তোমরা?
১ম প্রজা। মা, আমাদের রাজা কোথায়?
২য় প্রজা। মা, আমাদের রাজাকে নাকি দুষ্ট যবন কয়েদ করিয়াছে? মা, আমাদের বাহুতে কি বল নাই যে বাপের উদ্ধার করি? -বঙ্কিম-কণিকা, পৃ,১- ২২।
নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী
প্রথম পরিচ্ছেদ
“ভাল, সারি, সত্য বল দেখি, তোমার বিশ্বাস কি? ভূত আছে?”
বরদা, ছোট ভাই সারদাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিল। সন্ধ্যার পর, টেবিলে দুই ভাই খাইতেছিল-একটু রোষ্ট মটন প্লেটে করিয়া, ছুরি কাঁটা দিয়া তৎসহিত খেলা করিতে করিতে জ্যেষ্ঠ বরদা এই কথা কনিষ্ঠকে জিজ্ঞাসা করিল।
সারদা প্রথমে উত্তর না করিয়া এক টুকরো রোষ্টে উত্তম করিয়া মাষ্টার্ড মাখাইয়া, বদনমধ্যে প্রেরণপূর্ব্বক, আধখানা আলুকে তৎসহবাসে প্রেরণ করিয়া, একটি রুটি ভাঙ্গিয়া বাম হস্তে রক্ষাপূর্ব্বক, অগ্রজের মুখ পানে চাহিতে চাহিতে চর্ব্বর্ণ কার্য্য সমাপন করিল। পরে, এতটুকু সেরি দিয়া, গলাটা ভিজাইয়া লইয়া বলিল, “ভূত? না।”
এই বলিয়া সারদাকৃষ্ণ সেন পরলোকগত এবং সুসিদ্ধ মেষশাবকের অবশিষ্টাংশকে আক্রমণ করিবার উদ্যোগ করিলেন।
বরদাকৃষ্ণ কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইয়া বলিল, “Rather laconic.”
সারদাকৃষ্ণের রসনার সহিত রসাল মেষমাংসের পুনরালাপ হইতেছিল, অতএব সহসা উত্তর করিল না। যথাবিহিত সময়ে অবসর প্রাপণান্তর তিনি বলিলেন, “Laconic? বরং একটা কথা বেশী বলিয়াছি। তুমি জিজ্ঞাসা করিলে ‘ভূত আছে’-আমার বলিলেই হইত ‘না।’ আমি বলিয়াছি, ‘ভূত? না।’ ‘ভূত?’ কথাটা বেশী বলিয়াছি। কেবল তোমার খাতিরে।”
“অতএব তোমার ভ্রাতৃভক্তির পুরস্কারস্বরূপ, এই স্বর্গপ্রাপ্ত চতুষ্পদের খণ্ডান্তর প্রসাদ দেওয়া গেল।” এই বলিয়া বরদা, আর কিছু মটন কাটিয়া ভ্রাতার প্লেটে ফেলিয়া দিলেন। সারদা অবিচলিতচিত্তে, তৎপ্রতি মনোভিনিবেশ করিল!
তখন বরদা বলিল, Seriously সারি, ভূত আছে বিশ্বাস কর না?”
সারি। না।
বরদা। কেন বিশ্বাস কর না?
সারদা। সেই প্রাচীন ঋষির কথা-প্রমাণাভাবাৎ। কপিল প্রমাণ-অভাবে ঈশ্বর মানিলেন না-আর আমি প্রমাণ-অভাবে ভূত মানিব?
এই বলিয়া সারদা এক গেলাস সেরি মেষের সৎকারার্থ আপনার উদরমধ্যে প্রেরণ করিল।
বরদাকৃষ্ণ চটিয়া উঠিল-বলিল, “কোথাকার বাঁদর। ভূত নাই!- ঈশ্বর নাই! তবে তুমিও নেই, আমিও নেই?”
সারি। তাই বটে। তোমার মটন রোষ্ট ফুরাইল, দেখিয়া, আমি নেই। আর আমার আহারের ঘটা দেখিয়া, বোধ হয় তুমিও নেই।
বরদা, “কই, খেলি কই?” এই বলিয়া অবশিষ্ট মাংসটুকু কাটিয়া ভাইয়ের প্লেটে সংস্থাপিত করিয়া, গ্লাসে সেরি ঢালিয়া দিলেন। সারদা যতক্ষণ মাংসের ছেদন, বিন্ধন, মুখে উত্তোলন এবং চর্ব্বণ ইত্যাদি কার্য্যে নিযুক্ত ততক্ষণ বরদা চুপ করিয়া রহিল, পরে অবসর পাইলে, সারদা জ্যেষ্ঠকে বলিল, “তুমি নাই, আর আমি নাই-ইহা প্রায় philosophically true -কেন না, আমরা “mere permanent possibilities of sensation.” আর এই যে আহার করিলাম, ইহাও না করার মধ্যে জানিবে,-কেবল সেই possible sensation গুলার মধ্যে কতকগুলা sensation হইল মাত্র।
বরদা। সেই কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছি, ভূত দেখা, ভূতের শব্দ শুনা, এ সব possible sensation নহে?
সারদা। ভূত থাকিলে possible.
বর। ভূত নাই?
সার। তা ঠিক বলিতেছি না-তবে প্রমাণ নাই বলিয়া ভূতে বিশ্বাস নাই, ইহাই বলিয়াছি।
বর। প্রত্যক্ষ কি প্রমাণ নহে?
সার। আমি কখন ভূত প্রত্যক্ষ করি নাই।
বর। টেমস্ নদী প্রত্যক্ষ করিয়াছ?
সার। না।
বর। টেমস্ নদী আছে মান?
সার। যাহাদের কথায় বিশ্বাস করা যায়, এমন লোক প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
বর। ভূতও এমন লোক প্রত্যক্ষ করিয়াছে।
সার। বিশ্বাসযোগ্য এমন কে? এক জনের নাম কর দেখি?
বর। মনে কর, আমি।
এই কথা বলিতে বরদার মুখ কালো হইয়া গেল-শরীর রোমাঞ্চিত হইল।
সার। তুমি?
বর। তা হইলে বিশ্বাস কর।
সার। তুমি একটু imaginative, একটু sentimental-রজ্জুকে সর্প ভ্রম হইতে পারে।
বর। তুমি দেখিবে?
সার। দেখিব না কেন?
বর। আচ্ছা তবে আহার সমাপ্ত করা যাউক।
-‘নারায়ণ’, বৈশাখ ১৩২২, পরিশিষ্ট।
ভিক্ষা
আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিয়াছি, এ যাত্রা ভিক্ষা করিয়া কাটাইব। আমাদের দেশ-ভাল দেশ, ভিক্ষায় বড় মান ; যে নির্ব্বোধ, সে পরিশ্রম করুক, আমি ভিক্ষা করিব।
কেহ মনে করিবেন না যে, আমি অন্ধ, কি খঞ্জ, কি বধির, কি পীড়িত, কি দীনদুঃখী। এ দেশে ভিক্ষা করিতে সে সব আড়ম্বরের প্রয়োজন কি? ভিক্ষা করিলেই হইল।
কে ভিক্ষা না করে? দীন-হীন, ধনবানের নিকট ভিক্ষা করে, ধনবানও দীন-হীনের নিকট ভিক্ষা করে। বড় বড় প্রকাণ্ডোদর জমীদারেরা দুঃখী প্রজাদের কাছে ভিক্ষা করেন ; আজ পিতৃশ্রাদ্ধ, কাল পুত্রের যজ্ঞোপবীত, তার পরদিন কন্যার বিবাহ। প্রজার নিকট ভিক্ষা না করিলে এ সব কর্ম্মে মান থাকে কই? বড় বড় কুলীন, তাঁহারা স্ত্রীর কাছে ভিক্ষা করিয়া উদর পরিপূরণ করেন, নহিলে নবধা কুললক্ষণ উজ্জ্বল হয় না। বড় বড় অধ্যাপক আচার্য্য গোস্বামীরা ভিক্ষা করেন, নহিলে পরকালের কাজ হয় না। তাঁহারা একান্ত পরহিতৈষী সন্দেহ নাই।
কে ভিক্ষা না করে? আমাদের দেশে সকলেই ভিক্ষা করে, কেবল ভিক্ষুক বিশেষে আর ভিক্ষার সময় বিশেষে, ভিক্ষার বিশেষ বিশেষ নাম আছে মাত্র। জমীদারের ভিক্ষার নাম মাঙ্গন, তাঁহাদের অনুচরদিগের ভিক্ষার নাম পার্ব্বণী, ভব-পারাবারের ত্রাণকর্ত্তা গুরুবর্গের ভিক্ষার নাম প্রণামী, আত্মীয় সমতুল্য ব্যক্তির ভিক্ষার নাম বিদায়। বরযাত্রীর ভিক্ষার নাম গণ, বরের বাপের ভিক্ষার নাম পণ, যে গ্রামে বিবাহ সে গ্রামের ভদ্রলোকদিগের ভিক্ষার নাম ডেলাভাঙ্গানি, আর তাহাদের যুবতীদের – অবলাবালাদিগের ভিক্ষার নাম -সেজতোলানি। নাছোড়বন্ধ ব্রাহ্মণ ভিখারীর ভিক্ষার নাম বার্ষিক। যাঁহার বাড়ীতে ঠাকুরদেবতা আছেন, তাঁহার ভিক্ষার নাম দর্শনী। রাজরাজড়ার ভিক্ষার নাম নজর ; কেবল খঞ্জ দীন দুঃখীর ভিক্ষার নাম ভিক্ষা। না হবেই না কেন? তাহারা যে পরের ধন চাহিয়া লইবার বাসনা করে, তাহাদের এত বড় যোগ্যতা!
ভিক্ষা আমাদের সংস্কার। সকল জাতির একটা একটা বিশেষ সংস্কার থাকে ; আমাদের সংস্কার ভিক্ষা। জন্মগ্রহণ করিয়াই ভিক্ষা পাই, তারে বলি যৌতুক। তার পর অন্নপ্রাশন ; অন্নপ্রাশনেও যৌতুক। ব্রাহ্মণের তার পর উপনয়ন, উপনয়নে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে না করিলে ব্রাহ্মণ হয় না। পরে বিবাহ, তখন সোণায় সোহাগা, নববধূর চাঁদমুখ দেখাইয়া ভিক্ষা লই। শেষ মৃত্যু ; সে ব্যাপারটায় বড় বাঁধাবাঁধি,-যম ছেড়ে দেয় না, সুতরাং পুত্র গলায় কাচা বাঁধিয়া আমাদের জন্য ভিক্ষায় বাহির হয়।
আমাদের চক্ষে ভিক্ষাবৃত্তির অপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠ বৃত্তি নাই। সেই জন্য আমাদের পূজ্য-দেবতামধ্যে প্রধান-মহাদেবকে ভিখারী সাজাইয়াছি। আর বিষ্ণু বামন-অবতারে ভিক্ষা করিয়া ত্রিলোক রক্ষা করিলেন। এখনও কোন দেবমূর্ত্তি দর্শন করিতে গেলে ঠাকুরকে পয়সাটি না দিলে দর্শন মঞ্জুর হয় না। যখন বর্ণবিভাগ বদ্ধমূল হইল, তখন ইতর বর্ণ ইতর বৃত্তি অবলম্বন করিল ; যথা,-বৈশ্যে বাণিজ্য, ক্ষত্রিয়ে রাজত্ব, শ্রেষ্ঠ বর্ণ ব্রাহ্মণের বৃত্তিও শ্রেষ্ঠ হইল,-তিনি ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিলেন। অতএব ইহা স্থির যে, এ সংসারে ভিক্ষাই সার পদার্থ।
ভিক্ষায় আর এক সুখ আছে,-আদায়ের সুখ। খাতক যদি আমার কর্জ্জ শোধ না দেয়, তবে মহাকষ্ট ; তাহার নামে নালিশ করিতে হয়। প্রভু যদি বেতন না দেয়, তবে আরও জঞ্জাল ; উপায় নাই বলিলেই হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমনই সুনীতি যে, ভিক্ষা আদায়ের নানা শাসন আছে। প্রজা যদি জমীদারকে ভিক্ষা না দেয়, জরিমানা কর-মিথ্যা নালিশ কর-চাল কাটিয়া উঠাইয়া দাও। শিষ্যযজমান যদি ব্রাহ্মণকে ভিক্ষা না দেয়, অভিসম্পাত কর-বেটার সবংশে নির্ব্বংশ দাও ; তাহাতেও না দেয়, পইতা ছেঁড়-আর একটা পইতা কিনিয়া পরিও ; ইচ্ছা হয় তেরাত্রি কর, পার যদি ত লুকাইয়া লুকাইয়া কিছু কিছু আহার করিও ; উনানে পা পুরিও, কিন্তু দেখো, উনানে যেন আগুন না থাকে। আর যদি ব্রাহ্মণ না হইয়া জাতি-ভিখারী হও, তবে ধণ্বা দিও, মারে কাটে দ্বার ছেড়ো না। শ্রাদ্ধের সময় ভিক্ষা করিতে গেলে, যার শ্রাদ্ধ তার নরক দেখাইতে ভুলিও না। পশ্চিম দেশে আর একটা প্রথা আছে, সেইটা সর্ব্বাপেক্ষা ভাল,-তাহারা ঝাঁটা মারিয়া ভিক্ষা করে ; পার ত দাতাকে প্রথমে সেইরূপ সমাদরসূচক অভ্যর্থনা করিও।
ব্রাহ্মণ-ভিখারী! তোমাকে আরও দুই একটা পরামর্শ দিবার আছে। তুমি ভিক্ষুক-পূজ্য ব্যক্তি, যাহার দান লইবে, তাহার সহিত একাসনে বসিও না-উচ্চাসনে বসিও ; সে ব্যক্তি দাতা বইত নয়, তোমার সমানস্পর্দ্ধী? দাতার যদি সহজে মন না ভিজে, তাহার মাথায় শ্রীচরণখানি তুলিয়া দিও ; ইহাতে কোন ক্রমেই সঙ্কোচ করিও না। ভিখারীর পাদপদ্ম কখন কখন কাদা, গোবর ও বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ থাকে-তথাপি দাতার মাথায় সোণার কিরীট থাকিলেও তাহার উপর পদ স্থাপন করিতে সঙ্কোচ করিও না। তাহাতে কার্য্যোদ্ধার না হয়, ভ্রূভঙ্গী করিও-ফিরিয়া দাঁড়াইও ; আগে বলিও, “দেবে না কেন? তাহাতেও না দেয়, অভিসম্পাত করিও ; পুত্রগুলির অমঙ্গলটা আগে দেখাইও। তবু কিছু না দেয়, বাপ চৌদ্দপুরুষকে গালি দিয়া চলিয়া আসিও। কার্য্যোদ্ধারের আর এক উপায় আছে,-ডিপে-হাতে বৈদ্য, কি পাঁজি-হাতে এদৈবজ্ঞ ইত্যাদি লোকের দেখা পাইলে দুই চারিটি উদ্ভট কবিতা শিখিয়া রাখিও ; কষ্ট করিয়া অর্থ লিখিবার প্রয়োজন নাই। প্রথমে আসন গ্রহণ করিয়াই দুই একটা কবিতা ছাড়িও ; পরে উপস্থিত কথার সহিত সংলগ্ন বা অসংলগ্ন যা হোক একটা অর্থ করিয়া দিও। তসর কাপড়খানা আর ফোঁটার আড়ম্বরটা চাই, আর যখন তখন তেমনি দাঁও ফাঁদিয়া বসিও। সুদের সুদ ছাড়িও না,-শাস্ত্রসম্মত দানটা হইলে দক্ষিণাটা না এড়ায়। যদি শুনিতে পাও যে, অমুক বাবুদের বাড়ী একটা বড় ক্রিয়া, সেই সময় কালে গোহালের গরুগুলা বাহিরে বাঁধিয়া তথায় টোল ফাঁদিয়া বসিও ; মামাত পিসিতত ভাইগুলাকে সাধিয়া পাড়িয়া দিন দুই তথায় পুরিও। পরে পত্রখানা জুটিলে সভায় উপস্থিত হইও। দেখ, গ্রামের বার্ষিক সমাজিকগুলিন যেন না ফস্কায় ; সেটায় বড় মান। ফলাহারে কামাই দিও না ; ফলাহার করিতে বসিয়া পাত হইতে গোটাকতক সন্দেশ চুরি করিয়া রাখিও ; বিদ্যাটি ছেলেগুলিকে শিখাইও। দেখো, চিঁড়ে দইয়ের ফলাহারে নুন মাখিতে ভুলে যেও না। কণ্ঠায় কণ্ঠায় ফলাহারের সমাপ্ত করিয়া আচমনের পর খড়িকা খাইতে খাইতে বলিও, “এত কপালে ছিল, পাষণ্ড বেটার বাড়ী আহার করিতে হইল।” এমন কথা দুটা একটা না বলিলে পাছে লোকে বলে তুমি পেটের দায়ে ফলাহার করিতে গিয়াছিলে।
-‘বঙ্কিম-জীবনী’, ৩য় সং, পৃ. ৩৬৫-৬৮।
রাজমোহনের স্ত্রী
প্রথম পরিচ্ছেদ
মধুমতী নদীতীরে রাধাগঞ্জ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। প্রভূত ধনসম্পন্ন ভূস্বামীদিগের বসতি-স্থান বলিয়া এই গ্রাম গণ্ডগ্রামস্বরূপ গণ্য হইয়া থাকে। একদা চৈত্রের অপরাহ্নে দিনমণির তীক্ষ্ণ কিরণমালা ম্লান হইয়া আসিলে দুঃসহ নৈদাঘ উত্তাপ ক্রমে শীতল হইতেছিল; মন্দ সমীরণ বাহিত হইতে লাগিল; তাহার মৃদু হিল্লোল ক্ষেত্রমধ্যে কৃষকের ঘর্ম্মাক্ত ললাটে স্বেদবিন্দু বিশুষ্ক করিতে লাগিল, এবং সদ্যশয্যোত্থিতা গ্রাম্য রমণীদিগের স্বেদবিজড়িত অলকপাশ বিধূত করিতে লাগিল।
ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা একটা রমণী একটি সামান্য পর্ণকুটীর অভ্যন্তরে মাধ্যাহ্নিক নিদ্রা সমাপনান্তে গাত্রোত্থান করিয়া বেশভূষায় ব্যাপৃতা হইলেন। স্ত্রীজাতির এই বৃহৎ ব্যাপারসম্পাদনে রমণীর কালবিলম্ব হইল না; একটু জল, একখানি টিনে-মোড়া চারি আঙ্গুল বিস্তার দর্পণ, সেইরূপ দীর্ঘকায় একখানি চিরুণির দ্বারা এ ব্যাপার সুসম্পন্ন হইল। এতদ্ব্যতিরেকে কিছু সিন্দূরের গুঁড়ায় ললাট বিশোভিত হইল। পরিশেষে একটি তাম্বুলের রাগে অধর রঞ্জিত হইল। এইরূপে জগদ্বিজয়িনী রমণী জাতির একজন মহারথী সশস্ত্র হইয়া কলসীকক্ষে যাত্রা করিলেন, এবং কোনও প্রতিবাসীর বংশ-রচিত দ্বার সবলে উদ্ঘাটিত করিয়া গৃহাভ্যন্তরে প্রবিষ্টা হইলেন।র্য্য
যে গৃহমধ্যে ইনি প্রবেশ করিলেন, তাহার মধ্যে চারিখানি চালা ঘর-মাটির পোতা-ঝাঁপের বেড়া। কুটীরমধ্যে কোথাও দারিদ্র্যলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছিল না-সর্ব্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চতুষ্কোণ উঠানের চারিদিকে চারিখানি ঘর। তিনখানির দ্বার উঠানের দিকে-একখানির দ্বার বাহিরের দিকে। এই ঘরখানি বৈঠকখানা-অপর তিনখানি চতুষ্পার্শ্বে আবরণ বিশিষ্ট হইয়া অন্তঃপুরত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল। সদর বাটীর মণ্ডপ সম্মুখে সুকর্ষিত ভূমিখণ্ডে কিছু বার্ত্তাকু শাকাদি জন্মিয়াছিল। চারিপার্শ্বে নলের বেড়া; দ্বারে ঝাঁপের আগড়; সুতরাং অবলা অনায়াসে গৃহে প্রবেশ করিল।
বলা বাহুল্য যে, লব্ধপ্রবেশা প্রথমেই অন্তঃপুরাভিমুখে চলিলেন। পুরবাসী বা পুরবাসিনী বর্গ মাধ্যাহ্নিক নিদ্রা সমাপনান্তে স্ব স্ব কার্য্যে কে কোথায় গিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না। কেবলমাত্র তথায় দুই ব্যক্তি ছিল; একটি অষ্টাদশবর্ষীয়া তরুণী বস্ত্রোপরে কারুকার্য্যে ব্যাপৃতা ছিলেন, আর একটি চারি বৎসরের শিশু খেলায় মগ্নচিত্ত ছিল। তাহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পাঠশালায় যাইবার সময় জানিয়া শুনিয়া মস্যাধার ভুলিয়া গিয়াছিল। শিশু সেই মসীপাত্র দেখিতে পাইয়া অপর্য্যাপ্ত আনন্দ সহকারে সেই কালি মুখে মাখিতেছিল; পাছে দাদা আসিয়া দোয়াত কাড়িয়া লয়, বাছা যেন এই ভয়ে সকল কালিটুকু একেবারে মাখিয়া ফেলিতেছিল। অভাগ্যতা, কারুকার্য্যকারিণীর নিকট ধরাসনে উপবেশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি করিতেছিস্ লো?”
সম্বোধিতা রমণী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “আজ যে দিদি, বড় অনুগ্রহ; না জানি আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম।”
অভ্যাগতা হাসিয়া কহিল, “আর কার মুখ দেখে উঠ্বে? রোজ যার মুখ দেখে উঠ আজও তার মুখ দেখে উঠেছ।”
এই কথা শুনিয়া তরুণীর মুখমণ্ডল ক্ষণেকের জন্য মেঘাচ্ছন্ন হইল; অপরা নারীর অধরমূলে হাস্য অর্দ্ধপ্রকটিত রহিল। এই স্থলে উভয়ের বর্ণনা করি।
অভ্যাগতা যে ত্রিংশৎবর্ষবয়স্কা এ কথা পূর্ব্বেই বলিয়াছি। সে শ্যামবর্ণা-কাল নয়-কিন্তু তত শ্যামও নয়। মুখকান্তি নিতান্ত সুন্দর নয়, অথচ কোন অংশ চক্ষুর অপ্রিয়কর নয়; তন্মধ্যে ঈষৎ চঞ্চল মাধুরী ছিল, এবং নয়নের ‘হাসি হাসি’-ভাবে সেই মাধুরী আরও মধুর হইয়াছিল। দেহময় যে অলঙ্কারসকল ছিল, তাহা সংখ্যায় বড় অধিক না হইবে, কিন্তু একটি মুটের বোঝা বটে। যে শঙ্খবণিক সেই বিশাল শঙ্খ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তিনি বিশ্বকর্ম্মার অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্র সন্দেহ নাই। আভরণময়ীর স্থূলাঙ্গে একখানি মোটা শাটী ছিল; শাটীখানি বুঝি রজকের উপর রাগ করিয়াছিল, তাই সে পথে অনেক কাল গতিবিধি করে নাই।
অষ্টাদশবর্ষীয়ার কোমল অঙ্গে এতাদৃশ অলঙ্কার বেশী ছিল না। বস্তুতঃ তাহার বাক্যালাপে পূর্ব্ব বঙ্গীয় কোনরূপ কণ্ঠবিকৃতি সংলক্ষিত হইত না; ইহাতে স্পষ্ট অনুভূত হইতে পারে যে, এই সর্ব্বঙ্গসুন্দর রমণীকুসুম মধুমতী-তীরজ নহে-ভাগীরথী-কূলে রাজধানী সন্নিহিত কোনও স্থানে জাতা ও প্রতিপালিতা হইয়া থাকিবেক। তরুণীর আরক্ত গৌরবর্ণছটা মনোদুঃখ বা প্রগাঢ় চিন্তাপ্রভাবে কিঞ্চিৎ মলিন হইয়াছিল; তথাচ যেমন মধ্যাহ্ন রবির কিরণে স্থলপদ্মিনী অর্দ্ধ প্রোজ্জ্বল, অর্দ্ধশুষ্ক হয়, রূপসীর বর্ণজ্যোতি সেইরূপ কমনীয় ছিল। অতিবর্দ্ধিতকেশজাল অযত্নশিথিল গ্রন্থিতে স্কন্ধদেশে বদ্ধ ছিল; তথাপি অলককুন্তল সকল বন্ধন দশায় থাকিতে অসম্মত হইয়া ললাট কপোলাদি ঘিরিয়া বসিয়াছিল। প্রশস্ত পূর্ণায়ত ললাটতলে নির্দ্দোষ বঙ্কিম ভ্রূযুগল ব্রীড়াবিকম্পিত; নয়নপল্লবাবরণে লোচনযুগল সচরাচর অর্দ্ধাং শমাত্র দেখা যাইত; কিন্তু যখন সে পল্লব ঊর্দ্ধোত্থিত হইয়া কটাক্ষ স্ফুরণ করিত, তখন বোধ হইত যেন নৈদাঘ মেঘমধ্যে সৌদামিনী-প্রভা প্রকটিত হইল। কিন্তু সে যৌবনমদমত্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিক্ষেপে চিন্তাকুলতা প্রতীত হইত; এবং তথায় ক্ষুদ্র ওষ্ঠাধর দেখিলেই বুঝা যাইত, সে হৃদয়তলে কত সুখ দুঃখ বিরাজ করিতেছে। তাহার অঙ্গসৌষ্ঠ ও নির্ম্মাণ-পারিপাট্য, শারীরিক বা মানসিক ক্লেশে অনেক নষ্ট হইয়াছিল; তথাচ পরিধেয় পরিষ্কার শাটীখণ্ডমধ্যে যাহা অর্দ্ধ দৃষ্ট হইতেছিল, তাহার অনুরূপ শিল্পকর কখনও গড়ে নাই। সেই সুঠাম অঙ্গ প্রায় নিরাভরণ, কেবলমাত্র প্রকোষ্ঠে ‘চুড়ি’ ও বাহুতে ‘মুড়কিমাদুলি’ ইহাও বড় সুগঠন।
তরুণী হস্তস্থিত সুচ্যাদি একপার্শ্বে রাখিয়া অভ্যাগতার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইলেন। অভ্যাগতা কথোপকথনকালে নিজ গৃহযন্ত্রণা-বর্ণনে বিস্তর সদ্বক্তৃত্ব প্রকাশ করিলেন; দোষের মধ্যে এই, যে যন্ত্রণাগুলিন বর্ণনা করিলেন, তাহা প্রায় কাল্পনিক। বক্ত্রী নিজ কর্দ্দমময় বস্ত্রাঞ্চলের অগ্রভাগ লইয়া পুনঃ পুনঃ চক্ষে দিতে লাগিলেন; বিধাতা তাঁহাকে যে চক্ষুযুগল দিয়াছিলেন সে কিছু এমত অবস্থার যোগ্য নয়; কিন্তু কি হবে?-অবস্থাবিশেষে শালগ্রামেরও মৃত্যু ঘটে। চক্ষুর ঘটে নাই, যতবার কাপড়খানা এসে ঠেকে ততবার চক্ষু দুইটি কামধেনুর মত অজস্র অশ্রু বর্ষণ করে। বক্ত্রী-চূড়ামণি অনেকবার অশ্রুবৃষ্টি করিয়া একবার জাঁকাইয়া কাঁদিবার উদ্যোগে ছিলেন; কিন্তু ভাগ্যক্রমে কথিত চক্ষু দুইটি সেই সময় সেই শিশুটির কালিময় মুখের উপর পড়িল; শিশুটি মসীপাত্র শূন্য করিয়া অন্ধকারময় মূর্ত্তি লইয়া দণ্ডায়মান ছিল, বালকের এই অপরূপ অঙ্গরাগ দেখিয়া গৃহযন্ত্রণাবাদিনী কাঁদিতে গিয়া হাসিয়া ফেলিলেন; রসের সাগর উথলিয়া যন্ত্রণাদি ভাসাইয়া দিল।
রোদনাদির ব্যাপার সমাপ্ত হইলে, সূর্য্যদেবকে সত্য সত্যই অস্তাচলে যাইবার উদ্যোগী দেখিয়া বক্ত্রী তরুণীকে জল আনিতে যাইবার আমন্ত্রণ করিলেন। বস্তুতঃ এই আমন্ত্রণের জন্যই এত দূর আসা। নবীনা বারি-বাহনার্থ যাইতে অস্বীকৃতা হইলেন; কিন্তু তাঁহার সঙ্গিনী বিশেষ উত্তেজনা করিতে লাগিলেন। নবীনা কহিলেন, “মধুমতীতে বড় কুমীর, গেলে কুমীরে খাবে।”
ইহা শুনিয়া সঙ্গিনী যে ঘোর হাস্য করিল, নবীনা তাহাতেই বুঝিলেন,-তাঁহার আপত্তি গ্রাহ্য হইল না। তিনি পুনরায় কহিলেন, “যাবি কখন লা কনক, আর কি বেলা আছে?” “এখনও দুপুর বেলা” বলিয়া কনক অঙ্গুলী নির্দ্দেশে দেখাইলেন যে, এ পর্য্যন্ত সূর্য্যকর বৃক্ষোপরে দীপ্তিমান্ রহিয়াছে।
নবীনা তখন কিঞ্চিৎ গাম্ভীর্য্য সহকারে বলিলেন, “তুই জানিস্ ত কনক দিদি, আমি কখন জল আনিতে যাই না।”
কনক কহিল, “সেই জন্যই ত যাইতে কহি, তুই কেন সারাদিন পিঁজরেতে কয়েদ থাক্বি? আর বাড়ীর বউমানুষে জল আনে না?”
নবীনা গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “জল আনা দাসীর কর্ম্ম।”
“কেন, কে জল এনে দেয় লো? দাসী চাকর কোথা?”
“ঠাকুরঝি জল আনে।”
“ঠাকুরঝি যদি দাসীর কর্ম্ম করিতে পারে, তবে বৌ পারে না?”
তখন তরুণী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্বরে কহিল, “কথায় কাজ নাই কনক! তুমি জান আমার স্বামী আমাকে জল আনিতে বারণ করিয়াছেন। তুমি তাঁহাকে চেন ত?”
কনকময়ী কোনও উত্তর না করিয়া সচকিত কটাক্ষে চতুর্দ্দিকে নিরীক্ষণ করিলেন, যেন কেহ আসিতেছে কি না দেখিলেন। কোথাও কেহ নাই দেখিয়া সমভিব্যাহারিণীর মুখপ্রতি চাহিয়া রহিলেন, যেন কিছু বলিতে বাসনা আছে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আশঙ্কাপ্রযুক্ত কথনেচ্ছা দমন করিয়া অধোদৃষ্টি করতঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। তরুণী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি ভাবিতেছিস্?”
কনক কহিল-“যদি-যদি তোর চোখ্ থাকত্___”
নবীনা আর না শুনিয়া ইঙ্গিতের দ্বারা নিষেধ করিয়া কহিল, “চুপ্ কর্, চুপ্ কর্-বুঝিয়াছি।”
কনক বলিল, “বুঝিয়া থাক ত কি করিবে এখন?”
তরুণী কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন, ঈষৎ অধরকম্পে এবং অল্প ললাট-রক্তিমায় প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, যুবতীর মনোমধ্যে কোন্ চিন্তা প্রবল। তাদৃশ ঈষৎ দেহকম্পনে আরও দেখা গেল যে, সে চিন্তায় হৃদয় অতি চঞ্চল হইতেছে। ক্ষণেক পরে কহিলেন, “চল যাই, কিন্তু ইহাতে কি পাপ আছে?”
কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “পাপ আছে! আমি ভুঁড়ে ভট্টাচার্য্যনহি, শাস্ত্রের খবরও রাখি না; কিন্তু আমার আড়াই কুড়ি মিন্সে থাকিলেও যাইতাম।”
“বড় বুকের পাটা” বলিয়া হাসিতে হাসিতে যুবতী কলসী আনিতে উঠিল; “পঞ্চাশটা! হাঁলো, এতগুলো কি তোর সাধ?”
কনক দুঃখের হাসি হাসিয়া কহিল, “মুখে আনিতে পাপ; কিন্তু বিধাতা যে একটা দিয়াছেন, পঞ্চাশটাও যদি তেমনি হয়, তবে কোটীখানেকেই বা কি ক্ষতি? কাহারও সঙ্গে যদি দেখা সাক্ষাৎ না হইল তবে আমি কোটী পুরুষের স্ত্রী হইয়াও সতী সাধ্বী পতিব্রতা।”
“কুলীনে কপাল” বলিয়া তরুণী চঞ্চল পদে পাকশালা হইতে একটি ক্ষুদ্র কলসী আনয়ন করিলেন। যেমন বারিবাহিনী তেমনই কলসী। তখন উভয়ে প্রবাহিণী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কনক হাসিতে হাসিতে কহিল, “এখন এস দেখি মোর গৌরবিণী, হাঁ-করাগুলোকে একবার রূপের ছটাটা দেখাইয়া আনি।”
“মর্ পোড়ার বাঁদর” বলিয়া কনকের সমভিব্যাহারিণী অবগুণ্ঠনে সলজ্জ বদন আচ্ছন্ন করিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অপনীত সূর্য্যকর নারিকেলাদি বৃক্ষাগ্রভাগ হইতে অন্তর্হিত হইয়াছে; কিন্তু এখনও পর্য্যন্ত নিশা ধরাবাসিনী হয় নাই। এমন সময় কনক ও তাহার সমভিব্যাহারিণী কলসীকক্ষে গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। পথিপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র উদ্যান ছিল; পূর্ব্ববঙ্গ মধ্যে তদ্রূপ উদ্যান বড় বিরল। সুশোভন লৌহ রেইলের পরিধি মধ্য হইতে অসংখ্য গোলাপ ও মল্লিকার কলি পথিকার নেত্রমোদন করিতেছিল। পূর্ব্বতন পদ্ধতিমত চতুষ্কোণ ও অণ্ডাকার বহুতর চান্কার মধ্যে পরিষ্কার ইষ্টকচূর্ণ পথ সুরচিত ছিল। উদ্যানমধ্যে একটি পুষ্করিণী। তাহার তীর কোমল তৃণাবলিতে সুসজ্জিত; একদিকে ইষ্টকনির্ম্মিত সোপানাবলী। ঘাটের সম্মুখে বৈঠকখানা। বৈঠকখানার বারাণ্ডায় দাঁড়াইয়া দুই ব্যক্তি কথোকথন করিতেছিল।
বয়োধিক যে ব্যক্তি, তাহার বয়স ত্রিশ বৎসরের ঊর্দ্ধ হইবে; দীর্ঘ শরীর, স্থূলাকার পুরুষ। অতি স্থূলকায় বলিয়াই সুগঠন বলা যাইতে পারিল না। বর্ণ কঠোর শ্যাম; কান্তি কোনও অংশে এমত নহে যে, সে ব্যক্তিকে সুপুরুষ বলা যাইতে পারে; বরং মুখে কিছু অমধুরতা ব্যক্ত ছিল। বস্তুতঃ সে মুখাবয়ব অপর সাধারনের নহে; কিন্তু তাহার বিশেষত্ব কি যে, তাহাও হঠাৎ নিশ্চয় করা দুর্ঘট। কটিদেশে ঢাকাই ধুতি; লম্বা লম্বা পাকান ঢাকাই চাদরে পাগড়ি বাঁধা। পাগড়িটার দৌরাত্ম্যে, যে দুই এক গাছি চুল মাথায় ছিল, তাহাও দেখিতে পাওয়া ভার। ঢাকাই মলমলের পিরহাণ গাত্রে;-সুতরাং তদভ্যন্তরে অন্ধকারময় অসীম দেহখানি বেশ দেখা যাইতেছিল; আর সঙ্গে সঙ্গে সোনার কবচখানিও উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল। কিন্তু গলদেশে যে হেলেহার মন্দর পর্ব্বতে বাসুকির ন্যায় বিরাজ করিতেছিল, সে একেবারে পিরহাণের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। পিরহাণের সোনার বোতাম, তাহাতে চেন্ লাগান; প্রায় সকল আঙ্গুলেই অঙ্গুরীয়; হস্তে যমদণ্ডতুল্য পিচের লাঠি। বামনদেবের পাদপদ্মতুল্য দুইখানি পায়ে ইংরাজি জুতা।
ইহার সমভিব্যাহারী পরম সুন্দর, বয়স অনুমান বাইশ বৎসর। তাঁহার সুবিমল স্নিগ্ধ বর্ণ, শারীরিক ব্যায়ামের অসদ্ভাবেই হউক, বা ঐহিক সুখ সম্ভোগেই হউক, ঈষৎ বিবর্ণ হইয়াছিল। তাঁহার পরিচ্ছদ অনতিমূল্যবান্,-একখানি ধুতি, অতি পরিপাটী একখানি চাদর, একটি কেমব্রিকের পিরাণ; আর গোরার বাটীর জুতা পায়। একটি আঙ্গুলে একটি আংটি; কবচ নাই, হারও নাই।
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি অপরকে কহিল, “তবে মাধব, তুমি আবার কলিকাতা ধরিয়াছ! আবার এ রোগ কেন?”
মাধব উত্তর করিলেন, “রোগ কিসে? মথুর দাদা, আমার কলিকাতার উপর টান যদি রোগ হয়, তবে তোমার রাধাগঞ্জের উপর টানও রোগ।”
মথুর জিজ্ঞাসা করিল, “কিসে?”
মাধব। নয় কিসে? তুমি রাধাগঞ্জের আমবাগানের ছায়ায় বয়স কাটাইয়াছ, তাই তুমি রাধাগঞ্জ ভালবাসে; আমি কলিকাতার দুর্গন্ধে কাল কাটাইয়াছি, আমিও তাই কলিকাতা ভালবাসি।
মথুর। শুধু দুর্গন্ধ! ডেরেনের শুকো দুই; তাতে দুটো একটা পচা ইঁদুর, পচা বেরাল উপকরণ-দেবদুর্ল্লভ।
মাধব হাসিয়া কহিল, “শুধু এ সকল সুখের জন্য কলিকাতায় যাইতেছি না, আমার কাজও আছে।”
মথুর। কাজ ত সব জানি।-কাজের মধ্যে নূতন ঘোড়া নূতন গাড়ি-ঠক্ বেটাদের দোকানে টো টো করা-টাকা উড়ান-তেল পুড়ান-ইংরাজিনবিশ ইয়ার বক্শিকে মদ খাওয়ান-আর হয়ত রসের তরঙ্গে ঢলাঢল্। হাঁ করিয়া ওদিক কি দেখিতেছ? তুমি কি কখন কন্কিকে দেখ নাই? না ওর সঙ্গের ছুঁড়িটা আস্মান থেকে পড়েছে?-তাই ত বটে! ওর সঙ্গে ওটি কে?
মাধব কিঞ্চিৎ রক্তিমকান্তি হইলেন; কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভাবান্তর প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “কনকের কি স্বভাব দেখেছ? কপালে বিধাতা এত দুঃখ লিখেছেন, তবু হেসে হেসে মরে।”
মথুর। তা হউক-সঙ্গে কে?
মাধব। তা আমি কেমন করিয়া বলিব, আমার কি কাপড় ফুঁড়ে চোখ চলে? ঘোমটা দেখিতেছ না?
বস্তুতঃ কনক ও তাহার সঙ্গিনী কলসীকক্ষে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছিল। কনককে সকলেই চিনিত; কিন্তু দ্বিতীয় কুলকামিনীর প্রতি পদসঞ্চারে যে অনির্ব্বচনীয় লাবণ্য বিকাশ হইতেছিল, তাঁহার বস্ত্র ভেদ করিয়া যে অপূর্ব্ব অঙ্গসৌষ্ঠব দেদীপ্যমান হইতেছিল, তাহাতে প্রথমে মাধবের, পশ্চাৎ মথুরের দৃষ্টি মুগ্ধ হইল; এবং উভয়ে সঙ্গীতধ্বনিদত্তচিত্ত কুরঙ্গের ন্যায় অবহিত মনে তৎপ্রতি নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।
শেষ লিখিত কয়েকটি কথা যে সময়ে মাধবের মুখ হইতে নির্গত হইল, সেই সময় একবার মন্দ সমীরণ-হিল্লোল রমণীদিগের শিরোপরে বাহিত হইল; এই সময় তরুণী স্বীয় কক্ষস্থিত কলসী অনভ্যস্ত কক্ষে উত্তমরূপে বসাইবার জন্য অবগুণ্ঠন হইতে হস্ত লইবার সময়, দুষ্ট সমীরণ অবগুণ্ঠনদি উড়াইয়া ফেলিল। মুখ দেখিয়া মাধব বিস্মিতের ন্যায় ললাট আকুঞ্চিত করিলেন। মথুর কহিল, “ওই দেখ-তুমি ওকে চেন?”
“চিনি।”
“চেন? তুমি চেন, আমি চিনি না; অথচ আমি এইখানে জন্ম কাটাইলাম, আর তুমি কয়দিন! চেন যদি, তবে কে এটি?”
“আমার শ্যালী।”
“তোমার শ্যালী? রাজমোহনের স্ত্রী?”
“হাঁ।”
“রাজমোহনের স্ত্রী, অথচ আমি কখন দেখি নাই?”
“দেখিবে কিরূপে? উনি কখন বাটীর বাহির হয়েন না।”
মথুর কহিল, “হয়েন না, তবে আজ হইয়াছেন কেন?”
মাধব। কি জানি।
মথুর। মানুষ কেমন?
মাধব। দেখিতেই পাইতেছ-বেশ সুন্দর।
মথুর। ভবিষ্যদ্বক্তা গণকঠাকুর এলেন আর কি? তা বলিতেছি না-বলি, মানুষ ভাল?
মাধব। ভাল মানুষ কাহাকে বলে?
মথুর। আঃ কালেজে পড়িয়া একেবারে অধঃপাতে গিয়াছ। একবার যে সেখানে গিয়া রাঙ্গামুখোর শ্রাদ্ধর মন্ত্র পড়িয়া আসে, তাহার সঙ্গে দুটো কথা চলা ভার। বলি ওর কি-?
মাধবের বিকট ভ্রূভঙ্গ দৃষ্টে মথুর যে অশ্লীল উক্তি করিতে চাহিতেছিলেন তাহা হইতে ক্ষান্ত হইলেন।
মাধব গর্ব্বিত বচনে কহিলেন, “আপনার এত স্পষ্টতার প্রয়োজন নাই; ভদ্রলোকের স্ত্রী পথে যাইতেছে, তাহার সম্বন্ধে আপনার এত বক্তৃতার আবশ্যক কি?”
মথুর কহিল, “বলিয়াছি ত দু’ পাত ইংরেজি উল্টাইলে ভায়ারা সব অগ্নি-অবতার হইয়া বসেন। আর ভাই, শ্যালীর কথা কব না ত কাহার কথা কব? বসিয়া বসিয়া কি পিতামহীর যৌবন বর্ণনা করিব? যাক্ চুলায় যাক্; মুখখানা ভাই, সোজা কর-নইলে এখনই কাকের পাল পিছনে লাগিবে। রাজমুহুনে গোবর্দ্ধন এমন পদ্মের মধু খায়?”
মাধব কহিল, “বিবাহকে বলিয়া থাকে সুরতি খেলা।”
এইরূপ আর কিঞ্চিৎ কথোপকথন পরে উভয়ে স্ব স্ব স্থানে গমন করিলেন।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
কনকময়ী এবং তৎসঙ্গিনী নীরবে গৃহাভিমুখে চলিলেন। লোকের সম্মুখে কথা কহিতে কনকের সহচরী অতি লজ্জাকর বোধ করিতে লাগিলেন। তাঁহাকে নীরব দেখিয়া কনকও নীরব। কিন্তু এমন লোকালয়মধ্যে রসনারূপিণী প্রচণ্ডা অশ্বিনী যে নিজ প্রাখর্য্যাদি গুণ দেদীপ্যমান করিতে পারিল না, কনকের ইহাতে বড় মনোদুঃখ রহিল। তাঁহারা আপনাপন গৃহ-সান্নিধ্যে আসিলেন; তথায় লোকের গতিবিধি অধিক না থাকায় কনীয়সী কথোপকথন আরম্ভ করিলেন; বলিলেন, “কি পোড়া কপালে বাতাস দিদি, আমাকে কি নাস্তানাবুদই করিল।”
কনক হাসিয়া কহিল, “কেন, তোমার ভগ্নীপতি কি কখন তোমার মুখ দেখে নাই?”
কনীয়সী। আমি ত তাহার জন্য বলিতেছি না-অন্য একজন যে কে ছিল।
কনক। কেন, সে যে, মথুরবাবু; তাহাকে কি কখন দেখ নাই?
কনীয়সী। কবে দেখিলাম-আমার ভগ্নীপতির জ্যেঠাত ভাই মথুরবাবু?
কনক। সে না ত কে?
কনীয়সী। কি লজ্জা বোন্ কাহারও সাক্ষাতে বলিস্ না।
কনক। মরণ আর কি! আমি লোকের কাছে গল্প করিতে যাইতেছি যে, তুমি জল আনিতে ঘোমটা খুলে মুখ দেখাইয়াছিলে।
এই বলিয়া কনক মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। তরুণী সরোষে কহিল, “তুমি ভাগাড়ে পড় না কেন? কথার রকম দেখ। এমত জানিলে কি আমি তোমার সঙ্গে আসিতাম?”
কনক পুনরায় হাস্য করিতে লাগিল; যুবতী কহিলেন, “তোর ও হাসি আমার ভাল লাগে না-সর্ব্বনাশ! দুর্গা যা করেন।”
এই বলিয়া নবীনা গৃহাভিমুখে নিরীক্ষণ করিয়া কম্পিতকলেবরা হইল। কনকময়ীও সেই দিকে নিরীক্ষণ করিয়া এই আকস্মিক ভীতির হেতু অনুভূত করিলেন, তাঁহারা প্রায় গৃহ-সান্নিধ্যে উপনীতা হইয়াছিলেন। কনক দেখিতে পাইল যে, দ্বারে অগ্নিবিচ্ছুরিত নয়নে কালমূর্ত্তির ন্যায় রাজমোহন দণ্ডায়মান রহিয়াছে। সঙ্গিনীর কর্ণে কর্ণে সে কহিল,-“আজ দেখিতেছি মহাপ্রলয়; আমি তোর সঙ্গে যাই, যদি অকূলে কাণ্ডারী হইতে পারি।”
রাজমোহনের স্ত্রী তদ্রূপ মৃদুস্বরে কহিল, “না, না, আমারও সহ্য আছে-তুমি থাকিলে হয়ত হিতে বিপরীত হবে তুমি বাড়ী যাও।”
ইহা শুনিয়া কনক পথান্তরে নিজ গৃহে গমন করিল। তাঁহার সহচরী যখন নিজ গৃহে প্রবেশ করিলেন, তখন রাজমোহন কিছুই বলিল না। তাহার স্ত্রী জলকলসী লইয়া পাকশালায় রাখিলেন। রাজমোহন নিঃশব্দে সঙ্গে সঙ্গে পাকশালায় যাইলেন। স্ত্রী কলসীটি রাখিলে রাজমোহন কহিল, “একটু দাঁড়াও।” এই বলিয়া জলের কলসী লইয়া আঁস্তাকুড়ে জল ঢালিয়া ফেলিলেন। রাজমোহনের একটি প্রাচীনা পিসী ছিল। পাকের ভার তাঁরই প্রতি; তিনি এইরূপ জলের অপচয় দেখিয়া রাজমোহনকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন, “আবার জলটা অপচয় করিতেছিস্ কেন রে? তোর ক’গণ্ডা দাসী আছে যে, আবার জল আনিয়া দিবে?”
“চুপ কর্ মাগী হারামজাদী” বলিয়া রাজমোহন বারিশূন্য কলসীটা বেগে দূরে নিক্ষেপ করিল; এবং স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া অপেক্ষাকৃত মৃদু অথচ অন্তর্জ্বালাকর স্বরে কহিল, “তবে রাজরাণী, কোথায় যাওয়া হইয়াছিল?”
রমণী অতি মৃদুস্বরে দার্ঢ্য সহকারে কহিল, “জল আনিতে গিয়াছিলাম।”
যথায় স্বামী তাঁহাকে দাঁড়াইতে বলিয়াছিল তিনি তথায় চিত্রার্পিত পুত্তলিকার ন্যায় অস্পন্দিতকায় দাঁড়াইয়া ছিলেন।
রাজমোহন ব্যঙ্গ করিয়া কহিল, “জল আনিতে গিয়াছিলে? কাকে ব’লে গিছ্লে ঠাকুরাণি?”
“কাহারেও বলে যাই নাই।”
রাজমোহন আর ক্রোধপ্রবাহ সম্বরণ করিতে পারিল না, চিৎকার স্বরে কহিল, “কারেও বলে যাও নাই-আমি দশ হাজার বার বারণ করেছি না?”
অবলা পূর্ব্বমত মৃদুস্বরে কহিল, “করেছ।”
“তবে গেলি কেন হারামজাদি?”
রমণী অতি গর্ব্বিত বচনে কহিল, “আমি তোমার স্ত্রী।” তাঁহার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল, কণ্ঠস্বর বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল।
“গেলে কোন দোষ নাই বলিয়া গিয়াছিলাম।”
অসমসাহসের কথা শুনিয়া রাজমোহন একেবারে অগ্নিসম হইয়া উঠিলেন; বজ্রনাদবৎ চিৎকারে কহিলেন, “আমি তোকে হাজার বার বারণ করেছি কি না? এবং ব্যাঘ্রবৎ লম্ফ দিয়া চিত্রপুত্তলিসম স্থিররূপিণী সাধ্বীর কোমল কর বজ্রমুষ্টে এ হস্তে ধরিয়া প্রহারার্থ দ্বিতীয় হস্ত উত্তোলন করিলেন।”
অবলাবালা কিছু বুঝিলেন না; প্রহারোদ্যত হস্ত হইতে একপদও সরিয়া গেলেন না, কেবল এমন কাতর চক্ষে স্ত্রী-ঘাতকের প্রতি চাহিয়া রহিলেন যে, প্রহারকের হস্ত যেন মন্ত্রমুগ্ধ রহিল। ক্ষণেক নীরব হইয়া রহিয়া রাজমোহন পত্নীর হস্ত ত্যাগ করিল; কিন্তু তৎক্ষণাৎ পূর্ব্বমত বজ্রনিনাদে কহিল, “তোরে লাথিয়ে খুন করব।”
তথাপি তিরস্কৃতা কোন উত্তর করিল না, কেবল চক্ষে অবিরল জলধারা বিগলিত হইতেছিল। ঈদৃশী মানসিক যন্ত্রণা নীরবে সহ্য করিতে দেখিয়া নিষ্ঠুর কিঞ্চিৎ আর্দ্র হইল। সহধর্ম্মিণীর অচলা সহিষ্ণুতা দৃষ্টে প্রহারোদ্যমে বিতথপ্রযত্ন হইলেন বটে, কিন্তু রসনাগ্রে অবাধে বজ্রতাড়ন হইতে লাগিল। সে মধুমাখা শব্দাবলী এ স্থলে উদ্ধৃত করিয়া পাঠকের কর্ণ পীড়ন করা অবিধেয়। ধীরা সকলই নীরবে সহ্য করিল। ক্রমে রাজমোহনের প্রচণ্ডতা খর্ব্ব হইয়া আসিল; তখন প্রাচীনা পিসীর একটু সাহস হইল। তিনি ধীরে ধীরে ভ্রাতুষ্পুত্র-বধূর কর ধারণপূর্ব্বক তাঁহার গৃহাভ্যন্তরে লইয়া গেলেন; এবং যাইতে যাইতে ভ্রাতুষ্পুত্রকে দুই এক কথা শুনাইয়া দিলেন; কিন্ত তাহাও সাবধানে, সাবধানে-সাবধানের মার নাই। যখন দেখিলেন যে, রাজমোহনের ক্রোধ, মন্দীভূত হইয়া আসিয়াছে, তখন বর্ষীয়সী একেবারে স্বীয় কণ্ঠকূপ হইতে প্রচণ্ড তিরস্কারপ্রবাহ ছাড়িয়া দিলেন, ভ্রাতুষ্পুত্র যতগুলিন কুকথা মুখনির্গত করিয়াছিল, প্রায় সকলগুলিরই উপযুক্ত মূল্যে প্রতিশোধ দিলেন। রাজমোহন তখন ক্রোধ লইয়া ব্যস্ত, পিসীর মুখনিঃসৃত ভাষালালিত্যের বড় রসাস্বাদন করিতে পারিলেন না; আর পূর্ব্বে সে রস অনেক আস্বাদন করা হইয়াছিল, সুতরাং তিনি এক্ষণে তাহা অপূর্ব্ব বলিয়া বোধ করিলেন না। দুই জনে দুই দিকে গেলেন; পিসী বধূকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। রাজমোহন কাহার মাথা ভাঙ্গিবেন ভাবিতে ভাবিতে চলিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
এক্ষণে পাঠক মহাশয়ের সহিত যাঁহাদিগের পরিচয় হইল, তাঁহাদিগের পূর্ব্ব বিবরণ কথনে প্রবৃত্ত হই।
পূর্ব্বাঞ্চলে কোন ধনাঢ্য ভূস্বামীর আলয়ে বংশীবদন ঘোষ নামে এক ভৃত্য ছিল। এই ভূস্বামীর বংশ ও নাম এক্ষণে লোপ হইয়াছে, কিন্তু পূর্ব্বে তাঁহার যথেষ্ট খ্যাতি প্রতিপত্তি ছিল। বৃদ্ধকাল পর্য্যন্ত সন্তানের মুখাবলোকন না করিয়া শেষ বয়সে তিনি দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করিলেন। কিন্তু বিধির নির্ব্বন্ধ কে খণ্ডাইতে পারে? দ্বিতীয় পত্নীও সন্তানরত্নপ্রসবিনী হইলেন না। না হউন, বার্দ্ধক্যের তরুণী স্ত্রী একাই এক সহস্র। সত্য বটে মধ্যে মধ্যে দুই সপত্নীতে কিছু গোলযোগ উপস্থিত করিতেন; কখন কখন কর্ত্তার নিকট আসিয়া উভয়ে চীৎকারের মহলা দিতেন; কখন বা কনিষ্ঠা জ্যেষ্ঠার কাপড় টানিয়া ছিঁড়িতেন; জ্যেষ্ঠা কনিষ্ঠার চুল টানিয়া ছিঁড়িতেন। এখনও কখন হইয়াছে যে, ছেঁড়া ছিঁড়ি নাক কাণ পর্য্যন্ত উঠিয়াছে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হইলেই প্রায় উলু খাক্ড়ার প্রাণ বধ হইয়া থাকে,-বৃদ্ধ, সহধর্ম্মিণীদিগের সময়ে সময়ে নিকটে থাকিলেই লাথিটা গুঁতাটায় বঞ্চিত হইতেন না; কনিষ্ঠার পদাঘাত পাইলেই মনে করিতেন,-এইবার পূর্ব্বপুরুষেরা স্বর্গে উঠিলেন; এমনই লাথির জোর। জ্যেষ্ঠা সর্ব্বদা বলিতেন, “বড়র বড়, ছোটর ছোট।” শেষে করাল কাল মধ্যস্থ হইয়া “বড়র বড়, ছোটর ছোট” বলিয়া বড়কে আগে অন্তর্হিত করিল।
বয়োধিকা পত্নীর মৃত্যু দেখিয়া প্রাচীন মনে করিলেন, “ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে; আমাকেও কোন্ দিন ডাক পড়ে এই। মরি তাতে ক্ষতি নাই, বার ভূতে বিষয়টা খাবে।”
প্রেয়সী যুবতীর সাক্ষাতে মনের কথা বলিলে প্রেয়সী বলিলেন, “কেন আমি আছি, আমি কি তোমার বার ভূত?” বৃদ্ধ কর্ত্তা কহিলেন, তুমি যেখানে এক বিঘা জমি স্বহস্তে দান বিক্রয় করিতে পারিবে না, সেখানে তুমি আর বিষয় ভোগ করিলে কি?” চতুরা কহিল, “তুমি মনে করিলে সব পার; বিষয় বিক্রয় করিয়া আমায় নগদ টাকাটা দাও না।” তথাস্তু বলিয়া ভূস্বামী ভূমি বিক্রয় করিয়া অর্থসঞ্চয়ে মন দিলেন। স্ত্রীর আজ্ঞা এমনই ফলবতী যে, যখন বৃদ্ধ লোকান্তরে গমন করিল, তখন তাহার বিপুল সম্পত্তি প্রায় স্বর্ণরৌপ্যরাশিতেই ছিল-ভূমি অতি অল্প ভাগ। করুণাময়ী বড় বুদ্ধিমতী; তিনি মনে মনে ভাবিলেন, “এখন ত সকলই আমার; ধন আছে, জন আছে, যৌবনও আছে। ধন জন যৌবন সকলই বৃথা; যত দিন থাকে তত দিন ভোগ করিতে হয়।”
ভগবান্ শ্রীরামচন্দ্র অবতারে যখন জানকী বিচ্ছেদে কাতর হন, তখন কি করেন, সীতার একটি সুবর্ণ প্রতিমূর্ত্তি গঠন করিয়া মনকে আশ্বাস দিয়াছিলেন। করুণাময়ীও সেইরূপ স্বামীর কোনও প্রতিমূর্ত্তির মুখ নিরীক্ষণ করিয়া এ দুঃসহ বিরহ যন্ত্রণা নিবারণ না করেন কেন? আরও ভাবিলেন, রামচন্দ্র ধাতুময় প্রতিমূর্ত্তিতে হৃদয় স্নিগ্ধ করিতেন; নির্জ্জীব ধাতুতে যদি মনোদুঃখ নিবারণ হয়, তবে যদি একটা সজীব পতিপ্রতিনিধি করি তাহ’লে আরও সুখদ হইবে সন্দেহ কি? কেন না, সজীব প্রতিনিধিতে কেবল যে চক্ষুর তৃপ্তি হইবে এমত নহে, সময়ে সময়ে কার্য্যোদ্ধারও সম্ভাবনা। অতএব একটা উপ-স্বামী স্থির করা আবশ্যক। পতি এমন পরম পদার্থ যে, একেবারে পতিহীন হওয়া অপেক্ষা একটা উপপতি রাখাও ভাল; বিশেষ শ্রীরামচন্দ্র যাহা করিয়াছেন তাহাতে কি আর কিন্তু আছে?
এইরূপ বিবেচনা করিয়া করুণাময়ী স্বামীর সজীব প্রতিমূর্ত্তিত্বে কাহাকে বরণ করিবে ভাবিতে ভাবিতে বংশীবদন ঘোষ খানসামার উপর নজর পড়িল; বংশীবদনকে আর কে পায়? ধর্ম্ম অর্থ কাম মোক্ষ লইয়া সংসার, তাহার মধ্যে ধর্ম্ম আদৌ, কাম মোক্ষ-পশ্চাৎ। এই তিনকে যদি করুণাময়ী ভৃত্যের শ্রীচরণে সমর্পণ করিতে পারিল, রহিল অর্থ। অর্থ আর কয়দিন বাকি থাকে? খানসামা বাবু অতি শীঘ্র সদর নায়েব হইয়া বসিলেন। কালে সকলের লয়,-কালে প্রণয়ের লয়-কালে প্রণয়ীর লয়,-প্রণয়ময়ী অতি শীঘ্রই খানসামাকে ত্যাগ করিয়া প্রেমাপদ মৃত স্বামীর অনুবর্ত্তিনী হইলেন।
প্রথমে করুণাময়ীর অতি সামান্য জ্বর হয়; জ্বরটা অকস্মাৎ বৃদ্ধি পায়। লোকে বংশীবদনের নানামত নিন্দা করিতে লাগিল; কেহ কেহ এমনও কহিল যে, সে ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করণাশায় করুণাময়ীকে বিষপান করাইয়াছিল। যাহাই হউক, করুণাময়ী প্রাণত্যাগ করিলেন।
বংশীবদন প্রণয়িনী বিয়োগের মনোদুঃখেই হউক, অথবা “যঃ পলায়তি স জীবতি” বলিয়াই হউক, তৎক্ষণাৎ চাকরি স্থান পরিত্যাগ করিয়া বাটী আসিলেন।
করুণাময়ীর বিপুল অর্থরাশি যে তাহার সঙ্গে আসিল, তাহা বলা বাহুল্য। অপর্য্যাপ্ত ধনের অধিপতি হইয়াও বংশীবদন, পাছে অসম্ভব ব্যয় ভূষণ করিলে বিপদ্গ্রস্ত হইতে হয় এই আশঙ্কায় অতি সাবধানে কালযাপন করিতে লাগিলেন। তিনি পরলোক গমন করিলে তাঁহার পুত্রেরা তাদৃশ সাবধানতা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন না; এবং দীর্ঘকাল গতে নিশ্চিন্ত হইয়া ভূসম্পত্তি ক্রয় করিলেন, অট্টালিকা ও ক্রীড়া-হর্ম্ম্যাদি নির্ম্মাণ করিলেন, এবং পৈতৃক ধনরাশির উপর উপযুক্ত ঐশ্বর্য্য বিস্তার করিয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
জ্যেষ্ঠ রামকান্ত অতি বিষয়কার্য্যদক্ষ ছিলেন। তাঁহার দক্ষতার ফলে তাঁহার অংশ দ্বিগুণাধিক সম্বর্দ্ধিত হইল।-রামকান্ত এই সম্বর্দ্ধিত সম্পত্তি নিজ দক্ষতর পুত্র মথুরামোহনের হস্তে সমর্পণ করিয়া পরলোক গমন করেন।
রামকান্তের দৃঢ় সংস্কার ছিল যে, ইংরাজি স্কুল ইত্যাদি যে সকল স্থান বিদ্যাভ্যাস জন্য অধুনা সংস্থাপন হইতেছিল তৎসমুদায়ই কেবল খ্রীষ্টান ধর্ম্ম প্রচারের জন্য জাল বিস্তার মাত্র;-সুতরাং মথুরমোহনের কখন ইংরাজি বিদ্যালয় দর্শন করা হয় নাই। বাল্যাবধি বিষয়কার্য্য সম্পাদনে পিতৃসহযোগী হইয়া তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ পারদর্শিতা জন্মিয়াছিল; প্রজাপীড়ন, তঞ্চকতা ও অর্থ সংগ্রহ প্রভৃতি বিদ্যাতে বিশেষ নিপুণতা অর্জ্জিত হইয়াছিল।
বংশীবদনের দ্বিতীয় পুত্র রামকানাই অন্যপন্থাবলম্বী হইল। তিনি স্বভাবতঃ সাতিশয় ব্যয়শীল ছিলেন; এজন্য অল্পকালেই অতুল্য ঐশ্বর্য্য বিশৃঙ্খল হইয়া উঠিল। মধ্যম বাবুর যেমন বাটী, মধ্যম বাবুর যেমন বাগান, মধ্যম বাবুর যেমন আসবাব, এমন কোন বাবুরই নয়। কিন্তু মধ্যম বাবুর জমিদারীও সর্ব্বাপেক্ষা লাভশূন্য; এবং মধ্যম বাবুর ধনাগারও তদ্রূপ অপদার্থ। শেষে কতিপয় শঠ চাটুকার তাঁহাকে কোন বাণিজ্যাদি ব্যাপারে সংলিপ্ত করিল। কলিকাতায় থাকিয়া ব্যবসায় ঈদৃশ অপরিসীম অর্থলাভের সঙ্কল্প করিতে লাগিল যে, সরলচিত্ত ভূস্বামীপুত্র দুরাশাগ্রস্ত হইয়া কলিকাতায় গেলেন; এবং বাণিজ্যোপলক্ষে ধূর্ত্ত চাটুকারদিগের করে পতিত হইয়া হৃতসর্ব্বস্ব হইলেন। পরিশেষে ঋণ পরিশোধার্থ তাবৎ ভূসম্পত্তি বিক্রীত হইয়া গেল।
রামকানাই বাণিজ্য উপলক্ষে কলিকাতায় আসায় এক উপকার হইয়াছিল,-রাজধানীবাসীদিগের পদ্ধতি অনুসারে নিজ পুত্র মাধবকে দেশীয় ও বিদেশীয় বিদ্যায় শিক্ষিত করিয়াছিলেন। আরও মনুষ্যজন্মের সাধ মিটাইয়া উপযুক্ত পাত্রীর সহিত মাধবের পরিণয় ঘটাইয়াছিলেন। -কলিকাতার নিকটবর্ত্তী কোনও গ্রামে এক দরিদ্র কায়স্থ বাস করিত। জগদীশ্বর যেমন কাহাকে সর্ব্বাংশে সুখী করেন না, তেমনই কাহাকেও সর্ব্বাংশে দুঃখী করেন না। কায়স্থের দুস্তর দুঃখসাগরতলে অমূল্য দুই রত্ন জন্মিয়াছিল-তাঁহার দুই কন্যাতুল্য অনিন্দিত সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী অথবা অকুলষিতচরিত্রা আর কোন কামিনী তৎপ্রদেশে ছিল না। কিন্তু রূপেই বা কি করে, চরিত্রেই বা কি করে,-ললাটলিপিদোষে হউক বা যে কারণেই হউক সচরাচর দেখা যায় বঙ্গদেশসম্ভূত কত রমণীরত্ন শূকরদন্তে দলিত হয়,-কায়স্থের জ্যেষ্ঠা কন্যা মাতঙ্গিনীর অদৃষ্টের তদ্রূপ হইল-নীচস্বভাব রাজমোহন তাঁহার স্বামী হইল।
রাজমোহন কর্ম্মঠ, কোনও উপায়ে সংসার প্রতিপালন করিয়া থাকে; তাহার বাটীও নিকটে। এজন্য কন্যাকর্ত্তার ও কন্যাকর্ত্রীর পাত্র মনোনীত হইল,-রাজসিংহাসনের যোগ্য কন্যা মাতঙ্গিনী দুষ্টের দাসী হইলেন। কনিষ্ঠা হেমাঙ্গিনীর প্রতি বিধাতা প্রসন্ন,-মাধবের সহিত তাঁহার পরিণয় হইল।
মাধবের অধ্যয়ন সমাপ্ত হইবার কিছু পূর্ব্বে রামকানাই লোকান্তরে গমন করিলেন। মাধব পিতৃপরলোকের পর প্রায় দারিদ্র্যগ্রস্ত হইতেন, কিন্তু অদৃষ্ট প্রসন্ন। বংশীবদন ঘোষের কনিষ্ট পুত্র রামগোপাল, জ্যেষ্ঠের ন্যায় ধনসম্পত্তিশালী না হইলেও দ্বিতীয়ের ন্যায় হতভাগ্য ছিলেন না। রামগোপাল, রামকানাইয়ের পরই পীড়াক্রান্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। তাঁহার সন্তানসন্ততি ছিল না। তিনি এই মর্ম্মে উইল করিলেন যে, মাধব তাঁহার তাবৎ সম্পত্তির অধিকারী হইবেক, বিধবা স্ত্রী যত দিন মাধবের ঘরে বাস করিবেন তত দিন তাঁহার নিকট গ্রাসাচ্ছাদন পাইবেন মাত্র।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পিতৃবিয়োগের পরেও মাধব বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন-শেষ পর্য্যন্ত রহিলেন। তাঁহার অনুপস্থিতিকালে তাঁহার কার্য্যকারকেরা বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। পাঠ সমাপ্ত হইলে হেমাঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া রাধাগঞ্জে গমনোদ্যত হইয়া শ্বশুরালয়ে আগমন করিলেন।
মাতঙ্গিনী তৎকালে পিত্রালয়ে ছিলেন, এবং রাজমোহনও তথায় উপস্থিত ছিলেন। রাজমোহন সময়ের সুযোগ বুঝিয়া মাধবের নিকট নিজের দুঃখকাহিনী প্রকাশ করিলেন; বলিলেন, “পূর্ব্বে কোনরূপ দিন যাপন করিয়াছি, কিন্তু এক্ষণে কাজকর্ম্ম প্রায় রহিত হইয়াছে; আমাদের সহায় মুরুব্বি মহাশয় ব্যতীত আর কেহ নাই। মহাশয় কুবেরতুল্য ব্যক্তি, অনুগ্রহ করিলে অনেকের কাছে বলিয়া দিতে পারেন।”
মাধব জানিতেন যে, রাজমোহন অতি দুর্নীতস্বভাব, কিন্তু সরলা মাতঙ্গিনী তাহার গৃহিণী হইয়া যে গ্রাসাচ্ছদনের ক্লেশ পাইতেছিলেন ইহাতে মাধবের অন্তঃকরণে রাজমোহনের উপর মমতা জন্মাইল। তিনি বলিলেন, “আমার পূর্ব্বাবধি মানস যে, কোন বিশ্বস্ত আত্মীয়ব্যক্তি হস্তে বিষয়কর্ম্মের কিয়দংশ ভার ন্যস্ত করিয়া আপনি কতকটা ঝঞ্ঝাট এড়াই, তা মহাশয় যদি এ ভার গ্রহন করেন তবে ত উত্তমই হয়।”
রাজমোহন মনে মনে বিবেচনা করিল যে, মাধব যে প্রস্তাব করিতেছিলেন তাহাতে রাজমোহনের আশার অতিরিক্ত ফল হইতেছে; কেন না, সে যদি মাধবের জমিদারীর একজন প্রধান কর্ম্মকারক হইতে পারে, তাহা হইলে তাহার উপার্জ্জনের সীমা থাকিবে না। কিন্তু এক দোষ যে, দেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে। রাজমোহন উত্তর করিলেন, “আমার প্রতি মহাশয়ের দয়া যথেষ্ট; কিন্তু যদি মহাশয়ের সহিত যাইতে হয়, তা’হলে পরিবার কাহার কাছে রাখিয়া যাই?”
মাধব বলিলেন, “সে চিন্তার প্রয়োজন কি? একই সংসারে দুই ভগিনী একত্র থাকিবেন, মহাশয়ও আমার বাটীতে যেমন ভাবে ইচ্ছা তেমনই ভাবে থাকিবেন।”
এই শুনিয়া রাজমোহন ভ্রূভঙ্গ করিয়া মাধবের প্রতি চাহিয়া সক্রোধে বলিল,-“না মহাশয়, প্রাণ থাকিতে এমন কখনও পারিব না।”
এই বলিয়া রাজমোহন তদ্দণ্ডেই শ্বশুরালয় হইতে প্রস্থান করিল।
পরদিন প্রাতে রাজমোহন প্রত্যাগমন করিল, এবং মাধবকে পুনরায় কহিল, “মহাশয়, সপরিবারে দূরদেশে যাওয়া আমি পারৎপক্ষে স্বীকার নাহি, কিন্তু কি করি, আমার নিতান্ত দুর্দ্দশা উপস্থিত, সুতরাং আমাকে যাইতেই হইতেছে; কিন্তু একটা পৃথক্ ঘর-দ্বারের বন্দোবস্ত না হইলে যাওয়া যায় না।”
যাচকের যাঞ্ছার ভঙ্গী পৃথক্, নিয়মকর্ত্তার ভঙ্গী পৃথক্। মাধব দেখিলেন, রাজমোহন যাচক হইয়া নিয়মকর্ত্তার ন্যায় কথাবার্ত্তা কহিতেছেন; কিন্তু মাধব তাহাতে রুষ্ট না হইয়া বলিলেন, “তাহার আশ্চর্য্য কি? মহাশয় যাইবার পর পক্ষমধ্যে প্রস্তুত বাটী পাইবেন।”
রাজমোহন সম্মত হইল; এবং মাতঙ্গিনীর সহিত মাধবের পশ্চাতে রাধাগঞ্জে যাত্রা করিল।
রাজমোহনের এইরূপ অভিপ্রায় পরিবর্ত্তনের তাৎপর্য্য কি, তাহা প্রকাশ নাই। ফলতঃ এমত অনেকের বোধ হইয়াছিল যে, রাজমোহন এক্ষণে বাটী থাকিতে নিতান্ত অনিচ্ছুক হইয়াছিল; অনিচ্ছার কারণ কি, তাহাও প্রকাশ নাই।
রাধাগঞ্জে উপস্থিত হইয়া মাধব রাজমোহনকে কার্য্যের নামমাত্র ভার দিয়া অতি সুন্দর বেতন নির্দ্ধারণ করিয়া দিলেন; গৃহ নির্ম্মাণ করিতে নিষ্কর ভূমি প্রদান করিলেন; এবং নির্ম্মণ প্রয়োজনীয় তাবৎ সামগ্রী আহরণ করিয়া দিলেন।
রাজমোহন বিনা নিজ ব্যয়ে নিজোপযুক্ত পরিপাটী গৃহ স্বল্পকাল মধ্যে নির্ম্মাণ করিলেন। সেই গৃহের মধ্যেই এই আখ্যায়িকার সূত্রপাত।
রাজমোহন যদিও উচ্চ বেতন-ভোগী হইলেন, কিন্তু মাধব সন্দেহ করিয়া কোনও গুরুতর কার্য্যের ভার দিলেন না।-প্রতিপালনার্থ বেতন দিলেন মাত্র। রাজমোহনের কালক্ষেপনের উপায়াভাব প্রযুক্ত মাধব তাহাকে কৃষকের দ্বারা কর্ষণার্থ বহু ভূমি দান করিলেন; রাজমোহন প্রায় এই কার্য্যেই ব্যাপৃত থাকিতেন।
এইরূপে মাধবের নিকট শোধনাতীত উপকার প্রাপ্ত হইয়া রাজমোহন কোন অংশে কখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেন না। রাধাগঞ্জে আসা অবধি রাজমোহন, মাধবের প্রতি অপ্রীতিসূচক এবং অপ্রীতিজনক ব্যবহার করিতে লাগিলেন; উভয়ের সাক্ষাৎ সম্ভাবনাদি অতি কদাচিৎ সংঘটন হইত। এইরূপ আচরণে মাধব কখন দৃকপাত করিতেন না-দৃকপাত করিলেও তদ্ধেতু বিরক্তি বা বদান্যতার লাঘব জন্মাইত না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, মাতঙ্গিনী ও হেমাঙ্গিনী পরস্পর প্রাণতুল্য ভালবাসিতেন, তথাপি তাঁহাদের প্রায় সাক্ষাৎ হইত না। হেমাঙ্গিনী কখন কখন স্বামীকে অনুরোধ করিয়া অগ্রজা সন্নিধানে শিবিকা প্রেরণ করিতেন; কিন্তু রাজমোহন প্রায় মাতঙ্গিনীকে ভগিনীগৃহে গমন করিতে দিতেন না। হেমাঙ্গিনী মাধবের স্ত্রী হইয়াই বা কিরূপে রাজমোহনের বাটীতে আসেন?
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এক্ষণে আখ্যায়িকার সূত্র পুনঃগ্রহণ করা যাইতেছে। পুষ্পোদ্যান হইতে মাধব বাটীতে প্রত্যাগমন করিলে একজন পত্র-বাহক তাঁহার হস্তে একখানি লিপি প্রদান করিল। লিপির শিরোনামার স্থলে “জরুরি” এই শব্দ দৃষ্টে মাধব ব্যস্ত হইয়া পত্রপাঠে নিযুক্ত হইলেন। সদর মোকামে যে ব্যক্তি তাঁহার মোক্তার নিযুক্ত ছিল, সেই ব্যক্তি এই পত্র প্রেরণ করিয়াছিল। পত্রের মর্ম্ম নিম্নে উদ্ধৃত হইলঃ-
“মহিমার্ণবেষু-
অধীন এ মোকামে থাকিয়া হুজুরের মোকদ্দমা জাতের তদ্বিরে নিযুক্ত আছে, এবং তাহাতে যেমত যেমত আবশ্যক তাহা সাধ্যমত আমলে আনিতেছে। ভরসা করি সর্ব্বত্র মঙ্গল ঘটনা হইবেক। সম্প্রতি অকস্মাৎ যে এক গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে তাহা হুজুরের গোচরে নিবেদন করিতে অধীনের সাহসাভাব। হুজুরের শ্রীমতী খুড়ী ঠাকুরাণীর উকিল হুজুরের নামে অদ্য এ মোকামের প্রধান সদর আপিল আদালতে এই দাবিতে মোকদ্দমা রুজু করিয়াছেন যে, রামগোপাল ঘোষ মহাশয়ের উইলনামা সম্পূর্ণ মিথ্যা তঞ্চক-হুজুর কর্ত্তৃক জাল উইল প্রস্তুত হইয়া বিষয়াদি হইতে তেঁহ বেদস্ত হইয়াছেন। অতএব সমেৎ ওয়াশিলাত তাবৎ বিষয়ে দখল পাওয়ার ও উইল রদের দাবি ইত্যাদি।”
পত্রী মাধবের হস্তলিখিত হইয়া ভূপতিত হইল। মনে যে তাঁহার কিরূপ ক্রোধাবির্ভাব হইল তাহা বর্ণনা করা দুষ্কর। বহুক্ষণ চিন্তার পর পত্রী মৃত্তিকা হইতে উত্তোলন করিলেন, এবং ললাটের স্বেদস্রুতি করদ্বারা বিলুপ্ত করিয়া পুনঃপাঠে প্রবৃত্ত হইলেন। যথা-
“ইঁহার ছলাদার কে, তাহা অধীন এ পর্য্যন্ত জানিতে পারে নাই; কিন্তু অধীন অনেক অনুসন্ধান করিতেছে ও করিবেক। ফলে এমত বোধ হয় না যে, বিনা ছলা স্ত্রীলোক এরূপ নালিশ উত্থাপন করিবেন। অধীন অদ্য পরম্পরায় শ্রুত হইল যে, কোনও অতি প্রধান ব্যক্তির কুপরামর্শমতে এ ঘটনা উপস্থিত হইয়াছে।”
মাধব মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন যে, এমত ব্যক্তি কে, যে কুপরামর্শ দিয়াছে? মাধব অনেক ভাবিয়া কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। কখন একজন প্রতিযোগী প্রতিবাসীর প্রতি সন্দেহ, কখনও বা অপরের প্রতি সন্দেহ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্দেহ সমূলক বলিয়া বোধ হইল না।
পত্রপাঠে পুনঃপ্রবৃত্ত হইলেনঃ-
“অধীনের বিবেচনায় হুজুরের কোনও শঙ্কা নাই, কেন না, ‘যতো ধর্ম্মঃ ততো জয়’, কিন্তু যেরূপ বিপক্ষের সহায় দেখা যাইতেছে, তাহাতে সতর্কতার আবশ্যক।-বাবুদিগের এক্ষণে ওকালতনামা দেওয়া আবশ্যক-পশ্চাৎ সময়ে সময়ে সদর হইতে উকীল কৌন্সিলী আনান কর্ত্তব্য হইবেক। তৎপক্ষে হুজুরের যেমন মর্জি। আজ্ঞাধিন প্রাণপণে হুজুরের কার্য্যে নিযুক্ত রহিল-সাধ্যানুসারে ত্রুটি করিবেক না। ইতি তারিখ-
আজ্ঞানুবর্ত্তী শ্রীহরিদাস রায়”।
“পুনশ্চ নিং-
আপাততঃ মোকদ্দমায় খরচ প্রায় হাজার টাকার আবশ্যক হইবেক। যেরূপ হুজুর বুঝিবেন সেইরূপ করিবেন।”
পত্রপাঠ সমাপন মাত্র মাধব, খুল্লতাত-পত্নীর অনুসন্ধানে পুরমধ্যে চলিলেন। ক্রোধে কলেবর কম্পিত হইতেছিল, অতি তরল পদবিক্ষেপে গমন করিতে লাগিলেন;-তাঁহাকে খুল্লতাত-পত্নী কোন্ মুখে জাল সাজ বলিয়া বিচারাগারে ব্যক্ত করিয়াছেন, এ কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, এবং তৎক্ষণাৎ খুড়ীকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দিবেন স্থির করিলেন।
পুরমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, সন্ধ্যাকাল পাইয়া অন্তঃপুরবাসিনীরা যে হট্টগোল উপস্থিত করিয়াছেন, তাহাতে কর্ণপাত করাই কষ্ট, কথার উত্তর পাওয়া দূরে থাকুক। কোথাও কোন রূপসী-একে স্থূলাকার তাহাতে মেঘের বর্ণ-নানা মত চিৎকার করিয়া এটা ওটা সেটা চাহিতেছে, এবং নানামত মুখভঙ্গী অঙ্গভঙ্গী করিতেছে,-যেন একটা ক্ষুদ্র হস্তিনী কেলি করিতেছে। কোথাও একটি পরিচারিকা তদ্রূপ বিশাল দেহপর্ব্বত লইয়া ব্যস্ত-প্রায় বিবসনা-গৃহ মার্জ্জন করিতেছে; এবং যেমন ত্রিশূলহস্তে অসুরবিজয়িনী প্রমথেশ্বরী প্রতিবার শূলাঘাতে অসুরদল দলিত করিয়াছিলেন, পরিচারিকাও করাল সম্মার্জ্জনী হস্তে রাশি রাশি জঞ্জাল, ওজলা, তরকারির খোসা প্রভৃতি দলিত করিতেছিল, এবং যে আঁটকুড়ীরা এত জঞ্জাল করিয়াছিল তাহাদিগের পতিপুত্রের মাথা মহাসুখে খাইতেছিল। কোথাও অপরা কিঙ্করী আঁস্তাকুড়ে বসিয়া ঘোররবে বাসন মাজিতেছিল,-পাচিকার অপরাধ, সে কেন কড়া বগুনায় পাক করিয়াছিল?-তাই কিঙ্করীর এ গুরুতর কর্ম্মভোগ; যেমন মার্জ্জনা-কার্য্যে তাহার বিপুল করযুগল ঘর্ ঘর্ শব্দে চলিতেছিল, রসনাখানিও তদ্রূপ দ্রুতবেগে পাচিকার চতুর্দ্দশ পুরুষকে বিষ্ঠাদি ভোজন করাইতেছিল। পাচিকা স্বয়ং তখন স্থানান্তরে, গৃহিণীর সহিত ঘৃত লইয়া মহা গোলযোগ করিতেছিলেন, আঁস্তাকুড়ে যে তাঁহার পূর্ব্ব-পুরুষের আহারাদির পক্ষে এমন অন্যায় ব্যবস্থা হইতেছিল, তাহা কিছুমাত্র জানিলেন না-ঘৃতের বিষয়ে একেবারে উন্মত্তা। গৃহিণী পাকার্থ যতটুকু ঘৃত প্রয়োজন ততটুকু দিয়াছেন, কিন্তু পাচিকা তাহাতে সন্তুষ্টা নহেন। তিনি মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, যতটুকু পাকার্থ আবশ্যক তাহার দ্বিগুণ ঘৃত কোন সুযোগে লওয়াই যুক্তি; কারণ, অর্দ্ধেক পাক হইবে, অর্দ্ধেক আত্মসেবার জন্য থাকিবে।
কোথাও বা দারুণ বঁটীর আঘাতে মৎস্যকুল ছিন্নশীর্ষ হইয়া ভূমিতে লুটাইতেছিল, কোথাও বা বালক-বালিকার দল মহানন্দে ক্রীড়া করিতেছিল। পুরসুন্দরীরা কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে প্রদীপ-হস্তে যাতায়াত করিতেছিলেন; মলের শব্দ কোথাও ঝণাৎ ঝণাৎ, কোথাও রুণ্ রুণ্, কোথাও বা ঠুণু, ঠুণু; আর যেমন বয়স তার মলও তেমনই বাজিতেছিল। কখন বা বামাসুরে রামী বামী শ্যামীর ডাক পড়িতেছিল। পাড়ার গোটা দুই অধঃপেতে ছেলে নিজ নিজ পৌরুষ প্রকাশের উপযুক্ত সময় পাইয়া মল্লযুদ্ধ উপলক্ষে উঠানে চুল ছেঁড়াছিঁড়ি করিতেছিল। কতকগুলিন বালিকা কলরব করিয়া আগডুম বাগডুম খেলিতেছিল।
মাধব এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া হতাশ হইলেন; এ ঘোর কলরবের মধ্যে যে কেহ তাহার কথা শুনিতে পাইবে, এমত ভরসা রহিল না। তিনি অষ্টমে উঠিয়া চীৎকার করিয়া বলিলেন, “বলি, মাগীরা একটু থাম্বি।” এই বলিয়া উঠানে গিয়া মল্লযোদ্ধা-বালকদ্বয়ের মধ্যে একজনকে কেশাকর্ষণ করিয়া দুই-চারি চপেটাঘাত করিলেন।
একেবারে আগুনে জল পড়িল;- ঘোরতর কোলাহল পলকমধ্যে আর নাই, যেন ভোজবাজিতে সকলই তিরোহিত হইল। যে স্থূলাঙ্গিনী আকাশকে সম্বোধন করিয়া বিবিধ চীৎকার ও মুখভঙ্গি করিতেছিলেন, তাঁহার কণ্ঠ হইতে অর্দ্ধনির্গত চীৎকার অমনি কণ্ঠেই রহিয়া গেল, হস্তিনীর ন্যায় আকারখানি কোথায় যে লুক্কায়িত হইল তাহা আর দেখিতে পাওয়া গেল না; সমার্জ্জনীহস্তে যিনি বিবসনে বিষম ব্যাপার করিতেছিলেন, তিনি অমনি করস্থ ভীম প্রহরণ দূরে নিক্ষেপ করতঃ রণক্ষেত্র হইতে পলায়ন আরম্ভ করিলেন, কিন্তু প্রায়-বসনহীন, মাংসরাশি কোথায় লুকাইবেন স্থান না পাওয়ায় এ কোণ ও কোণ করিতে লাগিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে মেঝেতে কে জল ফেলিয়াছিল-পরিচারিকা দ্রুতপদে বিবসন শরীর লইয়া যেমন পলাইবেন, অমনি পা পিছলাইয়া চীৎপাত হইয়া ভূ-শায়িনী হইলেন; যিনি পাত্রাদি মার্জ্জনে হাত মুখ দুই ঘুরাইতে ঘুরাইতে পাচিকার পিতৃপুরুষের পিণ্ডাদির ব্যবস্থা করিতেছিলেন, তাঁহার একটা লম্বা গালির ছড়া আধখানা বই বলা হইল না-হাত ঘুরিতে ঘুরিতে যেমন উঁচু হইয়াছিল তেমনই উঁচু রহিয়া গেল; মৎস্যদল-দলনী বারেক নিস্তব্ধ হইলেন, পশ্চাৎ কার্য্যারম্ভ করিলেন বটে, কিন্তু আর তাদৃশ ঘটা রহিল না; রন্ধনশালার কর্ত্রী যে ঘৃতের কারণ বক্তৃতা আরম্ভ করিয়াছিলেন, অকস্মাৎ তাহা হইতে নিবৃত্ত হইয়া পলায়নতৎপরা হইলেন–অন্যমনস্কপ্রযুক্তই হউক, আর তাড়াতাড়িতে বিবেচনার অভাববশতঃই হউক, পাচিকা পলায়নকালে পূর্ণভাণ্ড ঘৃত হইয়া চলিয়া গেল-পাচিকা ইতিপূর্ব্বে কেবল অর্দ্ধভাণ্ড মাত্র ঘৃতের প্রার্থিতা ছিলেন; যে পুর-সুন্দরীরা প্রদীপহস্তে কক্ষে কক্ষে গমনাগমন করিতেছিলেন, তাঁহারা সকলে ত্রস্তে পলাইয়া লুক্কায়িত হইলেন, পলায়নকালে মলগুলি একেবারে ঝন্ ঝন্ করিয়া বাজিয়া উঠিল-হস্তের দীপসকল নিবিয়া গেল।
যে শিশু মল্লযোদ্ধাটি মাধবের চপেটাঘাত খাইয়াছিলেন, তিনি বীরত্বের এমত নূতনতর পুরস্কার প্রাপ্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ রণস্থলী হইতে বেগে প্রস্থান করিয়াছিলেন-দ্বিতীয় যোদ্ধাও সময়ের গতিক তাদৃশ সুবিধাজনক নয় বুঝিয়া রণে ভঙ্গ দিলেন, কিন্তু যেমন ঘটৎকচ মৃত্যুকালেও পিতৃবৈরী নষ্ট করিয়াছিলেন, ইনিও তেমনই পলায়নকালে বিপক্ষের ঊরুদেশে একটি পদাঘাত করিয়া গেলেন, যে বালিকাগণ কলরব-সহকারে খেলিতেছিল, তাহারা খেলা ত্যাগ করিয়া পলায়নতৎপর বীরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল-ভয় হইয়াছে, কিন্তু হাসিটা একেবারে থামিল না। যে অন্তঃপুর এতক্ষণ অতি ঘোর কোলাহলপরিপূর্ণ ছিল, তাহা এক্ষণে একেবারে নীরব। কেবল মাত্র গৃহিণী-অবিকৃত কান্তিমতী হইয়া-বাবুর সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলেন।
মাধব তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “কি মাসী, আমার বাড়ীতে বাজার!”
মাসী মৃদুহাস্য করিয়া কহিলেন, “বাছা, মেয়ে মানুষের স্বভাব বকা।”
মাধব কহিলেন, “খুড়ী কোথা, মাসী?”
উত্তর-“আমিও তাই ভাবিতেছিলাম, আজ সকাল বেলা হ’তে কেহই তাঁহাকে দেখে নাই।”
মাধব বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, “সকাল অবধি নাই! তবে সকলই সত্য!”
মাসী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি সত্য বাপু?”
মাধব। কিছু না-পশ্চাৎ বলিব। খুড়ী তবে কোথায়? কাহারও সঙ্গে কি তাঁহার আজও দেখা হয় নাই?
গৃহিণী ডাকিয়া কহিলেন, “অম্বিকা, শ্রীমতী! তোরা কেহ দেখেছিস?”
তাহারা সকলে সমস্বরে উত্তর করিল “না।”
মাধব কহিলেন, “বড়ই আশ্চর্য্যের কথা।”
পরে অন্তরাল হইতে একজন স্ত্রীলোক মৃদুস্বরে কহিল, “আমি নাবার বেলা বড় বাড়ীতে তাঁকে দেখেছিলাম।”
মাধব অধিকতর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন, “বড় বাড়ীতে? মথুর দাদার ওখানে!”
তাঁহার মনোমধ্যে এক নূতন সিদ্ধান্ত উপস্থিত হইল। ভাবিলেন, “তবে কি মথুর দাদার কর্ম্ম? না না, তা হ’তে পারে না-আমি অন্যায় দোষ দিতেছি”। পরে প্রকাশ্যে কহিলেন, “করুণা তুই বড় বাড়ীতে যা,-খুড়ীকে ডেকে আন্; যদি না আসেন, তবে কেন আস্বেন না, জিজ্ঞাসা করিস্।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এদিকে মাতঙ্গিনী স্বামীকৃত তিরস্কারের পর শ্বশ্রূস্বসা কর্ত্তৃক নিজ শয়নকক্ষে আনীত হইলে কক্ষের দ্বার অর্গলবব্ধ করিয়া মনের দুঃখে শয্যাবলম্বন করিলেন। রাত্রে পাকাদি সমাপন হইলে শ্বশ্রূস্বসা তাঁহাকে আহারার্থে ডাকিলেন, কিন্তু মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিলেন না। ননন্দা কিশোরী আসিয়া পিতৃষ্বসার সংযোগে অনেক অনুনয় সাধনাদি করিলেন; কিন্তু তাহাতে কোন ফল হইল না। অবশেষে তাঁহারা নিরস্ত হইলেন-মাতঙ্গিনী অনশনা রহিলেন।
মাতঙ্গিনী শয্যায় শুইয়া আপন অদৃষ্টের বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গিনীর প্রতি রুষ্ট হইলে রাজমোহন প্রায় শয়নাগারে আসিত না, সুতরাং অদ্য রাত্রে যে আসিবে না, ইহা মাতঙ্গিনী উত্তমরূপে জানিতেন না।
ক্রমে রজনী গভীরা হইল। একে একে গৃহস্থ সকলে নিদ্রামগ্ন হইলেন। সর্ব্বত্র নীরব হইল। মাতঙ্গিনীর শয়নকক্ষে প্রদীপ ছিল না। গবাক্ষরন্ধ্রের আচ্ছাদনীয় পার্শ্ব হইতে চন্দ্রালোক আসিয়া কক্ষতলে পড়িয়াছিল; তদ্ধেতু কক্ষের অংশবিশেষ ঈষৎ আলোকিত হইয়াছিল। তদ্ব্যতীত সর্ব্বত্র অন্ধকার।
প্রকৃত অপরাধে অপমানের যন্ত্রণা সততই এত তীক্ষ্ণ যে, যতক্ষণ না তৎসম্বন্ধীয় বিষময়ী স্মৃতি বিলোপিত হয়, ততক্ষণ মানবদেহে নিদ্রা অনুভূত হইতে পারে না। গ্রীষ্মাতিশয্যপ্রযুক্ত বক্ষঃস্থল হইতে অঞ্চল পদতলে প্রক্ষিপ্ত করিয়া উপাধান-ন্যস্ত বাম ভুজোপরে শিরঃ সংস্থাপন করিয়া মাতঙ্গিনী অশ্রুপূর্ণ লোচনে গৃহতলশোভিনী চন্দ্রপদরেখা প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। কেন? সে অমৃত শীতল কিরণ দৃষ্টে কত যে পূর্ব্বসুখ স্মৃতিপথগামী হইল, তাহা কে বর্ণনা করিতে পারে? কৈশোরে কত দিন প্রদোষকালে হেমাঙ্গিনীর সহিত গৃহ-প্রাঙ্গনে এক-শয্যায় শায়িনী হইয়া শিশু-মনোরঞ্জিনী উপকথা কখন বা শ্রবন করিতে করিতে নীলাম্বরবিহারী এই নিশানাথ প্রতি চাহিয়া থাকিতেন, তাহা মনে পড়িল। নীলাম্বর হইতে এই মৃদুল জ্যোতিঃ বর্ষিত হইয়া কত যে হৃদয়-তৃপ্তি জন্মাইত, এ বৃন্তোৎপন্ন কুসুমযুগলবৎ কণ্ঠলগ্না দুই সহোদরা তখন কত যে আন্তরিক সুখে উচ্চহাস্য হাসিতেন, তাহা স্মরণপথে লাগিল।
সেই এক দশা আর এই এক দশা। সে উচ্চহাস্য আর কাহার কণ্ঠে? সেই সকল প্রিয়জনই বা কোথায়? আর কি তাঁহাদের মুখ দেখিতে পাইবেন? আর কি তাঁহাদের সেই স্নেহপূর্ণ সম্বোধন কর্ণকুহরে সুধাবর্ষণ করিবে? মনঃপীড়াপ্রদান-পটু স্বামীর হস্তজ্বালিত কালাগ্নি অন্তর্দাহ ব্যতীত আর কিছু কি অদৃষ্টে আছে?
এই সকল দুঃখ চিন্তার মধ্যে একটি গূঢ় বৃত্তান্ত জাগিতেছিল। সে চিন্তা অনুতাপময়ী হইয়াও পরম সুখকরী। মাতঙ্গিনী এ চিন্তাকে হৃদয়-বহিষ্কৃত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু পারিলেন না। এই গূঢ় ব্যাপার কি তাহা কনক ব্যতীত আর কেহ জানিত না।
দুঃখ-সাগর মনোমধ্যে মন্থন করিয়া তৎস্মৃতিলাভে মাতঙ্গিনী কখন মনে করিতেন, রত্ন পাইলাম; কখন বা ভাবিতেন, হলাহল উঠিল। রত্নই হউক, আর গরলই হউক, মাতঙ্গিনী ভাবিয়া দেখিলেন, তাঁহার কপালে কোন সুখই ঘটিতে পারে না। চক্ষুর্দ্বয় বারিপ্লাবিত হইল।
ক্রমে গ্রীষ্মাতিশয্য দুঃসহ হইয়া উঠিল; মাতঙ্গিনী গবাক্ষ-রন্ধ্র মুক্ত করিবার অভিপ্রায়ে শয্যা ত্যাগ করিয়া তদভিমুখে গমন করিলেন। মুক্ত করেন, এমত সময়ে যেন কেহ শনৈঃ পদসঞ্চারে সেই দিকে অতি সাবধানে আসিতেছিল-এমত লঘু শব্দ তাঁহার কর্ণপ্রবিষ্ট হইল।
জানেলাটি যেমন সচরাচর এরূপ গৃহে ক্ষুদ্র হয়, তদ্রূপই ছিল,-দুই হস্ত মাত্র দৈর্ঘ্য, সার্দ্ধেএক হস্ত মাত্র বিস্তার। এ প্রদেশে চালাঘরে মৃত্তিকার প্রাচীর থাকে না, দরমার বেষ্টনীই সর্ব্বত্র প্রথা। রাজমোহনের গৃহেও সেইরূপ ছিল; এবং জানালার ঝাঁপ ব্যতীত কাষ্ঠের আবরণী ছিল ন।
পার্শ্বে যে ছিদ্র দিয়া গৃহমধ্যে জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়াছিল, পদসঞ্চার শ্রবণে ভীতা হইয়া মাতঙ্গিনী সেই ছিদ্র বহির্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে যত্ন করিলেন, কিন্তু নীলাম্বরস্পর্শী বৃক্ষশ্রেণীর শিরোভাগ ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পাইলেন না।
মাতঙ্গিনী জানিতেন, যে দিক্ হইতে পদসঞ্চার শব্দ তাঁহার কর্ণাগত হইল, সে দিক্ দিয়া মনুষ্য যাতায়াতের কোন পথ নাই; সুতরাং আশঙ্কা জন্মান বিচিত্র কি? মাতঙ্গিনী নিস্পন্দ শরীরে কর্ণোত্তলন করিয়া তথায় দণ্ডায়মান রহিলেন।
ক্রমশঃ পদক্ষেপণ শব্দ আরও নিকটাগত হইল; পরক্ষণেই দুই জন কর্ণে কর্ণে কথোপকথন করিতেছে শুনিতে পাইলেন। দুই-চারি কথায় মাতঙ্গিনী নিজ স্বামীর কণ্ঠস্বর চিনিতে পারিলেন। তাঁহার ত্রাস ও কৌতূহল দুই-ই সম্বর্দ্ধিত হইল। যথায় মাতঙ্গিনী গৃহমধ্যে দণ্ডায়মানা ছিলেন, আর যথায় আগন্তুক ব্যক্তিরা বিরলে কথোপকথন করিতেছিল, তন্মধ্যে দরমার বেষ্টনীমাত্র ব্যবধান ছিল। সুতরাং মাতঙ্গিনী তৎকথোপকথনের অনেক শুনিতে পাইলেন; আর যাহা শুনিতে পাইলেন না, তাহার মর্ম্মার্থ অনুভবে বুঝিতে পারিলেন।
এক ব্যক্তি কহিতেছিল, “অত বড় বড় করিয়া কথা কহ কেন? তোমার বাড়ীর লোকে যে শুনিতে পাইবে।”
দ্বিতীয় ব্যক্তি উত্তর করিল, “এত রাত্রে কে জাগিয়া থাকিবে?”
মাতঙ্গিনী কণ্ঠস্বরে বুঝিলেন, এ কথা রাজমোহন কহিল।
প্রথম বক্তা কহিল, “কি জানি যদি কেহ জাগিয়া থাকে, আমাদের একটু সরিয়া দাঁড়াইলে ভাল হয়।”
রাজমোহন উত্তর করিল, “বেশ আছি; যদি কেহ জাগিয়াই থাকে, তবে এ ছেঁচের ছায়ার মধ্যে কেহ আমাদিগকে ঠাওর পাইবে না, বরং সরিয়া দাঁড়াইলে দেখিতে পাবে।”
প্রথম বক্তা জিজ্ঞাসা করিল, “এ ঘরে কে থাকে?”
দ্বিতীয় বক্তা রাজমোহন উত্তর করিল, “সে কথায় দরকার কি?”
প্র ব। বলিতেই বা ক্ষতি কি?
দ্বি ব। এ আমার ঘর, আমার স্ত্রী ভিন্ন আর কেহ থাকেন না।
প্র ব। তুমি ঠিক জান ত, তোমার স্ত্রী ঘুমাইয়াছে?
দ্বি ব। বোধ করি ঘুমাইয়াছে, কিন্তু সেটা ভাল করিয়া জানিয়া আসিতেছি, তুমি এখানে ক্ষণেক দাঁড়াও।
মাতঙ্গিনী পুনরায় পদক্ষেপণ শব্দ শুনিতে পাইলেন; বুঝিলেন, রাজমোহন বাটীর ভিতর আসিতেছে। মাতঙ্গিনী নিঃশব্দে গবাক্ষ সন্নিধান হইতে সরিয়া শয্যায় আসিলেন; এবং এমত সাবধানে তদুপরি আরোহণ করিলেন যে, কিঞ্চিন্মাত্র পদশব্দ হইল না। তথায় নিমীলিত নেত্রে শয়ন করিয়া একান্ত নিদ্রাভিভূতার ন্যায় রহিলেন।
রাজমোহন আসিয়া দ্বারে মৃদু মৃদু করাঘাত করিল। পত্নী আসিয়া দারোদ্ঘাটন করিল না। তখন রাজমোহন মৃদুস্বরে মাতঙ্গিনীকে ডাকিতে লাগিল; তথাপি দ্বারোন্মোচিত হইল না। রাজমোহন বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। তথাপি কি জানি এমনই হয় যে, মাতঙ্গিনী সন্ধ্যাকালে ব্যাপারে অভিমানিনী হইয়া নীরব আছেন, এই সন্দেহে রাজমোহন কৌশলে কক্ষাভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে যত্ন করিল। পাকাশালায় গমন করিয়া তথাকার প্রদীপ জ্বালিয়া আনিল; দ্বারের নিকটে প্রদীপ রাখিয়া এক হস্তে একখানা কপাট টানিয়া রাখিয়া এক পদে দ্বিতীয় কবাট ঠেলিয়া ধরিল,-এইরূপে দুই কবাটমধ্যে অঙ্গুলিপ্রবেশের সম্ভাবনা হইলে, দ্বিতীয় হস্তের অঙ্গুলি দ্বারা পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, মাতঙ্গিনী, রাজমোহন স্বেচ্ছাকৃত শয়নাগারে প্রবেশ করিতে পারে, এই অভিপ্রায় কেবলমাত্র কাষ্ঠের “খিল” দিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছিলেন। রাজমোহন অনায়াসে “খিল” বাহির হইতে উদ্ঘাটিত করিল, এবং প্রদীপহস্তে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল।
রাজমোহন দেখিল যে, মাতঙ্গিনীর মুখকান্তি যথার্থ সুষুপ্তি-সুস্থিরের ন্যায় রহিয়াছে। বার কয়েক তাঁহাকে ডাকিল; কোন উত্তর পাইল না। যদি পত্নী অভিমানে নিরুত্তরা থাকে তবে অভিমান ভঞ্জনার্থ দুই চারিটা মিষ্ট কথা কহিল; তথাপি মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ রহিয়াছেন, ও ঘন ঘন গভীর শ্বাস বহিতেছে দেখিয়া মনে নিশ্চিত বিবেচনা করিল, মাতঙ্গিনী নিদ্রিতা। সে নিদ্রার ছল করিবে কেন? অতঃপর নিঃসন্দিগ্ধমনে পূর্ব্ব কৌশলে দ্বার বন্ধ করিয়া অন্য কক্ষদ্বারে গমন করিলে দ্বারে দ্বারে সকলকে মৃদুস্বরে ডাকিল, কেহই উত্তর দিল না; সুতরাং সকলেই নিদ্রামগ্ন বিবেচনায় রাজমোহন প্রদীপ নির্ব্বাপিত করিয়া আগন্তুক ব্যক্তির নিকট গমন করিল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
মাতঙ্গিনী পুনর্ব্বার নিঃশব্দে পদসঞ্চারে শয্যা ত্যাগ করিয়া গবাক্ষসান্নিধ্যে গমন করিলেন; এবং নিম্নোদ্ধৃত মত কথোপকথন শ্রবণ করিলেন।
সকলেই নিদ্রিত, এ সংবাদ রাজমোহন প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়া আগন্তুক কহিল, “তুমি আমাদের এ উপকার করিতে তবে স্বীকার আছ?”
রাজমোহন কহিল, “বড় নহি-আমি কিন্তু তা বলিয়া ভালমানুষির বড়াই করিতেছি না; তবু নেমকহারামি; আমি লোকটাকে দু’চক্ষে দেখিতে পারি না বটে, কিন্তু আমার উপকার অনেক করিয়াছে।”
অপরিচিত ব্যক্তি কহিল, “উপকার করিয়াছে, তবে দেখিতে পার না কেন?”
রাজ। উপকার করেছে, কিন্তু মন্দও করেছে। আমার ভাল কর, কর, না কর-সে তোমার ইচ্ছা; কিন্তু আমায় যে দুঃখ দেয়, সে শত উপকার করিলেও তার মাপ নাই।
অপরিচিত। তবে আর নেমকহারামি কি? আমাদের কাজে লাগিবে?
রাজ। লাগি, যদি যা চাই, দাও। আমার ইচ্ছা এখানকার বাস উঠাই-ওর কাছে না থাকিতে হয়। কিন্তু যাই কি নিয়ে-হাত খালি; দেশে গেলে বাঁচি কি মরি। তাই আমি এমন এক হাত মারিতে চাই যে, সেই টাকায় অন্যত্র আমার কিছুকাল গুজরাণ হয়। যদি তোমাদের এ কর্ম্মে এমন হাত মারিতে পারি, তা হলে লাগিব না কেন? লাগিব।
অপ। আচ্ছা, কি নেবে বল?
রাজ। তুমি আগে বল দেখি আমায় কি করিতে হইবে?
অপ। যাহা বরাবর করেছ তাহাই করিবে; মাল বই করিয়া দিবে। এইবার মনে করিতেছি যে, নগদ ছাড়া যা কিছু পাইব তা তোমার কাছে রেখে যাব।
রাজ। বুঝেছি, আমি নইলে তোমার কাজ চলিবে না। তোমরা বেশ বুঝেছ যে, এত বড় বাড়ীতে একটা কর্ম্ম হইলে এ দিকেও বড় গোলযোগ হইয়া উঠিবে; রাঁড়ী বালতির বাড়ী নয় যে, দারোগা বাবু কিছু প্রণামী লইয়া স্বচ্ছন্দে দেখনহাসির বাড়ীতে বসিয়া ইয়ারকি মারিবে। একটা তল্লাস তাগাদার বড় রকম সকমই হইয়া উঠিবে; তাহা হইলে সোণা কোলে করিয়া বসিয়া থাকিলে ত হইবে না। তাই তোমরা চাও যে, যত দিন না লেঠাটা মিটে তত দিন আমার কাছে সব থাকে। তা বড় মন্দ মতলব নয়; আর আমারও এমত যুত বরাত আছে যে, কোন শালা খড়্কে গাছটিও টের পাবে না। বিশেষ আমি ভায়রা ভাই, আমাকে কোন্ শালা শেষ করবে? অতএব আমার দ্বারা যে কাজ হবে, আর কাহারও দ্বারা তেমনটি হবে না। কিন্তু আমার সঙ্গে বনিয়া উঠা ভার।
অপ। যদি ভাই এতই বুঝিতেছ, তবে কেন বনাইয়া লও না।
রাজ। আমি দশ কথা পাঁচ কথার মানুষ নই; প্রাণ চায় দাও-না হয়, আপনার কর্ম্ম আপনি কর,-সিকিভাগ চাই।
দস্যু। ভালরূপ জানিত যে, রাজমোহনের এ বিষয়ে কাজে কথায় এক, অপহৃত দ্রব্যের চতুর্থাংশের ন্যূন সে সহায়তা করিতে স্বীকার হইবে না; অতএব বাক্যব্যয় বৃথা। কিয়ৎক্ষণচিন্তা করিয়া কহিল, “আমি সম্মত হইলাম। তাদের একবার জিজ্ঞাসার আবশ্যক, তা তারা কিছু আমার মত ছাড়া হবে না।”
রাজমোহন উত্তর করিল, “তাতে সন্দেহ কি? কিন্তু আর একটা কথা আছে। যা আমার কাছে থাকিবে, তার আমরা একটা মোটামুটি দাম ধরিব; ইহারই সিকি তোমরা আমাকে নগদ দিয়া যাবে; তার পর মহাজনে কম দেয় আমি কম্তির সিকি ফেরত দিব, আর বেশী দেয় তোমরা আমাকে বেশীটা দেবে।”
দস্যু। তাই হবে; কিন্তু আমারও আর একটি কথা আছে। তোমাকে আর একটি কাজ করিতে হইবে।
রাজ। আর এক মুঠো টাকা।
দস্যু। তা ত বটেই। আমরা মাধব ঘোষের যথাসর্ব্বস্ব লুঠিব, সে কেবল আমাদের আপনাদেরই জন্য; কিন্তু পরের একটা কাজ আছে।
রাজমোহন কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি কাজ?”
দস্যু। তাহার খুড়ার উইলখানা চাই।
রাজমোহন কিছু চমকিয়া কহিল, “হুঁ।”
দস্যু। কহিল, “হুঁ, কিন্তু উইলখানা কোথায় আছে আমরা তা জানি না। আমরা ত সমস্ত রাত্রি কেবল কাগজ উটকাইয়া বেড়াইতে পারব না। কোথায় আছে সে খবরটা তুমি অবশ্য জান।”
রাজ। জানি; কিন্তু কাহার জন্য উইল চাই?
দস্যু। তাহা কেন বলিব?
রাজ। কেন, আমাকেও বলিবে না?-আমার কাছে লুকাইবার আবশ্যক?
দস্যু। তোমাকেও বলিতে বারণ।
রাজ। মথুর ঘোষ?
দস্যু। যেই হউক-আমাদের বাদশার মুখ নিয়ে কাজ। যেই হউক, কিছু মজুরি দেবে, আমরা কাজ তুলে দেব।
রাজ। আমারও ঐ কথা।
দস্যু। উইল পাব কোথায়?
রাজ। আমায় কি দিবে বল?
দস্যু। তুমি বল না।
রাজ। পাঁচ শত খানি দিও; তোমরা পাবে ঢের, দিলেই বা।
দস্যু। এটা বড় জিয়াদা হইতেছে; আমরা মোটে দুই হাজার দক্ষিণা পাইব, তার মধ্যে সিকি দিই কেমন করে।
রাজ। তোমাদের ইচ্ছা।
দস্যু। পুনর্ব্বার চিন্তা করিয়া কহিল, “আচ্ছা, তাই সই; আমার ঢের কাজ আছে, আমি কাগজ হাঁটকাইয়া বেড়াইলে চলিবে না। নয়ত কোনও ছোঁড়া ফোঁড়ার হাতে পড়িবে, আর পুড়াইয়া ফেলিবে-পাঁচ শতই দেব।”
রাজ। মাধবের শুইবার খাটের শিয়রে একটা নতুন দেরাজ-আলমারি আছে; তাহার সব নীচের দেরাজের ভিতর একটা বিলিতী টিনের ছোট বাক্সতে উইল, কবালা, খত ইত্যাদি রাখিয়া থাকে; আমার গোপন খবর জানা আছে।
দস্যু। ভাল কথা; যদি এ লেঠা চুকিল, তবে চল জুটি গিয়া। কর্ম্ম হইয়া গেলে যেখানে আসিয়া তোমার সঙ্গে দেখা করিব, তাহা সকলে থেকে স্থির করা যাইবে। এস, আর দেরি করে কাজ নেই; চাঁদনি ডুবিলে কর্ম্ম হবে-এখনকার রাত ছোট।
এই কহিয়া উভয়ে ধীরে ধীরে গৃহের ছায়াবরণ হইতে বনের দিকে প্রস্থান করিল। মাতঙ্গিনী বিস্মিত ও ভীতি-বিহ্বলা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।
নবম পরিচ্ছেদ
মাতঙ্গিনী অন্তরালে থাকিয়া তাবৎ শুনিয়াছিলেন। এই বিষম কু-সঙ্কল্পকারিদিগের মুখনির্গত যতগুলি শব্দ তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, ততগুলি বজ্রাঘাত তাঁহার বোধ হইয়াছে। যতক্ষণ না কথোপকথন সমাপ্ত হইয়াছিল, ততক্ষণ বসন্ত-বাতাহত অশ্বত্থ পত্রের ন্যায় তাঁহার ভীতি-কম্পিত তনু কোন মতে দণ্ডামান ছিল; কিন্তু কথা সমাপ্তি হইবামাত্র মাতঙ্গিনী আত্ম-বিবশা হইয়া ভূতলে বসিয়া পড়িলেন।
প্রথমতঃ কিয়ৎক্ষণ ত্রাস ও উৎকট মানসিক যন্ত্রণার আধিক্য প্রযুক্ত বিমূঢ়া হইয়া রহিলেন; ক্রমে মনঃস্থির হইলে দৈব-প্রকাশিত এই বিষম ব্যাপার মনোমধ্যে পরিচালনা করিতে লাগিলেন। এ পর্য্যন্ত তিনি নিজ ভর্ত্তাকে সম্পূর্ণরূপে চিনিতেন না; আজ তাঁহার চক্ষুরুন্মীলিত হইল। চক্ষুরুন্মীলনে যে করাল মূর্ত্তি দেখিলেন, তাহাতে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। এ পর্য্যন্ত মনে ভাবিতেন যে, বিধাতা তাঁহাকে ক্রোধ-পরবশ দুর্নীত ব্যক্তির পাণিগৃহিতী করিয়াছেন; আজ জানিলেন যে, তিনি দস্যুপত্নী-দস্যু তাঁহার হৃদয়-বিহারী।
জানিয়াই বা কি? দস্যু-স্পর্শ হইতে পলাইবার উপায় আছে কি? স্ত্রী-জাতি-পতিসেবাপরায়ণা দাসী-পতিত্যাগের শক্তি কোথায়? চিরদিন দস্যুপদে দেহ-রত্ন অর্পিত হইবে-গরলোদ্গীর্ণমান বিষধর হৃদয়-পথে আসীন থাকিবে, পাছে সে আন্দোলনে আসনচ্যুত হয় বলিয়া কখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিতে পারিবে না। ইহা অপেক্ষা আর কি ভয়ঙ্কর ললাট-লিপি বিধাতার লেখনী হইতে নির্গত হইতে পারে?
মাতঙ্গিনী ক্ষণেককাল এইরূপ চিন্তা করিলেন; পরক্ষণেই যে দস্যুদল-সঙ্কলিত দারুণপ্রমাদ ঘটনা হইবে তাহাই মনোমধ্যে প্রখর তেজে প্রদীপ্ত হইতে লাগিল। আর কাহারই বা এই সর্ব্বনাশ ঘটনা হইবে? হেমাঙ্গিনীর সর্ব্বনাশ, মাধবের সর্ব্বনাশ! মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চ কণ্টকিত,-শোণিত শীতল হইতে লাগিল, মস্তক বিঘূর্ণিত হইতে লাগিল। যখন ভাবিলেন যে প্রিয় সহোদরা এক্ষণে এই নির্জ্জন নিশীথে হৃদয়বল্লভের কণ্ঠলগ্না হইয়া নিশ্চিন্ত মনে সুষুপ্তি সুখানুভব করিতেছে, সে মনেও জানে না যে, দারিদ্র্যরাক্ষসী তাহার পশ্চাতে মুখব্যাদান করিয়া রহিয়াছে, এখনই গ্রাস করিবে; হয়ত ধনহানির সঙ্গে মানহানি, প্রাণহানি পর্য্যন্ত হইবে তখনই মাতঙ্গিনীর নিজ সম্বন্ধীয় মর্ম্মব্যথক ভূত ভবিষ্যত চিন্তা অন্তর্হিত হইল। মনে মনে স্থির বুঝিলেন যে, আমি না বাঁচাইলে হেমাঙ্গিনী ও মাধবের রক্ষা নাই, যদি প্রাণ পর্য্যন্ত পণ করিয়া তাহাদের রক্ষা করিতে পারি, তবে তাহাও করিব।
মাতঙ্গিনী প্রথমোদ্যমে মনে করিলেন, গৃহস্থ সকলকে জাগরিত করিয়া সকল ঘটনা বিবৃত করেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সে ভাব অন্তর্হিত হইল; ভাবিলেন, তাহাতে কোন উপকার হইবে না। কেন না, রাজমোহনের আত্মপরিবার এমত অশ্রুতপূর্ব্ব সংবাদ বিশ্বাস হইবেক না; বিশ্বাস করিলেও মাধবের উপকারার্থ রাজমোহনের বিরুদ্ধাচারী হইবেক না। বরং লাভের মধ্যে তাহারা রাজমোহনের নিকট মাতঙ্গিনীকে এতদ্বিষয়ে সংবাদ-দাত্রী বলিয়া পরিচিত করিলে মাতঙ্গিনীর মহাবিপদ্ সম্ভাবনা।
পশ্চাৎ বিবেচনা করিলেন যে, কেবল কনককে জাগ্রত করিয়া তাহাকে সকল সংবাদ অবগত করান; এবং যাহা উচিত হয় পরামর্শ করেন। তদভিপ্রায়ে মাতঙ্গিনী শয্যাত্যাগ করিয়া বাটীর বাহিরে আসিলেন। কনকের গৃহ সন্নিকট। মাতঙ্গিনী ধীরে ধীরে কনকের গৃহাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রালোকে পৃথিবী প্রফুল্লিতা। মাতঙ্গিনী কনকের গৃহ দ্বারে উপনীত হইয়া ধীরে ধীরে করাঘাত করিলেন, কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইতে না হইতে কনকের মাতা কহিল, “কে রে?”
সর্ব্বনাশ! কনকের মাতা অতিশয় মুখরা, মাতঙ্গিনীর এ কথা স্মরণই ছিল না। মাতঙ্গিনী ভয়ে নিঃশব্দ রহিলেন। কনকের মাতা পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কে রে?” “কে রে?”
মাতঙ্গিনী সাহস করিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, “আমি গো।”
কনকের মাতা কোপযুক্ত স্বরে কহিল, “কে?-রাজুর বৌ বুঝি, এত রাত্রে তুমি এখানে কেন গা?”
মাতঙ্গিনী মৃদুস্বরে বলিলেন, “কনককে একটা কথা বলিব।”
কনকের মাতা বলিল, “রাত্রে কথা কি আবার একটা? সারাদিন কথা কয়ে কি আশ মেটে না? ভালমানুষের মেয়েছেলে রাত্রে এ-বাড়ী ও-বাড়ী কি গা? বউ-মানুষ, এখনই এ সব ধরেছ?-চল দেখি তোমার পিশেসের কাছে।”
মাতার তর্জ্জনে গর্জ্জনে কনকের নিদ্রাভঙ্গ হইল; বৃত্তান্ত বুঝিয়া কনক কহিল, “মা, দুয়ারটা খুলে দাও, শুনিই না কি বলে।”
কনকের মাতা গর্জ্জন করিয়া বলিল, “দেখ্ কন্কি, এমন মুড়ো ঝাঁটা তোর কপালে আছে।”
কনক নিস্পন্দ ও নির্ব্বাক্ হইল। মাতঙ্গিনী দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন, এবং পুনরায় গভীর চিন্তায় অভিভূত হইলেন। ভাবিলেন, “কি করি? কেমন করে তাদের রক্ষা হয়? কে সংবাদ দিবে?-কে এ রাত্রে যাইবে? আমি আপনিই যাই, এ ছাড়া অন্য উপায় নাই।” পরক্ষণে ভাবিলেন-“কেমন করিয়া যাইব? লোকে কি বলিবে? মাধব কি মনে করিবে? শুধু তাহাই নহে, স্বামী জানিতে পারিলে প্রমাদ ঘটিবে। তাহা হউক-লোকে যাই বলুক-মাধব যাহা হয় মনে করুক-স্বামী যাহা করে করুক, তজ্জন্য মাতঙ্গিনী ভীতা নহে।”
কিন্তু মাতঙ্গিনী যাইতে সাহস করিলেন না। এ গভীর নিশীথকালে, এই নিস্তব্ধ বনান্ত পথ, তাহাতে আবার একাকিনী অবলা, নবীন বয়সী, বাল্যকালাবধি ভৌতিক উপন্যাস শ্রবণে হৃদয়মধ্যে ভৌতিক-ভীতি বিষম প্রবলা। পথ অতি দুর্গম। তাহাতে আবার দস্যুদল কোথায় জটলা করিয়া আছে; যদি তাহাদের করকবলিত হয়েন? এই কথা স্মৃতিমাত্র ভয়ে মাতঙ্গিনীর শরীর রোমাঞ্চিত হইল। যদি দস্যুদলমধ্যে মাতঙ্গিনী স্বামীর দৃষ্টিপথে পতিতা হয়েন? এই ভয়ে মাতঙ্গিনী পুনঃ পুনঃ রোমাঞ্চিত হইতে লাগিলেন।
স্বভাবতঃ মাতঙ্গিনীর হৃদয় সাহস-সম্পন্ন। যে অন্তঃকরণে স্নেহ আছে, প্রায় সে অন্তঃকরণে সাহস বিরাজ করে। প্রিয়তমা সহোদরা ও তৎপ্রতির মঙ্গলার্থ মাতঙ্গিনী প্রাণ পর্য্যন্ত দিতে উদ্যত হইলেন। যেমন উপস্থিত বিপত্তির বিকট মূর্ত্তি পুনঃ পুনঃ মনোমধ্যে প্রকটিত হইতে লাগিল, অমনি মাতঙ্গিনীও হৃদয়গ্রন্থি দৃঢ়বদ্ধ হইতে লাগিল-তখন অগাধ প্রনয়-সলিলে ভাসমান হইয়া বলিলেন, “এ ছার জীবন কার আর কি জন্য? যদি এ সঙ্কল্পে প্রাণ রক্ষা না হয়, তাতেই বা ক্ষতি কি? এ গুরুভার বহন করা আমার পক্ষে কষ্টকর হইয়াছে। কাজেই এ দেহ ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করে। যাহারা প্রাণাধিক্ তাহাদের মঙ্গল সাধনে এ প্রাণ ত্যাগ না করি কেন? আমার ভয় কি? প্রাণনাশাধিক বিপদও ঘটিতে পারে; জগদীশ্বর রক্ষাকর্ত্তা।”
কিন্তু মাধবের বাটীতে এ নিশীথে একাকিনী কি প্রকারেই যান? মাতঙ্গিনীর চিন্তাকুলতা সহনানীত হইল।
কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া মাতঙ্গিনী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া চিন্তাসম্বর্দ্ধিত গ্রীষ্মাতিশয্যের প্রতিকার হেতু জালরন্ধ্র সন্নিধানে গিয়া জালাবরণী উত্তোলন করিলেন। দেখিলেন যে, বিটপী শ্রেণীর ছায়া এক্ষণে দীর্ঘাকৃত হইয়াছে-অস্তাচলাভিমুখী নিশাললাটরত্ন প্রায়-দিগন্তব্যাপী বৃক্ষশিরোরাজির উপরে আসিয়া নির্ব্বাণোন্মুখ আলোক বর্ষণ করিতেছেন। আর দুই চারি দণ্ড পরে সে আলোক একেবারে নির্ব্বাপিত হইবে; তখন আর হেমাঙ্গিনীকে রক্ষা করিবার সময় থাকিবে না। বিপদ্ একেবারে সম্মুখে দেখিয়া মাতঙ্গিনী আর বিলম্ব করিলেন না।
মাতঙ্গিনী ঝটিতি এক খণ্ড শয্যোত্তরচ্ছদে আপাদমস্তক দেহ আবরিত করিলেন, এবং কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্তা হইয়া যে কৌশলপ্রভাবে ক্ষণপূর্ব্বে রাজমোহন বাহির হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়াছিলেন, মাতঙ্গিনীও তদ্রূপ করিলেন।
গৃহের বাহিরে দণ্ডায়মানা হইয়া যখন মাতঙ্গিনী ঊর্দ্ধে অসীম নীলাম্বর, চতুর্দ্দিকে বিজন বন-বৃক্ষের নিঃশব্দ নিস্পন্ত্র শিরঃশ্রেণীর নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, তখন পুনর্ব্বার সাহস দ্রবীভূত হইয়া গেল-হৃদয় শঙ্কাকম্পিত হইল-চরন অচল হইল। মাতঙ্গিনী অঞ্জলিবদ্ধ করে ইষ্টদেবের স্তব করিলেন। হৃদয়ে আবার সাহস আসিল; তিনি দ্রুতপাদবিক্ষেপে পথ বহিয়া চলিলেন।
বনময় পথ দিয়া যাইতে প্রভাতবাতাহত পদ্মের ন্যায় মাতঙ্গিনীর শরীর কম্পিত হইতে লাগিল। সর্ব্বত্র নিঃশব্দ; মাতঙ্গিনীর পাদবিক্ষেপশব্দ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল; স্থানে স্থানে নিবিড় ছায়ান্ধকারে অন্তঃকরণ শিহরিতে লাগিল। যত বৃক্ষের গুঁড়ি ছিল প্রত্যেককে করালবদন পৈশাচ মূর্ত্তি বলিয়া ভ্রম হইতে লাগিল, বৃক্ষে বৃক্ষে, শাখায় শাখায়, পত্রে পত্রে, নরঘ্ন প্রেত লুক্কায়িতভাবে মাতঙ্গিনীকে লক্ষ্য করিতেছে তাহা তাঁহার প্রতীতি হইতে লাগিল। যে যে স্থলে তমসা নিবিড়তর, সেই সেই স্থানে দুরন্ত ভূতযোনী বা দস্যুর প্রচ্ছন্ন শরীরের ছায়া মাতঙ্গিনীর চক্ষুর্জ্বালা উৎপাদন করিতে লাগিল। বাল্যকালে যত ভৌতিক উপন্যাস শ্রুত হইয়াছিল, নিশীথ পান্থের গহনমধ্যে বিকট পৈশাচ দংষ্ট্র ভঙ্গী সন্দর্শনে ভীতি-বিহ্বল হইয়া প্রাণত্যাগ করার যে সকল উপকথা শ্রবণ করিয়াছিলেন, সে সকলই একেবারে তাঁহার স্মরণপথে আসিতে লাগিল।
যদি কোথাও শাখাচ্যুত শুষ্কপত্র-পতন শব্দ হইল, যদি কোনও শাখারূঢ় নৈশ বিহঙ্গ পক্ষস্পন্দন করিল, যদি কোথাও শুষ্কপত্রমধ্যে কোন কীট দেহ সঞ্চালন করিল, অমনি মাতঙ্গিনী ভয়ে চমকিয়া উঠিতে লাগিলেন; তথাপি দৃঢ় সঙ্কল্প-বিবদ্ধা সাহসিকা তরুণী, কখন বা ইষ্টদেব নামজপ কখন বা প্রিয়জনগনের বিপত্তি চিন্তা করিতে করিতে চঞ্চলপদে উদ্দিষ্ট স্থানাভিমুখে চলিলেন।
ভয়সঙ্কুল নিবিড় তমসাচ্ছন্ন পথের এক পার্শ্বে বৃহৎ আম্র-কানন অপর পার্শ্বে এক দীর্ঘিকার পাহাড়। বন্য উচ্চভূমিখণ্ডমধ্যে পথ অতি সঙ্কীর্ণ; তদুপরি দীর্ঘিকার উপর প্রকাণ্ডাকার কতিপয় বটবৃক্ষের ছায়ায় চন্দ্রালোকের গতি নিরুদ্ধ হইয়াছিল, সুতরাং এই স্থানে পথান্ধকার নিবিড়তর। দীর্ঘিকার পাহাড়ের বটবৃক্ষতল বহুতর লতাগুল্ম কণ্টক বৃক্ষাদিতে সমাচ্ছন্ন।
মাতঙ্গিনী ভীতি-চকিতনেত্রে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। আম্র-কাননের মধ্যে একটা প্রচণ্ড আলোক প্রদীপ্ত হইতেছিল, এবং অস্ফুটস্বরে বহু ব্যক্তির কথোপকথনের শব্দও মাতঙ্গিনীর কর্ণগোচর হইল।
মাতঙ্গিনী বুঝিলেন, যাহা ভর করিয়াছিলেন, তাহাই ঘটিল। এই আম্র-কাননের মধ্যে দস্যুদল জটলা করিতেছে। দুঃসময়ে বিপদ্ এক প্রকারে কেবল উপস্থিত হয় না;-পথিমধ্যে একটা কুকুর শয়ন করিয়াছিল, নিশাকালে পথিক দেখিয়া উচ্চরব করিতে লাগিল। আম্র-কাননের কথোপকথন তৎক্ষণাৎ বন্ধ হইল। মাতঙ্গিনী বুঝিতে পারিলেন যে, কুকুর-শব্দে দুরাত্মারা লোকসমাগত অনুভূত করিয়াছে; অতএব শীঘ্রই তাহারা কাছে আসিবে। আসন্নকালে মাতঙ্গিনী নিঃশব্দ গমনে দীর্ঘিকার জলের নিকট আসিয়া দাঁড়াইলেন। আম্র-কানন বা পথ হইতে তাঁহাকে কেহ দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা রহিল না। কিন্তু যদি দস্যুরা দীর্ঘিকার তটারোহণ করিয়া পথিকের অণ্বেষণ করে, তাহা হইলে মাতঙ্গিনী তৎক্ষণাৎ দৃষ্টিপথে পতিত হইবেন। নিকটে এমত কোন ক্ষুদ্র বৃক্ষলতাদি ছিল না যে, তদন্তরালে লুক্কায়িত হইতে পারেন। কিন্তু আসন্ন বিপদে মাতঙ্গিনীর ধৈর্য্য ও কর্ত্তব্যতৎপরতা বিশেষ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া উঠিল।
ক্ষণমধ্যে মাতঙ্গিনী জলতীরস্থ এক খণ্ড গুরুভার আর্দ্র মৃৎখণ্ড উত্তোলন করিয়া অঙ্গস্থ শয্যোত্তরচ্ছদের মধ্যে রাখিয়া গ্রন্থিবন্ধন করিলেন। অনায়াস-গোপনযোগ্য পরিধেয় শাটীমাত্র অঙ্গে রাখিয়া কৃতপ্রতিজ্ঞ হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। এক্ষণে পুষ্করিণীর পাহাড়ের অপর দিকে মনুষ্যকণ্ঠস্বর স্পষ্ট শ্রুতিগোচর হইল, এবং মনুষ্যসঞ্চালনশব্দও নিঃসন্দেহে শ্রুত হইল। মাতঙ্গিনী ঈদৃশ সাবধানতার সহিত শয্যোত্তরচ্ছদ জলমগ্ন করিলেন যে, জলশব্দ না হয়। বস্ত্রখণ্ড মৃৎখণ্ডের গুরুভারে তলস্পর্শ করিয়া অদৃশ্য হইল। মাতঙ্গিনী এক্ষণে ধীরে ধীরে জলমধ্যে অবতরণ করিয়া অন্ধকারবর্ণ স্বচ্ছ সরোবর-বক্ষে যথায় কথিত বটবিটপীর ছায়ায় প্রগাঢ়তর অন্ধকার হইয়াছিল, তথায় অধর পর্য্যন্ত জলমগ্ন হইয়া রহিলেন। তাঁহার মুখমণ্ডল ব্যতীত আর কিছু জলের উপর জাগিতেছিল না। তথাপি কি জানি, যদি সেই মুখমণ্ডলের উজ্জ্বলবর্ণ সে নিবিড় অন্ধকার মধ্যে কেহ লক্ষ্য করে, এই আশঙ্কায় মাতঙ্গিনী নিজ কবরীবন্ধনী উন্মোচন করিয়া কোমলকুঞ্চিত কুন্তলজাল মুখের উপর লম্বিত করিয়া দিলেন। অতঃপর সেই ঘনান্ধকারবর্ণ সরসীজলের উপরে, ঘনতর বৃক্ষ-ছায়াভ্যন্তরে যে নিবিড় কেশদাম ভাসিতেছিল তাহা মনুষ্য কর্ত্তৃক আবিষ্কৃত হওয়া অসম্ভব। পরক্ষণেই কথোপকথনকারীরা দীর্ঘিকা-তট অবতরণ করিয়া অর্দ্ধপথ আসিল। মাতঙ্গিনী তাহাদের কেবলমাত্র কণ্ঠস্বর ও পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। তাহাদের পানে যে চাহিয়া দেখিবেন, এমত সাহস হইল না।
আগন্তুকদের মধ্যে একজন অর্দ্ধস্ফুট বাক্যে দ্বিতীয় ব্যক্তিকে কহিল, “এ ত বড় তাজ্জব! আমি সঠিক বলিতেছি, আমি বেশ দেখিয়াছিলাম, এই পথের উপর একটা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়া যাইতেছিল; বাগানের বেড়ার ফাঁক দিয়া আমি দেখিয়াছিলাম।”
দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, “গাছপালা দেখে তোর ধাঁধা লেগে থাক্বে; অপদেবতা টেবতাই বা দেখে থাক্বি। এত গর্মিতে মানুষে কাপড় মুড়ি দিয়া বেড়াবে কেন?”
“হবে” বলিয়া পুনশ্চ উভয়ে ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল ; আশঙ্কার মূল কারণ যে ভীতিবিহ্বলা অবলা তাঁহাকে তাহারা দেখিতে পাইল না।
দস্যুরা কিছু দেখিতে না পাইয়া চলিয়া গেল। যতক্ষণ তাহাদের প্রত্যাবর্ত্তন-শব্দ কর্ণগোচর হইতে লাগিল ততক্ষণ মাতঙ্গিনী জলমধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত করিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। যখন বিবেচনা হইল যে, আর তাহাদের দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন জল হইতে উঠিয়া গমনোদ্যোগিনী হইলেন।
মাতঙ্গিনী যে পথে গমনকালীন এরূপ বিপদ্গ্রস্ত হইয়াছিলেন, শঙ্কাক্রমে এবার সে পথ ত্যাগ করিলেন। পুষ্করিণীর তীর পরিবেষ্টন করিয়া অপর দিকে এক পথে উঠিলেন। মধুমতী যাইতে মাতঙ্গিনীর নিষেধ ছিল বটে, কিন্তু পুষ্করিণী নিষিদ্ধ ছিল না, এবং মধ্যে মধ্যে আহ্নিক স্নানাদি ক্রিয়ার্থ এই জলে আসিতেন। সুতরাং এ স্থানের সকল পথ উত্তমরূপে চিনিতেন। পুষ্করিণীর অন্য এক পাহাড়ে উঠিয়া অন্য এক পথ অবলম্বন করিলে যে পূর্ব্বাবলম্বিত পথে পড়িতে হয়, অথচ আম্র-কাননের ধারে যাইতে হয় না, ইহা এই সময়ে মাতঙ্গিনীর স্মরণ হইল। বৃক্ষলতাকণ্টকাদির প্রাচুর্য্য বশতঃ এই পথ অতি দুর্গম, কিন্তু মাতঙ্গিনীর পক্ষে কণ্টকাদির বিঘ্ন, তুচ্ছ বিঘ্ন অলক্তক পরিবর্ত্তে কণ্টক-বেধবাহিত রক্তধারা চরণদ্বয় রঞ্জিত করিতে লাগিল। এক দিকে গুরুতর সঙ্কল্প সিদ্ধির জন্য উৎকণ্ঠা, অপর দিকে দস্যু-হস্ত হইতে পরিত্রাণের জন্য ব্যগ্রতা; এই উভয় কারণে মাতঙ্গিনী তিলার্দ্ধ বিলম্ব না করিয়া কণ্টকলতাদি পদদলিত করিয়া চলিলেন। কিন্তু এক নূতন ব্যাঘাত উপস্থিত হইবার উপক্রম হইল;-মাতঙ্গিনী রাধাগঞ্জে আসিয়া অবধি দুই তিনবার মাত্র সহোদরাবল্লভ মাধবের আলয়ে আগমন করিয়াছিলেন, কিন্তু পদব্রজে একবারও গমন করেন নাই। সুতরাং এদিকের পথ তাঁহার তেমন জানা ছিল না। এক্ষণে মাতঙ্গিনী চতুর্দ্দিকবাহী পথ-সন্নিধানে উপনীতা হইয়া কোন্ পথে যাইবেন, তাহা অবধারণে অক্ষম হইলেন। মাতঙ্গিনী পাগলিনীর ন্যায় ইতস্ততঃ চাহিতে লাগিলেন। ভাগ্যক্রমে মাধবের অট্টালিকার সম্মুখ-রোপিত দেবদারু-শ্রেণীর শিরোমালা নয়নগোচর হইল। দৃষ্টিমাত্র হর্ষিতচিত্তে তদভিমুখে চলিলেন; এবং সত্বর অট্টালিকার সমীপবর্ত্তিনী হইয়া খিড়কির দ্বারে উপস্থিত হইলেন। তথাপি মাতঙ্গিনীর ক্লেশের চূড়ান্ত হইল না। এ নিশীথে বাটীর সকলেই নিদ্রিত, কে দ্বার খুলিয়া দিবে? অনেকবার করাঘাত করিয়া মাতঙ্গিনী পুরকিঙ্করী করুণাকে নিদ্রোত্থিতা করিলেন। নিদ্রাভঙ্গে করুণা অপ্রসন্ন হইয়া ভীষণ গর্জ্জন করিয়া কহিল, “এত রেতে কে রে দোর ঠেঙ্গায়?”
মাতঙ্গিনী উৎকণ্ঠা-তীব্র স্বরে কহিলেন, “শীঘ্র-শীঘ্র করুণা, দ্বার খোল।” নিদ্রাভঙ্গকরণ-অপরাধ অতি গুরুতর ; এমন সহজে ক্ষমা সম্ভাবনা কি? করুণার ক্রোধোপণম হইল না, পূর্ব্ববৎ পুরুষ বচনে কহিল, “তুই কে যে তোকে আমি তিন পর রেতে দোর খুলে দেব?”
মাতঙ্গিনী স্পষ্টে আপন নাম ডাকিয়া কহিতে পারেন না, অথচ শীঘ্র গৃহ-প্রবেশ জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন; অতএব পুনরায় সবিনয়ে কহিলেন, “তুমি এস শীঘ্র এসো গো, এলেই দেখ্তে পাবে।”
করুণা সম্বর্দ্ধত রোষে কহিল, “তুই কে বল্ না, আ মরণ!”
মাতঙ্গিনী কহিলেন, “ওগো বাছা, আমি চোর ছ্যাঁচড় নই, মেয়ে মানুষ।”
তখন করুণার স্থূল বুদ্ধিতেও একটু একটু আভাস হইল যে, চোর ছ্যাঁচড়ের কণ্ঠস্বর এত সুমধুর প্রায় দেখা যায় না। অতএব আর গণ্ডগোল না করিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। এবং মাতঙ্গিনীকে দেখিবামাত্র সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, “এ কি! তুমি! তুমি ঠাকুরাণী!”
মাতঙ্গিনী কহিলেন, “আমি একবার হেমের সঙ্গে দেখা করিব-বড় দরকার; শীঘ্র আমাকে হেমের কাছে লইয়া চল।”
গদ্য পদ্য ও কবিতাপুস্তক
অধঃপতন সঙ্গীত
১
বাগানে যাবি রে ভাই? চল সবে মিলে যাই,
যথা হর্ম্ম্য সুশোভন, সরোবরতীরে।
যথা ফুটে পাঁতি পাঁতি, গোলাব মল্লিকা জাতি,
বিগ্নোনিয়া লতা দোলে মৃদুল সমীরে ||
নারিকেল বৃক্ষরাজি, চাঁদের কিরণে সাজি,
নাচিছে দোলায় মাথা ঠমকে ঠমকে।
চন্দ্রকরলেখা তাহে, বিজলি চমকে ||
২
চল যথা কুঞ্জবনে, নাচিবে নাগরী গণে,
রাঙ্গা সাজ পেসোয়াজ, পরশিবে অঙ্গে।
তম্বুরা তবলা চাটি, আবেশে কাঁপিবে মাটি,
সারঙ্গ তরঙ্গ তুলি, সুর দিবে সঙ্গে ||
খিনি খিনি খিনি খিনি,
ঝিনিক ঝিনিক ঝিনি
তাধ্রিম্ তাধ্রিম্ তেরে গাও না বাজনা!
চমকে চাহনি চারু, ঝলকে গহনা ||
৩
ঘরে আছে পদ্মমুখী কভু না করিল সুখী,
শুধু ভাল বাসা নিয়ে, কি হবে সংসারে।
নাহি জানে নৃত্যগীত, ইয়ার্কিতে নাহি চিত,
একা বসি ভাল বাসা ভাল লাগে কারে?
গৃহকর্ম্মে রাখে মন, হিত ভাবে অনুক্ষণ,
সে বিনা দুঃখের দিনে অন্য গতি নাই!
এ হেন সুখের দিনে, তারে নাহি চাই ||
৪
আছে ধন গৃহপূর্ণ, যৌবন যাইবে তূর্ণ,
যদি না ভুঞ্জিনু সুখ, কি কাজ জীবনে?
ঠুসে মদ্য লও সাতে, যেন না ফুরায় রাতে,
সুখের নিশান গাঢ় প্রমোদভবনে।
খাদ্য লও বাছা বাছা, দাড়ি দেখে লও চাচা,
চপ্ সুপ কারি কোর্ম্মা, করিবে বিচিত্র।
বাঙ্গালির দেহ রত্ন, ইহাতে করিও যত্ন,
সহস্র পাদুকা স্পর্শে, হয়েছে পবিত্র।
পেটে খায়, পিঠে সয়, আমার চরিত্র ||
৫
বন্দে মাতা সুরধুনি, কাগজে মহিমা শুনি,
বোতলবাহিনি পুণ্যে একশ নন্দিনি!
করি ঢক ঢক নাদ, পূরাও ভকতসাধ,
লোহিত বরণি বামা, তারেতে বন্দিনি!
প্রণমামি মহানীরে, ছিপির কিরীটি শিরে,
উঠ শিরে ধীরে ধীরে যকৃৎজননি!
তোমার কৃপার জন্য, যেই পড়ে সেই ধন্য
শয্যায় পতিত রাখ, পতিতপাবনি!
বাক্স বাহনে চল, ডজন ডজনি ||
৬
কি ছার সংসারে আছি, বিষয় অরণ্যে মাছি,
মিছা করি ভন্ভন্ চাকরি কাঁটালে।
মারে জুতা সই সুখে, লম্বা কথা বলি মুখে,
উচ্চ করি ঘুষ তুলি দেখিলে কাঙ্গালে ||
শিখিয়াছি লেখা পড়া, ঠাণ্ডা দেখে হই কড়া,
কথা কই চড়া চড়া, ভিখারি ফকিরে।
দেখ ভাই রোখ কত, বাঙ্গালি শরীরে!
৭
পূর পাত্র মদ্য ঢালি, দাও সবে করতালি,
কেন তুমি দাও গালি, কি দোষ আমার?
দেশের মঙ্গল চাও? কিসে তার ত্রুটি পাও?
লেক্চারে কাগজে বলি, কর দেশোদ্ধার ||
ইংরেজের নিন্দা করি, আইনের দোষ ধরি,
সম্বাদ পত্রিকা পড়ি, লিখি কভু তায়।
আর কি করিব বল স্বদেশের দায়?
৮
করেছি ডিউটির কাজ, বাজা ভাই পাখোয়াজ,
কামিনি, গোলাপি সাজ, ভাসি আজ রঙ্গে।
গেলাস পূরে দে মদে, দে দে দে আরো আরো দে,
দে দে এরে দে ওরে দে, ছড়ি দে সারঙ্গে।
কোথায় ফুলের মালা,আইস্ দে না? ভাল জ্বালা,
“বংশী বাজায় চিকণ কালা?” সুর দাও সঙ্গে।
ইন্দ্র স্বর্গে খায় সুধা, স্বর্গ ছাড়া কি বসুধা?
কত স্বর্গ বাঙ্গালায় মদের তরঙ্গে।
টলমল বসুন্ধরা ভবানী ভ্রূভঙ্গে ||
৯
যে ভাবে দেহের হিত, না বুঝি তাহার চিত,
আত্মহিত ছেড়ে কেবা, পরহিতে চলে?
না জানি দেশ বা কার? দেশে কার উপকার?
আমার কি লাভ বল, দেশ ভাল হলে?
আপনার হিত করি, এত শক্তি নাহি ধরি,
দেশহিত করিব কি, একা ক্ষুদ্র প্রাণী।
ঢাল মদ! তামাক দে! লাও ব্রাণ্ডি পানি ||
১০
মনুষ্যত্ব? কাকে বলে? স্পিচ দিই টোনহলে,
লোকে আসে দলে দলে, শুনে পায় প্রীত।
নাটক নবেল কত, লিখিয়াছে শত শত,
এ কি নয় মনুষ্যত্ব? নয় দেশহিত?
ইংরেজি বাঙ্গালা ফেঁদে, পলিটিক্স লিখি কেঁদে,
পদ্য লিখি নানা ছাঁদে, বেচি সস্তা দরে।
অশিষ্টে অথবা শিষ্টে, গালি দিই অষ্টে পৃষ্ঠে,
তবু বল দেশহিত কিছু নাহি করে?
নিপাত যাউক দেশ! দেখি বসে ঘরে ||
১১
হাঁ! চামেলি ফুলিচম্পা! মধুর অধর কম্পা!
হাম্বীর কেদার ছায়ানট সুমধুর!
হুক্কা না দুরস্ত বোলে? শের মে ফুল না ডোলে!
পিয়ালা ভর দে মুঝে! রঙ্ ভরপুর!
সুপ্ চপ কটলেট, আন বাবা প্লেট প্লেট,
কুক্ বেটা ফাষ্টরেট, যত পার খাও!
মাথামুণ্ড পেটে দিয়ে, পড় বাপু জমি নিয়ে,
জনমি বাঙ্গালিকুলে, সুখ কর্যেও যাও।
পতিতপাবনি সুরে, পতিতে তরাও ||
১২
যাব ভাই অধঃপাতে, কে যাইবি আয় সাতে,
কি কাজ বাঙ্গালি নাম, রেখে ভূমণ্ডলে?
লেখাপড়া ভস্ম ছাই, কে কবে শিখিছে ভাই
লইয়া বাঙ্গালি দেহ, এই বঙ্গস্থলে?
হংসপুচ্ছ লয়ে করে, কেরাণির কাজ করে,
মুন্সেফ চাপরাশি আর ডিপুটী পিয়াদা।
অথবা স্বাধীন হয়ে, ওকালতি পাশ লয়ে,
খোশামুদি জুয়াচুরি, শিখিছে জিয়াদা!
সার কথা বলি ভাই, বাঙ্গালিতে কাজ নাই,
কি কাজ সাধিব মোরা, এ সংসারে থাকি,
মনোবৃত্তি আছে যাহা, ইন্দ্রিয় সাগরে তাহা
বিসর্জ্জন করিয়াছি, কিবা আছে বাকি?
কেহ দেহভার বয়ে, যমে দাও ফাঁকি?
১৩
ধর তবে গ্লাস আঁটি, জ্বলন্ত বিষের বাটি
শুন তবলার চাঁটি, বাজে খন্ খন্।
নাচে বিবি নানা ছন্দ, সুন্দর খামিরা গন্ধ,
গম্ভীর জীমূতমন্দ্র হুঁকার গর্জ্জন ||
সেজে এসো সবে ভাই, চল অধঃপাতে যাই,
অধম বাঙ্গালি হতে, হবে কোন কাজ?
ধরিতে মনুষ্যদেহ, নাহি করে লাজ?
১৪
মর্কটের অবতার, রূপগুণ সব তার
বাঙ্গালির অধিকার, বাঙ্গালি ভূষণ!
হা ধরণি, কোন্ পাপে, কোন্ বিধাতার শাপে
হেন পুত্রগণ গর্ব্ভে, করিলে ধারণ?
বঙ্গদেশ ডুবাবারে, মেঘে কিম্বা পারাবারে,
ছিল না কি জলরাশি? কে শোষিল নীরে?
আপনা ধ্বংসিতে রাগে কতই শকতি লাগে?
নাহি কি শকতি তত বাঙ্গালি শরীরে?
কেন আর জ্বলে আলো বঙ্গের মন্দিরে?
১৫
মরিবে না? এসো তবে, উন্নতি সাধিয়া সবে,
লভি নাম পৃথিবীতে, পিতৃ সমতুল!
ছাড়ি দেহ খেলা ধূলা, ভাঙ বাদ্যভাণ্ডগুলা
মারি খেদাইয়া দাও, নর্ত্তকীর কুল।
মারিয়া লাঠির বাড়ি, বোতল ভাঙ্গহ পাড়ি,
বাগান ভাঙ্গিয়া ফেল পুকুরের তলে।
সুখ নামে দিয়ে ছাই, দুঃখ সার কর ভাই,
কভু না মুছিবে কেহ, নয়নের জলে,
যত দিন বাঙ্গালিকে লোকে ছি ছি বলে ||
আকবর শাহের খোষ রোজ
১
রাজপুরী মাঝে কি সুন্দর আজি।
বসেছে বাজার, রসের ঠাট,
রমণীতে বেচে রমণীতে কিনে
লেগেছে রমণীরূপের হাট ||
বিশালা সে পুরী নবমীর চাঁদ,
লাখে লাখে দীপ উজলি জ্বলে।
দোকানে দোকানে কুলবালাগণে
খরিদদার ডাকে, হাসিয়া ছলে ||
ফুলের তোরণ, ফুল আবরণ
ফুলের স্তম্ভেতে ফুলের মালা।
ফুলের দোকান, ফুলের নিসান,
ফুলের বিছানা ফুলের ডালা ||
লহরে লহরে ছুটিছে গোলাব,
উঠিছে ফুয়ারা জ্বলিছে জল।
তাধিনি তাধিনি নাচিতেছে নটী,
গায়িছে মধুর গায়িকা দল ||
রাজপুরী মাঝে লেগেছে বাজার,
বড় গুলজার সরস ঠাট।
রমণীতে বেচে রমণীতে কিনে
লেগেছে রমণীরূপের হাট ||
কত বা সুন্দরী, রাজার দুলালী
ওমরাহজায়া, আমীরজাদী।
নয়নেতে জ্বালা, অধরেতে হাসি,
অঙ্গেতে ভূষণ মধুর-নাদী ||
হীরা মতি চুণি বসন ভূষণ
কেহ বা বেচিছে কেনে বা কেউ।
কেহ বেচে কথা নয়ন ঠারিয়ে
কেহ কিনে হাসি রসের ঢেউ ||
কেহ বলে সখি এ রতন বেচি
হেন মহাজন এখানে কই?
সুপুরুষ পেলে আপনা বেচিয়ে
বিনামূল্যে কেনা হইয়া রই ||
কেহ বলে সখি পুরুষ দরিদ্র
কি দিয়ে কিনিবে রমণীমণি।
চারি কড়া দিয়ে পুরুষ কিনিয়ে
গৃহেতে বাঁধয়ে রেখ লো ধনি ||
পিঞ্জরেতে পুরি, খেতে দিও ছোলা,
সোহাগ শিকলি বাঁধিও পায়।
অবোধ বিহঙ্গ পড়িবে আটক
তালি দিয়ে ধনি, নাচায়ো তায় ||
২
একচন্দ্রাননী, মরাল-গামিনী,
সে রসের হাটে ভ্রমিছে একা।
কিছু নাহি বেচে কিছু নাহি কিনে,
কাহার(ও) সহিত না করে দেখা ||
প্রভাত-নক্ষত্র জিনিয়া রূপসী,
দিশাহারা যেন বাজারে ফিরে।
কাণ্ডারী বিহনে তরণী যেন বা
ভাসিয়া বেড়ায় সাগরনীরে ||
রাজার দুলালী রাজপুতবালা
চিতোরসম্ভবা কমলকলি।
পতির আদেশে আসিয়াছে হেথা
সুখের বাজার দেখিবে বলি ||
দেখে শুনে বামা সুখী না হইল-
বলে ছি ছি এ কি লেগেছে ঠাট।
কুলনারীগণে, বিকাইতে লাজ
বসিয়াছে ফেঁদে রসের হাট!
ফিরে যাই ঘরে কি করিব একা
এ রঙ্গসাগরে সাঁতার দিয়ে?
এত বলি সতী ধীরি ধীরি ধীরি
নির্গমের দ্বারে গেল চলিয়ে ||
নির্গমের পথ অতি সে কুটিল,
পেঁচে পেঁচে ফিরে, না পায় দিশে।
হায় কি করিনু বলিয়ে কাঁদিল,
এখন বাহির হইব কিসে?
না জানি বাদশা কি কল করিল
ধরিতে পিঞ্জরে, কুলের নারী।
না পায় ফিরিতে নারে বাহিরিতে
নয়নকমলে বহিল বারি ||
৩
সহসা দেখিল সমুখে সুন্দরী
বিশাল উরস পুরুষ বীর।
রতনের মালা দুলিতেছে গলে
মাথায় রতন জ্বলিছে স্থির ||
যোড় করি কর, তারে বিনোদিনী
বলে মহাশয় কর গো ত্রাণ।
না পাই যে পথ পড়েছি বিপদে
দেখাইয়ে পথ, রাখ হে প্রাণ ||
বলে সে পুরুষ অমিয় বচনে
আহা মরি, হেন না দেখি রূপ।
এসো এসো ধনি আমার সঙ্গেতে
আমি আকব্বর-ভারত-ভূপ ||
সহস্র রমণী রাজার দুলালী
মম আজ্ঞাকারী, চরণ সেবে।
তোমা সমা রূপে নহে কোন জন,
তব আজ্ঞাকারী আমি হে এবে ||
চল চল ধনি আমার মন্দিরে
আজি খোষ রোজ সুখের দিন।
এ ভারত ভূমে কি আছে কামনা
বলিও আমারে, শোধিব ঋণ ||
এত বলি তবে রাজারাজপতি
বলে মোহিনীরে ধরিল করে।
যূথপতি বল সে ভূজবিটপে
টুটিল কঙ্কণ তাহার ভরে ||
শূকাল বামার বদন-নলিনী
ডাকি ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি মে দুর্গে।
ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি বাঁচাও জননী!
ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি ত্রাহি মে দুর্গে ||
ডাকে কালি কালি ভৈরবী করালি
কৌষিকি কপালি কর মা ত্রাণ।
অর্পণে অম্বিকে চামুণ্ডে চণ্ডিকে
বিপদে বালিকে হারায় প্রাণ ||
মানুষের সাধ্য নহে গো জননি
এ ঘোর বিপদে রক্ষিতে লাজ।
সমর-রঙ্গিণি অসুর-ঘাতিনি
এ অসুরে নাশি, বাঁচাও আজ ||
৪
বহুল পুণ্যেতে অনন্ত শূন্যেতে
দেখিল রমণী, জ্বলিছে আলো।
হাসিছে রূপসী নবীনা ষোড়শী
মৃগেন্দ্র বাহনে, মূরতি কালো ||
নরমুণ্ডমালা দুলিছে উরসে
বিজলি ঝলসে লোচন তিনে।
দেখা দিয়া মাতা দিতেছে অভয়
দেবতা সহায় সহায়হীনে ||
আকাশের পটে নগেন্দ্র-নন্দিনী
দেখিয়া যুবতী প্রফুল্ল মুখ।
হৃদি সরোবর পুলকে উছলে
সাহসে ভরিল, নারীর বুক ||
তুলিয়া মস্তক গ্রীবা হেলাইল
দাঁড়াইল ধনী ভীষণ রাগে।
নয়নে অনল অধরেতে ঘৃণা
বলিতে লাগিল নৃপের আগে ||
ছিছি ছিছি ছিছি তুমি হে সম্রাট্,
এই কি তোমার রাজধরম।
কুলবধূ ছলে গৃহেতে আনিয়া
বলে ধর তারে নাহি শরম ||
বহু রাজ্য তুমি বলেতে লুটিলে,
বহু বীর নাশি বলাও বীর।
বীরপণা আজি দেখাতে এসেছ
রমণীর চক্ষে বহায়ে নীর?
পরবাহুবলে পররাজ্য হর,
পরনারী হর করিয়ে চুরি।
আজি নারী হাতে হারাবে জীবন
ঘুচাইব যশ মারিয়ে ছুরি ||
জয়মল্ল বীরে ছলেতে বধিলে
ছলেতে লুটিয়ে চারু চিতোর।
নারীপদাঘাতে আজি ঘুচাইব
তব বীরপণা, ধরম চোর।
এত বলি বামা হাত ছাড়াইল
বলিতে ধরিল রাজার অসি।
কাড়িয়া লইয়া, অসি ঘুরাইয়া,
মারিতে তুলিল, নবরূপসী ||
ধন্য ধন্য বলি রাজা বাখানিল
এমন কখন দেখিনে নারী।
মানিতেছি ঘাট ধন্য সতী তুমি
রাখ তরবারি ; মানিনু হারি ||
৫
হাসিয়া রূপসী নামাইল অসি,
বলে মহারাজ, এ বড় রস।
পৃথিবীপতির বাড়িল যশ ||
দুলায়ে কুণ্ডল, অধরে অঞ্চল,
হাসে খল খল, ঈষৎ হেলে।
বলে মহাবীর, এই বলে তুমি
রমণীরে বল করিতে এলে?
পৃথিবীতে যারে, তুমি দাও প্রাণ,
সেই প্রাণে বাঁচে, বল হে সবে।
আজি পৃথ্বিনাথ আমার চরণে
প্রাণ ভিক্ষা লও, বাঁচিবে তবে ||
যোড়ো হাত দুটো, দাঁতে কর কুটো
করহ শপথ ভারতপ্রভু।
শপথ করহ হিন্দুললনার
হেন অপমান না হবে কভু ||
তুমি না করিবে, রাজ্যেতে না দিবে
হইতে কখন এ হেন দোষ।
হিন্দুললনারে যে দিবে লাঞ্ছনা
তাহার উপরে করিবে রোষ ||
শপথ করিল, পরশিয়ে অসি,
নারী আজ্ঞামত ভারপ্রভু।
আমার রাজ্যতে হিন্দুললনার
হেন অপমান না হবে কভু ||
বলে শুনি ধনি হইয়াছি প্রীত
দেখিয়া তোমার সাহস বল।
যাহা ইচ্ছা তব মাগি লও সতি,
পূরাব বাসনা, ছাড়িয়া ছল ||
এই তরবারি দিনু হে তোমারে
হীরক-খচিত ইহার কোষ।
বীরবালা তুমি তোমার সে যোগ্য
না রাখিও মনে আমার দোষ ||
আজি হতে তোমা ভগিনী বলিনু,
ভাই তব আমি ভাবিও মনে।
যা থাকে বাসনা মাগি লও বর
যা চাহিবে তাই দেব এখান ||
তুষ্ট হয়ে সতী বলে ভাই তুমি
সম্প্রীত হইনু তোমার ভাষে।
ভিক্ষা যদি দিবা দেখাইয়া দাও
নির্গমের পথ, যাইব বাসে ||
দেখাইল পথ আপনি রাজন্
বাহিরিল সতী, সে পুরী হতে।
সবে বল জয়, হিন্দুকন্যা জয়,
হিন্দুমতি থাক্ ধর্ম্মের পথে ||
৬
রাজপুরী মাঝে, কি সুন্দর আজি
বসেছে বাজার রসের ঠাট।
রমণীতে কেনে রমণীতে বেচে
লেগেছে রমণীরূপের হাট ||
ফুলের তোরণ ফুল আবরণ
ফুলের স্তম্ভেতে ফুলের মালা।
ফুলের দোকান ফুলের নিশান
ফুলের বিছানা ফুলের ডালা ||
নবমীর চাঁদ বরষে চন্দ্রিকা
লাখে লাখে দীপ উজলি জ্বলে ||
দোকানে দোকানে কুলবালগণে
ঝলসে কটাক্ষ হাসিয়া ছলে ||
এ হতে সুন্দর, রমণী-ধবম
আর্য্যনারীরধ্ঁচ্চমর্ম, সতীত্ব ব্রত।
জয় আর্য্য নামে, আজ(ও) আর্য্যধামে
আর্য্যধর্ম্ম রাখে রমণী যত ||
জয় আর্য্যকন্যা এ ভুবন ধন্যা,
ভারতের আলো, ঘোর আঁধারে।
হায় কি কারণে, আর্য্যপুত্রগণে
আর্য্যের ধরম রাখিতে নারে ||
আকাঙ্ক্ষা
(সুন্দরী)
১
কেন না হইলি তুই, যমুনার জল,
রে প্রাণবল্লভ!
কিবা দিবা কিবা রাতি, কূলেতে আঁচল পাতি
শুইতাম শুনিবারে, তোর মৃদুরব ||
রে প্রাণবল্লভ!
২
কেন না হইলি তুই, যমুনাতরঙ্গ,
মোর শ্যামধন!
দিবারাতি জলে পশি, থাকিতাম কালো শশি,
করিবারে নিত্য তোর, নৃত্য দরশন ||
ওহে শ্যামধন!
৩
কেন না হইলি, তুই, মলয় পবন,
ওহে ব্রজরাজ!
আমার অঞ্চল ধরি, সতত খেলিতে হরি,
নিশ্বাসে যাইতে মোর, হৃদয়ের মাঝ ||
ওহে ব্রজরাজ!
৪
কেন না হইলি তুই, কাননকুসুম,
রাধাপ্রেমাধার।
না ছুঁতেম অন্য ফুলে, বাঁধিতাম তোরে চুলে,
চিকণ গাঁথিয়া মালা, পরিতাম হার ||
মোর প্রাণাধার!
৫
কেন না হইলে তুমি, চাঁদের কিরণ,
ওহে হৃষীকেশ!
বাতায়নে বিষাদিনী, বসিতে যবে গোপিনী,
বাতায়নপথে তুমি, লভিতে প্রবেশ ||
আমার প্রাণেশ!
৬
কেন না হইলে তুমি, চিকণ বসন,
পীতাম্বর হরি!
নীলবাস তেয়াগিয়ে, তোমারে পরি কালিয়ে,
রাখিতাম যত্ন কর্যে হৃদয় উপরি ||
পীতাম্বর হরি!
৭
কেন না হইলে শ্যাম, যেখানে যা আছে,
সংসারে সুন্দর।
ফিরাতেম আঁখি যথা, দেখিতে পেতেম তথা,
মনোহর এ সংসারে, রাধামনোহর।
শ্যামল সুন্দর!
(সুন্দর)
১
কেন না হইনু আমি, কপালের দোষে,
যমুনার জল।
লইয়া কম কলসী, সে জল মাঝারে পশি,
হাসিয়া ফুটিত আসি, রাধিকা-কমল-
যৌবনেতে ঢল ঢল ||
২
কেন না হইনু আমি, তোমার তরঙ্গ,
তপননন্দনি!
রাধিকা আসিলে জলে, নাচিয়া হিল্লোল ছলে,
দোলাতাম দেহ তার, নবীন নলিনী-
যমুনাজলহংসিনী ||
৩
কেন না হইনু আমি, তোর অনুরূপী
মলয় পবন!
ভ্রমিতাম কুতূহলে, রাধার কুন্তল দলে,
কহিতাম কানে কানে, প্রণয় বচন-
সে আমার প্রাণধন ||
৪
কেন না হইনু, হায়! কুসুমের দাম,
কণ্ঠের ভূষণ।
এক নিশা স্বর্গ সুখে, বঞ্চিয়া রাধার বুকে,
ত্যজিতাম নিশি গেলে জীবন যাতন-
মেখে শ্রীঅঙ্গচন্দন ||
৫
কেন না হইনু আমি, চন্দ্রকরলেখা,
রাধার বরণ।
রাধার শরীরে থেকে, রাধারে ঢাকিয়ে রেখে,
ভুলাতাম রাধারূপে, অন্যজনমন-
পর ভুলান কেমন?
৬
কেন না হইনু আমি চিকণ বসন,
দেহ আবরণ।
তোমার অঙ্গেতে থেকে, অঙ্গের চন্দন মেখে,
অঞ্চল হইয়ে দুলে, ছুঁতেম চরণ,-
চুম্বি ও চাঁদবদন ||
৭
কেন না হইনু আমি, যেখানে যা আছে,
সংসারে সুন্দর।
কে হতে না অভিলাষে, রাধা যাহা ভালবাসে,
কে মোহিতে নাহি চাহে, রাধার অন্তর-
প্রেম-সুখরত্নাকর?
আদর
আদর
১
মরুভূমি মাঝে যেন, একই কুসুম,
পূর্ণিত সুবাসে।
বরষার রাত্রে যেন, একই নক্ষত্র,
আঁধার আকাশে ||
নিদাঘ সন্তাপে যেন, একই সরসী,
বিশাল প্রান্তরে।
রতন শোভিত যেন, একই তরণী,
অনন্ত সাগরে।
তেমনি আমার তুমি, প্রিয়ে, সংসার-ভিতরে ||
২
চিরদরিদ্রের যেন, একই রতন,
অমূল্য, অতুল।
চিরবিরহীর যেন, দিনেক মিলন,
বিধি অনুকূল ||
চিরবিদেশীর যেন, একই বান্ধব,
স্বদেশ হইতে।
চিরবিধবার যেন, একই স্বপন,
পতির পীরিতে।
তেমনি আমার তুমি, প্রাণাধিকে, এ মহীতে ||
৩
সুশীতল ছায়া তুমি, নিদাঘ সন্তাপে,
রম্য বৃক্ষতলে।
শীতের আগুন তুমি, তুমি মোর ছত্র,
বরষার জলে ||
বসন্তের ফুল তুমি, তিরপতি আঁখি,
রূপের প্রকাশে।
শরতের চাঁদ তুমি, চাঁদবদনি লো,
আমার আকাশে।
কৌমুদীমুখের হাসি, দুখের তিমির নাশে ||
৪
অঙ্গের চন্দন তুমি, পাখার ব্যজন,
কুসুমের বাস।
নয়নের তারা তুমি, শ্রবণেতে শ্রুতি,
দেহের নিশ্বাস ||
মনের আনন্দ তুমি, নিদ্রার স্বপন,
জাগ্রতে বাসনা।
সংসার সহায় তুমি, সংসার-বন্ধন,
বিপদে সান্ত্বনা।
তোমারি লাগিয়ে সই, ঘোর সংসার-যাতনা ||
খদ্যোত
খদ্যোত যে কেন আমাদিগের উপহাসের স্থল, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। বোধ হয়, চন্দ্র সূর্য্যাদি বৃহৎ আলোকাধার সংসারে আছে বলিয়াই জোনাকির এত অপমান। যেখানেই অল্পগুণবিশিষ্ট ব্যক্তিকে উপহাস করিতে হইবে, সেইখানেই বক্তা বা লেখক জোনাকির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আমি দেখিতে পাই যে, জোনাকির অল্প হউক, অধিক হউক, কিছু আলো আছে-কই, আমাদের ত কিছুই নাই। এই অন্ধকারে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার পথ আলো করিলাম? কে আমাকে দেখিয়া, অন্ধকারে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার পথ আলো করিলাম? কে আমাকে দেখিয়া, অন্ধকারে, দুস্তরে, প্রান্তরে, দুর্দ্দিনে, বিপদে, বিপাকে বলিয়াছে, এস ভাই, চল চল, ঐ দেখ আলো জ্বলিতেছে, চল, ঐ আলো দেখিয়া পথ চল? অন্ধকার! এ পৃথিবী ভাই বড় অন্ধকার! পথ চলিতে পারি না। যখন চন্দ্র সূর্য্য থাকে, তখন পথ চলি-নহিলে পারি না। তারাগণ আকাশে উঠিয়া, কিছু আলো করে বটে, কিন্তু দুর্দ্দিনে ত তাহাদের দেখিতে পাই না। চন্দ্রসূর্য্যও সুদিনে-দুর্দ্দিনে, দুঃসময়ে, যখন মেঘের ঘটা, বিদ্যুতের ছটা, একে রাত্রি, তাহাতে ঘোর বর্ষা, তখন কেহ না। মনুষ্যনির্ম্মিত যন্ত্রের ন্যায় তাহারাও বলে- “Hora non numero nisi serenas!” কেবল তুমি খদ্যোৎ,-ক্ষুদ্র, হীনভাস, ঘৃণিত, সহজে হন্য, সর্ব্বদা, হত-তুমিই সেই অন্ধকার দুর্দ্দিনে বর্ষাবৃষ্টিতে দেখা দাও। তুমিই অন্ধকারে আলো। আমি তোমাকে ভাল বাসি।
আমি তোমায় ভাল বাসি, কেন না, তোমার অল্প, অতি অল্প আলো আছে-আমিও মনে জানি, আমারও অল্প, অতি অল্প আলো আছে-তুমিও অন্ধকারে, আমিও ভাই, ঘোর অন্ধকারে। অন্ধকারে সুখ নাই কি? তুমিও অনেক অন্ধকারে বেড়াইয়াছ-তুমি বল দেখি? যখন নিশীথমেঘে জগৎ আচ্ছন্ন, বর্ষা হইতেছে ছাড়িতেছে, ছাড়িতেছে হইতেছে ; চন্দ্র নাই, তারা নাই, আকাশের নীলিমা নাই, পৃথিবীর দীপ নাই-প্রস্ফুটিত কুসুমের শোভা পর্য্যন্ত নাই-কেবল অন্ধকার, অন্ধকার! কেবল অন্ধকার আছে-আর তুমি আছ-তখন, বল দেখি, অন্ধকারে কি সুখ নাই? সেই তপ্ত রৌদ্রপ্রদীপ্ত কর্কশ স্পর্শপীড়িত, কঠোর শব্দে শব্দায়মান অসহ্য সংসারের পরিবর্ত্তে সংসার আর তুমি! জগতে অন্ধকার ; আর মুদিত কামিনীকুসুম জলনিষেকতরুণায়িত বৃক্ষের পাতায় পাতায় তুমি! বল দেখি ভাই, সুখ আছে কি না?
আমি ত বলি আছে। নহিলে কি সাহসে, তুমি ঐ বন্যান্ধকারে, আমি এই সামাজিক অন্ধকারে এই ঘোর দুর্দ্দিনে ক্ষুদ্র আলোকে আলোকিত করিতে চেষ্টা করিতাম? আছে-অন্ধকারে মাতিয়া আমোদ আছে। কেহ দেখিবে না-অন্ধকারে তুমি জ্বলিবে-আর অন্ধকারে আমি জ্বলিব ; অনেক জ্বালায় জ্বলিব। জীবনের তাৎপর্য্য বুঝিতে অতি কঠিন-অতি গূঢ় অতি ভয়ঙ্কর-ক্ষুদ্র হইয়া তুমি কেন জ্বল, ক্ষুদ্র হইয়া আমি কেন জ্বলি? তুমি তা ভাব কি? আমি ভাবি। তুমি যদি না ভাব, তুমি সুখী,-আমি ভাবি-আমি অসুখী। তুমিও কীট-আমিও কীট, ক্ষুদ্রাধিক ক্ষুদ্র কীট-তুমি সুখী,-কোন পাপে আমি অসুখী? তুমি ভাব কি? তুমি কেন জগৎসবিতা সূর্য্য হইলে না, এককালীন আকাশ ও সমুদ্রের শোভা যে সুধাকর, কেন তাই হইলে না-কেন গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতু নীহারিকা,-কিছু না হইয়া কেবল জোনাকি হইলে, ভাব কি? যিনি এ সকলকে সৃজন করিয়াছেন, তিনিই তোমায় সৃজন করিয়াছেন, যিনিই উহাদিগকে আলোক দিয়াছেন, তিনিই তোমাকে আলোক দিয়াছেন-তিনি একের বেলা বড় ছাঁদে-অন্যের বেলা ছোট ছাঁদে গড়িলেন কেন? অন্ধকারে এত বেড়াইলে, ভাবিয়া কিছু পাইয়াছ কি?
তুমি ভাব না ভাব, আমি ভাবি। আমি ভাবিয়া স্থির করিয়াছি যে, বিধাতা তোমায় আমায় কেবল অন্ধকার রাত্রের জন্য পাঠাইয়াছেন। আলো একই-তোমার আলো ও সূর্য্যের-উভয়ই জগদীশ্বরপ্রেরিত-তবে তুমি কেবল বর্ষার রাত্রের জন্য ; আমি কেবল বর্ষার রাত্রের জন্য।-এসো কাঁদি।
এসো কাঁদি-বর্ষার সঙ্গে, তোমার আমার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ কেন? আলোকময়, নক্ষত্রপ্রোজ্জ্বল বসন্তগগনে তোমার আমার স্থান নাই কেন? বসন্ত চন্দ্রের জন্য, সুখীর জন্য, নিশ্চিন্তের জন্য; বর্ষা তোমার জন্য, দুঃখীর জন্য, আমার জন্য। সেই জন্য কাঁদিতে চাহিতেছিলাম-কিন্তু কাঁদিব না। যিনি তোমার আমার জন্য এই সংসার অন্ধকারময় করিয়াছেন, কাঁদিয়া তাঁহাকে দোষ দিব না। যদি অন্ধকারের সঙ্গে তোমার আমার নিত্য সম্বন্ধই তাঁহার ইচ্ছা, আইস, অন্ধকারই ভালবাসি। আইস, নবীন নীল কাদম্বিনী দেখিয়া, এই অনন্ত অসংখ্য জগন্ময় ভীষণ বিশ্বমণ্ডলের করাল ছায়া অনুভূত করি ; মেঘগর্জ্জন শুনিয়া, সর্ব্বধ্বংসকারী কালের অবিশ্রান্ত গর্জ্জন স্মরণ করি ;-বিদ্যুদ্দাম দেখিয়া কালের কটাক্ষ মনে করি। মনে করি, এই সংসার ভয়ঙ্কর ক্ষণিক,-তুমি আমি ক্ষণিক, বর্ষার জন্যই প্রেরিত হইয়াছিলাম ; কাঁদিবার কথা নাই। আইস, নীরবে জ্বলিতে জ্বলিতে, অনেক জ্বালায় জ্বলিতে জ্বলিতে সকল সহ্য করি।
নহিলে, আইস মরি। তুমি দীপালোক বেড়িয়া বেড়িয়া পুড়িয়া মর, আমি আশারূপ প্রবল প্রোজ্জ্বল মহাদীপ বেড়িয়া বেড়িয়া পুড়িয়া মরি। দীপালোকে তোমার কি মোহিনী আছে জানি না-আশার আলোকে আমার যে মোহিনী আছে, তাহা জানি। এ আলোকে কত বার ঝাঁপ দিয়া পড়িলাম, কত বার পুড়িলাম, কিন্তু মরিলাম না। এ মোহিনী কি, আমি জানি। জ্যোতিষ্মান্ হইয়া এ সংসারে আলো বিতরণ করিব-বড় সাধ ; কিন্তু হায়! আমরা খদ্যোৎ! এ আলোকে কিছুই আলোকিত হইবে না! কাজ নাই! তুমি ঐ বকুলকুঞ্জকিসলয়কৃত অন্ধকারমধ্যে, তোমার ক্ষুদ্র আলোক নিবাও, আমিও জলে হউক, স্থলে হউক, রোগে হউক, দুঃখে হউক, এ ক্ষুদ্র দীপ নিবাই।
মনুষ্য খদ্যোৎ।
জলে ফুলে
জলে ফুলে
১
কে ভাসাল জলে তোরে কানন-সুন্দরী!
বসিয়া পল্লবাসনে, ফুটেছিলে কোন্ বনে
নাচিতে পবন সনে, কোন্ বৃক্ষোপরি?
কে ছিঁড়িল শাখা হতে শাখার মঞ্জরী?
২
কে আনিল তোরে ফুল তরঙ্গিণী-তীরে?
কাহার কুলের বালা, আনিয়া ফুলের ডালা,
ফুলের আঙ্গুলে তুলে ফুল দিল নীরে?
ফুল হতে ফুল খসি, জলে ভাসে ধীরে!
৩
ভাসিছে সলিলে যেন, আকাশেতে তারা।
কিম্বা কাদম্বিনী-গায়, যেন বিহঙ্গিনী প্রায়,
কিম্বা যেন মাঠে ভ্রমে, নারী পথহারা;
কোথায় চলেছ ধরি, তরঙ্গিণীধারা?
৪
একাকিনী ভাসি যাও, কোথায় অবলে!
তরঙ্গের রাশি রাশি, হাসিয়া বিকট হাসি,
তাড়াতাড়ি করি তোরে খেলে কুতূহলে?
কে ভাসাল তোরে ফুল কাল নদীজলে!
৫
কে ভাসাল তোরে ফুল, কে ভাসাল মোরে!
কাল স্রোতে তোর(ই) মত, ভাসি আমি অবিরত,
কে ফেলেছে মোরে এই তরঙ্গের ঘোরে?
ফেলেছে তুলিছে কভু, আছাড়িছে জোরে
৬
শাখার মঞ্জরী আমি, তোরই মত ফুল।
বোঁটা ছিঁড়ে শাখা ছেড়ে, ঘুরি আমি স্রোতে পড়্যে,
আশার আবর্ত্ত বেড়ে, নাহি পাই কূল।
তোরই মত আমি ফুল তরঙ্গে আকুল।
৭
তুই যাবি ভেসে ফুল, আমি যাব ভেসে।
কেহ না ধরিবে তোরে কেহ না ধরিবে মোরে
অনন্ত সাগরে তুই, মিশাইবি শেষে।
চল যাই দুই জনে অনন্ত উদ্দেশে।
দুর্গোৎসব
১
বর্ষে বর্ষে এসো যাও এ বাঙ্গালা ধামে
কে তুমি ষোড়শী কন্যা, মৃগেন্দ্রবাহিনি?
চিনিয়াছি তোরে দুর্গে, তুমি নাকি ভব দুর্গে,
দুর্গতির একমাত্র সংহারকারিণী ||
মাটি দিয়ে গড়িয়াছি, কত গেল খড় কাছি,
সৃজিবারে জগতের সৃজনকারিণী।
গড়ে পিটে হলো খাড়া, বাজা ভাই ঢোল কাড়া,
কুমারের হাতে গড়া ঐ দীনতারিণী।
বাজা-ঠমকি ঠমকি ঠিকি, খিনিকি
ঝিনিকি ঠিনি ||
২
কি সাজ সেজেছ মাতা রাঙ্গতার সাজে।
এ দেশে যে রাঙ্গই সাজ কে তোরে শিখালে?
সন্তানে রাঙ্গতা দিলে আপনি তাই পরিলে,
কেন মা রাঙ্গের সাজে এ বঙ্গ ভুলালে?
ভারত রতন খনি, রতন কাঞ্চন মণি,
সে কালে এদেশে মাতা, কত না ছড়ালে?
বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, আজ তুমি রাঙ্গতা পরা,
ছিঁড়া ধুতি রিপু করা, ছেলের কপালে?
তবে-বাজা ঢোল কাঁশি মধুর
খেমটা তালে ||
৩
কারে মা এনেছ সঙ্গে, অনন্তরঙ্গিণি!
কি শোভা হয়েছে আজি, দেখ রে সবার!
আমি বেটা লক্ষ্মীছাড়া, আমার ঘরে লক্ষ্মী খাড়া,
ঘরে হতে খাই তাড়া, ঘরখরচ নাই ||
হয়েছিল হাতে খড়ি, ছাপার কাগজ পড়ি,
সরস্বতী তাড়াতাড়ি, এলে বুঝি তাই?
করো না মা বাড়াবাড়ি, তোমায় আমায়
ছাড়াছাড়ি,
চড়ে না ভাতের হাঁড়ি, বিদ্যায় কাজ নাই।
তাক্ তাক্ ধিনাক্ ধিনাক্ বাজনা
বাজা রে ভাই ||
৪
দশ ভুজে দশায়ুধ কেন মাতা ধর?
কেন মাতা চাপিয়াছ সিংহটার ঘাড়ে?
ছুরি দেখে ভয় পাই, ঢাল খাঁড়া কাজ নাই,
ও সব রাখুক গিয়ে রামদীন পাঁড়ে।
সিংহ চড়া ভাল নয়, দাঁত দেখে পাই ভয়,
প্রাণ যেন খাবি খায়, পাছে লাফ ছাড়ে,
আছে ঘরে বাঁধা গাই, চড়তে হয় চড় তাই,
তাও কিছু ভয় পাই পাছে সিঙ্গ নাড়ে।
সিংহপৃষ্ঠে মেয়ের পা! দেখে কাঁপি
হাড়ে হাড়ে ||
৫
তোমার বাপের কাঁধে-নগেন্দ্রের ঘাড়ে
তুঙ্গ শৃঙ্গোপরে সিংহ-দেখে গিরিবালে!
শিমলা পাহাড়ে ধ্বজা, উড়ায় করিয়া মজা,
পিতৃ সহ বন্দী আছ, হর্য্যক্ষের জালে।
তুমি যারে কৃপা কর সেই হয় ভাগ্যধর-
সিংহের চরণ দিয়ে কতই বাড়ালে!
জনমি ব্রাহ্মণ কুলে, শতদল পদ্ম তুলে
আমি পূজে পাদপদ্ম পড়িনু আড়ালে!
রুটি মাখন খাব মা গো! আলোচাল ছাড়ালে!
৬
এই শুন পুনঃ বাজে মজাইয়া মন,
সিংহের গভীর কণ্ঠ, ইংরেজ কামান!
দুড়ুম দুড়ুম দুম, প্রভাতে ভাঙ্গায় ঘুম,
দুপুরে প্রদোষে ডাকে, শিহরয় প্রাণ!
ছেড়ে ফেলে ছেঁড়া ধুতি, জলে ফেলে খুঙ্গী
পুঁথি,
সাহেব সাজিব আজ ব্রাহ্মণ সন্তান।
লুচি মণ্ডার মুখে ছাই, মেজে বস্যে মটন খাই,
দেখি মা পাই না পাই তোমার সন্ধান।
সোলা-টুপি মাথায় দিয়ে পাব জগতে সম্মান ||
৭
এনেছ মা বিঘ্ন-হরে কিসের কারণে?
বিঘ্নময় এ বাঙ্গালা, তা কি আছে মনে?
এনেছ মা শক্তিধরে, দেখি কত শক্তি ধরে?
মেরেছ মা বারে বারে দুষ্টাসুরগণে,
মেরেছ তারকাসুর, আজি বঙ্গ ক্ষুধাতুর,
মার দেখি ক্ষুধাসুর, সমাজের রণে?
অসুরে করিয়া ফের, মায়ে পোয়ে মারলে ঢের,
মার দেখি এ অসুরে, ধরি ও চরণে ||
তখন-“কত নাচ গো রণে!” বাজাব
প্রফুল্ল মনে।
৮
তোমার মহিমা মাতা বুঝিতে নারিনু,
কিসে লাগিয়া আন কাল বিষধরে?
ঘরে পরে বিষধর, বিষে রঙ্গ জ্বর জ্বর,
আবার এ অজগর দেখাও কিঙ্করে?
হই মা পরের দাস, বাঁধি আঁটি কেটে ঘাস,
নাহিক ছাড়ি নিশ্বাস কালসাপ ডরে।
নিতি নিতি অপমান, বিষে জ্বর জ্বর প্রাণ,
কত বিষ কণ্ঠ মাঝে, নীলকণ্ঠ ধরে;
বিষের জ্বালায় সদা প্রাণ ছটফট করে!
৯
দুর্গা দুর্গা বল ভাই দুর্গাপূজা এলো,
পুঁতিয়া কলার তেড় সাজাও তোরণ।
বেছে বেছে তোল ফুল সাজাব ও পদমূল,
এবার হৃদয় খুলে পূজিব চরণ ||
সাজা ভাই ঢাক ঢোল, কাড়া নাগড়া গণ্ডগোল,
দেব ভাই পাঁটার ঝোল, সোনার বরণ ||
ন্যায়রত্ন এসো সাজি, প্রতিপদ হল আজি,
জাগাও দেখি চণ্ডীরে বসায়ে বোধন?
১০
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু-ছায়া রূপ ধরে!
কি পুঁথি পড়িলে বিপ্র! কাঁদিল হৃদয়!
সর্ব্বভূতে সেই ছায়া! হইল পবিত্র কায়া,
ঘুচিবে সংসারে মায়া, যদি তাই হয় ||
আবার কি শুনি কথা! শক্তি নাকি যথা তথা?
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু, শক্তিরূপে রয়?
বাঙ্গালি ভূতের দেহ- শক্তি ত না দেখে কেহ;
ছিলে যদি শক্তিরূপে, কেন হলে লয়?
আদ্যাশক্তি শক্তি দেহ। জয় মা চণ্ডীর জয়।
১১
পরিল এ বঙ্গবাসী, নূতন বসন,
জীবন্ত কুসুমসজ্জা, যেন বা ধরায়।
কেহ বা আপনি পরে, কেহ বা পরায় পরে,
যে যাহারে ভালবাসে, সে তারে সাজায়।
বাজারেতে হুড়াহুড়ি, আপিসেতে তাড়াতাড়ি,
লুচি মণ্ডা ছড়াছড়ি ভাত কেবা খায়?
সুখের বড় বাড়াবাড়ি, টাকার বেলা ভাঁড়াভাঁড়ি,
এই দশা ত সকল বাড়ী, দোষিব বা কায়?
বর্ষে বর্ষে ভুগি মা গো, বড়ই টাকার দায়!
১২
হাহাকার বঙ্গদেশে, টাকার জ্বালায়।
তুমি এলে শুভঙ্করি! বাড়ে আরো দায়।
কে এসো কেন দাও, কেন চাল কলা খাও,
তোমার প্রসাদে যদি টাকা কুলায়।
তুমি ধর্ম্ম তুমি অর্থ, তার বুঝি এই অর্থ,
তুমি মা টাকারূপিণী ধরম টাকায়।
টাকা কাম, টাকা মোক্ষ, রক্ষ মাতঃ রক্ষ রক্ষ,
টাকা দাও লক্ষ লক্ষ, নৈলে প্রাণ যায়।
টাকা ভক্তি, টাকা মতি, টাকা মুক্তি, টাকা গতি,
না জানি ভকতিস্তুতি, নমামি টাকায়?
হা টাকা যো টাকা দেবি, মরি যেন টাকা সেবি,
অন্তিম কালে পাই মা যেন রূপার চাকায়?
১৩
তুমিই বিষ্ণুর হস্তে সুদর্শন চক্র,
হে টাকে! ইহ জগতে তুমি সুদর্শন।
শুন প্রভু রূপচাঁদ, তুমি ভানু তুমি চাঁদ,
ঘরে এসো সোনার চাঁদ, দাও দরশন ||
আমরি কি শোভা, ছেলে বুড়ার মনোলোভা,
হৃদে ধর বিবির মুণ্ড, লতায় বেষ্টন।
তব ঝন্ ঝন্ নাদে, হারিয়া বেহালা কাঁদে,
তম্বুরা মৃদঙ্গ বীণা কি ছার বাদন।
পশিয়া মরম-মাঝে, নারীকণ্ঠ মৃদু বাজে,
তাও ছার তুমি যদি কর ঝন্ ঝন্!
টাকা টাকা টাকা টাকা!
বাক্সতে এসো রে ধন।
১৪
তোর লাগি সর্ব্বত্যাগী, ওরে টাকা ধন!
জনমি বাঙ্গালী-কুলে, ভুলিনু ও রূপে!
তেয়াগিনু পিতা মাতা, শত্রু যে ভগিনী ভ্রাতা,
দেখি মারি জ্ঞাতি গোষ্ঠী, তোরে প্রাণ সপে!
বুঝিয়া টাকার মর্ম্ম, ত্যজেছি যে ধর্ম্ম কর্ম্ম,
করেছি নরকে ঠাঁই, ঘোর কৃমিকূপে ||
দুর্গে দুর্গে ডাকি আজ, এ লোভে পড়ুক বাজ,
অসুরনাশিনি চণ্ডি আয় চণ্ডিরূপে!
এ অসুরে নাশ মাত!
শুম্ভে নাশিলে যেরূপে!
১৫
এসো এসো জগন্মাতা, জগদ্ধাত্রী উমে
হিসাব নিকাশ আমি, করি তব সঙ্গে।
আজি পূর্ণ বার মাস, পূর্ণ হলো কোন আশ?
আবার পূজিব তোমা, কিসের প্রসঙ্গে?
সেই ত কঠিন মাটি, দিবা রাত্রি দুখে হাঁটি,
সেই রৌদ্র সেই বৃষ্টি, পীড়িতেছে অঙ্গে।
কি জন্য গেল বা বর্ষ? বাড়িয়াছে কোন হর্ষ?
মিছামিছি আয়ুঃক্ষয়, কালের ভ্রূভঙ্গে।
বর্ষ কেন গণি তবে, কেন তুমি এস ভবে,
পিঞ্জর যন্ত্রণা সবে বনের বিহঙ্গে?
ভাঙ্গ মা দেহ-পিঞ্জর! উড়িব মনের রঙ্গে।
১৬
ওই শুন বাজিতেছে গুম্ গাম্ গুম্
ঢাক ঢোল কাড়া কাঁশি, নৌবত নাগরা।
প্রভাত সপ্তমী নিশি, নেয়েছে শঙ্করী পিসী,
রাঁধিবে ভোগের রান্না, হাঁড়ি মাল্শা ভরা।
কাঁদি কাঁদি কেটে কলা, ভিজায়েছি ডাল ছোলা,
মোচা কুমড়া আলু বেগুন,
আছে কাঁড়ি করা ||
আর মা চাও বা কি? মট্কিভরা আছে ঘি,
মিহিদানা সীতাভোগ, লুচি মনোহরা!
আজ এ পাহাড়ে মেয়ের,
ভাল কর্যে পেট ভরা।
১৭
আর কি খাইবে মাতা? ছাগলের মুণ্ড?
রুধিরে প্রবৃত্তি কেন হে শান্তিরূপিণি।
তুমি গো মা জগন্মাতা, তুমি খাবে কার মাথা!?
তুমি দেহ তুমি আত্মা, সংসারব্যাপিনি!
তুমি কার কে তোমার, তোর কেন মাংসাহার?
ছাগলে এ তৃপ্তি কেন, সর্ব্বসংহারিণি?
করি তোমায় কৃতাঞ্জলি, তুমি যদি চাও বলি,
বলি দিব সুখ দুঃখ, চিত্তবৃত্তি জিনি ;
ছ্যাডাং ড্যাড্যাং ড্যাং ড্যাং!
নাচো গো রণরঙ্গিণি।
১৮
ছয় রিপু বলি দিব, শক্তির চরণে
ঐশিকী মানসী শক্তি! তীব্র জ্যোতির্ম্ময়ি!
বলি ত দিয়াছি সুখ, এখন বলি দিব দুখ,
শক্তিতে ইন্দ্রিয় জিনি হইব বিজয়ী।
এ শক্তি দিতে কি পার? ঠুসে তবে পাঁটা মার,
প্রণমামি মহামায়ে তুমি ব্রহ্মময়ী।
নৈলে তুমি মাটির ঢিপি, দশমীতে গলা টিপি,
তোমায় ভাসিয়ে গাঁজা টিপি, সিদ্ধিরস্তু কই।
ঐটুকু মা ভাল দেখি, পূজি তোমায় মৃণ্ময়ি!
——————-
5 এই কাব্যে ছন্দের নিয়ম পুন: পুন: লঙ্ঘিত হইয়াছে-ব্যকরণের ত কথাই নেই।-লেখক।
পুষ্পনাটক
যূথিকা। এসো, এসো, প্রাণনাথ এসো ; আমার হৃদয়ের ভিতর এসো ; আমার হৃদয় ভরিয়া যাউক। কত কাল ধরিয়া তোমার আশায় ঊর্দ্ধমুখী হইয়া বসিয়া আছি, তা কি তুমি জান না? আমি যখন কলিকা, তখন ঐ বৃহৎ আগুনের চাকা-ঐ ত্রিভুবনশুষ্ককর মহাপাপ, কোথায় আকাশের পূর্ব্বদিকে পড়িয়াছিল! তখন এমন বিশ্বপোড়ান মূর্ত্তিও ছিল না। তখন এর তেজের এত জ্বালাও ছিল না-হায়! সে কত কাল হইল! এখন দেখ, সেই মহাপাপ ক্রমে আকাশের মাঝখানে উঠিয়া, ব্রহ্মাণ্ড জ্বালাইয়া, ক্রমে পশ্চিমে হেলিয়া হেলিয়া, এখন বুঝি অনন্তে ডুবিয়া যায়! যাক্! দূর হৌক-তা তুমি এত কাল কোথা ছিলে প্রাণনাথ? তোমায় পেয়ে দেহ শীতল হইল, হৃদয় ভরিয়া গেল-ছি, মাটিতে পড়িও না! আমার বুকে তুমি আছ, তাতে সেই পোড়া তপন আর আমাকে না জ্বালাইয়া তোমাকে কেমন সাজাইতেছে! সেই রৌদ্রবিম্বে তুমি কেমন রত্নভূষিত হইয়াছ। তোমার রূপে আমিও রূপসী হইয়াছি-থাক, থাক, হৃদয়স্নিগ্ধকর!-আমার হৃদয়ে থাক, মাটিতে পড়িও না।
টগর। (জনান্তিকে কৃষ্ণকলির প্রতি) দেখ্ ভাই কৃষ্ণকলি,-মেয়েটার রকম দেখ্!
কৃষ্ণকলি। কোন্ মেয়েটার?
টগর। ঐ যূঁইটা। এত কাল মুখ বুজে ঘাড় হেঁট করে, যেন দোকানের মুড়ির মত পড়িয়া ছিল-তার পর আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা, নবাবের বেটা নবাব, বাতাসের মোড়ায় চ’ড়ে একেবারে মেয়েটার ঘাড়ের উপর এসে পড়িল। অমনি মেয়েটা হেসে, ফুটে, একেবারে আটখানা। আঃ, তোর ছেলে বয়স! ছেলেমানুষের রকমই এক স্বতন্ত্র।
কৃষ্ণকলি। আ ছি! ছি!
টগর। তা দিদি! আমরা কি ফুট্তে জানিনে? তা, সংসারধর্ম্ম করিতে গেলে দিনেও ফুট্তে হয়, দুপুরেও ফুট্তে হয়, গরমেও ফুট্তে হয়, ঠাণ্ডাতেও ফুট্তে হয়, না ফুট্লে চলবে কেন বহিন? আমাদেরই কি বয়স নেই? তা, ও সব অহঙ্কার ঠেকার আমরা ভালবাসি না।
কৃষ্ণকলি। সেই কথাই ত বলি।
যুঁই। তা এত কাল কোথা ছিলে প্রাণনাথ! জান না কি যে, তুমি বিনা আমি জীবন ধারণ করিতে পারি না?
বৃষ্টিবিন্দু। দুঃখ, করিও না প্রাণাধিকে! আসিব আসিব অনেক কাল ধরিয়া মনে করিতেছি, কিন্তু ঘটিয়া উঠে নাই। কি জান, আকাশ হইতে পৃথিবীতে আসা, ইহাতে অনেক বিঘ্ন। একা আসা যায় না, দলবল যুটিয়া আসিতে হয়, সকলের সব সময় মেজাজ মরজি সমান থাকে না। কেহ বাষ্পরূপ ভাল বাসেন, আপনাকে বড় লোক মনে করিয়া আকাশের উচ্চ স্তরে অদৃশ্য হইয়া থাকিতে ভাল বাসেন ; কেহ বলেন, একটু ঠাণ্ডা পড়ুক, বায়ুর নিম্ন স্তর বড় গরম, এখন গেলে শুকাইয়া উঠিব; কেহ বলেন, পৃথিবীতে নামা, ও অধঃপতন, অধঃপাতে কেন যাইবো? কেহ বলেন, আর মাটিতে গিয়া কাজ নাই, আকাশে কালামুখো মেঘ হ’য়ে চিরকাল থাকি, সেও ভাল ; কেহ বলেন, মাটিতে গিয়া কাজ নাই, আবার সেই চিরকেলে নদী নালা বিল খাল বেয়ে সেই লোণা সমুদ্রটায় পড়িতে হইবে, তার চেয়ে এসো, এই উজ্জ্বল রৌদ্রে গিয়া খেলা করি, সবাই মিলে রামধনু হইয়া সাজি, বাহার দেখিয়া ভূচর খেচর মোহিত হইবে। তা সব যদি মিলিয়া মিশিয়া আকাশে যোটপাট হওয়া গেল, তবু জ্ঞাতিবর্গের গোলযোগ মিটে না। কেহ বলেন, এখন থাক্; এখন এসো, কালিমাময়ী কালী করালী কাদম্বিনী সাজিয়া, বিদ্যুতের মালা গলায় দিয়া, আমরা সেইখানে বসিয়া বাহার দিই। কেহ বলে, অত তাড়াতাড়ি কেন? আমরা জলবংশ, ভূলোক উদ্ধার করিতে যাইব, অমনি কি চুপি চুপি যাওয়া হয়? -এসো, খানিক ডাক-হাঁক করি। কেহ ডাক-হাঁক করে, কেহ বিদ্যুতের খেলা দেখে-মাগী নানা রঙ্গে রঙ্গিণী-কখন এ মেঘের কোলে, কখন ও মেঘের কোলে, কখন আকাশপ্রান্তে, কখন আকাশমধ্যে, কখনও মিটি মিটি, কখনও চিকি চাকি-
যূঁই। তা তোমার যদি সেই বিদ্যুতেই এত মন মজেছে, তা এলে কেন? সে হ’লো বড়, আমরা হলেম ক্ষুদ্র।
বৃষ্টিবিন্দু। আ ছি! ছি! রাগ কেন? আমি কি সেই রকম? দেখ, ছেলে ছোকরা হাল্কা যারা, তারা কেহই আসিল না, আমরা জন কত ভারি লোক, থাকিতে পারিলাম না, নামিয়া আসিলাম। বিশেষ তোমাদের সঙ্গে অনেক দিন দেখা শুনা হয় নাই।
পদ্ম। (পুকুর হইতে) উঃ, বেটা কি ভারি রে! আয় না, তোদের মত দু লাখ্ দশ লাখ্ আয় না-আমার একটা পাতায় বসাইয়া রাখি।
বৃষ্টিবিন্দু। বাছা, আসল কথাটা ভুলে গেলে? পুকুর পুরায় কে? হে পঙ্কজে, বৃষ্টি নহিলে জগতে পাঁকও থাকিত না, জলও থাকিত না, তুমি ভাসিতেও পাইতে না, হাসিতেও পাইতে না। হে জলজে, তুমি আমাদের ঘরের মেয়ে, তাই আমরা তোমাকে বুকে করিয়া পালন করি,-নহিলে তোমায় এ রূপও থাকিত না, এ সুবাসও থাকিত না, এ গর্ব্বও থাকিত না। পাপীয়সি! জানিস্ না-তুই তোর পিতৃকুলবৈরী সেই অগ্নিপিণ্ডটার অনুরাগিণী!
যূঁই। ছি! প্রাণাধিক! ও মাগীটার সঙ্গে কি অত কথা কহিতে আছে। ওটা সকাল থেকে মুখ খুলিয়া সেই অগ্নিময় নায়কের মুখপানে চাহিয়া থাকে ; সেটা যে দিকে যায়, সেই দিকে মুখ ফিরাইয়া হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে, এর মধ্যে কত বোলতা, ভোমরা, মৌমাছি আসে, তাতেও লজ্জা নাই। অমন বেহায়া জলেভাসা, ভোমরা মৌমাছি আশা, কাঁটার বাসার সঙ্গে কথা কহিতে আছে কি?
কৃষ্ণকলি। বলি, ও যূঁই, ভোমরা কথাটা ঘরে ঘরে নয় কি?
যূঁই। আপনাদের ঘরের কথা কও দিদি, আমি ত এই ফুটিলাম। ভোমরা মৌমাছির জ্বালা ত এখনও কিছু জানি না।
বৃষ্টিবিন্দু। তুমিই বা কেন বাজে লোকের সঙ্গে কথা কও! যারা আপনারা কলঙ্কিনী, তারা কি তোমার মত অমল ধবল শোভা, এমন সৌরভ দেখিয়া সহ্য করিতে পারে?
পদ্ম। ভাল রে ক্ষুদে! ভাল! খুব বক্তৃতা কর্চিস! ঐ দেখ, বাতাস আসচে!
যূঁই। সর্ব্বনাশ! কি বলে যে!
বৃষ্টিবিন্দু। তাই ত! আমার আর থাকা হইল না।
যূঁই। থাক না!
বৃষ্টিবিন্দু। থাকিতে পারিব না। বাতাস আমাকে ঝরাইয়া দিবে।-আমি উহার বলে পারি না।
যূঁই। আর একটু থাক না।
[বাতাসের প্রবেশ]
বাতাস। (বৃষ্টিবিন্দুর প্রতি) নাম্।
বৃষ্টিবিন্দু। কেন মহাশয়!
বাতাস। আমি এই অমল কমল সুশীতল সুবাসিত ফুল্লকলিকা লইয়া ক্রীড়া করিব! তুই বেটা অধঃপতিত, নীচগামী, নীচবংশ-তুই এই সুখের আসনে বসিয়া থাকিবি? নাম্!
বৃষ্টিবিন্দু। আমি আকাশ থেকে এয়েছি।
বাতাস। তুই বেটা পার্থিবযোনি-নীচগামী-খালে বিলে খানায় ডোবায় থাকিস-তুই এ আসনে? নাম্।
বৃষ্টিবিন্দু। যূথিকে! আমি তবে যাই।
যূঁই। থাক না।
বৃষ্টিবিন্দু। থাকিতে দেয় না যে।
যূঁই। থাক না-থাক না-থাক না।
বাতাস। তুই অত ঘাড় নাড়িস কেন?
যূঁই। তুই সর।
বাতাস। আমি তোকে ধরি, সুন্দরি! [যূথিকার সরিয়া সরিয়া পলায়নের চেষ্টা]
বৃষ্টিবিন্দু। এত গোলযোগে আর থাকিতে পারি না।
যুঁই। তবে আমার যা কিছু আছে, তোমাকে দিই, ধূইয়া লইয়া যাও।
বৃষ্টিবিন্দু। কি আছে?
যূঁই। একটু সঞ্চিত মধু-আর একটু পরিমল।
বাতাস। পরিমল আমি নিব-সেই লোভেই আমি এসেছি। দে-
[বায়ুকৃত পুষ্প প্রতি বল প্রয়োগ]
যূঁই। (বৃষ্টিবিন্দুর প্রতি) তুমি যাও-দেখিতেছ না ডাকাত!
বৃষ্টিবিন্দু। তোমাকে ছাড়িয়া যাই কি প্রকারে? যে তাড়া দিতেছ, থাকিতেও পারি না-যাই-যাই-
[বৃষ্টিবিন্দুর ভূপতন]
টগর ও কৃষ্ণকলি। এখন, কেমন স্বর্গবাসী! আকাশ থেকে নেমে এয়েচ না? এখন মাটিতে শোষ, নরদমায় পশ, খালে বিলে ভাস-
যূঁই। (বাতাসের প্রতি) ছাড়! ছাড়!
বাতাস। কেন ছাড়িব? দে পরিমল দে!
যূঁই। হায়! কোথা গেলে তুমি অমল, কোমল, স্বচ্ছ, সুন্দর, সূর্য্যপ্রতিভাত, রসময়, জলকণা! এ হৃদয় স্নেহে ভরিয়া আবার শূন্য করিলে কেন জলকণা! একবার রূপ দেখাইয়া, স্নিগ্ধ করিয়া, কোথায় মিশিলে, কোথায় শুষিলে প্রাণাধিক! হায়, আমি কেন তোমার সঙ্গে গেলেম না, কেন তোমার সঙ্গে মরিলাম না! কেন অনাথ, অস্নিগ্ধ পুষ্পদেহ লইয়া এ শূন্য প্রদেশে রহিলাম-
বাতাস। নে। কান্না রাখ্-পরিমল দে-
যূঁই। ছাড় ; নহিলে যে পথে আমার প্রিয় গিয়াছে, আমিও সেই পথে যাইব।
বাতাস। যাস্ যাবি, পরিমল দে।-হুঁ হুম্।
যূঁই। আমি মরিব-মরি-তবে চলিলাম।
বাতাস। হুঁ হুম্! [ইতি যূথিকার বৃন্তচ্যুতি ও ভূপতন]
বাতাস। হু! হায়! হায়!
যবনিকা পতন
EPILOGUE
প্রথম শ্রোতা। নাটককার মহাশয়! এ কি ছাই হইল?
দ্বিতীয় ঐ। তাই ত, একটা যূঁই ফুল নায়িকা, আর এক ফোটা জল নায়ক। বড় ত Drama!
তৃতীয় ঐ। হতে পারে, কোন Moral আছে। নীতিকথা মাত্র।
চতুর্থ। না হে-এক রকম Tragedy.
পঞ্চম ঐ। Tragedy, না একটা Farce?
ষষ্ঠ ঐ। Farce না-Satire-কাহাকে লক্ষ্য করিয়া উপহাস করা হইয়াছে।
সপ্তম ঐ। তাহা নহে। ইহার গূঢ় অর্থ আছে। ইহা পরিমার্থবিষয়ক কাব্য বলিয়া আমার বোধ হয়। “বাসনা” বা “তৃষ্ণা” নাম দিলেই ইহার ঠিক নাম হইত বোধ হয়, গ্রন্থকার ততটা ফুটিতে চান না।
অষ্টম ঐ। এ একটা রূপক বটে। আমি অর্থ করিব?
প্রথম ঐ। আচ্ছা, গ্রন্থকারই বলুন না কি এটা।
গ্রন্থকার। ও সব কিছুই নহে। ইহার ইংরাজি Title দিব-
“A true and faithful account of a lamentable Tragedy which occurred in a flower-plot on the evening of the 19th July 1885, Sunday, and of which the writer was an eye-witness!”
বায়ু
১
জন্ম মম সূর্য্য-তেজে, আকাশ মণ্ডলে।
যথা ডাকে মেঘরাশি,
হাসিয়া বিকট হাসি,
বিজলি উজলে ||
কেবা মম সম বলে,
হুহুঙ্কার করি যবে, নামি রণস্থলে।
কানন ফেলি উপাড়ি,
গুঁড়াইয়া ফেলি বাড়ী,
হাসিয়া ভাঙ্গিয়া পাড়ি,
অটল অচলে।
হাহাকার শব্দ তুলি এ সুখ অবনীতলে ||
২
পর্ব্বতশিখরে নাচি, বিষম তরসে,
মাতিয়া মেঘের সনে,
পিঠে করি বহি ঘনে,
সে ঘন বরষে।
হাসে দামিনী সে রসে।
মহাশব্দে ক্রীড়া করি, সাগর উরসে ||
মথিয়া অনন্ত জলে
সফেন তরঙ্গবদলে,
ভাঙ্গি তুলে নভস্তলে,
ব্যাপি দিগ্দশে।
শীকরে আঁধারি জগৎ, ভাসাই দেশ অলসে ||
৩
বসন্তে নবীন লতা, ফুল দোলে তায়।
যেন বায়ু সে বা নহি,
অতি মৃদু মৃদু বহি,
প্রবেশি তথায় ||
হেসে মরি যে লজ্জায়-
পুষ্পগন্ধ চুরি করি, মাখি নিজ গায়ে ||
সরোবরে স্নান করি,
যাই যথায় সুন্দরী,
বসে বাতায়নোপরি,
গ্রীষ্মের জ্বালায় ||
তাহার অলকা ধরি,
মুখ চুম্বি ঘর্ম্ম হরি,
অঞ্চল চঞ্চল করি,
স্নিগ্ধ করি কায় ||
আমার সমান কেবা যুবতিমন ভুলায়?
৪
বেণুখণ্ড মধ্যে থাকি, বাজাই বাঁশরী।
রন্ধ্রে রন্ধ্রে যাই আসি,
আমিই মোহন বাঁশী,
সুরের লহরী ||
আর কার গুণে হরি,
ভুলাইত বৃন্দাবনে, বৃন্দাবনেশ্বরী?
ঢল ঢল চল চল,
চঞ্চল যমুনা জল,
নিশীথে ফুলে উজল,
কানন বল্লরী,
তার মাঝে বাজিতাম বংশীনাদ রূপ ধরি ||
৫
জীবকণ্ঠে যাই আসি, আমি কণ্ঠস্বর!
আমি বাক্য, ভাষা আমি,
সাহিত্য বিজ্ঞান স্বামী,
মহীর ভিতর ||
সিংহের কণ্ঠেতে আমিই হুঙ্কার
ঋষির কণ্ঠেতে আমিই ওঙ্কার
গায়ককণ্ঠেতে আমিই ঝঙ্কার,
বিশ্ব-মনোহর ||
আমিই রাগিণী আমি ছয় রাগ,
কামিনীর মুখে আমিই সোহাগ,
বালকের বাণী অমৃতের ভাগ,
মম রূপান্তর ||
গুণ গুণ রবে ভ্রময়ে ভ্রমর,
কোকিল কুহরে বৃক্ষের উপর,
কলহংস নাদে সরসী ভিতর
আমারি কিঙ্কর ||
আমি হাসি আমি কান্না, স্বরূপে শাসি নর ||
৬
কে বাঁচিত এ সংসারে, আমার বিহনে?
আমি না থাকিলে ভুবনে?
আমিই জীবের প্রাণ,
দেহে করি অধিষ্ঠান,
নিশ্বাস বহনে।
উড়াই খগে গগনে।4
দেশে দেশে লয়ে যাই, বহি যত ঘনে।
আনিয়া সাগরনীরে,
ঢালে তারা গিরিশিরে
সিক্ত করি পৃথিবীরে,
বেড়ায় গগনে।
মম সম দোষে গুণে, দেখেছ কি কোন জনে?
৭
মহাবীর দেব অগ্নি জ্বালি সে অনলে।
আমিই জ্বালাই যাঁরে,
আমিই নিবাই তাঁরে,
আপনার বলে।
মহাবলে বলী আমি, মন্থন করি সাগর।
রসে সুরসিক আমি, কুসুমকুলনাগর ||
শিহরে পরসে মম কুলের কামিনী।
মজাইনু বাঁশী হয়ে, গোপের গোপিনী ||
বাক্যরূপে জ্ঞান আমি স্বরূপে গীত।
আমারি কৃপায় ব্যক্ত ভক্তি দম্ভ প্রীত ||
প্রাণবায়ুরূপে আমি রক্ষা করি জীবগণ।
হুহু হুহু! মম সম গুণবান্ আছে কোন জন?
বৃষ্টি
চল নামি-আষাঢ় আসিয়াছে-চল নামি।
আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টিবিন্দু, একা এক জনে যূথিকাকলির শুষ্ক মুখও ধুইতে পারি না-মল্লিকার ক্ষুদ্র হৃদয় ভরিতে পারি না। কিন্তু আমরা সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি,-মনে করিলে পৃথিবী ভাসাই। ক্ষুদ্র কে?
দেখ, যে একা, সেই ক্ষুদ্র, সেই সামান্য। যাহার ঐক্য নাই, সেই তুচ্ছ। দেখ, ভাই সকল কেহ একা নামিও না-অর্দ্ধপথে ঐ প্রচণ্ড রবির কিরণে শুকাইয়া যাইবে,-চল, সহস্রে সহস্রে, লক্ষে লক্ষে, অর্ব্বুদে, অর্ব্বুদে এই বিশোষিতা পৃথিবী ভাসাইব।
পৃথিবী ভাসাইব। পর্ব্বতের মাথায় চড়িয়া, তাহার গলা ধরিয়া, বুকে পা দিয়া, পৃথিবীতে নামিব ; নির্ঝরপথে স্ফটিক হইয়া বাহির হইব। নদীকূলের শূন্যহৃদয় ভরাইয়া, তাহাদিগকে রূপের বসন পরাইয়া, মহাকল্লোলে ভীম বাদ্য বাজাইয়া, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ মারিয়া, মহারঙ্গে ক্রীড়া করিব। এসো, সবে নামি।
কে যুদ্ধ দিবে-বায়ু। ইস! বায়ুর ঘাড়ে চড়িয়া দেশ দেশান্তরে বেড়াইব। আমাদের এ বর্ষাযুদ্ধে বায়ু ঘোড়া মাত্র ; তাহার সাহায্য পাইলে স্থলে জলে এক করি। তাহার সাহায্য পাইলে, বড় বড় গ্রাম অট্টালিকা, পোত মুখে করিয়া ধুইয়া লইয়া যাই। তাহার ঘাড়ে চড়িয়া, জানালা লোকের ঘরে ঢুকি। যুবতীর যত্ননির্ম্মিত শয্যা ভিজাইয়া দিই-সুষুপ্ত সুন্দরীর গায়ের উপর গা ঢালি। বায়ু! বায়ু ত আমাদের গোলাম।
দেখ ভাই, কেহ একা নামিও না-ঐক্যেই বল-নহিলে আমরা কেহ নাই। চল-আমরা ক্ষুদ্র বৃষ্টিবিন্দু-কিন্তু পৃথিবী রাখিব। শস্যক্ষেত্রে শস্য জন্মাইব-মনুষ্য বাঁচিবে। নদীতে নৌকা চালাইব-মনুষ্যের বাণিজ্য বাঁচিবে। তৃণ লতা বৃক্ষাদির পুষ্টি করিব-পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বাঁচিবে। আমরা ক্ষুদ্র বৃষ্টিবিন্দু-আমাদের সমান কে? আমরাই সংসার রাখি।
তবে আয়, ডেকে ডেকে, হেঁকে হেঁকে, নবনীল কাদম্বিনী! বৃষ্টিকুলপ্রসূতি! আয় মা দিঙ্মণ্ডলব্যাপিনী ; সৌরতেজঃসংহারিণি! এসো এসো গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন কর, আমরা নামি! এসো ভগিনি সুচারুহাসিনি চঞ্চলে! বৃষ্টিকুলমুখ আলো কর! আমরা ডেকে ডেকে, হেসে হেসে, নেচে নেচে, ভূতলে নামি। তুমি বৃত্রমর্ম্মভেদী বজ্র, তুমিও ডাক না –এ উৎসবে তোমার মতো বাজান কে ? তুমিও ভূতেল পড়িবে? পড়, কিন্তু কেবল গর্ব্বোন্নতের মস্তকের উপর পড়িও। এই ক্ষুদ্র পরোপকারী শস্যমধ্যে পড়িও না-আমরা তাহাদের বাঁচাইতে যাইতেছি। ভাঙ্গ ত এই পর্ব্বতশৃঙ্গ ভাঙ্গ ; পোড়াও ত ঐ উচ্চ দেবালয়চূড়া পোড়াও। ক্ষুদ্রকে কিছু বলিও না-আমরা ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্রের জন্য আমাদের বড় ব্যথা।
দেখ, দেখ, আমাদের দেখিয়া আহ্লাদ দেখ! গাছপালা মাথা নাড়িতেছে-নদী দুলিতেছে, ধান্যক্ষেত্র মাথা নামাইয়া প্রণাম করিতেছে-চাষা চষিতেছে-ছেলে ভিজিতেছে-কেবল বেনে বউ আমসী ও আমসত্ত্ব লইয়া পলাইতেছে। মর্ পাপিষ্ঠা! দুই একখানা রেখে যা না-আমরা খাব। দে, মাগীর কাপড় ভিজিয়ে দে।
আমরা জাতিতে জল, কিন্তু রঙ্গরস জানি। লোকের চাল ফুটা করিয়া ঘরে উঁকি মারি-দম্পতির গৃহে ছাদ ফুটা করিয়া টু দিই। যে পথে সুন্দর বৌ জলের কলসী লইয়া যাইবে, সেই পথে পিছল করিয়া রাখি। মল্লিকার মধু লইয়া গিয়া, ভ্রমরের অন্ন মারি। মুড়ি মুড়কির দোকান দেখিলে প্রায় ফলার মাখিয়া দিয়া যাই। রামী চাকরাণী কাপড় শুকুতে দিলে, প্রায় তাহার কাজ বাড়াইয়া রাখি। ভণ্ড বামুনের জন্য আচমনীয় যাইতেছে দেখিলে, তাহার জাতি মারি। আমরা কি কম পাত্র! তোমরা সবাই বল-আমরা রসিক।
তা যাক্-আমাদের বল দেখ। দেখ, পর্ব্বতকন্দর, দেশ প্রদেশ ধুইয়া লইয়া, নূতন দেশ নির্ম্মান বিশীর্ণা সূত্রাকারা তটিনিকে কূলপ্লাবিনী দেশমজ্জিনী অনন্তদেহধারিণী অনন্ত তরঙ্গিণী জলরাক্ষসী করিব। কোন দেশের মানুষ রাখিব-কোন দেশের মানুষ মারিব-কত জাহাজ বহিব, কত জাহাজ ডুবাইব-পৃথিবী জলময় করিব-অথচ আমরা কি ক্ষুদ্র! আমাদের মত ক্ষুদ্র কে? আমাদের মত বলবান্ কে?
ভাই ভাই
(সমবেত বাঙ্গালিদিগের সভা দেখিয়া)
১
এক বঙ্গভূমে জনম সবার,
এক বিদ্যালয়ে জ্ঞানের সঞ্চার,
এক দুঃখে সবে করি হাহাকার,
ভাই ভাই সবে, কাঁদ রে ভাই।
এক শোকে শীর্ণ সবার শরীর,
এক শোকে বয় নয়নের নীর,
এক অপমানে সবে নতশির,
অধম বাঙ্গালি মোরা সবাই ||
২
নাহি ইতিবৃত্ত নাহিক গৌরব,
নাহি আশা কিছু নাহিক বৈভব,
বাঙ্গালির নামে করে ছিছি রব,
কোমল স্বভাব, কোমল দেহ।
কোমল করেতে ধর কমলিনী,
কোমল শয্যাতে, কোমল শিঞ্জিনী,
কোমল শরীর, কোমল যামিনী,
কোমল পিরীতি, কোমল স্নেহ ||
৩
শিখিয়াছ শুধু উচ্চ চীৎকার!
“ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!” সার
দেহি দেহি দেহ বল বার বার
না পেলে গালি দাও মিছামিছি।
দানের অযোগ্য চাও তবু দান,
মানের অযোগ্য রাখ তবু মান,
বাঁচিতে অযোগ্য রাখ তবু প্রাণ,
ছিছি ছিছি ছিছি!
ছি ছি ছি ছি।
৪
কার উপকার করেছ সংসারে?
কোন্ ইতিহাসে তব নাম করে?
কোন্ বৈজ্ঞানিক বাঙ্গালির ঘরে?
কোন্ রাজ্য তুমি করেছ জয়?
কোন্ রাজ্য তুমি শাসিয়াছ ভাল?
কোন্ মারাথনে ধরিয়াছ ঢাল?
এই বঙ্গভূমি এ কাল সে কাল
অরণ্য, অরণ্য অরণ্যময় ||
৫
কে মিলাল আজি এ চাঁদের হাট?
কে খুলিল আজি মনের কপাট?
পড়াইব আজি এ দুঃখের পাঠ,
শুন ছি ছি রব, বাঙ্গালি নামে,
য়ুরোপে মার্কিনে ছিছি ছিছি বলে,
শুন ছিছি ছিছি রব, হিমালয়তলে,
শুন ছিছি ছিছি রব, সমুদ্রের জলে,
স্বদেশে, বিদেশে, নগরে, গ্রামে ||
৬
কি কাজ বহিয়া এ ছার জীবনে,
কি কাজ রাখিয়া এ নাম ভুবনে,
কলঙ্ক থাকিতে কি ভয় মরণে?
চল সবে মরি পশিয়া জলে।
গলে গলে ধরি, চল সবে মরি,
সারি সারি সারি, চল সবে মরি,
শীতল সলিলে এ জ্বালা পাসরি,
লুকাই এ নাম সাগরতলে ||
মন এবং সুখ
মন এবং সুখ
১
এই মধুমাসে, মধুর বাতাসে,
শোন লো মধুর বাঁশী।
এই মধু বনে, শ্রীমধুসূদনে,
দেখ লো সকলে আসি ||
মধুর সে গায়, মধুর বাজায়,
মধুর মধুর ভাষে।
মধুর আদরে, মধুর অধরে,
মধুর মধুর হাসে ||
মধুর শ্যামল, বদন কমল,
মধুর চাহনি তায়। ।
কনক নূপুর, মধুকর যেন,
মধুর বাজিছে পায় ||
মধুর ইঙ্গিতে, আমার সঙ্গেতে,
কহিল মধুর বাণী।
সে অবধি চিতে, মাধুরি হেরিতে,
ধৈরয নাহিক মানি ||
এ সুখ রঙ্গেতে পর লো অঙ্গেতে
মধুর চিকণ বাস।
তুমি মধুফল, পর কানে দুল,
পরাও মনের আশ ||
গাঁথি মধুমালা, পর গোপবালা
হাস লো মধুর হাসি।
চল যথা বাজে, যমুনার কূলে,
শ্যামের মোহন বাঁশী ||
২
চল কথা বাজে, যমুনার কূলে
ধীরে ধীরে ধীরে বাঁশী।
ধীরে ধীরে যথা, উঠিছে চাঁদনি,
স্থল জল পরকাশি ||
ধীরে ধীরে রাই, চল ধীরে যাই,
ধীরে ধীরে ফেল পদ।
ধীরে ধীরে শুন, নাদিছে যমুনা,
কল কল গদ গদ ||
ধীরে ধীরে জলে, রাজহংস চলে,
ধীরে ধীরে ভাসে ফুল।
ধীরে ধীরে বায়ু, বহিছে কাননে
দোলায়ে আমার দুল ||
ধীরে যাবি তথা, ধীরে কবি কথা
রাখিবি দোহার মান।
ধীরে ধীরে তার বাঁশীটি কাড়িবি,
ধীরেতে পূরিবি তান ||
ধীরে শ্যাম নাম, বাঁশীতে বলিবি,
শুনিবে কেমন বাজে।
ধীরে ধীরে চূড়া কাড়িয়ে পরিবি,
দেখিব কেমন সাজে ||
ধীরে বনমালা, গলাতে দোলাবি,
দেখিব কেমন দোলে।
ধীরে ধীরে তার, মন করি চুরি,
লইয়া আসিবি চলে ||
৩
শুন মোর মন মধুরে মধুরে,
জীবন করহ সায়।
ধীরে ধীরে ধীরে, সরল সুপথে,
নিজ গতি রেখ তায় ||
এ সংসার ব্রজ, কৃষ্ণ তাহে সুখ,
মন তুমি ব্রজনারী।
নিতি নিতি তার, বংশীরব শুনি,
হতে চাও অভিসারী ||
যাও যাবে মন, কিন্তু দেখ যেন,
একাকী যেও না রঙ্গে।
মাধুর্য্য ধৈরয, সহচরী দুই,
রেখ আপনার সঙ্গে ||
ধীরে ধীরে ধীরে, কাল নদীতীরে,
ধরম কদম্ব তলে।
মধুর সুন্দর, সুখ নটবর,
ভজ মন কুতূহলে ||
মেঘ
আমি বৃষ্টি করিব না। কেন বৃষ্টি করিব? বৃষ্টি করিয়া আমার কি সুখ? বৃষ্টি করিলে তোমাদের সুখ আছে। তোমাদের সুখে আমার প্রয়োজন কি?
দেখ, আমার কি যন্ত্রণা নাই? এই দারুণ বিদ্যুদগ্নি আমি অহরহ হৃদয়ে ধারণ করিতেছি। আমার হৃদয়ে সেই সুহাসিনীর উদয় দেখিয়া তোমাদের চক্ষু আনন্দিত হয়, কিন্তু ইহার স্পর্শ মাত্রে তোমরা দগ্ধ হও। সেই অগ্নি আমি হৃদয়ে ধরি! আমি ভিন্ন কাহার সাধ্য এ আগুন হৃদয়ে ধরে?
দেখ, বায়ু আমাকে সর্ব্বদা অস্থির করিতেছে। বায়ু, দিগ্বিদিক্ বোধ নাই, সকল দিক্ হইতে বহিতেছে। আমি যাই জলভারগুরু, তাই বায়ু আমাকে উড়াইতে পারে না।
তোমরা ভয় করিও না, আমি এখনই বৃষ্টি করিতেছি-পৃথিবী শস্যশালিনী হইবে। আমার পূজা দিও।
আমার গর্জ্জন অতি ভয়ানক-তোমরা ভয় পাইও না। আমি যখন মন্দগম্ভীর গর্জ্জন করি, বৃক্ষপত্র সকল কম্পিত হইয়া, শিখিকুলকে নাচাইয়া, মৃদু গম্ভীর গর্জ্জন করি, তখন ইন্দ্রের হৃদয়ে মন্দারমালা দুলিয়া উঠে, নন্দসূনুশীর্ষকে শিখিপুচ্ছ কাঁপিয়া উঠে, পর্ব্বত-গুহায় মুখরা প্রতিধ্বনি হাসিয়া উঠে। আর বৃত্রনিপাতকালে, বজ্রসহায় হইয়া যে গর্জ্জন করিয়াছিলাম, সে গর্জ্জন শুনিতে চাহিও না-ভয় পাইবে।
বৃষ্টি করিব বৈ কি? দেখ, কত নবযূথিকা-দাম আমার জলকণার আশায় ঊর্দ্ধমুখী হইয়া আছে। তাহাদিগের শুভ্র, সুবাসিত বদনমণ্ডলে স্বচ্ছ বারিনিষেক, আমি না করিলে কে করে?
বৃষ্টি করিব বৈ কি? দেখ, তটিনীকুলের দেহের এখনও পুষ্টি হয় নাই। তাহারা যে আমার প্রেরিত বারিরাশি প্রাপ্ত হইয়া, পরিপূর্ণ হৃদয়ে হাসিয়া হাসিয়া, নাচিয়া নাচিয়া, কল কল শব্দে উভয় কূল প্রতিহত করিয়া, অনন্ত সাগরাভিমুখে ধাবিত হইতেছে, ইহা দেখিয়া কাহার না বর্ষিতে সাধ করে?
আমি বৃষ্টি করিব না। দেখ, ঐ পাপিষ্ঠা স্ত্রীলোক, আমারই প্রেরিত বারি, নদী হইতে কলসী পূরিয়া তুলিয়া লইয়া যাইতেছে, এবং “পোড়া দেবতা একটু ধরণ কর না” বলিয়া আমাকেই গালি দিতেছে। আমি বৃষ্টি করিব না।
দেখ, কৃষকের ঘরে জল পড়িতেছে বলিয়া আমায় গালি দিতেছে। নহিলে সে কৃষক কেন? আমার জল না পাইলে তাহার চাষ হইত না-আমি তাহার জীবনদাতা। ভদ্র, আমি বৃষ্টি করিব না।
সেই কথাটি মনে পড়িল,
মন্দং মন্দং পবনশ্চানুকূলো যথা ত্বাং
বামশ্চায়ং নদতি মধুরশ্চাতকস্তে সগর্ব্বঃ।
কালিদাসাদি যেখানে আমার স্তাবক, সেখানে আমি বৃষ্টি করিব না কেন?
আমার ভাষা শেলি বুঝিয়াছিল। যখন বলি, I bring fresh showers for the thirsting flowers, তখন সে গম্ভীরা বাণীর মর্ম্ম শেলি নহিলে কে বুঝিবে? কেন জান? সে আমার মত হৃদয়ে বিদ্যুদগ্নি বহে। প্রতিভাই তাহার বিদ্যুৎ।
আমি অতি ভয়ঙ্কর। যখন অন্ধকারে কৃষ্ণকরাল রূপ ধারণ করি, তখন আমার ভ্রূকুটি কে সহিতে পারে? এই আমার হৃদয়ে কালাগ্নি বিদ্যুৎ তখন পলকে পলকে ঝলসিতে থাকে। আমার নিঃশ্বাসে, স্থাবর জঙ্গম উড়িতে থাকে, আমার রবে ব্রহ্মাণ্ড কম্পিত হয়।
আবার আমি কেমন মনোরম! যখন পশ্চিম-গগনে, সন্ধ্যাকালে লোহিতভাস্কারঙ্কে বিহার করিয়া স্বর্ণতরঙ্গের উপর স্বর্ণতরঙ্গ বিক্ষিপ্ত করি, তখন কে না আমায় দেখিয়া ভূলে? জ্যোৎস্না-পরিপ্লুত আকাশে মন্দ পবনে আরোহণ করিয়া কেমন মনোহর মূর্ত্তি ধরিয়া আমি বিচরণ করি। শুন পৃথিবীবাসীগণ! আমি বড় সুন্দর, তোমরা আমাকে সুন্দর বলিও।
আর একটা কথা আছে, তাহা বলা হইলেই আমি বৃষ্টি করিতে যাই। পৃথিবীতলে একটি পরম গুণবতী কামিনী আছে, সে আমার মনোহরণ করিয়াছে। সে পর্ব্বত-গুহায় বাস করে, তাহার নাম প্রতিধ্বনি। আমার সাড়া পাইলেই সে আসিয়া আমার সঙ্গে আলাপ করে। বোধ হয়, আমায় ভাল বাসে। আমিও তাহার আলাপে মুগ্ধ হইয়াছি। তোমরা কেহ সম্বন্ধ করিয়া আমার সঙ্গে তাহার বিবাহ দিতে পার?
রাজার উপর রাজা
গাছ পুঁতিলাম ফলের আশায়,
পেলাম কেবল কাঁটা।
সুখের আশায় বিবাহ করিলাম
পেলাম কেবল ঝাঁটা ||
বাসের জন্য ঘর করিলাম
ঘর গেল পুড়ে।
বুড়ো বয়সের জন্য পুঁজি করিলাম
সব গেল উড়ে ||
চাকুরির জন্যে বিদ্যা করিলাম,
ঘটিল উমেদারি।
যশের জন্য কীর্ত্তি করিলাম,
ঘটিল টিটকারী ||
সুদের জন্য কর্জ্জ দিলাম,
আসল গেল মারা।
প্রীতির জন্য প্রাণ দিলাম,
শেষে কেঁদে সারা ||
ধানের জন্য মাঠ চষিলাম,
হলো খড় কুটো ||
পারের জন্য নৌকা করিলাম,
নৌকা হলো ফুটো ||
লাভের জন্য ব্যবসা করিলাম,
সব লহনা বাকি।
সেটাম দিয়া আদালত করিলাম,
ডিক্রীর বেলায় ফাঁকি ||
তবে আর কেন ভাই, বেড়াও ঘুরে,
বেড়ে ভবের হাট।
ঘূর্ণী জলে নৌকা যেমন, ঝড়ের কুটো,
জ্বলন্ত আগুনের কাঠ ||
মুখে বল হরিনাম ভাই,
হৃদে ভাব হরি!
এ ব্যবসায় লোকসান নেই ভাই,
এসো লাভে ঘর ভরি ||
এ গুণেতে শত লাভ,
শত গুণে হাজার।
হাজারেতে লক্ষ লাভ,
ভারি ফলাও কারবার ||
ভাই বল হরি, হরি বোল,
ভাঙ্গ ভবের হাট!
রাজার উপর হওগে রাজা
লাট সাহেবের লাট ||
সংযুক্তা
১। স্বপ্ন
১
নিশীথে শুইয়া, রজত পালঙ্কে
পুষ্পগন্ধি শির, রাখি রামা অঙ্কে,
দেখিয়া স্বপন, শিহরে সশঙ্কে,
মহিষীর কোলে, শিহরে রায়।
চমকি সুন্দরী, নৃপে জাগাইল,
বলে প্রাণনাথ, এ বা কি হইল,
লক্ষ যোধ রণে, যে না চমকিল
মহিষীর কোলে সে ভয় পায়!
২
উঠিয়া নৃপতি কহে মৃদু বাণী
যে দেখিনু স্বপন, শিহরে পরাণি,
স্বর্গীয়া জননী চৌহনের রাণী
বন্য হস্তী তাঁরে মারিতে ধায়।
ভয়ে ভীত প্রায় রাজেন্দ্রঘরণী
আমার নিকটে আসিল অমনি
বলে পুত্র রাখ, মরিল জননী
বন্যহস্তি-শূণ্ডে প্রাণ বা যায় ||
৩
ধরি ভীম গদা মারি হস্তিতুণ্ডে
না মানিল গদা, বাড়াইয়া শূণ্ডে
জননীকে ধরি, উঠাইলে মুণ্ডে;
পড়িয়া ভূমেতে বধিল প্রাণ।
কুস্বপন আজি দেখিলাম রাণি,
কি আছে বিপদ কপালে না জানি
মত্ত হস্তী আসি বধে রাজেন্দ্রাণী
আমি পুত্র নারি করিতে ত্রাণ ||
৪
শুনিয়াছি নাকি তুরস্কের দল
আসিতেছে হেথা, লঙ্ঘি হিমাচল
কি হইবে রণে, ভাবি অমঙ্গল,
বুঝি এ সামান্য স্বপন নয়।
জননীরূপেতে বুঝি বা স্বদেশ
বুঝি বা তুরস্ক মত্ত হস্তী বেশ,
বার বার বুঝি এইবার শেষ!
পৃথ্বীরাজ নাম বুঝি না রয় ||
৫
শুনি পতিবাণী যুড়ি দুই পাণি
জয় জয় জয়! বলে রাজরাণী
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজের জয়-
জয় জয় জয়! বলিল বামা।
কার সাধ্য তোমা করে পরাভব
ইন্দ্র চন্দ্র যম বরুণ বাসব।
কোথাকার ছার তুরষ্ক পহ্লব
জয় পৃথ্বীরাজ প্রথিতনামা ||
৬
আসে আসুক না পাঠান পামর,
আসে আসুক না আরবি বানর,
আসে আসুক না নর না অমর।
কার সাধ্য তব শকতি সয়?
পৃথ্বীরাজ সেনা অনন্ত মণ্ডল
পৃথ্বীরাজভূজে অবিজিত বল
অক্ষয় ও শিরে কিরীট কুণ্ডল
জয় জয় পৃথ্বীরাজের জয় ||
৭
এত বলি বামা দিল করতালি
দিল করতালি গৌরবে উছলি,
ভূষণে শিঞ্জিনী, নয়নে বিজলি
দেখিয়া হাসিল ভরতপতি।
সহসা কঙ্কণে লাগিল কঙ্কণ,
আঘাতে ভাঙ্গিয়া খসিল ভূষণ,
নাচিয়া উঠিল দক্ষিণ নয়ন,
কবি বলে তালি না দিও সতি ||
২। রণসজ্জা।
১
রণসাজে সাজে চৌহানের বল,
অশ্ব গজ রথ পদাতির দল,
পতাকার রবে, পবন চঞ্চল,
বাজিল বাজনা-ভীষণ নাদ।
ধূলিতে পূরিল গগনমণ্ডল,
ধূলিতে পূরিল যমুনার জল,
ধূলিতে পূরিল অলক কুন্তল,
যথা কূলনারী গণে প্রমাদ ||
২
দেশ দেশ হতে এলো রাজগণ
স্থানেশ্বর পদে বধিতে যবন
সঙ্গে চতুরঙ্গ সেনা অগণন-
হর হর বলে যতেক বীর।
মদবার2 হতে আইল সমর3
আবু হতে এলো দুরন্ত প্রমর
আর্য্য বীরদল ডাকে হর! হর!
উছলে কাঁপিয়া কালিন্দী-নীর ||
৩
গ্রীবা বাঁকাইয়া চলিল তুরঙ্গ
শূণ্ড আছাড়িয়া চলিল মাতঙ্গ
ধনু আস্ফালিয়া- শুনিতে আতঙ্গ-
দলে দলে দলে পদাতি চলে।
বসি বাতায়নে কনৌজনন্দিনী
দেখিলা অদূরে চলিছে বাহিনী
ভারত ভরসা, ধরম রক্ষিণী-
ভাসিলা সুন্দরী নয়নজলে ||
৪
সহসা পশ্চাতে দেখিল স্বামীরে,
মুছিলা অঞ্চলে নয়নের নীরে,
যুড়ি দুই কর বলে “হেন বীরে
রণসাজে আমি সাজাব আজ।”
পরাইল ধনী কবচকুণ্ডল
মুকতার দাম বক্ষে ঝলমল
ঝলসিল রত্ন কিরীট মণ্ডল
ধনু হস্তে হাসে রাজেন্দ্ররাজ ||
৫
সাজাইয়া নাথে যোড় করি পাণি
ভারতের রাণী কহে মৃদু বাণী
“সুখী প্রাণেশ্বর তোমায় বাখানি
এ বাহিনীপতি চলিলা রণে।
লক্ষ যোধ প্রভু তব আজ্ঞাকারী,
এ রণসাগরে তুমি হে কাণ্ডারী
মথিবে সে সিন্ধু নিয়তি প্রহারি
সেনার তরঙ্গ তরঙ্গসনে ||
৬
আমি অভাগিনী জনমি কামিনী
অবরোধে আজি রহিনু বন্দিনী
না হতে পেলাম তোমার সঙ্গিনী,
অর্দ্ধাঙ্গ হইয়া রহিনু পাছে।
যবে পশি তুমি সমর-সাগরে
খেদাইবে দূরে ঘোরির বানরে
না পাব দেখিতে, দেখিবে ত পরে,
তব বীরপনা! না রব কাছে ||
৭
সাধ প্রাণনাথ সাধ নিজ কাজ
তুমি পৃথ্বীপতি মহা মহারাজ
হানি শত্রুশিরে বাসবের বাজ
ভারতের বীর আইস ফিরে।
নহে যদি শম্ভু হয়েন নির্দ্দয়
যদি হয় রণে পাঠানের জয়
না আসিও ফিরে,- দেহ যেন বয়
রণক্ষেত্রে ভাসি শত্রুরুধিরে ||
৮
কত সুখ প্রভু, ভুঞ্জিলে জীবনে!
কি সাধ বা বাকি এ তিন ভূবনে?
নয় গেল প্রাণ, ধর্ম্মের কারণে?
চিরদিন রহে জীবন কার?
যুগে যুগে নাথ ঘোষিবে সে যশ
গৌরবে পূরিত হবে দিক্ দশ
এ কান্ত শরীর এ নব বয়স
স্বর্গ গিয়ে প্রভু পাবে আবার ||
৯
করিলাম পণ শুন হে রাজন
নাশিয়া ঘোরীরে, জিতি এই রণ
নাহি যতক্ষণ কর আগমণ,
না খাব কিছু, না করিব পান।
জয় জয় বীর জয় পৃথ্বীরাজ,
লভ পূর্ণ জয় সমরেতে আজ
যুগে যুগে প্রভু ঘোষিবে এ কাজ
হর হর শম্ভো কর কল্যাণ ||
১০
হর হর হর! বম্ বম্ কালী!
বম্ বম্ বলি রাজার দুলালি,
করতালি দিল- দিল করতালি
রাজরাজপতি ফুল্ল হৃদয়।
ডাকো বামা জয় জয় পৃথ্বীরাজ
জয় জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ-
জয় জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ
কর, দুর্গে, পৃথ্বীরাজের জয় ||
১১
প্রসারিয়া রাজ মহা ভূজদ্বয়ে,
কমনীয় বপু, ধরিল হৃদয়ে,
পড়ে অশ্রুধারা চারি গণ্ড বয়ে,
চুম্বিল সুবাহু চন্দ্রবদনে।
স্মরি ইষ্টদেবে বাহিরিল বীর,
মহাগজপৃষ্ঠে শোভিল শরীর
মহিষীর চক্ষে বহে ঘন নীর।
যে জানে এতই জল নয়নে।
১২
লুটাইয়া পড়ি ধরণীর তলে
তবু চন্দ্রাননী জয় জয় বলে
জয় জয় বলে- নয়নের জলে
জয় জয় কথা না পায় ঠাই।
কবি বলে মাতা মিছে গাও জয়
কাঁদ যতক্ষণ দেহ প্রাণ রয়,
ও কান্না রহিবে এ ভারতময়
আজিও আমরা কাঁদি সবাই ||
৩। চিতারোহণ
১
কত দিন রাত পড়ে রহে রাণী
না খাইল অন্ন না খাইল পানি
কি হইল রণে কিছুই না জানি,
মুখে বলে পৃথ্বীরাজের জয়।
হেন কালে দূত আসিল দিল্লীতে
রোদন উঠিল পল্লীতে পল্লীতে-
কেহ নারে কারে ফুটিয়া বলিতে,
হায় হায় শব্দ ফাটে হৃদয়!
২মহারবে যেন সাগর উছলে
উঠিল রোদন ভারতমণ্ডলে
ভারতের রবি গেল অস্তাচলে
প্রাণ ত গেলই, গেল যে মান।
আসিছে যবন সামাল সামাল
আর যোদ্ধা নাই সে ধরিবে ঢাল?
পৃথ্বীরাজ বীরে হরিয়াছে কাল,
এ ঘোর বিপদে কে করে ত্রাণ ||
৩
ভূমিশয্যা ত্যজি উঠে চন্দ্রানী,
সখীজনে ডাকি বলিল তখনি,
সম্মুখ সমরে বীরশিরোমণি
গিয়াছে চলিয়া অনন্ত স্বর্গে।
আমি যাইব সেই স্বর্গপুরে,
বৈকুণ্ঠেতে গিয়া পূজিব প্রভুরে,
পূরাও রে সাধ; দুঃখ যাক দূরে,
সাজা মোর চিতা সজনীবর্গে ||
৪
যে বীর পড়িল সম্মুখ সমরে
অনন্ত মহিমা তার চরাচরে
সে নহে বিজিত; অপ্সরে কিন্নরে,
গায়িতেছে তাহার অনন্ত জয়।
বল সখি সবে জয় জয় বল,
জয় জয় বলি চড়ি গিয়া চল
জ্বলন্ত চিতার প্রচণ্ড অনল,
বল জয় পৃথ্বীরাজের জয় ||
৫
চন্দনের কাষ্ঠ এলো রাশি রাশি
কুসুমের হার যোগাইল দাসী
রতন ভূষণ কর পরে হাসি
বলে যাব আজি প্রভুর পাশে।
আয় আয় সখি, চড়ি চিতানলে
কি হবে রহিয়ে ভারতমণ্ডলে?
আয় আয় সখি যাইব সকলে
যথা প্রভু মোর বৈকুণ্ঠবাসে ||
৬
আরোহিলা চিতা কামিনীর দল
চন্দনের কাষ্ঠে জ্বলিল অনল
সুগন্ধে পূরিল গগনমণ্ডল-
মধুর মধুর সংযুক্তা হাসে।
বলে সবে বল পৃথ্বীরাজ জয়
জয় জয় জয় পৃথ্বীরাজ জয়
করি জয়ধ্বনি সঙ্গে সখীচয়
চলি গেলা সতী বৈকুণ্ঠবাসে ||
৭
কবি বলে মাতা কি কাজ করিলে
সন্তানে ফেলিয়া নিজে পলাইলে,
এ চিতা অনল কেন বা জ্বালিলে,
ভারতের চিতা, পাঠান ডরে।
সেই চিতানল, দেখিল সকলে
আর না নিবিল ভারতমণ্ডলে
দহিল ভারত তেমনি অনলে
শতাব্দী শতাব্দী শতাব্দী পরে ||
======================
1 পৃথ্বীরাজের মহিষী-কান্যকুব্জরাজার কন্যা। টডকৃত রাজস্থানের সংযুক্তার বৃত্তান্ত দেখ।
2 মেবার।
3 সমর সিংহ।
সাবিত্রী
১
তমিস্রা রজনী ব্যাপিল ধরণী,
দেখি মনে মনে পরমাদ গণি,
বনে একাকিনী বসিলা রমণী
কোলেতে করিয়া স্বামীর দেহ।
আঁধার গগন ভুবন আঁধার,
অন্ধকার গিরি বিকট আকার
দুর্গম কান্তার ঘোর অন্ধকার,
চলে না ফেরে না নড়ে না কেহ ||
২
কে শুনেছে হেথা মানবের রব?
কেবল গরজে হিংস্র পশু সব,
কখন খসিছে বৃক্ষের পল্লব,
কখন বসিছে পাখী শাখায়।
ভয়েতে সুন্দরী বনে একেশ্বরী,
কোলে আরও টানে পতিদেহ ধরি,
পরশে অধর অনুভব করি,
নীরবে কাঁদিয়া চুম্বিছে তায় ||
৩
হেরে আচম্বিতে এ ঘোর সঙ্কটে,
ভয়ঙ্কর ছায়া আকাশের পটে,
ছিল যত তারা তাহার নিকটে
ক্রমে ম্লান হয়ে গেল নিবিয়া।
সে ছায়া পশিল কাননে,-অমনি,
পলায় শ্বাপদ উঠে পদধ্বনি,
বৃক্ষশাখা কত ভাঙ্গিল আপনি,
সতী ধরে শবে বুকে আঁটিয়া ||
৪
সহসা উজলি ঘোর বনস্থলী,
মহাগদাপ্রভা, যেন বা বিজলী,
দেখিয়া সাবিত্রী যেন রত্নাবলী,
ভাসিল নিঝরে আলোক তার।
মহাগদা দেখি প্রণমিলা সতী,
জানিল কৃতান্ত পরলোকপতি,
এ ভীষণা ছায়া তাঁহারই মূরতি,
ভাগ্যে যাহা থাকে হবে এবার ||
৫
গভীর নিস্বনে কহিলা শমন,
থর থর করি কাঁপিল গহন,
পর্ব্বতগহ্বরে ধ্বনিল বচন,
চমকিল পশু বিবর মাঝে।
“কেন একাকিনী মানবনন্দিনী,
শব লয়ে কোলে যাপিছ যামিনী,
ছাড়ি দেহ শবে ; তুমি ত অধীনী,
মম অঙ্গে তব বাদ কি সাজে ||”
৬
“এ সংসারে কাল বিরামহীন,
নিয়মের রথে ফিরে রাত্রি দিন,
যাহারে পরশে সে মম অধীন,
স্থাবর জঙ্গম জীব সবাই।
সত্যবানে আসি কাল পরশিল,
লতে তারে মম কিঙ্কর আসিল,
সাধ্বী অঙ্গ ছুঁয়ে লইতে নারিল,
আপনি লইতে এসেছি তাই ||”
৭
সব হলো বৃথা না শুনিল কথা,
না ছাড়ে সাবিত্রী শবের মমতা,
নারে পরশিতে সাধ্বী পতিব্রতা,
অধর্ম্মের ভয়ে ধর্ম্মের পতি।
তখন কৃতান্ত কহে আর বার,
“অনিত্য জানিও এ ছার সংসার,
স্বামী পুত্র বন্ধু নহে কেহ কার,
আমার আলয়ে সবার গতি ||
৮
“রত্নছত্র শিরে রত্নভূষা অঙ্গে,
রত্নাসনে বসি মহিষীর সঙ্গে,
ভাসে মহারাজা সুখের তরঙ্গে,
আঁধারিয়া রাজ্য লই তাহারে।
বীরদর্প ভাঙ্গি লই মহাবীরে,
রূপ নষ্ট করি লই রূপসীরে,
জ্ঞান লোপ করি গরাসি জ্ঞানীরে,
সুখ আছে শুধু মম আগারে ||
৯
“অনিত্য সংসার পুণ্য কর সার,
কর নিজ কর্ম্ম নিয়ত যে যার,
দেহান্তে সবার হইবে বিচার,
দিই আমি সবে করমফল।
যত দিন সতী তব আয়ু আছে,
করি পুণ্য কর্ম্ম এসো স্বামী পাছে-
অনন্ত যুগান্ত রবে কাছে কাছে,
ভুজিবে অনন্ত মহা মঙ্গল ||
১০
“অনন্ত বসন্তে তথা অনন্ত যৌবন,
অনন্ত প্রণয়ে তথা অনন্ত মিলন,
অনন্ত সৌন্দর্য্যে হয় অনন্ত দর্শন,
অনন্ত বাসনা, তৃপ্তি অনন্ত।
দম্পতি আছয়ে, নাহি বৈধব্য-ঘটনা,
মিলন আছয়ে, নাহি বিচ্ছেদযন্ত্রণা,
প্রণয় আছয়ে, নাহি কলহ গঞ্জনা,
রূপ আছে, নাহি রিপু দুরন্ত ||
১১
“রবি তথা আলো করে, না করে দাহন,
নিশি স্নিগ্ধকরী, নহে তিমির কারণ,
মৃদু গন্ধবহ ভিন্ন নাহিক পবন,
কলা নাহি চাঁদে, নাহি কলঙ্ক।
নাহিক কণ্টক তথা কুসুম রতনে,
নাহিক তরঙ্গ স্বচ্ছ কল্লোলিনীগণে,
নাহিক অশনি তথা সুবর্ণের ঘনে,
পঙ্কজ সরসে নাহিক পঙ্ক ||”
১২
“নাহি তথা মায়াবশে বৃথায় রোদন,
নাহি তথা ভ্রান্তিবশে বৃথায় মনন,
নাহি তথা রিপুবশে বৃথায় যতন,
নাহি শ্রমলেশ, নাহি অলস।
ক্ষুধা তৃষ্ণা তন্দ্রা নিদ্রা শরীরে না রয়,
নারী তথা প্রণয়িনী বিলাসিনী নয়,
দেবের কৃপায় দিব্য জ্ঞানের উদয়,
দিব্য নেত্রে নিরখে দিক্ দশ ||”
১৩
“জগতে জগতে দেখে পরামাণুরাশি
মিলিছে ভাঙ্গিছে পুনঃ ঘুরিতেছে আসি,
লক্ষ লক্ষ বিশ্ব গড়ি ফেলিছে বিনাশি,
অচিন্ত্য অনন্ত কালতরঙ্গে।
দেখে লক্ষ কোটী ভানু অনন্ত গগনে,
বেড়ি তাহে কোটী কোটী ফিরে গ্রহগণে,
অনন্ত বর্ত্তন রব শুনেছি শ্রবণে,
মাতিছে চিত্ত সে গীতের সঙ্গে ||
১৪
“দেখে কর্ম্মক্ষেত্রে নয় কত দলে দলে,
নিয়মের জালে বাঁধা ঘুরিছে সকলে,
ভ্রমে পিপীলিকা যেন নেমীর মণ্ডলে,
নির্দ্দিষ্ট দূরতা লঙ্ঘিতে নারে।
ক্ষণকাল তবে সবে ভবে দেখা দিয়া,
জলে যেন জলবিম্ব যেতেছে মিশিয়া,
পুণ্যবলে পুণ্যধামে মিলিছে আসিয়া,
পুণ্যই সত্য অসত্য সংসার ||
১৫
“তাই বলি কন্যে, ছাড়ি দেহ মায়া,
ত্যজ বৃথা ক্ষোভ ; ত্যজ পতিকায়া,
ধর্ম্ম আচরণে হও তার জায়া,
গিয়া পুণ্যধাম।
গৃহে যাও ত্যজি কানন বিশাল
থাক যত দিন পরশে কাল,
কালের পরশে মিটিবে জঞ্জাল,
সিদ্ধ হবে কাম ||”
১৬
শুনি যমবাণী জোড় করি পাণি,
ছাড়ি দিয়া শবে, তুলি মুখখানি
ডাকিছে সাবিত্রী ;- কোথায় না জানি,
কোথা ওহে কাল।
দেখা দিয়া রাখ এ দাসীর প্রাণ,
কোথায় গেলে পাব কালের সন্ধান,
পরশিয়ে কর এ সঙ্কটে ত্রাণ,
মিটাও জঞ্জাল ||
১৭
“স্বামীপদ যদি সেবে থাকি আমি,
কায় মনে যদি পূজে থাকি স্বামী,
যদি থাকে বিশ্বে কেহ অন্তর্য্যামী,
রাখ মোর কথা।
সতীত্বে যদ্যপি থাকে পুণ্যফল,
সতীত্বে যদ্যপি থাকে কোন বল,
পরশি আমারে, দিয়ে পদে স্থল,
জুড়াও এ ব্যথা ||”
১৮
নিয়মের রথ ঘোষিল ভীষণ,
আসি প্রবেশিল সে ভীম কানন,
পরশিল কাল সতীত্ব রতন,
সাবিত্রী সুন্দরী।
মহাগদা তবে চমকে তিমিরে,
শবপদরেণু তুলি লয়ে শিরে,
ত্যজে প্রাণ সতী অতি ধীরে ধীরে
পতি কোলে করি ||
১৯
বরষিল পুষ্প অমরের দলে,
সুগন্ধি পবন বহিল ভূতলে,
তুলিল কৃতান্ত শরীরিযুগলে,
বিচিত্র বিমানে।
জনমিল তথা দিব্য তরুবর,
সুগন্ধি কুসুমে শোভে নিরন্তর,
বেড়িল তাহাতে লতা মনোহর,
সে বিজন স্থানে ||
চিঠিপত্র
অসম্পূর্ণ নাটক
অসম্পূর্ণ নাটক
DRAMATIS PERSONÆ
রামধন—
রামকৃষ্ণ—
কলাবতী—
দিবা—
নিশা—
প্রথম অঙ্ক
SCENE I
প্রতাপনগরের রাজবর্ত্ম
রামধন—রামকৃষ্ণ।
রামধন। কিসের এত গোল। [নেপথ্যে বহুলোকে “জয় জয় কলাবতী”] ও কিসের জয়ধ্বনি। রামকৃষ্ণ। জান না রাণী কলাবতী স্নান করিয়া যাইতেছেন। রামধন। রাণী স্নান করিয়া যাইতেছেন, তার এত জয়ধ্বনি কেন? [নেপথ্যে “জয় জয় রাণীজিকি জয়”] ঐ শুন। রামকৃষ্ণ। তুমি বিদেশী তাই অবাক হইতেছ। রাণী কলাবতীকে এ নগরের লোক ভক্তি করে। বড়ই ভালবাসে। রামধন। কেন রাণীর কিছু বিশেষ গুণ আছে? রামকৃষ্ণ। তা আছে—রাণী অতিশয় দান-শীলা আর বড় প্রজাবৎসলা। যার যে দুঃখ থাকে, রাণীকে জানাইতে পারিলেই—হইল—তার দুঃখ ঘুচিবে। [নেপথ্যে “জয় জয় মা মা কলাবতীর জয়”] ঐ শোন সকলেই রাণীকে মা বলিতেছে, তিনি প্রজামাত্রেরই মা’র মত। তাঁর গুণেই এখানকার প্রজারা এত সুখী। রামধন। বটে! তবে রাজার এত সুখ্যাতি কেন? রামকৃষ্ণ। রাণীর গুণে। রামধন। তাঁহাকে দেখিতে পাওয়া যায়? তিনি কি প্রাচীনা। রামকৃষ্ণ। না তিনি বড় অল্পবয়স্কা তবে সকলের মা বলিয়া সকলকেই দেখা দেন। চল না আমরা মাতৃ-দর্শনে যাই। রাম। চল।
[উভয়ে নিষ্ক্রান্ত]
SCENE II
রাজার অন্তঃপুর
রাজা রাজেন্দ্র একা।
রাজা। কে না জানে আকাশে মেঘ উঠে? মেঘ-উঠে মেঘ ছাড়ে। এ মেঘও উড়িয়া যাইবে —তবে কেন এত চিন্তা করি?মনে করিয়াছিলাম এ নির্মল আকাশে কখনও বুঝি মেঘ উঠিবে না, আমি মূর্খ তাই এত ভাবি। হায়! কোথা হইতে আবার এ প্রবল শত্রু দেখা দিল? (কলাবতীর সজ্জিতা সখীদিগের প্রবেশ) তোরা কেন গো? এত সাজ গোজ যে। দিবা। আমরা নাচব। রাজা। খামকা নাচবে কেন গো? নিশা। রাণী কলাবতীর হুকুম [নৃত্য আরম্ভ]* রাজা। কেন নাচের হুকুম কেন? দিবা। আগে নাচি। [নৃত্য] রাজা। আগে বল্। নিশা। আগে নাচি। রাজা। আ মর! তোর পা যে থামে না—জোর করে নেচে যাবি নাকি—আমি দেখব না—এই চোক বুজিলাম।
[চোখ বুজিয়া]
দিবা। দেখুন মহারাজ! আপনাকে মুখ ভেঙ্গাচ্চে। নিশা। দেখুন মহারাজ, আপনাকে কলা দেখাচ্চে। রাজা। মরগে যা তোরা! আমি চোক চাব না। নিশা। আচ্ছা কান তো খোলা আছে। (করতালি দিয়া গীত) নয়ন মুদিয়া, দেখিনু সজনী, কানুর কুটিল রূপ। গলেতে বাঁধিয়া পিরীতি কলসী সাগরে দিনু যে ডুব রাজা। শুনবো না (কর্ণে হস্তার্পণ) দিবা। তবে ফুলের ঘ্রাণ নিন। (কবরী হইতে পুষ্প লইয়া রাজার নাসিকার নিকট ধারণ) রাজা। নিঃশ্বাস বন্ধ করিলাম। নিশা। চক্ষু কর্ণ নাসিকা বন্ধ। রসনা বাকি আছে—চল ভাই রান্না মহলে খবর দিই। রাজা। মুখ বুজিয়া থাকিব। নিশা। তবে বড় মা ঠাকুরাণীকে ডেকে দিই রাজা। কেন সে ভয়ঙ্কর ব্যাপার কেন? নিশা। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে আপনার বাকি আছে পিটের চামড়া। (কলাবতীর প্রবেশ) কলা। আ মলো, তোরা বড় বাড়ালি দূর হ!
[সখীদ্বয় নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। দেখ ত কলাবতী তোমার লোকজন আমায় কিছু মানে না আমার উপর বড় অত্যাচার করে! কলা। কি অত্যাচার করেছে মহারাজ? একটু হাসিয়েছে? সেটা আমারই অপরাধ। তোমার মুখে কয়দিন হাসি দেখি নাই বলিয়া আমি ওদের পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। রাজা। আমার মাথায় পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে—আমি হাসিব কি? কলা। কি পাহাড় মহারাজ! আমায় ত কিছু বল নাই। যা ইচ্ছা করিয়া বল না—তা সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করি নাই। কি পাহাড় মহারাজ! পড়িলে তোমার একার ঘাড়ে পড়িবে না। রাজা। পাহাড় আর কিছু নয়—খোদ দিল্লীশ্বর ঔরঙ্জেব।এই ক্ষুদ্র রাজ্যের উপর নজর পড়িয়াছে, বাদশাহের যাহাতে নজর পড়ে তাহা তিনি না লইয়া ছাড়েন না। কলা। এ সম্বাদ কোথা পাইলেন? রাজা। আত্মীয়লোকে দূতমুখে বলিয়া পাঠাইয়াছে। বিশেষ, ঢাকায় সুবাদার অনেক সৈন্য জমা করিতেছেন। লোকে বলে প্রতাপনগরের জন্য। কলা। কেন আমরা কি অপরাধ করিয়াছি? রাজা। অপরাধ বিস্তর। প্রতাপনগর ধনধান্য পূর্ণ-লোক এখানে দারিদ্র্যশূন্য—আর আমরা হিন্দু! হিন্দুর ঐশ্বর্য বাদশাহের চক্ষুশূল। কলা। না, তবে বিনা যুদ্ধে মরিব কেন? রাজা। দেখি যদি বিনা যুদ্ধে কার্যোদ্ধার হয়। আমার ইচ্ছা একবার ঢাকায় যাই। আপনি সুবাদারের মন বুঝি, কোন ছলে যদি বশীভূত করিতে পারি করি। কলা। এমন কর্ম করিও না—ঔরঙ্গজেবের নায়েবকে বিশ্বাস কি? আর আসিতে দিবে না। রাজা। সম্ভব—কিন্তু তাহাতে তাহার লাভ হইবে কি? কলা। রাজহীন রাজ্য সহজে হস্তগত করিবে। রাজা। আমি গেলে তুমি রাজ্যের রক্ষক থাকিবে। কলা। ছি! স্ত্রীলোকের বাহুতে বল কি? রাজা। এখানে বাহুবলের কাজ নয়। বুদ্ধিবলেই ভরসা। প্রতাপনগরের বুদ্ধিবল তুমি একা। কলা। মহারাজ আপনাকে যাইতে দিতে আমার মন সরিতেছে না। রাজা। থাকিলেই কোন মঙ্গল! যুদ্ধেই কোন মঙ্গল! কলা। মারহাট্টা যুদ্ধ করিতেছে—আমরা কি মানুষ নই? রাজা। না আমরা মানুষ নই। শিবাজীর কাজ কি আমার দ্বারা সম্ভবে? আমি যাওয়াই স্থির করিতেছি। এখন শয়ন ঘরে চলিলাম।
[নিষ্ক্রান্ত]
কলাবতী। (স্বগত) বিধাতা, যদি আমায় স্ত্রীলোক করিয়াছিলে তবে আমায়—দূর হৌক সে কথায় এখন আর কাজ কি? হায়! আমি রাণী কিন্তু রাজা কই? রাজা অভাবে প্রতাপনগর রক্ষা হইবে না। হায়! রাণী হইলাম ত রাজা পাইলাম না কেন?
দিবার প্রবেশ
(চক্ষু মুছিয়া) কি লো দিবি? দিবা। এই কাগজটুকু কুড়িয়ে পেয়েছি। [এক পত্র দিল।] কলা। (পড়িলেন) “আমি রাজা রাজেন্দ্রের আজিও প্রবল শত্রু—প্রতাপনগর ধ্বংস করিয়া তোমাকে গ্রহণ করিব। নইলে ভালোয় ভালোয় এসো।” এ পত্র কোথায় পাইলি? দিবা। আজ্ঞে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি। কলা। তোকে ফাঁসি দিব। আবশ্যক হইলে আমি হুকুম দিই, তা তুই জানিস? দিবা। জানি—তা আমি কুড়িয়ে না পেলুম তা কোথা পেলুম? কলা। কোথায় পেলি? তুই হাতে হাতে নিয়েছিস! দিবা। মাইরি রাণীমা আমি হাতে হাতে নিই নে। কলা। তবে কোথায় পেলি বল, নইলে ফাঁসি দিব। দিবা। আমি পায়রার গলায় পেয়েছি। কলা। সে পায়রা কোথায়? দিবা। পায়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি। কলা। কালী কলম নিয়ে আয়—জবাব লেখ্। দিবা। কালী কলম আছে—কি লিখিব। কলা। লেখ “আমি তোমার পরম শত্রু—তোমায় ধ্বংস করিয়া প্রতাপনগর রক্ষা করিব।” লেখা হইল? দিবা। লিখেছি—পায়রার গলায় বেঁধে দিয়ে আসি? কলা। দে গিয়ে। দিবা। হাঁ রাণীমা এ কে মা— কলা। চুপ! কথা মুখে আনিলে মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দিব।
[দিবা নিষ্ক্রান্ত]
কলা। পায়ে কাঁটা ফুটিলে কাঁটা দিয়া বাহির করিতে হয়, বুঝি আমাকে তাহাই করিতে হইবে।
SCENE III
রাজার অন্তঃপুর
দিবা-নিশা
দিবা। রাজা ঢাকায় চলিল কেন ভাই?
নিশা। তোর জন্য ঢাকাই কাপড় আন্তে।
দিবা। আমি ত এমন হুকুম দিই নে, আমার যে ঢাকাই কাপড় আছে।
নিশা। তবে তোর বর আন্তে।
দিবা। কেন এদেশে কি বর পাওয়া যায় না?
নিশা। এ দেশে তেমন দাড়ী পাওয়া যায় না—তোমাকে একটা নেড়ে বর এনে দেবে।
দিবা। তা তার জন্য আর রাজার নিজে যাবার দরকার কি? আমায় বললে আমি একটা খুঁজে পেতে নিতুম। না হয় গোবিন্দ বখশীকে একটা পরচুলো দাড়ি পরিয়ে ঘরে নিয়ে আসতুম।
নিশা। আচ্ছা বখশী মশাইকে বলে রাখ্ব।
দিবা। দূর হ পাপিষ্ট—তোর কাছে কোন কথাই বলবার যো নাই। তা যাক;—সত্য সত্য রাজা ঢাকায় চলল?ৌ কেন?
নিশা। কি জানি কেন—রাজা রাজড়ার মন তুমি আমি কি বুঝ্ব।
দিবা। তা, রাজা কি ফিরিবে না নাকি?
নিশা। সে কি কথা? অমন কথা মুখে আনতে আছে।
দিবা। রাণী কলাবতী অত কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে কেন?
নিশা। স্বামী বিদেশে গেলে একটু কাঁদ্তে হয়।
দিবা। দূর! স্বামী ছেড়ে স্বামীর বাবার জন্য আমি কাঁদিনে।
নিশা। তোর সাত পুরুষের ভিতর স্বামী নাই তুই আবার কাঁদিবি কার জন্য? বরং রাজার জন্য একটু কাঁদিস ত কাঁদ।
দিবা। না ভাই তা পারিব না। বরং মনের দুঃখে বসে বসে লুচি মণ্ডা খাই গে চল।
নিশা। তাও মন্দ নয়।
দ্বিতীয়াঙ্ক
SCENE I
রাজা। আমার কি অপরাধ? কি জন্য দিল্লীশ্বর আমার উপর পীড়ন করিতে উদ্যত?
সুবা। আপনি মুসলমানের দ্বেষক। পাদশাহ মুসলমানের ধর্মরক্ষক। সুতরাং বাদশাহ—
রাজা। আমি কিসের মুসলমানের দ্বেষক? আমার রাজ্যে হিন্দু মুসলমানের তুল্য—
সুবা। প্রতাপনগরে একটি মসজীদ নাই —মুসলমানে নমাজ করিতে পায় না।
রাজা। আমি মসজীদ প্রস্তুত করিয়া দিব।
সুবা। প্রতাপনগরে একটি কাজি নাই—মুসলমানের বিচার কি হিন্দুর কাছে হয়?
রাজা। আমি কাজি নিযুক্ত করিব।
সুবা। মহারাজ—আপনি যদি বাদশাহের এরূপ বশ্যতাপন্ন হন, তবে বাদশাহ কেন আপনাকে রাজ্যচ্যুত করিবেন? কিন্তু আসল কথা এখনও বাকি আছে—প্রতাপনগরে মুসলমান জবাই করিতে পায় না—তার কি হইবে?
রাজা। গোরু ভিন্ন অন্য জবাইয়ে আপত্তি করিব না।
সুবা। কিন্তু গোরুই আসল কথা।
রাজা। হিন্দু হইয়া গোহত্যা করিতে দিব কি প্রকারে?
সুবা। তবে হিন্দুয়ানি ত্যাগ করুন।
রাজা। ধর্মত্যাগ করিব? ইহকাল পরকাল খোওয়াইব? এ কথাও কানে শুনিতে হইল।
সুবা। ইহকাল নষ্ট হইবে না। আপনি ইসলামেরধর্ম গ্রহণ করিলে বরং ইহকালে সুখী হইবেন। রাজ্য বজায় থাকিবে এবং আরও বাড়াইয়া দিব। আর পরকালও যাইবে না। ইসলামই সত্যধর্ম—দেখুন কত বড় বড় হিন্দু এখন মুসলমান হইতেছে। তাহারা কি না বুঝিয়া ধর্মত্যাগ করিতেছে? বরং আপনার যদি সন্দেহ থাকে, তবে আমি ভাল ভাল মোল্লা মুফ্তি আপনার কাছে পাঠাইয়া দিতেছি। তাদের সঙ্গে বিচার করুন—বিচারে যদি ইসলাম সত্য ধর্ম বলিয়া বোধ হয়, তবে গ্রহণ করিবেন ত?
রাজা। ইচ্ছা হয় মোল্লা মুফ্তি পাঠাইবেন।
কিন্তু কিছু ফলোদয় সম্ভাবনা নাই। সম্প্রতি আমি যাহা নিবেদন করিলাম, অনুগ্রহ করিয়া বাদশাহের নিকট জানাইবেন। গোহত্যা ভিন্ন আর সকলেই আমি সম্মত—বার্ষিক কর দিতেও সম্মত। আজ আমি বিদায় হইব—যে হুকুম হয় অনুগ্রহ করিয়া জানাইবেন।
সুবা। কোথা যাইবেন?
রাজা। অনেক দিন আসিয়াছি, স্বদেশে যাইব।
সুবা। সে কি? আপনার শুভাগমনের সম্বাদ আমি দিল্লীতে এত্তেলা করিয়াছি। সেখান হইতে খেলওয়াত আসিবে—তাহা না গ্রহণ করিয়া কি যাওয়া হয়।
রাজা। বড় অনুগৃহীত হইতেছি কিন্তু আমার অবর্তমানে রাজ্য বিশৃঙ্খল হইতেছে।
সুবা। নাচার—আপনাকে অবশ্য অপেক্ষা করিতে হইতেছে। আপনার ফৌজ সকল বিদায় দিন।
রাজা। সে কি আমাকে কয়েদ রাখিতে চাহেন?
সুবা। ও সব কথা কেন? তবে দিনকত আপনাকে এখানে থাকিতে হইবে। দিল্লীর হুকুম না আসিলে ছেড়ে দিতে পারিব না।
রাজা। (স্বগত) হায়! কলাবতী তুমি যা বলিয়াছিলে তাহাই হইল। (সুবাদারকে) যাহা হুকুম হয় তাহাই তামিল করিব।
সুবা। তছলীম।
[সুবাদার নিষ্ক্রান্ত]
রাজা। কয়েদই ত হইলাম। প্রমথ—প্রমথ—
প্রমথের প্রবেশ।
আমার আজ কাল ফিরিয়া যাওয়া হইতেছে না, তুমি প্রতাপনগরে এই সম্বাদ লইয়া যাও।
প্রমথ। যাইব কি প্রকারে? সকল পথে পাহারা—আমাদের কয়েদ করিয়াছে।
রাজা। আমার শিপাহী সব কোথা?
প্রমথ। নবাবের লোকে তাহাদের হাতিয়ার কাড়িয়া লইয়াছে—তাহাদিগকে প্রতাপনগরে ফিরিয়া যাইবার হুকুম হইয়াছে।
রাজা। ভাল, তাহারাই গিয়া সম্বাদ দিবে।
প্রমথ। দিলেই বা কি হইবে।
SCENE II
কলাবতী-নিশা।
কলা। আজ একুশ দিন হইল মহারাজ ঢাকায় গিয়াছেন আজও কই কোন সম্বাদ ত পাইলাম না।
নিশা। হাঁ, রাণীমা, রাজরাণীতেও কি এমনি করে দিন গণে?
কলা। কই আমি দিন গণিলাম?
নিশা। কাঁদ কেন মা, আমি এমন কিছু বলি নাই।
কলা। নিশা, তুই একবার শহরের ভিতর একটা শিয়ানা পাঠাইতে পারিস্—অবশ্য কেহ কোন সম্বাদ শুনিয়াছে কেন না ঢাকায় ঢের লোক যায় আসে। আমি এত লোক পাঠাইলাম কেহ ত ফিরিল না। বোধ হয়, মন্দ সম্বাদই আসিয়াছে—লোকে সাহস করিয়া আমার সাক্ষাতে বলিতে পারিতেছে না।
নিশা। আপনাকে ব্যস্ত দেখিয়া আমি আপনার বুদ্ধিতেই শহরে অনুসন্ধান করিতে লোক পাঠাইয়া দিলাম—কিন্তু—
কলা। কিন্তু কি?
নিশা। লোকে বলে মহারাজকে সুবাদার আটক করেছে—অমন কর কেন মা! এই জন্য ত বলি নাই। একটু শোও আমি বাতাস করি। উড়ো কথায় বিশ্বাস কি?
(কলার শয়ন)
কলা। বিশ্বাস সম্পূর্ণ। আমি আগেই বলিয়াছিলামযে গেলে তাঁকে আটক করিবে। নিশি! এখন আমার দশা কি হইবে! (রোদন)
নিশা। কাঁদিলে কি হবে মা। আমাদের সকলেরই ত এক দশা হবে। আমরাও নিরাশ্রয় হইলাম—এখন মুসলমানের হাতে জাতি মান প্রাণ সব যাবে?
কলা। কি বললি সবার এক দশা? তোদের যে রাজা মাত্র—আমার যে স্বামী। তুই কি জানিস স্বামী কি ধন!
নিশা। তা বটে। রাজ্য যায় তবু প্রাণটা থাকিলে আমরা বজায় থাকিব। ভাল মা, এক কাজ কর না কেন? রাজার কাছে কেন লোক পাঠাও না যে সুবাদারকে রাজ্য ছাড়িয়া দিয়া আসুন—আমরা না হয় তাঁকে গহনাপত্র বিক্রয় করিয়া খাওয়াইব। কাঁদ কেন মা এ কথায়?
কলা। তুই কেন আমায় অপমান করিস্? কি! আমার স্বামীকে আমি রাজ্য ত্যাগ করিয়া প্রাণ বাঁচাইতে বলিব! নিশা—তোদের ভয় হইয়া থাকে তোরা চলিয়া যা—আমার স্বামী রাজা—তিনি রাজার কাজ করিবেন।—কিসের গোল ঐ?
[নেপথ্যে বহু লোক “জয় মা কলাবতীর জয়”]
আজিকার দিনে কে বলে কলাবতীর জয়?
(দিবার প্রবেশ)
দিবা। মহারাণী! নগরের সকল প্রজা আসিয়া রাজবাড়ী ঘেরিল।
কলা। কি হয়েছে!
দিবা। সকলে বলিতেছে ঢাকার সুবাদার রাজাকে কয়েদ করিয়াছে।
কলা। তারপর প্রজারা কি বলে।
[নেপথ্যে “মহারাণী কলাবতীর জয়”]
ওরা কি চায় দিবা?
দিবা। আপনি স্বকর্ণে শুনুন।
কলা। প্রজারা আমার পুত্র, আমার [নিকট] অবারিতদ্বার। প্রধানদিগকে আমার কাছে ডাকিয়া আন।
[দিবার প্রস্থান। কতিপয় নগরবাসীর সহিত পুনপ্রবেশ]
প্রজাবর্গ। জয় কলাবতীর জয়।
কলা। কি চাও বাবা তোমরা?
১ম প্রজা। মা, আমাদের রাজা কোথায়?
২য় প্রজা। মা, আমাদের রাজাকে নাকি দুষ্ট যবন কয়েদ করিয়াছে। মা, আমাদের বাহুতে কি বল নাই যে বাপের উদ্ধার করি?
পরিশিষ্ট ক
বঙ্কিমচন্দ্র লিখিত অসম্পূর্ণ নাটকটীর পরিত্যক্ত অংশগুলি নিম্নে দেওয়া হইল। বঙ্কিমচন্দ্র প্রথমে নাটকটী এইভাবে আরম্ভ করিয়াছিলেনঃ—
DRAMATIS PERSONÆ
মেঘ রায়
অকলঙ্ক গণিকা
প্রথম অঙ্ক
SCENE I
প্রতাপনগরের রাজবর্ত্ম
মেঘ রায়ের প্রবেশ।
মেঘ। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইল—আর যাইব কি?
এখন আর নগরের ভিতর যাইয়া কি হইবে?
আর একটু রাত্রি হোক্। এই বটতলে বসিয়া [অপেক্ষা] করা যাউক।
[বৃক্ষতলে আসন।
কেনই এত পরিশ্রম করিতেছি? যত্ন সফল হইলেই কি সুখী হইব? না তা নয় তবে যত্নে সুখ আছে—পরিশ্রমেই আরাম। পরিশ্রম বড় মন্দ হইতেছে না—
ইহারই মধ্যে তৃষ্ণা পাইয়াছে—যে ক্ষুধা তৃষ্ণায়
কাতর, তার দ্বারা কোন কার্য উদ্ধার হইবে?
অকলঙ্কের প্রবেশ।
তুমি কি জাতের মেয়ে গা?
অক। আমাদের কি জাত আছে মশাই?
মেঘ। তুমি বেশ্যা? তা হোক তোমার দোকানপাট আছে?
অক। একখানি দোকান করি—পথিক লোক রেঁধে বেড়ে খেয়ে যায়। আপনাকেও ত বিদেশীর মত দেখছি—বিশ্রাম করেন ত আমার দোকানেই আসুন না।
মেঘ। আমার রাঁধা বাড়া নাই একটা ডাব
খেতে পেলেই তৃষ্ণা নিবারণ হয়।
অক। তবে আমার দোকানে আসুন—হাতে
পায়ে জল দিয়ে ঠাণ্ডা হবেন তারপর ডাব কেটে দেব।
মেঘ। (জনান্তিকে) এও কপালে ছিল, আপনার
কাজের জন্য কেন না যাইব। (প্রকাশ্যে) তবে চল।
[উভয়ের প্রস্থান।
SCENE II
অকলঙ্কের দোকান
মেঘ—অকলঙ্ক।
মেঘ। হা গা তোমার দোকোনে এত লোকের
ভীড় কেন?
অক। এখন শহরে ঢের লোক আসছে যাচ্ছে আপনি বিদেশী তাই জানেন না।
মেঘ। কেন গা?
অক। লড়াই বাধবে জান না।
মেঘ। কাতে কাতে?
অক। আমার।
চিঠিপত্র
চিঠিপত্র দৈনন্দিন প্রয়োজন সাধনের কাজে লাগে বলে তার ,প্রকাশ ভঙ্গিতে, রীতি পদ্ধতিতে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আকর্শনীয় করে তুলতে হবে
চিঠি লেখার সময় যে সব দিক সম্পর্কে সচেতন থাকতেন থাকতে হবে সে সব হল:
- চিঠির বক্তব্য সুস্পস্ট হতে হবে ।
- সহজ সরল ভাষায় চিঠি লিখতে হবে ।
- প্রকাশ ভঙ্গি হবে আকর্ষণীয়।
- চিঠি লেখার পদ্ধতি মেনে চলতেহবে ।
- হাতে লেখা চিঠিতে হস্তাক্ষর সুন্দর হ ওয়া উচিত ।
- খামের নাম ঠিকানা স্পষ্টাক্ষরে লিখতে হবে।
চিঠিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অর্ন্তভুক্ত থাকবে:
- চিঠি লেখার স্থান ।
- চিঠি লেখার তারিখ ।
- প্রেরক –প্রাপক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রাপককে সম্বাধন ও প্রাথমিক সম্ভাষন ।
- বিষয়বস্তু ।
- চিঠির সমাপ্তিমূলক।
- লেখকের নাম
- চিঠির খামের শিরোনামে প্রাপকের নাম-ঠিকানা।
চিঠির বিভিন্ন অংশ
- চিঠির ওপরের অংশ মঙ্গল সূচক শব্দ।
- চিঠির ওপরের অংশের ডান কোনে স্থানের তারিখ ।
- চিঠির ওপরের অংশের বাম দিকে প্রাপকের উদ্দেশে সম্বোধন।
- চিঠির বক্তব্য বিষয়।
- চিঠির শেষে ডান দিকে লেখকের স্বাক্ষর ও ঠিকানা।
- চিঠির শিরনাম।
এই অংশ কয়টি চিঠির আনুষ্ঠানিকতা চিঠি লেখার বেলায় এগুলো মানতে হবে ।তবে চিঠির বৈচিত্র্যের প্রেক্ষিতে এসব বিষয় ও ভিন্ন রকম হতে পারে ।
- মঙ্গলসূচক শব্দ:
ব্যক্তিগত চিঠিতে মঙ্গল সূচক শব্দ ব্যবহারের রীতি প্রচলিত আছে, ব্যবহারিক পত্রে তার আবশ্যকতা নাই। আগের দিনে এসব মঙ্গলসূচক শব্দ চিঠিতে ব্যবহৃত হত। এখনকার পুরান ঢংয়ের চিঠিতে এসবের ব্যবহার দেখা যেতে পারে । মঙ্গল সূচক শব্দ ব্যবহারে মুসলিম ও হিন্দু -রীতি নামে দুটো রীতি লক্ষ্য করা যায় । কোন কোন ক্ষেত্রে শব্দের ব্যবহারে স্বাতন্ত্র্য থাকার জন্য মুসলিম ও হিন্দু লেখক নিজস্ব রীতির শব্দ ব্যবহার করে থাকে । অন্য ধর্মাবলম্বীর বেলায় তেমনি স্বতন্ত্র শব্দ ব্যবহার পারে । মুসলিম রীতিতে ইয়া রব ,ইয়া আল্লাহ,আল্লাহুআকবর, এলাহি ভরসা ,৭৮৬ ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। হিন্দু রীতিতে আছে ওঁ’,ওম,শ্রী শ্রী র্দুগা হরি সহায় ,সরস্বৈত্যে নম: ইত্যাদি শব্দ । - চিঠি লেখার স্থান ও তারিখ :
চিঠির ওপরের অংশের কোণে চিঠি লেখার স্থান ও তারিখ উল্লেখ করার রীতি প্রচলিত আছে । ব্যক্তিগত ও সামাজিক চিঠি এ ধরনের স্থান ও তারিখ নির্দেশিত থাকে । আবার কখনও কখনও চিঠির মূল বক্তব্যের শেষে ইতি দিয়ে তারিখ উল্লেখ করা হয় । নামের নিচে ও অনেকে তারিখ ঊল্লেখ করে।কখন ও পত্রের নিচের দিকে বাঁ পাশে ও তারিখ লেখা হয় । আবেদনপত্রে ও স্মারকপত্রে এ ধরনের স্থান -তারিখের ঊল্লেখ থাকে । অফিসের চিঠিতে ওপরের অংশে চিঠির নম্বর ও তারিখ থাকে। - চিঠির সম্বোধন :
চিঠি পত্রে বক্তব্য বিষয় লেখা শুরুর আগে বাম দিকে প্রাপকের ঊদ্দেশে সম্বোধন সূচক কথা লিখতে হয় । এতে মুসলিম ও হিন্দু রীতির মধ্যে পার্থক্য আছে। পত্র প্রেরক ও প্রাপকের সম্পর্ক ও বয়সের প্রেক্ষিতে এই সম্বোধন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে । মুসলিম রীতিতে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিকে ‘পাক জনাবেষু,বখেদমতেষু ,ইত্যাদি এবং হিন্দু রীতিতে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে ‘শ্রীচরণেষু ,শ্রীচরণকমলেষু’পূজনীয়’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগকরা হয়। বয়সের দিক থেকে ছোটদের সম্বোধনে মুসলিম রীতিতে দোয়াবরেষু, এবং হিন্দু রীতিতে কল্যাণীয়েষু, স্নেহাস্পদ’ইত্যাদি লিখতে হয় । বন্ধুবান্ধবের প্রতি বন্ধুবর’ প্রিয় ,প্রিয়বেরষু,সুহৃদয়েষু ,ইত্যাদি শব্দ লেখার রিতি আছে। - চিঠির বক্তব্য:
চিঠির সম্বোধনের পর মূল বক্তব্য উপস্থাপন হয় ।এটাই চিঠির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দিক। বক্তব্য স্পষ্টভাবে সুশৃঙ্খলরূপে এখানে বিধৃত হবে । বক্তব্যের সূত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে বক্তব্য বিষয় বিন্যস্ত হতে পারে । - পত্র লেখকের স্বাক্ষর :
চিঠির বক্তব্য লেখা শেষ করার পর নিচে ডান দিকে লেখকের নাম স্বাক্ষর করতে হয় । কেউ বাম পাশেও সাক্ষর করে । চিঠির শেষাংশে ব্যক্তিগত কুশলাদি প্রকাশ করে দু-একটি কথা লেখা হয়। লেখকের সাথে সম্পক ও বয়সের প্রক্ষিতে পৃথক মুসলিম ও হিন্দুরীতির নিম্নরূপ শব্দ ব্যবহারের নিদশন রযেছে:- গুরুজনেরপ্রতি:স্নেহের ,খাকসার ,প্রণত,সেবক,স্নেহভাজন ইত্যাদি।
- ছোটদের প্রতি :আশীবাদ ,শুভাথী,তোমার ইত্যাদি।
- বন্ধুবানধবের প্রতি:প্রীতিমুগ্ধ, তোমার ,ইত্যাদি।
- সাধারণ:আপনার বিশ্বস্ত ,নিবেদক ইত্যাদি।এসব শব্দ ব্যবহারে ওবৈচিত্র্য আছে।
- চিঠির শিরোনাম:
চিঠি খামে ভরে প্রাপকের কাছেপাঠাতে হয়্।তাই খামের ওপরে প্রাপকের পূর্ন নাম ঠিকানা লেখা দরকার -যাতে প্রাপককে খুঁজে বের করতে কোন অসুবিধা না ঘটে ।খামের ওপরের অংশে ডান দিকে প্রয়োজনীয় ডাকটিকেট লাগাতে হয়।এইডাকটিকিটের নিচের অংশে প্রাপকের নাম ,ঠিকানাআর চিঠিরখামে নিচের বাম দিকে প্রেরকের নাম,ঠিকানা লিখতে হয় । প্রাপকের নাম লেখার সময় জনাব, মৌলভী, মি:, শ্রীযুক্ত, শ্রীমান, শ্রীমতী, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা দরকার । অবশ্য নামের আগে শুধু জনাব, লেখার সরকারী নির্দেশ রয়েছে। পোস্টকার্ড নির্দিষ্ট স্থানে লেখতে হয়।
পত্রাবলী
সুহৃদ্বরেষু—
আপনার পত্রগুলির যে উত্তর দিতে পারি না, তাহার অন্যান্য কারণের মধ্যে একটি কারণ এই যে, তাহার উত্তর অদেয়। আপনি যাহা লেখেন তাহা এত মধুর, যে উত্তর যাহাই দিই না কেন তাহা কর্কশ হইবে। আপনার পত্রের উত্তর দেওয়া, আর অমৃত পান করিয়া ধন্বন্তরিকে মূল্য দেওয়া সমান বলিয়া বোধ হয়। আপনার পত্রের উত্তর না দেওয়াই ভাল–কোকিলকে Thanks দিয়া কি হইবে? আপনার নববর্ষ প্রভৃতি দিবসের সম্ভাষণ সম্বন্ধে এই কথা বিশেষ খাটে। আপনি নিজে পীড়িত ; চক্ষের যন্ত্রণায় লিখিতে অসমর্থ, তথাপি আমাদের মঙ্গল আন্তরিক কামনা করিয়া পত্র লিখিয়াছেন। আপনার তুল্য মনুষ্য অতি দুর্লভ। আপনাকে কায়মনোবাক্যে আশীর্বাদ করিতেছি, আপনি অচিরাৎ সুস্থ হইয়া স্বদেশের উন্নতি সাধন করিতে থাকুন।
স্যার আশলি ইডেনের স্বদেশ গমন উপলক্ষে কলিকাতায় হুলুস্থূল পড়িয়া গিয়াছে। কেহ বলে, গোবর জল ছড়া দাও। কেহ বলে, “অরে নিদারুণ প্রাণ! কোন পথে…যান, আগে যা রে পথ দেখাইয়া” ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের লাভের মধ্যে দুই একটা সমারোহ দেখিতে যাইব।
আমার দৌহিত্রটি এ পর্যন্ত আরোগ্য লাভ করিতে পারে নাই, তবে পূর্বাপেক্ষা ভাল আছে। আর ইন্দ্র, চন্দ্র, বায়ু বরুণ, যম, কুবের প্রভৃতি দিক্পালগণ পূর্বমত দিক্পালন করিতেছেনচন্দ্রের মধ্যে মধ্যে, পূর্ণোদয় হয়, মধ্যে মধ্যে অমাবস্যা। এখন কালী প্রসন্ন হইলেই আনন্দমঠ বজায় হয়। ইতি তাং ৪ বৈশাখ [১২৮৯ সাল] [১৬ এপ্রিল, ১৮৮২]
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন’]
[কালীপ্রসন্ন ঘোষকে লিখিত]
সুহৃদ্বরেষু—
আপনার অনুগ্রহ পত্র পাইয়া আনন্দ লাভ করিলাম।
আমি যখন প্রথম এখানে আসি, তখন দুই এক মাসের জন্য আসিতেছি এরূপ কর্তৃপক্ষের নিকট শুনিয়াছিলাম। এজন্য একাই আসিয়াছি। বিশেষ পরিবার আনিবার স্থান এ নহে। এক্ষণে জানিলাম ইহার ভিতর অনেক চক্র আছে।*** সেই মন্থরার দল আমাদের স্বদেশী স্বজাতি, আমার তুল্য পদস্থ ; আমার ও আপনার বন্ধুবর্গের মধ্যে গণ্য। আমিই বা আনন্দমঠ লিখিয়া কি করিব, আপনিই বা তাহার মূলমন্ত্র বুঝাইয়া কি করিবেন? এ ঈর্ষ্যাপরবশ, আত্মোদরপরায়ণ জাতির উন্নতি নাই। বল, “বন্দেউদরং”।
বৈশাখের “বান্ধব” পাইয়াছি। এবং “মূলমন্ত্র” “জাতীয় সঙ্গীত” এবং অন্যান্য প্রবন্ধ পড়িয়া অতিশয় প্রীত হইয়াছি।
আপনিও “শাপেনাস্তং গমিতমহিমা”, শুনিয়া দুঃখিত হইলাম। তবে আপনি মহৎ কর্তব্যানুরোধেই এ দশা প্রাপ্ত, কাজেই তাহা সহ্য হয়, কিন্তু আমি যে কি জন্য বৈতরণীসৈকতে পড়িয়া ঘোড়ার ঘাস কাটি তাহা বুঝিতে পারি না। যে ব্যক্তি লিখিয়াছিল “যমদ্বারে মহাঘোরে তপ্তা বৈতরণী নদী” সে ব্যক্তি নিশ্চিত জানিত উড়িষ্যার বৈতরণীপারেই যমদ্বার বটে।
দশমহাবিদ্যার কিয়দংশ হস্তলিপি হইতে হেম বাবুর মুখেই শুনিয়াছিলাম। সেটুকু আমার বড় ভাল লাগিয়াছিল। বোধ হয় সেটুকু আপনিও গ্রন্থকারের মুখে শুনিয়া থাকিবেন। অবশিষ্টাংশ এখনও ভাল করিয়া পড়ি নাই। যেটুকু পড়িলাম তাহাতে বুঝিলাম যে গ্রন্থকারের মুখে না শুনিলে গ্রন্থের সকল রসটুকু পাওয়া যায় না। বিশেষ তাঁহার ছন্দ নূতনআমার আবৃত্তির সম্পূর্ণ আয়ত্ত নহে। এ জন্য স্থির করিয়াছি, যদি কখন রজনী প্রভাত হয়, তবে তাঁহারই মুখে অবশিষ্টাংশ শুনিয়া হৃদয়ঙ্গম করিব।
আনন্দমঠে বিস্তর ছাপার ভুল দেখিলাম। অনুগ্রহ করিয়া মার্জনা করিবেন। ইতি ২৩শে পৌষ [১২৮৯] [৬ জানুয়ারি ১৮৮৩]
অনুগ্রহকাঙ্ক্ষী
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন’]
[সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত]
শ্রীচরণেষু
অঘোর বরাটকে একটু পত্র লিখিবেন, যে, মাঘ মাসের বঙ্গদর্শন বাহির করার পক্ষে আপত্তি নাই, ভবিষ্যৎ সংখ্যার প্রতি আপত্তি আছে। অর্থাৎ মাঘ সংখ্যা ভিন্ন আর বাহির করিতে দিবেন না। ইহা লিখিবেন।
পত্র পাঠ মাত্র ইহা লিখিবেন। চন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া অনেক কাকুতি মিনতি করিতেছে। কিন্তু এটুকু লইলে বিবাদ সম্পূর্ণ মিটিবে না। ইতি তাং ২৩ ফেব্রুয়ারি [১৮৮৪]1
“শ্রীশচন্দ্র মজুমদার” সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা—পৃষ্ঠা ৩৫]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
[শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত]
প্রিয়তমেষু,
আমি হাঁপানির পীড়ায় অত্যন্ত অসুস্থ থাকায় তোমার পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব হইয়াছে।
গেজেটে তোমার appointment দেখিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলাম। ভরসা করি শীঘ্রই চাকরী চিরস্থায়ী হইবে।
“পদরত্নাবলী” পাইয়াছি। কিন্তু সুখ্যাতি কাহার করিব? কবিদিগের না সংগ্রহকারদিগের? যদি কবিদিগের প্রশংসা করিতে বল, বিস্তর প্রশংসা করিতে পারি। আর যদি সংগ্রহকারদিগের প্রশংসা করিতে বল, তবে কি কি বলিব আমায় লিখিবে, আমি সেইরূপ লিখিব। তুমি বরং রবীন্দ্রনাথ, যখন সংগ্রহকারক, তখন সংগ্রহ যে উৎকৃষ্ট হইয়াছে তাহা কেহই সন্দেহ করিবে না এবং আমার সার্টিফিকেট নিষ্প্রোয়োজন। তথাপি তোমরা যাহা লিখিতে বলিবে, লিখিব।
কৃষ্ণ সম্বন্ধে যে প্রশ্ন করিয়াছ, পত্রে তাহার উত্তর সংক্ষেপে দিলেই চলিবে। আমি যাহা লিখিয়াছি (নবজীবনে ও প্রচারে) ও যাহা লিখিব, তাহাতে এই দুইটি তত্ত্ব প্রমাণিত হইবে।
১। শ্রীকৃষ্ণ ইচ্ছাক্রমে কদাপি যুদ্ধে প্রবৃত্ত নহেন।
২। ধর্মযুদ্ধ আছে। ধর্মার্থেই মনুষ্যকে অনেক সময় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে হয় (যথা William the Silent) ধর্মযুদ্ধে অপ্রবৃত্তি অধর্ম। সে সকল স্থানে ভিন্ন শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধে কখনও প্রবৃত্ত হয়েন।
৩। অন্যে যাহাতে ধর্মযুদ্ধ ভিন্ন কোন যুদ্ধে কখন প্রবৃত্ত না হয়, এ চেষ্টা তিনি সাধ্যানুসারে করিয়াছিলেন।
মনুষ্যে ইহার বেশী পারে না। কৃষ্ণচরিত্র মনুষ্যচরিত্র। ঈশ্বর লোকহিতার্থে মনুষ্যচরিত্র গ্রহণ করিয়াছিলেন।
কৃষ্ণনগরে কবে যাইবে? ইনি তাং ২৫শে আশ্বিন [১২৯২] [১০ অক্টোবর ১৮৮৫]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
‘প্রদীপ’]
——————
1 অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যা ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রকাশিত চন্দ্রনাথ বসুর “পশুপতি সম্বাদ” বঙ্কিমচন্দ্রকে ক্ষুণ্ণ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্রকে উক্ত পত্রখানি লেখেন।
——————
[গিরিজাপ্রসন্ন রায়কে লিখিত]
সাদর সম্ভাষণম্
আপনার পত্র পাইয়া প্রীত হইয়াছি। আপনি যে সঙ্কল্প করিয়াছেন, তাহাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি হইতে পারে না। কেবল এই কথা যে, আমার প্রণীত নরনারীচরিত্রগুলি আপনাদিগের এতদূর পরিশ্রমের যোগ্য কিনা সন্দেহ।
তবে, আপনি সুলেখক এবং উৎকৃষ্ট বোদ্ধা, তাহার পরিচয় পূর্বে পাইয়াছি। আপনার যত্নে আমার রচনা আশার অতীত সফলতা লাভ করিতে পারিবে, এমন ভরসা করি।
আমার পুস্তক হইতে যেখানে যতদূর উদ্ধৃত করা আবশ্যক বোধ করিবেন, তাহা করিবেন। তাহাতে আমার কোন ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।
পুস্তকের নাম যাহা নির্বাচিত করিয়াছেন, তাহাতেও আমার কোন আপত্তি হইতে পারে না।
আমি চন্দ্র বাবুর মতের অপেক্ষা না করিয়াই আপনার পত্রের উত্তর দিলাম, কেননা আপনার বিচার-শক্তি পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছি।
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ সম্বন্ধে একটা কথা বলিয়া রাখা ভাল। প্রথম সংস্করণে কয়েকটা গুরুতর দোষ ছিল, দ্বিতীয় সংস্করণে তাহা কতক কতক সংশোধন করা হইয়াছে। পুস্তকের অর্ধেক মাত্র সংশোধিত হইয়া মুদ্রিত হইলে, আমাকে কিছু দিনের জন্য কলিকাতা হইতে অতিদূরে যাইতে হইয়াছিল। অতএব অবশিষ্ট অংশ সংশোধিত না হইয়াই ছাপা হইয়াছিল। তাহাতে প্রথমাংশে ও শেষাংশে কোথাও কিছু অসঙ্গতি থাকিতে পারে।
চন্দ্র বাবু ও অক্ষয় বাবু আপনার সহায়তা করিবেন, আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। *** ইতি ১১ই জৈষ্ঠ্য [১২৯৩] [২৪ মে ১৮৮৬]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র শর্মণঃ।
‘বঙ্কিমচন্দ্র’]
[জ্যোতিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত]
[১৮৮৭ সনে সঞ্জীবচন্দ্রের একমাত্র পুত্র জ্যোতিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেহেরপুরে পুলিস-ইন্স্পেক্টরের পদে নিয়োগের পর চাকরিতে পাকা হইয়া পুলিসের চাকরি কিভাবে নির্বাহ করিবেন, তাহার উপদেশ চাহিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে এক পত্র দিয়াছিলেন। ইহার উত্তরে নিম্নলিখিত উপদেশ সম্বলিত পত্র বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাকে লেখেন।] প্রিয়তমেষু
বোধ করি পূজার সময় বাড়ী গিয়াছিলে, এতদিনে ফিরিয়া আসিয়া থাকিবে।
আমার নিকট উপদেশ চাহিয়াছিলে, আমি এই পত্রের মধ্যে সাতটি উপদেশ লিখিয়া পাঠাইলাম। ঐ সাতটি Golden rule বিবেচনা করিবে। বিশেষ প্রথম পাঁচটি। উহার অনুবর্তী হইলে সর্বত্র মঙ্গল ঘটিবে। এখানকার সমস্ত মঙ্গল। ভরসা করি এই মাস হইতে তুমি সংসারের ভার লইতে পারিবে। ইতি ১৩ আশ্বিন।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিশেষ উপদেশ
I. প্রথম প্রয়োজনীয় কথা। সত্য ভিন্ন কখন মিথ্যা পথে যাইবে না। কলমের মুখে কখন মিথ্যা নির্গত না হয়। তাহা হইলে চাকরি থাকে না। নিতান্ত পক্ষে কর্তৃপক্ষের অবিশ্বাস জন্মে। অবিশ্বাস জন্মিলে আর উন্নতি হয় না।
II. দ্বিতীয় প্রয়োজনীয় কথা। পরিশ্রম। বিনা পরিশ্রমে কখন উন্নতি হয় না। কখন কোন কাজ পড়িয়া না থাকে।
III. উপরওয়ালাদের আজ্ঞাকারী তাঁহাদিগের নিকট বিনীতভাব। চাকরি রাখার পক্ষে এবং উন্নতির পক্ষে ইহা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। তর্ক করিও না।
IV. আপনার কাজের Rules & Laws বিশেষরূপে অবগত হইবে।
V. কাহারও উপর অত্যাচার করিবে না। পুলিসের লোকে আসামীর উপর বড় অত্যাচার করে। অনেকের বিশ্বাস যে তা নহিলে কাজ চলে না। তাহা ভ্রান্তি। না চলে সেও ভাল। ইহা নিজে কখন করিবে না, বা অধীনস্থ কাহাকে করিতে দিবে না। ইহার কারাদণ্ড আছে।
VI. সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করিবে। অধীনস্থ ব্যক্তিদিগকে ব্যবহার দ্বারায় বশীভূত করিবে। কেহ শত্রু না হয়। কর্তব্য কর্মের অনুরোধে অনেকের অনিষ্ট করিতে হয়। তাহার উপায় নাই। দোষীর অবশ্য দণ্ড চাই।
VII. নিষ্কারণে ভীত হইবে না।
‘প্রবাসী’, শ্রাবণ ১৩৫৮]
[ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]
শ্রদ্ধাস্পদেষু
তিনকড়ি বাবুর নিকট এক সেট পুস্তক দিয়াছি। তন্মধ্যে আর একটি নূতন পুস্তক ধর্মতত্ত্ব আছে। ঐ গ্রন্থ পাঠকালে আপনার যাহা কিছু মনে উদয় হয় অথবা গ্রন্থকারকে বলিবার প্রয়োজন হয়, তাহা যদি অনুগ্রহ করিয়া মার্জিনে নোট করিয়া রাখেন, তবে ভবিষ্যতে উপকৃত হইতে পারিবে।
‘ভূদেব-চরিত’]
[ভূদেব মুখোপাধ্যায়কে লিখিত]
৫ নং প্রতাপ চাটুয্যার গলি
কলিকাতা—-১৩ জুন [১৮৮৮]
[৩২ জৈষ্ঠ্য ১২৯৫]
শ্রদ্ধাস্পদেষু—
আপনার অনুগ্রহপত্র পাইয়াছি। আমার পুস্তকগুলি আপনি নিজে স্টেশনে আসিয়া লইয়া গিয়াছেন, এবং অনুরুদ্ধ না হইয়াও পাড়িয়া থাকেন, ইহার অপেক্ষা পুস্তকের আদর আর কি বেশী হইতে পারে? ইহাই আমার আশার অতীত ফল।
পুস্তকগুলি যেরূপ বাজারে বিক্রয় হয়, সেইরূপ বাঁধানই আপনাকে পাঠান হইয়াছে, ভাল করিয়া বাঁধান হয় নাই। সকলগুলি, এক রকম বাঁধান, এবং বাঁধান ইহার অপেক্ষা ভাল হয়, এইরূপ করিয়া বাঁধাইয়া পাঠাইবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাঁধান পুস্তক আবার বাঁধাইতে গেলে, ছোট মার্জিন আরও ছাঁটা পড়িয়া যাইবে, এবং আবাঁধা পুস্তক এক সেট পুরা হয় না, এজন্য যেমন ছিল তেমনি পাঠাইতে বাধ্য হইয়াছি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালা গ্রন্থেরও একটু বাহ্য সৌষ্ঠব চাই, এজন্য পুস্তকগুলি সোণার জলে এবং কাপড়ে বাঁধাইয়া বিক্রয় করিয়া থাকি।
গীতা পুনশ্চ প্রচারে প্রকাশিত হইতেছে। যদি আপনার দেখিবার ইচ্ছা হয়, তবে পাঠাইতে পারি। উহাতে আপনার দেখিবার যোগ্য কিছু নাই, ইহা বলা বাহুল্য। তবে, আমরা কি ভাবি, কি করি, ইহা বোধ হয় দেখিতে আপনার ইচ্ছা হইতে পারে। ইতি
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
[কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেবকে লিখিত]
অশেষ গুণসম্পন্ন শ্রীযুক্ত কুমার বিনয়কৃষ্ণ দেব
আশীর্বাদ ভাজনেষু
আপনি আমাকে যে কয়েক প্রশ্ন করিয়াছেন, ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ীরাই তাহার উপযুক্ত উত্তর দিতে সক্ষম। আমি ধর্মশাস্ত্রব্যবসায়ী নহি, এবং ধর্মশাস্ত্রবেত্তার আসন গ্রহণ করিতেও প্রস্তুত নহি। তবে সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে যে আন্দোলন উপস্থিত, তৎসম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিবার আমার আপত্তি নাই।
প্রথমতঃ—শাস্ত্রের দোহাই দিয়া কোন প্রকার সমাজ সংস্কার যে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা সম্পন্ন করা উচিত, আমি এমন বিশ্বাস করি না। যখন মৃত মহাত্মা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বহুবিবাহ নিবারণ জন্য শাস্ত্রের সাহায্য গ্রহণ করিয়া আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তখনও আমি এই আপত্তি করিয়াছিলাম, এবং এখনও পর্যন্ত সে মত পরিবর্তন করার কোন কারণ আমি দেখি নাই। আমার এরূপ বিবেচনা করিবার দুইটী কারণ আছে। প্রথম এই যে, বাঙ্গালী সমাজ শাস্ত্রে বশীভূত নহে,—দেশাচার বা লোকাচারের বশীভূত। সত্য বটে যে, অনেক সময়ে লোকাচার শাস্ত্রানুযায়ী, কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায় যে, লোকাচার শাস্ত্রবিরুদ্ধ। যেখানে লোকাচার এবং শাস্ত্রে বিরোধ, সেখানে লোকাচারই প্রবল।
উপরিউক্ত বিশ্বাসের দ্বিতীয় কারণ এই যে, সমাজ সর্বত্র শাস্ত্রের বিধানানুসারে চলিলে, সামাজিক মঙ্গল ঘটিবে কি না সন্দেহ। আপনারা সমুদ্রযাত্রা সম্বন্ধে শাস্ত্রেয় বিধান সকল অনুসন্ধান দ্বারা বাহির করিয়া, সমাজকে তদনুসারে চলিতে পরামর্শ দিতে ইচ্ছা করিতেছেন; কিন্তু সকল বিষয়েই কি সমাজ শাস্ত্রের বিধানানুসারে চলিতে বলিতে সাহস করিবেন? ধর্মশাস্ত্রের একটি বিধি এই, ব্রাহ্মণাদি শ্রেষ্ঠ বর্ণের পরিচর্যাই শূদ্রের ধর্ম। বাঙ্গালার শূদ্রেরা কি সেই ধর্মাবলম্বী? শাস্ত্রের ব্যবস্থা এখানে চলে না। আপনারা কেহ চালাইতে সাহসী হয়েন কি? চেষ্টা করিলেও এ ব্যবসা চালান যায় কি? হাইকোর্টের শূদ্র জজ জজিয়তি ছাড়িয়া, বা সৌভাগ্যশালী শূদ্র জমিদার জমিদারের আসন ছাড়িয়া, ধর্মশাস্ত্রের গৌরবার্থ লুচিভাজা ব্রাহ্মণের পদ সেবায় নিযুক্ত হইবেন কি? কোন মতেই না। বাঙ্গালী সমাজ, প্রয়োজন মতে ধর্মশাস্ত্রের কিয়দংশ মানে ; প্রয়োজন মতে অবশিষ্টাংশ অনেককাল বিসর্জন দিয়াছে। এবং সেইরূপ প্রয়োজন বুঝিলে, অবশিষ্টাংশ বিসর্জন দিবে। এমন স্থলে ধর্মশাস্ত্রের ব্যবস্থা খুঁজিয়া কি ফল? আমার নিজের বিশ্বাস যে, ধর্ম সম্বন্ধে এবং নীতি সম্বন্ধে সামাজিক উন্নতি (Religious and moral regeneration) না ঘটিলে, কেবল শাস্ত্রের বা গ্রন্থ বিশেষের দোহাই দিয়া, সামাজিক প্রথা বিশেষ পরিবর্তন করা যায় না। আমার প্রণীত কৃষ্ণ-চরিত্র বিষয়ক গ্রন্থে, ইহা আমি সবিস্তারে বুঝাইয়াছি। আমি উপরে বলিয়াছি যে, সমাজ দেশাচারের অধীন,—শাস্ত্রের অধীন নহে। এই দেশাচার পরিবর্তন জন্য ধর্ম সম্বন্ধীয় এবং নীতি সম্বন্ধীয় সাধারণ উন্নতি ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। এই সাধারণ উন্নতি কিয়ৎ পরিমাণে ঘটিয়াছে বলিয়াই এই আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছে। এই উন্নতি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইলে, সমুদ্রযাত্রায় সমাজের কাহারও কোন আপত্তি থাকিবে না, কাহারও আপত্তি থাকিলেও সে আপত্তির কোন বল থাকিবে না। কিন্তু যতদিন না সেই উন্নতির উপযুক্ত মাত্রা পরিপূর্ণ হয়, ততদিন কেহই সমুদ্রযাত্রা সাধারণে প্রচলিত করিতে পারিবেন না।
তবে ইহাও বক্তব্য যে, সমুদ্রযাত্রার পক্ষে বাঙ্গালী সমাজ বর্তমান সময়ে কতদূর বিরোধী, তাহা এখন আমাদের কাহারও ঠিক জানা নাই। দেখিতে পাই যে, যাঁহার অর্থ ও অবস্থা সমুদ্রযাত্রার অনুকূলে, তিনিই ইচ্ছা করিলে ইউরোপ যাইতেছেন। সমুদ্রযাত্রা শাস্ত্রনিষিদ্ধ বলিয়া কেহ কেহ যে যান নাই, ইহা আমার দৃষ্টিগোচরে কখনও আসে নাই। তবে ইহা স্বীকার করিতে আমি বাধ্য যে, যাঁহারা ইউরোপ হইতে ফিরিয়া আসেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই এক প্রকার সমাজ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া আছেন, কিন্তু তাঁহাদের দোষে কি আমাদের দোষে, তাহা ঠিক বলা যায় না। তাঁহারা এ দেশে আসিয়াই সাহেব সাজিয়া ইচ্ছাপূর্বক বাঙ্গালী সমাজের বাহিরে অবস্থিতি করেন। বিদেশীয় পরিচ্ছদ, বিদেশীয় ভোজন প্রথা এবং বিদেশীয় ব্যবহার দ্বারা আপনাদিগকে পৃথক্ রাখেন। যাঁহারা ইউরোপ হইতে আসিয়া সেরূপ আচরণ না করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ অনায়াসে হিন্দুসমাজে পুনর্মিলিত হইয়াছেন। ইউরোপ হইতে প্রত্যাগত মহাশয়েরা সকলেই দেশে ফিরিয়া আসিয়া হিন্দুসমাজসম্মত ব্যবহার করিলে, সাধারণতঃ তাঁহারা যে পরিত্যক্ত হইবেন, একথা নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না।
পরিশেষে আমার এই বক্তব্য, সমুদ্রযাত্রা হিন্দুদিগের ধর্মশাস্ত্রানুমোদিত কি না, তাহা বিচার করিবার আগে দেখিতে হয় যে, ইহা ধর্মানুমোদিত কি না? যাহা ধর্মানুমোদিত, কিন্তু ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহা কি ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া পরিহার্য? অনেকে বলিবেন যে, যাহা ধর্মশাস্ত্রসম্মত, তাহাই ধর্ম, যাহা হিন্দুদিগের ধর্মশাস্ত্রবিরুদ্ধ, তাহাই অধর্ম? এ কথা আমি স্বীকার করিতে প্রস্তুত নহি। হিন্দুদিগের প্রাচীন গ্রন্থে এরূপ কথা পাই না। মহাভারতে কৃষ্ণোক্তি এইরূপ আছে।
ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহুর্ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ।
যৎ স্যাদ্ধারণ প্রযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ।
কর্ণপর্ব একোনসপ্ততিতমোহধ্যায়, ৫৯ শ্লোক।
ধর্ম লোক সকলকে ধারণ (রক্ষা) করেন, এই জন্য ধর্ম বলে। যাহা হইতে লোকের রক্ষা হয়, ইহাই ধর্ম নিশ্চিত জানিবে।
যদি মহাভারতকার মিথ্যা না লিখিয়া থাকেন, যদি হিন্দুদের আরাধ্য ঈশ্বরাবতার বলিয়া সমাজে পূজিত কৃষ্ণ মিথ্যাবাদী না হন, তবে যাহা লোকহিতকর তাহাই ধর্ম। এই সমুদ্রযাত্রা পদ্ধতি লোকহিতকর কি না? যদি লোকহিতকর হয়, তবে ইহা স্মৃতিশাস্ত্রবিরুদ্ধ হইলেও কেন পরিত্যাগ করিব?
আমি এইরূপ বুঝি ধর্মশাস্ত্রে যাহাই আছে, তাহাই হিন্দুধর্ম নহে। হিন্দুধর্ম অতিশয় উদার। স্মার্ত ঋষিদিগের হাতে—বিশেষতঃ আধুনিক স্মার্ত রঘুনন্দনাদির হাতে—ইহা অতিশয় সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়িয়াছে। স্মার্ত ঋষিগণ হিন্দুধর্মের স্রষ্টা নহেন,হিন্দুধর্ম সনাতনতাঁহাদিগের পূর্ব হইতেই আছে। অতএব সনাতন ধর্মে এবং এই ধর্ম্মশাস্ত্রে বিরোধ অসম্ভব নহে। যেখানে এরূপ বিরোধ দেখিব, সেখানে সনাতন ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করাই উচিত। ধর্মে এবং হিন্দুধর্মের কোন বিরোধ আমি স্বীকার করিতে পারি না। ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মে যদি কোন বিরোধ থাকে, তবে হিন্দুধর্মের গৌরব কি? উহাকে সনাতন ধর্ম বলিব কেন? এরূপ বিরোধ নাই। সমুদ্রযাত্রা লোকহিতকর বলিয়া ধর্মানুমোদিত। সুতরাং ধর্মশাস্ত্রে যাহাই থাকুক, সমুদ্রযাত্রা হিন্দুধর্মানুমোদিত।
আপনার একান্ত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী,
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৩ জুলাই, ১৮৯২
কলিকাতা,
‘হিতবাদী’]
[গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়কে লিখিত]
নমস্কার পূর্বক নিবেদন
আপনার যাহা বক্তব্য তাহা কাল বৈকালে মুখে মুখেই বলিতে পারিতেন, তথাপি পত্রখানি যে নিজে হাতে করিয়া আনিয়াছিলেন, ইহা আমার বিশেষ সৌভাগ্য কারণ, মুখের কথা তখনই অন্তর্হিত হইত, কিন্তু পত্রখানি যত্ন করিয়া রাখিলে শত বৎসর থাকিতে পারে। আমি উহা যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিব এবং আমার মৃত্যুর পর ঐরূপ যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিবার জন্য আমার দৌহিত্রদিগকে বলিয়া যাইব। কারণ উহাতে আপনি আমাকে বলিয়াছিলেন যে “আপনার সম্মানে বঙ্গবাসী মাত্রেরই সম্মান করা হইয়াছে ও সম্মানও সম্মানিত হইয়াছে”। অন্যে এ কথা বলিলে, তাহার মূল্য যাহাই হউক, আপনি সত্যবাদী ও সমাজের শিরোভূষণ স্বরূপ অতএব আপনার এই উক্তি আমার বংশে চিরস্মরণীয় ও চিররক্ষণীয়।
যদি বিষবৃক্ষ অনুবাদিত হইয়া প্রথম পরিচিত হয় তখন একখানি ইংরেজি সংবাদপত্র (Scotsman) বলিয়াছেন যে, ঐ গ্রন্থ সংস্কৃত Epic কাব্যের Episode গুলির সহিত তুলনীয়, এবং একজন বলিয়াছেন যে Sophocles প্রণীত Antigone চরিত্রের পর আর ইহার তুল্য স্ত্রী চরিত্র কোন সাহিত্যে সৃষ্ট হয় নাই। এই সকল কথা আমি বড় গৌরবের কথা মনে করিয়াছিলাম। কিন্তু আপনার উক্তি আমার পক্ষে তদপেক্ষা অধিকতর গৌরবের হইয়াছে। ইতি ১৯ পৌষ ১৩০০ [২ জানুয়ারি ১৮৯৪]
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রতিবেদন
প্রতিবেদন বলতে কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যানুসন্ধান ভিত্তিক বিবরণী বোঝায়। কোন ঘটনা, তথ্য বা বক্তব্য সম্পকে সুচিন্তিত বক্তব্য প্রদানই প্রতিবেদন। প্রতিবেদন কথাটি ইংরেজি রিপোর্ট কথাটির বাংলা পারিভাষিক শব্দ। তবে প্রতিবেদন কথাটির পাশাপাশি ইংরেজি রিপোর্ট শব্দটি ও বাংলা ভাষায় প্রচলিত আছে। প্রতিবেদন রচনাকারীকে বলা হয় প্রতিবেদক। সাধারনত প্রতিবেদকের দায়িত্ব হল কোন বিষয়ের তথ্য উপাত্ত, সিদ্ধান্ত, ফলাফল ইত্যাদি খুঁটিনাটি অনুসন্ধানের পর বিবরণী তৈরি করে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠন বা কোন কতৃপক্ষের বিবেচনার জন্য পেশ করা।
প্রতিবেদন বিশেষ বিষয় বা কাজের বিশ্লষনী র্বণনা প্রকাশ পায়। প্রতিবেদনে কাজের নির্দেশ, পরামর্শ, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি সম্পর্কে ও মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদন বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতি অবলম্বনে রচিত বিবৃত বা বিবরণী বোঝায়। তথ্যগত ও সত্যনিষ্ঠ বিবরনীই প্রতিবেদন। প্রতিবেদন হলো কয়টি সুসংগঠিত তথ্যগত বিবৃতি যা কোন বক্তব্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত অথচ সঠিক বর্ণনা বিশেষ। একে যথেষ্ট সতর্কতা, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, গবেষনা ও বিচার বিশ্লেষণের পর তৈরি করতে হয়। প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোন বিষয়ে পুন:উপস্থাপন করা হয়ে থাকে ।
প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য:
প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্ট কোন বিষয়বস্তু সর্ম্পকে কর্তৃপক্ষকে সুস্পষ্টভাবে অবহিতকরা। এর বক্তব্য হবে নিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য অনুসারী।এতে জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা থাকবে। প্রতিবেদনে কোন বিষয় সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন কাজের সমন্বয় সাধন ও সিদ্ধন্ত গ্রহনে সহায়তা করে।
প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য:
প্রতিবেদন হতে হবে নির্দিষ্ট কাঠামো সম্বলিত এবং নিয়মানুযায়ী তা রচিত হতে হবে। কোন নির্দিষ্ট ঘটনা অবলম্বনে তা লিখতে হয় এবং তার বক্তব্য হবে যুক্তি যুক্ত প্রতিবেদন নিরপেক্ষভাবে রচনা করতে হয় এবং তাতে লেখকের ব্যক্তিগত আবেগের স্থান লাভের কোন সুযোগ নেই। প্রতিবেদনের বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটবে উপসংহার ও সুপারিশের মাধ্যমে।
প্রতিবেদন রচনায় অনুসরণীয় বৈশিষ্ট্যগুলো:
- সুনির্দিষ্ট কাঠামো:
কোন প্রতিবেদন প্রণয়নকালে একটি নির্দিস্ট কাঠামো অনুসারে করতে হয়। এতে থাকবে একটি শিরোনাম, প্রাপকের নাম-ঠিকানা, আলোচ্যবিষয়ের সূচিপত্র, বিষয়বস্তু, তথ্যপঞ্জি, স্বাক্ষর, তারিখ ইত্যাদি। - সঠিক তথ্য:
প্রতিবেদন রচিত হবে সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। কথ্যানুসন্ধান ই হল প্রতিবেদনের প্রধান কাজ। সেজন্য তথ্যের যথার্থতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। - সম্পূর্ণতা:
প্রতিবেদন যেসব তথ্য পরিবেশিত হবে তা হতে হবে নির্ভুল সম্পূর্ণ ওনির্ভরযোগ্য। - স্পষ্টতা:
প্রতিবেদনের বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টতা থাকবে যাতে বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা লাভ সহজ হয়। - সংক্ষিপ্ততা:
প্রতিবেদন হবে বাহুল্যবর্জিত ।বক্তব্য হবে সুনির্বাচিত এবংকোনঅনাবশ্যক বক্তব্য সংযোজিত হতে পারেনা - সুন্দর উপস্থাপনা:
প্রতিবেদনের উপস্থাপন হবে আকর্র্ষণীয় ।এরবক্তব্য সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ পায়। - সুপারিশ:
প্রতিবেদনে উপসংহারে সুপারিশ সংযোজন করতে হবে যাতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সমস্যা সম্পর্কে সিদ্ধন্ত গ্রহন করতে পারে ।
প্রতিবেদনের প্রকারভেদ:
প্রতিবেদন নানান প্রকার হয়ে থাকে।বিষয়ের বৈচিত্র্য অনুযায়ী প্রতিবেদনের ওবৈচিত্র্য অনুযায়ী প্রতিবেদনেরো বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়।বিভিন্ন প্রকার প্রতিবেদনের মধ্য উল্লেখযোগ্য হল:রীতিসিদ্ধ বা ফর্মাল প্রতিবেদন, রিতিবিরুদ্ধ বা িনফর্মাল প্রতিবেদন, নিয়মিত প্রতিবেদন, সাময়িক প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদন, নির্বাহীপ্রতিবেদন, প্রার্থিত প্রতিবেদন, অপ্রার্থিত প্রতিবেদন, কোম্পানিপ্রতিবেদন ইত্যাদি ।এছাড়া ও আছে সংগঠনের প্রতিবেদন, সরকারি প্রতিবেদন, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ইত্যাদি।
প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা:
প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যবসা -বানিজ্য, আইন আদালতো অন্যান ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের বিশেষ গুরুত্বো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আগে সাধারনত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণীকেই প্রতিবেদন বলে অবহিত কলা হয়েছে বা হত। কিন্তু বর্তমান কালে সমাজ জীবনের বিচিত্র জটিলতার প্রেক্ষিতে নানা জাতের প্রতিবেদনের গুরুত্ব বেড়েছে । এর উপযোগিতা মানুষের দৈনিক জীবনে ওব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।প্রতিবেদন থেকে আলোচিত বিষয় সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য অবগত হ ওয়া যায়।প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোন বিষয়ে পরি কল্পনা গ্রহন, সংগঠন, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, ফলাফল নিরূপণ, সমন্বয় সাধন ইত্যাদি কাজে সহায়তা পাওয়া যায়্ ।
প্রতিবেদনের বিভিন্ন অংশ :
প্রতিবেদনের তিনটি অংশ হল :১।প্রারম্ভিক অংশ ২।প্রধানঅংশ ৩।পরিশিষ্ট।
- প্রারম্ভিক অংশ:
প্রতিবেদনের প্রারম্ভিক অংশে থাকে প্রতিবেদনের মুল শিরনাম ।প্রাপকের নাম ঠিকানা, সূত্র বিষয়ের সংক্ষিপ্ত সার নির্দেশক কথা। - প্রতিবেদনের প্রধান অংশ:
প্রতিবেদনের প্রধান অংশে থাকে বিষয় সম্পর্কে ভূমিকা, মূলপ্রতিবেদন, উপসংহার ও সুপারিশ। - পরিশিষ্ট অংশ:
প্রতিবেদনের পরিশিষ্টে থাকে তথ্য নির্দেশ, গ্রন্থ বিবরণী, কমিটির তালিকা ও আনুসঙ্গিক বিষয়াদি। প্রতিবেদন রচনার পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত থাকলে উত্তম প্রতিবেদন প্রণয়ন করা সম্ভব।এসব পদ্ধতির মধ্যে আছে প্রতিবেদনের আকার, শ্রেণী, বৈশিষ্ট্য, রীতিনীতি ও বিন্যাস।
প্রতিবেদনের আকার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন সীমাবদ্ধতা নেই। বিষয়ের গুরুত্ব ও পরিধি অনুসারে তা ছোট হতে পারে, বড়ও হতে পারে। ছোট আকারের প্রতিবেদনে শিরনাম, বিষয়বস্তু সুপারিশ ও উপসংহার থাকে।বড় প্রতিবেদন পুস্তককারে হতেপারে এবং তাতে বিভিন্ন প্রকারের সারণি, চিত্র, নকশা, ছক, পরিশিষ্ট, তথ্যনির্দেশ ইত্যাদি সহ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা সংযুক্ত করা হয়।
সংযোজন
মধ্যমাগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং বহরমপুরের রামদাস সেন ও ভ্রাতুষ্পুত্র জ্যোতিষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত বঙ্কিমচন্দ্রের কয়েকখানি পত্রের পাণ্ডুলিপি নৈহাটী বঙ্কিম ভবনে রক্ষিত আছে। এই পত্রগুলি কোন কোন পত্রিকায় ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়। হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের “ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র” শীর্ষক পুস্তকেও এ সমুদয় গ্রথিত হইয়াছে। আমরা এখানে চিঠিগুলি দিলাম। পাঠক লক্ষ্য করিবেন কোন কোন পত্রে সম্পূর্ণ তারিখ নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উইলটিও এখানে দেওয়া হইল।
বঙ্কিমচন্দ্রের একখানি অসম্পূর্ণ নাটিকা বিমলচন্দ্র সিংহ “বঙ্কিম কণিকা” নামক পুস্তকে প্রকাশিত করিয়াছেন। ঐ গ্রন্থের ভূমিকায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নাটিকাটি সম্বন্ধেও বিমলচন্দ্র লিখিয়াছেনঃ “পূর্বের ন্যায় এ গুলিও আমার পিতামহদেবের সহধ্যায়ী ও সুহৃৎ শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ মহাশয়ের নিকট পাইয়াছি এবং তাঁহারই সস্নেহ অনুগ্রহে এগুলি প্রকাশ করা সম্ভব হইল। ইহার মধ্যে প্রথমটি একটি অসম্পূর্ণ নাটক—এ পর্যন্ত অপ্রকাশিত ছিল।”
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র
To Babu Sanjib Chandra Chatterjee
সেবক শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র শর্মণঃ
প্রণামা শত সহস্র নিবেদনঞ্চ বিশেষ—
আপনি যতীশের বিবাহ সম্বন্ধে যে পত্র লিখিয়াছেন, তাহার উত্তর আমি বাঙ্গলায় লিখিলাম। ইহার কারণ এই যে, আবশ্যক হইলে বা উচিত বিবেচনা করিলে পিতাঠাকুরকে পড়িতে পাঠাইয়া দিবেন।
শ্রীযুক্ত—আপনাকে যতীশের বিবাহ সম্বন্ধে ১৬০০৲ ষোলশত টাকা কর্জ করিতে বলিয়াছেন। কর্জ পাওয়া আশ্চর্য নহে। আপনি না পান শ্রীযুক্ত আজ্ঞা করিলে অনেকে কর্জ দিবে। কর্জ করিলে আপনার বর্তমান পাঁচ হাজার টাকা ঋণের উপর ৭০০০৲ টাকা হইবে। ইহা পরিশোধের সম্ভাবনা কি? এক্ষণে আপনি কত করিয়া মাসে কর্জ শোধ করিয়া থাকেন। কোন মাসে কুড়ি টাকা কোন মাসে কিছুই না। অদ্য ২০ বৎসর অবধি আপনি ঋণগ্রস্ত, কখনও ঋণের বৃদ্ধি ব্যতীত পরিশোধ করিতে পারেন না। ভবিষ্যতে যে অন্য প্রকার হইবে, তাহার কি লক্ষণ দেখা যায়? কিছুই না। তবে ইহা নিশ্চিত বলা যাইতে পারে যে, এক্ষণে আপনি যে ঋণ করিবেন, তাহা পরিশোধের সম্ভাবনা নাই।
যে ঋণ পরিশোধ করিতে পারেন না মনে জানিতেছেন, তাহা গ্রহণ করা পরকে ফাঁকি দিয়া টাকা লওয়া হয়। আপনি যদি এখন ১৫০০/- টাকা কর্জ করেন, তবে ঋণ গ্রহণ করাকে বঞ্চনা বলিতে হইবে। বরং ভিক্ষাবৃত্তি ভাল, তথাপি বঞ্চনা ভাল নহে। পিতৃ-আজ্ঞা পালনার্থ অথবা পিতার সুখবর্ধনের জন্য তাহা কর্তব্য নহে। এরূপ অধর্মাচরণ অপেক্ষা পিতার আজ্ঞা লঙ্ঘন কর্তব্য।
২। এই ৭০০০৲ টাকার ঋণ পরিশোধ হইবে না। ইহার পরিণাম কি হইবে? মহাজন ছাড়িবে না, তাহারা নালিশ করিয়া ডিক্রি করিবে। এমন কোন সম্পত্তি আমাদের নাই যাহা বিক্রয় করিয়া টাকা আদায় হইতে পারিবে। সুতরাং আপনি যে পরিমাণে পরামর্শের কথা লিখিয়াছেন, তাহা অন্যায় হইল কি প্রকার? এমন সর্বনাশ যাহাতে ঘটিবার সম্ভাবনা সে ঋণ কেন করিবেন? ইহা জানেন যে, ডিক্রি হইলে একখানি ওয়ারেণ্ট বাহির হইলেই আপনার চাকুরীটি যাইবে এরূপ নিয়ম হইয়াছে।
৩। আপনি যদি এই ঋণ বৃদ্ধি করেন তবে যতীশের যাবজ্জীবনের জন্য যে কি গুরুতর অনিষ্ট করিবেন তাহা বলা যায় না। যতীশ সে সবেরই দায়িক। যেদিন সে প্রথম উপার্জন করিতে শিখিবে সেই দিন হইতে এই ঋণের ভার তাহার মাথার উপর চাপিবে। আর ইহজন্মে তাহা নামাইতে পারিবে কি না বলা যায় না। আপনাদিগের অবস্থা দেখিয়া ভরসা হয় না যে কখনও উদ্ধার পাইবে। যাহার স্কন্ধে ঋণের ভার চাপে তাহার অপেক্ষা অসুখী পৃথিবীতে আর কেহ নাই। যত টাকা উপার্জন করে তাহার একটী পয়সাও আপনার বলিয়া বোধ করিবার অধিকার থাকে না। উদাহরণ আমাকেই দেখিতেছেন। রমেশ মিত্র হাইকোর্টের জজ্, আর আমি মালদহের ক্ষুদ্র চাকুরীজীবী, পিতৃঋণই ইহার কারণ। অতএব আপনি যদি আর ঋণবৃদ্ধি করেন তবে আপনাকে যতীশের শত্রু বিবেচনা করিব। যদি বলেন, ঋণ না করিলে পিতার এই শেষ অবস্থায় অত্যন্ত মনঃপীড়া পাইবেন। আমার বিবেচনায় তাঁহাকে এই সকল কথা বুঝাইলে তিনি কদাচ ঋণ করিতে বলিবেন না। তিনি পুত্রবৎসল, অবশ্য আপনার এবং যতীশের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের প্রতি দৃষ্টি করিবেন। যদি না করেন, তবে তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতে হইবে। পিতার অনুরোধে পুত্রের অনিষ্ট করিলে আপনি ধর্মে পতিত হইবেন।
আমার নিশ্চিত বিশ্বাস যে, এই সকল কথা তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলে, তিনি আপনাকে ঋণ করিতে দিবেন না। কিন্তু স্বয়ং ঋণ করিয়া যতীশের বিবাহ দিবেন। আপনার কাছে বিশেষ ভিক্ষা এই যে, কোন মতে তাহা করিতে দিবেন না। তিনি যদি ঋণ করিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তবে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন যে, তিনি যে ঋণ করিতেছেন, তাহা কে পরিশোধ করিবে? তিনি বলিবেন যে, আমার ২২৫৲ টাকা পেন্সন আছে, আমি তাহা হইতে পরিশোধ করিব। তখন বুঝাইয়া দিবেন যে, তাহা ভ্রম মাত্র। আজি নয় বৎসর হইল আমরা পৃথক হইয়াছি। তখন শ্রীযুক্তের ৮০০০৲ টাকা দেনা ছিল। এক্ষণে ৩৬০০৲ আছে, অতএব এই ৯ বৎসরে ৪৪০০৲ টাকা মাত্র পরিশোধ হইয়াছে। আমাতে ও দাদাতে ঋণ পরিশোধার্থেই নয় বৎসরে ৪৪০০৲ টাকা দিয়াছি। অতএব নয় বৎসরের মধ্যে শ্রীযুক্ত পেন্সন হইতে একটী পয়সাও কর্জ শোধ করেন নাই। অতএব ভবিষ্যতে করিবেন তাহার কোন সম্ভাবনা নাই।
অতএব তিনি এক্ষণে ঋণ করিলে পরিশোধ করিবে কে? তিনি বলিবেন, পুত্রগণ। কিন্তু পুত্রগণের মধ্যে মধ্যম নিজের দেনাই পরিশোধ করিতে অশক্ত, পিতৃঋণের এক পয়সাও পরিশোধ করিবার সম্ভাবনা নাই। কনিষ্ঠও তদ্রূপ, তাহার যে আয় তাহাতে কোনমতে সংসার নির্বাহ হয়, ঋণ পরিশোধ হইতে পারে না। জ্যেষ্ঠ এক পয়সাও দিবেন না, ইহা নিশ্চিত, বাকী আমি কেবল একা দায়ে ধরা পড়ি। অতএব তিনি যদি এখন যতীশের বিবাহের জন্য ঋণ করেন, তবে আমার ঘাড়ে ফেলিবার জন্য। উহা আমার প্রতি কতবড় অত্যাচার হইবে তাহা তাঁহাকে আপনি বুঝাইবেন।
আর একটি কথা যদিও অবক্তব্য, তথাপি এস্থলে না বলিলে নয়। আমার উপর রাগ করিবেন না, আমার দেহের প্রতি বিশ্বাস নাই। আমার শরীরে শ্বাস কাশাদির বীজ রোপিত আছে, অন্যান্য উৎকট রোগেরও লক্ষণ আছে। তাহার প্রতিকারের চেষ্টা করি না, কেন না দীর্ঘজীবন বাসনা করি না। অধিক দিন বাঁচিলে অধিক কষ্ট পাইতে হয় এবং প্রতিকারের চেষ্টায় কষ্ট পাইতে হয়, প্রায়ই কোন না কোন ব্যাধিতে আমার শরীর রোগগ্রস্ত।
অতএব কতদিন বাঁচিয়া থাকিব তাহা বলিতে পারি না, বোধহয় ঋণ পরিশোধ পর্যন্ত আমাকে বাঁচিতে হইবে না। আর কেবল ঋণ পরিশোধের জন্য বাঁচিয়া কি হইবে। কোন ঋণ হইতে মুক্তি না পাই, তবে রোগের কোন চিকিৎসা হইবে না।
যতীশের বিবাহে আপনি বা শ্রীযুক্ত এক পয়সাও ঋণ করিতে পারিবেন না। ইহাতে বলিবেন যতীশের কি বিবাহ দেওয়া হইবে না? আমার বিবেচনায় যতীশের বিবাহ দুই বৎসর পরেও ভাল, তথাপি ঋণ কর্তব্য নহে। নিতান্ত যদি বিবাহ দেওয়া কর্তব্য হয়, (কিন্তু তাহার প্রয়োজন নাই); অক্ষয় সরকারের কাছে আপনার চারিশত টাকা পাওনা আছে, সে এখন দিবে না সত্য বটে, কিন্তু গঙ্গাচরণকে ধরিতে পারিলে সে দিতে পারে, সেই চারিশত টাকা আদায় করুন। আর আপনি ২০০৲ টাকা দিতে পারেন, শ্রীযুক্ত ২০০৲, আমিও দুই শত টাকা দিব। এই হাজার টাকা ব্যয় করিয়া বিবাহ দিন। ঋণ করিতে পারিবেন না। এই সকল টাকা সংগ্রহ করিতে দুই তিন মাস লাগিবে। অতএব এই ফাল্গুন মাসে বিবাহ হইতে পারে।
প্রণতঃ বঙ্কিম
৩০ কার্তিক
শ্রীচরণেষু—
আপনি মঙ্গলবার যে পত্র লিখিয়াছিলেন তাহা আমি বৃহস্পতিবারে পাইয়াছি। আর বুধবারে যে পত্র লেখেন তাহা শুক্রবার পাইয়াছি। এরূপ বিলম্বের কারণ আপনার চিঠি সময়ে post হয় না। তিনটার মধ্যে চিঠি post করিতে হয়।
দাদার পীড়া মারাত্মক নহে তজ্জন্য ব্যস্ত হইবেন না। গোড়ায় Homeopathic treatment করিলে tap করিবার প্রয়োজন হইত না। এক্ষণে হইয়াছে ঔষধ আমি তাঁহাকে বলিয়া দিব যদি আর কখনও হয় তবে প্রথমাবস্থায় ব্যবহার করিলে সহজে আরাম হইবে। আমার ভরসা আছে রক্ষা পাইবেন।
যতদিন না নিঃশেষ আরাম হন ততদিন কলিকাতায় রাখিবেন। বোধ করি তাঁহার চিকিৎসার ব্যয় তাঁহাকে কিছুই বহন করিতে দেন নাই। ব্যয় আমার ব্যয়ে হওয়া কর্তব্য। টাকার প্রয়োজন হইলে উমাচরণকে বলিবেন সে সরবরাহ করিবে। দাদার নিঃশেষ আরোগ্য সম্বাদের প্রতীক্ষায় রহিলাম। ১০ই মাঘ।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শ্রীচরণেষু—
আপনার একখানা পত্র পাইলাম, তাহার তারিখ নাই, প্রায় থাকে না।
বরদা ভট্টাচার্য ৫৲ খাজানা পায় তজ্জন্য সে ৫X২০=১০০৲ পাইতে পারে। High Court ruling এই যে Every person should receive amount of compensation proportionate to his interest in the land, উহার interest ৫৲ annually— এ জন্য ১০০৲ পাইতে পারে। আমি ঐ ১০০৲ লইয়া সাধাসাধি করিয়াছি তাহাতে সে আমাকে কটূক্তি করিয়া গিয়াছে।
তার উপর উহাকে বলিয়াছি যে যদি তুমি না লও তবে তোমাকে চিরকাল ঐ খাজনা দিব। এবং তাহার খাজানা আদায়ের জন্য আমার অন্য সম্পত্তি আবদ্ধ রাখিয়া লেখাপড়া করিয়া registry করিয়া দিতে চাহিয়াছিলাম। তাহাতে সে রাজী না হইয়া কড়া কথা বলিয়া গিয়াছে।
তাহাকে কেহ বুঝাইয়াছে যে আমি ১২০০৲ টাকা পাইয়াছি তাহার মধ্যে ৮০০৲ তাহার প্রাপ্য, বড়বাবু আমাকে আটশত টাকা দিবার জন্য পুনঃ পুনঃ অনুরোধ করিয়াছেন এবং নিজে চণ্ডী ভট্টচার্য প্রভৃতিকে ফাঁকি দিবার জন্য আমার সাহায্য চাহিতেছেন। যখন জমি মাপ হয় তখন আমি ঝিনাইদহ ছিলাম, আমার লোকজন জরিপের সময়ে কেহ উপস্থিত ছিল না। তথাপি এই ভট্টাচার্য বলিয়া বেড়াইতেছে যে আমি জুয়াচুরি করিয়া খরিদা ব্রহ্মোত্তর বলিয়া তাহা খাইয়াছি এবং আপনাকেও ঐরূপ লিখিতে সাহস করিয়াছে। যখন কাঁটালপাড়ার সকল লোকের আমার প্রতি এই ব্যবহার, তখন কাজেই কাঁটালপাড়ার বাড়ী ফেলিয়া দিলাম।
ইতি ১১ জুন
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
Midnapore, 1887
17th Aug., ২রা ভাদ্র
শ্রীচরণেষু—
কাঁটালপাড়ায় স্কুল বা কলেজ বা University যাহাই হ’ক তাহাতে আমি কোন সাহায্য করিব না। কাঁটালপাড়ার পূজায় আমি টাকা দিব না। এ বৎসর আমি ও আমার পরিবার পূজার সময়ে মেদিনীপুরেই থাকিব। সুতরাং কলিকাতাতেও পূজা করিতে পারিলাম না।
যেখানে বরদা ভট্টাচার্যের মত ব্যক্তি আমাকে জুয়াচোর বলে, যে স্থানে রামকৃষ্ণ ও ব্রজনাথের মত লোক আমার পিতাকে জালসাজ বলে, যে দেশে বসন্ত ও চণ্ডী ভট্টাচার্যের মত লোকের সঙ্গে দলাদলি এবং যেখানে বড়বাবুর মত সহোদরের মুখদর্শন করিতে হয়, সে দেশের সঙ্গে আমি কোন সম্বন্ধ রাখিব না। সেখানে আমার দুর্গোৎসব হইবে না।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
আপনি বাড়ী আসিয়াছেন জানিয়া আনন্দিত হইলাম। আসিবেন তাহা জানিতাম, কেন না আমি দেখিয়াছি আপনার মনে রাগ ভিন্ন বৈরাগ্য উপস্থিত হয় নাই, রাগ পড়িয়া যায়, বৈরাগ্য ভিন্ন সংসার ত্যাগ হইতে পারে না। এজন্য আমি যতীশের মাতাকে বলিয়াছিলাম যে চারিমাস অপেক্ষা কর, কেননা টিকিটের ম্যায়াদ ৪ মাস। চারিমাসে না আসেন তখন ব্যস্ত হইও। যাহা হউক আসিয়া ভালই…
অনেক দুঃখ পাইয়াছেন; ইহাই প্রমাণ যে বৈরাগ্যের অনেক দেরী, মমতা পরিত্যাগই বৈরাগ্য, যাহা হউক আসিয়াছেন ভালই হইয়াছে, এখন আমার বোধ হইতেছে যে আমাকে আপনার ঠিকানা বলিয়া দিতে নিষেধ না করিলে ভাল হইত। কেননা আমি ঠিকানা বলিতে অস্বীকৃত হইয়া অনেকের কাছে শত্রু হইয়াছি, অন্ততঃ বড়বাবু ঐরূপ প্রতিপন্ন করিতেছেন।
চিরণ প্রভৃতির…অবস্থা তাহাও আমারই দোষ বলিতে হইবে, কেননা আমি মাসে ত্রিশ টাকা মাত্র দিয়াছি কিন্তু আমারও দোষ বড় নাই কেননা আমি আপনাকে টাকা পাঠাইয়াছি। আপনি বিদেশ যাত্রার পর তাহাকে কিছু দিই নাই বটে…সে খুচরা ১০/২০ টাকা নিতে নারাজ এককালীন বেশী দিতে হইবে। আমি টাকার সাশ্রয় করিবার জন্য বাড়ীর ত্রিশ টাকা বরাদ্দ করি নাই। কিন্তু অনেকের সেই বিশ্বাস এবং সেইজন্য আমি নিন্দিত হইয়াছি। বড়বাবুর কাছে অনেক গালি খাইয়াছি। কপালী যে তাহার ভাইকে ২৫৲ টাকা দেয় সেই দৃষ্টান্ত দ্বারা আমার চরিত্রের শোধন করিবার চেষ্টা পাইয়াছেন। বড়বাবু…
তিনি আমাকে সম্প্রতি লিখিয়াছেন তাঁহার সহিত শত্রুতা করাই ভায়েদের কার্য, তিনি মরিলে আমরা কি করিব জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। আমি কোন উত্তর দেই নাই।
শ্রীচরণেষু—
27.12.87
জ্যোতিশের নিজ পরিবার প্রতিপালন…কিন্তু আপনার ভার তাহার উপর আমার দিবার ইচ্ছা নাই। তাহা পূর্বপত্রে লিখিয়াছিলাম। এবং এক্ষণে সবিস্তার বিবেচনা করিয়া লিখিতেছি—
স্বর্গীয় কর্তা মহাশয় জীবিত থাকিতে তাঁহার (১) আহার (২) পরিধেয় (৩) চিকিৎসা এই তিন প্রকারের ব্যয় আমরা নির্বাহ করিতাম। আপনার সম্বন্ধেও আমি তাহাই করিতে চাহি। অতএব ইহার বন্দোবস্ত আমি নিম্নলিখিতভাবে করিলাম।—
(১) নিজ প্রয়োজনীয় ঘৃত ময়দা কিনিয়া দিয়া আসিবে। /১॥• সের দুগ্ধ বরাদ্দ থাকিতে পারে তাহার মূল্য মাস মাস আমি দিব…
(২) বস্ত্র…তা এবং শয্যা গাত্রবস্ত্র প্রভৃতি যখন যাহা নিজের জন্য প্রয়োজনীয় হইবে উমাচরণকে বা আমাকে জানাইলে পাঠাইয়া দিব।
(৩) আপনার নিজ চিকিৎসার বিল ডাক্তারকে আমার কাছে পাঠাইতে বলিয়া দিলাম।
কর্তার প্রতি যাহা করিতাম আপনার প্রতি তাহা করিতে চাহিতেছি ইহাতে আপনার অনভিমত হইবে না বিবেচনা করি।
…দ্বারা লেপের খোল পাঠাইয়া দিয়াছি পৌঁছ সংবাদ দিবেন। ১৩ পৌষ।
জ্যোতিষচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র
নীলমণি কি পাইবে না পাইবে তাহা জানি না। তুমি আমার বড় সুসময় দেখিয়াছ। রথযাত্রা, ঠাকুর বাড়ীর মেরামত, তোমার কন্যার বিবাহ, বাকী দেনার পরিশোধ (তোমার ছোটকাকা কিছুই দিলেন না।) ইত্যাদিতে ব্যতিব্যস্ত, এই সময় তুমি গচ্ছিত টাকার মত ব্যতিব্যস্ত করিয়াছ। আমার অসাধ্য হইয়াছে—ইতি—
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
তাং ২৩শে আষাঢ়
কাল তোমাকে যখন পত্র লিখিয়াছিলাম, তখন আমার তেতলা ঘরে আগুন লাগিয়াছিল। ঘর পোড়ে নাই কিন্তু বিস্তর দ্রব্য সামগ্রী পুড়িয়া ক্ষতি হইয়াছে। সেই সময়ে তোমার পত্র পাইয়া উত্তর দিয়াছিলাম, তাই অমন পত্র লিখিয়াছিলাম। নহিলে লিখিতাম না। টাকাকড়ি এক পয়সা হাতে নাই। পূঁজি ভাঙ্গিয়া বিবাহের উদ্যোগ করিতেছি—
ইতি—তাং ২৪শে আষাঢ়
1st Aug. 1889
প্রিয়তমেষু—
তোমার পত্র পাইয়া ও তুমি কঠিন রকম পড়িয়া যাওয়ার সম্বাদ পাইয়া চিন্তিত আছি। কোথায় কি রকম জখম হইয়াছে কিরূপ চিকিৎসা হইতেছে এক্ষণে কেমন আছ আর এখন লোক পাঠান আবশ্যক কিনা লিখিবে।
তুমি বাড়ী আসিলে সপিণ্ডীকরণ হইবে। আমি সেই সময় দিনস্থির করিয়া দিব। ভাদ্র মাস পড়িতে না পড়িতে যাহাতে পরিবার লইয়া যাওয়া হয় সে চেষ্টা করা আবশ্যক।
কাঁটালপাড়ার সব ভাল আছে, সংবাদ পাইয়াছি।
14th Aug., 1889
কল্যাণবরেষু—
তোমার পত্র পাইয়াছি। তুমি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিয়াছ কিনা লিখিবে। তোমার কনিষ্ঠ পুত্রের অন্নপ্রাশন এক্ষণে হইতে পারে না, কেননা তাহার সর্বাঙ্গে ফোঁড়া ও জ্বরও কখন কখন হইয়া থাকে। অসুস্থ শরীরে অন্নপ্রাশন দিতে নাই। উপনয়নের সময়ে হইবে।
সুতরাং এক্ষণে সপিণ্ডীকরণের প্রয়োজন নাই। নীলমণি মুড়াগাছায় গিয়াছিল। পুনশ্চ আসিয়াছে; সে মুড়াগাছায় যাওয়ার পর আমার পরিবারবর্গ লইয়া রাখিতে কাঁটালপাড়ায় গিয়াছিল, এক্ষণে তাহারা সেইখানেই আছে অতএব চিন্তার বিষয় নাই।
টাকা মাসকাবারে কৈলাসের নিকট পাঠাইব। কৈলাসকে টাকা মজুত রাখিতে বলিবে, আমি বাড়ী গিয়া খরচপত্র করিব। আমি সংসারের সকল বন্দোবস্ত করিতেছি।
যদি মেহেরপুরে পীড়া বেশী না থাকে তবে পরিবার লইয়া যাওয়াই ভাল। কেননা তোমার নিজের তত্ত্বাবধান না হইলে ছেলেগুলি ভাল থাকে না। আর তোমাদের বাড়ীর কূয়া-পায়খানা অতিশয় অনিষ্টকারী জানিবে।
অনিলার একটী সম্বন্ধ আসিয়াছে। পাত্র ধনী ব্যক্তি, সব ভাল কিন্তু বয়স ৩৬ বৎসর। তোমার মত কি-না। অনিলার বিবাহে ব্যয় করা তোমার বা আমার ক্ষমতা নাই, অতএব যাহাতে অল্পব্যয় হয় তাহাই খুঁজিতে হয়। কৃতদার পাত্রে ব্যয় হইবে না।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
২৮শে শ্রাবণ
প্রাণাধিকেষু—
এবার যখন কোন সুযোগ পাইবে আমার ঘরের চাবির গোছা পাঠাইয়া দিও। তোমার পিতার আমলের বঙ্গদর্শন তিন বৎসর আমার জন্য বাঁধাইয়া দিও।
আমি এক বেল কাগজ পাঠাইয়াছি, পৌঁছিয়াছে কিনা সংবাদ পাই নাই। সংবাদ লিখিবে। রথের সে ১৫ টাকা কি হইল লিখিবে। বড়বাবু দিয়াছেন কি?
আনন্দমঠ যে সংখ্যায় বাহির হইয়াছে সেই সংখ্যা হইতে এক কপি বঙ্গদর্শন অক্ষয় সরকারকে দিও। “With B.C. Chatterjee’s compliments” লিখিয়া দিও। তাহা হইলে তোমাদের দেওয়া বুঝাইবে না। আনন্দমঠ শেষ হইলে দেওয়া বন্ধ করিবে।
আমায় হাবড়ায় পত্র লিখিও। বঙ্গদর্শন অচল হইলে আমাকে জানাইও। টাকা বা matter সম্বন্ধে যাহা উপকার করিতে পারি করিব।
রাধানাথ আমাকে আন্দাজি ৩০৲ দিয়াছে। তোমাদের যদি despatch বন্ধ থাকে তবে লিখিও, আমি টাকা পাঠাইব।
ইতি তাং ১৪ জুলাই
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চাটার্জি
ঝিনাইদাহ, ২২শে কার্তিক
প্রিয়তমেষু—
তোমার পিতাকে আর অধিক কুইনাইন খাওয়াইবা না। কলিকাতায় পাঠাইবা। আমি জ্বরে বড় কষ্ট পাইয়াছি। যশোহর হইতে ডাক্তার ও ঔষধ আনাইয়া চিকিৎসা হইয়াছে। কাল রাত্রিতে জ্বর ছাড়িয়াছে। এই পত্রের সহিত তোমাদের সাংসারিক খরচ ১০০৲ টাকা, পূজার ১০৲ টাকা, ৺ঠাকুর সেবার বাকী ১৬৲, একুনে ১২৬৲ টাকা পাঠাইলাম। তোমার পিতর হাতে দিবে।
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রাণাধিকেষু,
বারাসতের ডেপুটি-ম্যাজিষ্ট্রেট কেদার বসু রবিবার দিন প্রাতে কাঁটালপাড়ায় যাইবেন ও বৈঠকখানায় দুইদিন বাস করিবেন। বৈঠকখানাটি ঝাঁট দিয়া সাফ করাইয়া টেবিল চৌকি পাতিয়া রাখিবা। শয়ন জন্য একখানি তক্তপোষ পাতিয়া দিবা। রন্ধন জন্য কোন চালা সাফ করাইয়া রাখিবা, রাত্রিতে শয়ন জন্য আমায় যেরূপ বিছানা দাও, সেইরূপ দিবা। কেদারবাবু বড় ভদ্রলোক, পরম বৈষ্ণব ও শুদ্ধাচার। তাঁহাকে আনাইবার জন্য ষ্টেশনে ৮||• টার ট্রেণে লোক উপস্থিত থাকিলে ভাল হয়।
পুঃ কর্তার সপিণ্ড সময়ে সমাজ খাওয়ানো হয় নাই, আগামী বুধবার উদ্যোগ করার ইচ্ছা আছে, আম্র দধি ইত্যাদির বন্দোবস্ত রাখিবা। ভাল গ্লাস দেওয়ার জন্য কুম্ভকার ঠিক করিবা।
কেদারবাবুকে আনিতে ষ্টেশনে তুমি নিজে গেলে ভাল হয়।
আং শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
প্রিয়তমেষু,
মুরলী যে কাঁটালপাড়ায় যায় এমন কোন সম্ভাবনা নাই। বড়বাবুরও চাকর নাই। চাকর যাহাকে যাহাকে বহাল করিয়াছিলেন তাহারা পালাইয়াছে। কেহ থাকিতে চাহে না। আজ তিনি পৃথক বাসা করিয়াছেন, তাঁহার বাসায় অটল মোতায়েন আছে, অতএব মুরলীকে পাঠাইলে আমার বাসায় কাজ চলিবে না। অটল মুরলী উভয়ে উপস্থিত না থাকিলে বড়বাবুর কার্য চলে না। কেননা তাঁহার বাসায় জনপ্রাণী নাই। আমার কাঁটালপাড়া যাইবার কোন সম্ভাবনা নাই। বড়বাবুর অবস্থা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হইতেছে, কখন কি রকম হয় তাহার স্থির নাই। তিনি আমাকে কোথাও যাইতে দেন না। রাত্রে উঠাইয়া আনেন। সুতরাং তাঁহাকে ফেলিয়া আমি কাঁটালপাড়া যাইতে পারিব না।
তোমার জ্যেষ্ঠতাতের এই মরণাপন্ন অবস্থা, আর তোমার পিতার শয্যাগত এই অবস্থায় তুমি যে ভোজের ঘটা বাধাইয়াছ তাহা অতি বিস্ময়কর। তোমার বালকবুদ্ধি আজও যায় নাই।
যাহা হউক সেখানে মুরলীর যাওয়া হইল না। সেখানে লোকাভাবে অটলকে পাঠান হইল না। আমার ছুরিকাঁটা যাহা ছিল তাহা ঝিনাইদহ হইতে আসিবার সময় Shirres সাহেবকে দিয়া আসিয়াছি। বেসেট যাহা আছে তাহা টেবিলে বাহির করা যায় না।
আমার বিবেচনায় যদি গোপেন্দ্রকৃষ্ণকে খাওয়াইতে হয়, তবে আমাদের দেশী ব্যঞ্জনাদি উত্তম করিয়া খাওয়াইলে ভাল হইতে পারে। তুমি যে ২||• পাঠাইয়াছিলে তাহা ফেরত পাঠাইলাম।
ইতি তাং বুধবার
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
১লা ফেব্রুয়ারী ১৮৮৬
প্রিয়তমেষু—
তোমার চাকরী হওয়ার সংবাদ পাইয়া আমার বিশেষ আনন্দ হইয়াছে। তোমার চাকরীতে আমার বিশেষ উপকার; কিন্তু তাহা তত আনন্দের কারণ নহে। তুমি অমানুষ হইয়া যাইতেছিলে, এক্ষণে মনুষ্যত্বলাভ করিতে পারিবে। আর আমি আজ মরিলে কাল তোমাদের সংসার নির্বাহের উপায় ছিল না। সে উপায় হইল, ইহাই আমার আনন্দের কারণ।
কোন organic disease না থাকিলে কেহই certificate দিতে অস্বীকার করে না। তোমার সেরূপ কোন পীড়া নাই। কর্মকার্য সম্বন্ধে উপদেশ চাহিয়াছ তাহা আমি দিব। অনুবর্তী হইলে তোমার উপকার হইবে। আপাততঃ নিম্নলিখিত বইগুলি মনোযোগ পূর্বক অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করিবে।
(1) Code of Cr. Procedure Chap. 5, 6, 7, 14, cal 3 sub, II,
(2) Penal Code.
(3) Evidence Act.
(4) Police Manual.
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
কল্যাণবরেষু—
তোমার পত্র পাইয়াছি, আঙ্গুলের একটু বেদনা হওয়ায় নিজহাতে পত্র লিখিতে পারিলাম না। তুমি নূতন কার্যে প্রবৃত্ত হইয়া যেরূপভাবে ব্যবহার করিতেছ তাহাতে সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা নাই। উপরওয়ালা সাহেবরা যখন যাহা বলিবেন তখনই তাহা স্বীকার করিতে হইবে এবং সাধ্যানুসারে তাহা সম্পন্ন করিতে হইবে। রাসবিহারীবাবু কুলোক হইলেও তাঁহার উপর কিছুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করিবে না। তাঁহার সম্বন্ধে কোন কথা সাহেবের নিকট বা অপর কাহারও নিকট কিছুমাত্র বলিবে না এবং তাঁহার খুব আনুগত্য করিবে। তিনি কাজ শেখান বা না শেখান আপনি কাজ শিখিবে। যে আপনি কাজ শিখিতে জানে তাহার পরের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না, যে আপনি কাজ শিখিতে না জানে পরের সাহায্যে তাহার কোন উপকার হয় না। সাহেব যদ্যপি তোমাকে পুনর্বার “কুষ্টিয়া” যাইতে বলেন তখনই তাহা স্বীকার করিবে, কাজের জন্য আটকাইবে না। অপরজনকে জিজ্ঞাসা করিয়া কাজ করা যাইতে পারে। Magistrate সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ হইলে তোমাকে সদরে রাখার জন্য কোন কথা বলিবে না। ইহাকে “ঘোড়া ডিঙ্গাইয়া ঘাস খাওয়া বলে।” District সাহেব তাহাতে খুব রাগ করিবার সম্ভাবনা। বংশমর্যাদা লইয়া একশবার বড়াই করিবে না, উহাতে লোক বিরক্ত হয়, উপহাস করে এবং বংশেও এমন কিছু গৌরবের কথা নাই যে সকলের কাছে সে বড়াই করা যায়। অমুককে কুষ্টিয়া দাও, আমি যাইব না, এমন সকল কথা সাহেবের কাছে বলিবে না। সর্বদা নম্রভাবে চলিবে। নম্রতা শিক্ষা তোমার নিতান্ত আবশ্যক। যাহারা তোমাকে পরামর্শ দিয়াছে যে, তুমি ছয়মাসকাল সদরে থাকিতে চাও একথা তুমি জোর করিয়া বলিতে পার, তাহারা তোমার পরম শত্রু। জোর করিয়া কোন কথা বলিলে তোমার চাকরী থাকিবে না। সাহেবের যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে পারে। বাঙ্গালী বিশেষতঃ তোমার মত ক্ষুদ্র চাকুরের কোন কথায় জোর চলে না ইহা নিশ্চিত জানিও। কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে। রাসবিহারীবাবু কি অন্য কাহাকেও শত্রু করিও না। ইতি—১৭ই ভাদ্র
শ্রীবঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়
তুমি বোধকরি পূজার সময় বাড়ী গিয়াছিলে, এতদিনে ফিরিয়া আসিয়া থাকিবে। আমার নিকট উপদেশ চাহিয়াছিলে, আমি এই পত্রের মধ্যে সাতটী উপদেশ লিখিয়া পাঠাইলাম। এই সাতটী Golden Rule বিবেচনা করিবে। বিশেষ প্রথম পাঁচটি। ইহার অনুবর্তী হইলে সর্বত্র মঙ্গল ঘটিবে।
এখানকার সমস্ত মঙ্গল। ভরসা করি এই মাস হইতে তুমি সংসারের ভার লইতে পারিবে। ইতি—১লা আশ্বিন
শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিশেষ উপদেশ
১। প্রথম প্রয়োজনীয় কথা—সত্য ভিন্ন মিথ্যা পথে যাইবে না। কলমের মুখে কখন মিথ্যা নির্গত না হয়। তাহা হইলে চাকরী থাকে না। নিতান্তপক্ষে কর্তৃপক্ষের অবিশ্বাস জন্মে। অবিশ্বাস জন্মিলে আর উন্নতি হয় না।
২। দ্বিতীয়—প্রয়োজনীয় কথা পরিশ্রম। বিনা পরিশ্রমে কখন উন্নতি হয় না। কখনও কোন কাজ পড়িয়া না থাকে।
৩। উপরওয়ালাদের আজ্ঞাকারিতা। তাঁহাদিগের নিকট বিনীত ভাব। চাকরী রাখার এবং উন্নতির পক্ষে ইহা নিতান্ত প্রয়োজনীয়। তর্ক করিও না।
৪। আপনার কাজের Rules & Hours বিশেষরূপে অবগত হইবে।
৫। কাহারও উপর অত্যাচার করিবে না। পুলিশের লোকে আসামীর উপর বড় অত্যাচার করে। অনেকের বিশ্বাস তাহা না হইলে কাজ চলে না, তাহা ভ্রান্তি। না চলে সেও ভাল। ইহা নিজে কখন করিবে না বা অধীনস্থ কাহাকেও করিতে দিবে না। ইহার কারাদণ্ড আছে।
৬। সকলের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করিবে। অধীনস্থ ব্যক্তিদিগকে সদ্ব্যবহার দ্বারা বশীভূত করিবে। কেহ শত্রু না হয়। কর্তব্য কর্মের অনুরোধে অনেকের অনিষ্ট করিতে হয়। উহার উপায় নাই। দোষীর অবশ্য দণ্ড চাই।
৭। নিষ্কারণে ভীত হইও না।
রামদাস সেনকে লিখিত পত্র
সুহৃদ্বরেষু—
আপনার প্রণয়োপহার স্বরূপ গ্রন্থ দুইখানি পাইয়াছি। পীড়াপ্রযুক্ত এতদিন পুস্তক প্রাপ্তির সংবাদ ও পত্রের উত্তর লিখিতে পারি নাই। অপরাধ মার্জনা করিবেন। কমলাকান্তের দ্বিতীয় সংস্করণ একখণ্ড আপনার নিকট পাঠাইবার জন্য কলিকাতায় আমার কার্যকারককে লিখিয়াছি। ভরসা করি আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। ১লা অগ্রহায়ণ
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বিপিনচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত পত্র
প্রিয়তমেসু—
মেজবাবুর রীতিমত চিকিৎসা করাইবে। ব্যয় জন্য কুণ্ঠিত হইবে না। আমার কাঁটালপাড়া যাওয়া দুর্ঘট। Suburban Police Court এর চার্জ আমার নিকট, Confession or Dying Declaration লিখিতে হয়, এজন্য কোথাও যাইতে বাসনা করি না। তবে নিতান্ত আবশ্যক হইলে তখন বিবেচনা করা যাইবে।
ডাক্তার যেরূপ বলিয়াছে আমার সেরূপ বোধ হয় না। কোন চিন্তার বিষয় নাই। মেজবাবুর ওরূপ জ্বর হইয়া থাকে। এক্ষণে কেমন থাকে আগামী কালই আমাকে সম্বাদ দিবে।
আমার নিজের ব্যবস্থা, এক আধ dose China দিবে। China এই অবস্থায় বলকারক।
পুঃ আমি রবিবার কাঁটালপাড়া যাইব।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্রের শেষ উইল
লিখিতং শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পিতা ৺যাদবচন্দ্র জাতি ব্রাহ্মণ সাং কাঁটালপাড়া পরগণা হাবিলীসহর ষ্টেশন ও সবরেজিষ্টারী নৈহাটী ডিষ্ট্রিক্ট রেজিষ্টারী ২৪ পরগণা হাল সাকিন কলিকাতা পটলডাঙ্গা ৫নং প্রতাপ চাটুয্যের লেন কস্য উইল পত্রমিদং কার্যঞ্চাগে, যেহেতু আমার শরীর অসুস্থ হওয়ায় এবং আমার সাবেক উইল পরিবর্তন করা আবশ্যক বোধ হওয়ায় আমি নিম্নলিখিত উইল করিতেছি—
১ দফা কলিকাতা পটলডাঙ্গার ৫ নম্বর প্রতাপ চাটুয্যের গলির ভদ্রাসন বাটীর ও ৪ নম্বর দুর্গাপ্রসাদ ঘোষের নামীয় জমি যাহাতে আমি স্বত্ত্বাধিকারী ও দখলিকার আছি, আমার মৃত্যুর পর হইতে আমার বনিতা শ্রীমতী রাজলক্ষ্মী দেবী তদুভয়ের সম্পূর্ণ স্বত্তাধিকারিণী হইবেন এবং তদুভয়ের তাঁহার দান বিক্রয় ও হস্তান্তর করিবার সম্পূর্ণ অধিকার এবং তিনি উইল করিয়া অন্যকে দিয়া যাইতে পারিবেন কেবল উপদেশ বা পরামর্শ স্বরূপ আমি লিখিতেছি যে তিনি ঐ উভয় সম্পত্তি আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবীকে উইল করিয়া দিয়া যাইবেন কিন্তু এই উপদেশের দ্বারা তাঁহার অন্যপ্রকার হস্তান্তর করার ক্ষমতা কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ করিতেছি না।
২ দফা আমার অপরাপর স্থাবর সম্পত্তি সম্বন্ধে উইল করার কোন প্রয়োজন দেখি না।
৩ দফা আমার মৃত্যুর পর আমার সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তিতে আমার বনিতা আইনানুসারেই সম্পূর্ণ অধিকারিণী হইবেন এজন্য সে সম্বন্ধেও কোন উইলের প্রয়োজন নাই, আমার পুস্তকের কপিরাইট অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে গণ্য।
৪ দফা আমার কৃত সাবেক উইল সমস্ত বাতিল ও নামঞ্জুর হইল। ইতি—১৮৯০। ২৩ মে—
সার্থক ভাষনের বৈশিষ্ট্য
- বিষয় বস্তু সম্পর্কে সুস্পস্ট ধারনা
কোন বিষয় সম্পর্কে উত্তম ধারনা না থাকলে সে বিষয়ে ভাল ভাষন দেয়া যায় না। বক্তাকে তার বক্তব্যের বিষয়ে গভির জ্ঞান অর্জন করতে হবে। - বক্তব্যের ধারাবাহিকতা:
ভাষনের মধ্যে বিষয়কে পূর্বাপর সামঞ্জস্য রক্ষা করে ধারাবাহিকভাবে ও সুসৃঙ্খলতার সাথে উপস্থাপন করতে হবে। বিষয়ের বিভিন্ন সূত্রের গুরুত্ব বিবেচনা করে ধারাবাহিকতা সাজাতে হবে। - ভাবের সংগতি:
ভাষনের বক্তব্য অবশ্যই বিষয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। - পূনরুক্ত বর্জন:
একই কথা বারবার বললে শ্রোতারকাছে তা ভালো সোনায় না,শ্রোতার ধয্যচ্যুতি ঘটায়। - সূচনা ও উপসংহার:
ভাষনে থাকবে আকর্ষনীয় সূচনা এবং পরিতৃপ্তকর উপসংহার - যুক্তি, উপমা ও উদ্ধৃতির প্রয়োগ:
ভাষনের বিষয় আলোচনার জন্য প্রয়োজনে যুক্তির অবতারনা করতে হবে। উপমা ও উদ্ধৃতির সঠিক প্রয়োগে বক্তব্যকে স্পস্ট ও হৃদয়গ্রাহী করতে সক্ষম হতে হবে। - বক্তব্যে আন্তরিকতা:
ভাষনে বক্তার আলোচ্যবিষয় সম্পর্কে আন্তরিকতা ফুটে উঠতে হবে। যা বলা হবে তা সম্পর্কে আস্থাশীল থাকতে হবে, কোন দিধা-দ্বন্দ থাকতে পারবে না। - ভাষা নির্বাচন:
বিষয়বস্তু উপযোগি ভাষা নির্বাচন করতে হবে। - ভাষারীতি:
ভাষনের ভাষা হবে চলিত রীতি। - ভাষার বোধগম্যতা:
সহজ সরল ভাষা ব্যবহার করতে হবে। শ্রোতার শিক্ষার মান বিবেচনা করে ভাষার প্রয়োগ করতে হবে। - আবেগময় ভাষার পরিমিতবোধ:
ভাষনে আবেগ-উচ্ছ্বাস প্রকাশে সংযত হতে হবে। শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তারে আবেগের প্রয়োজন হতে পারে তবে বহুল্য বর্জন করতে হবে। - রসবোধ:
ভাষনের প্রকাশভঙ্গিতে রসের সঞ্চার করতে হবে। হাস্যরস,রম্যকৌতুক ব্যবহারে পরিমিতবোধ থাকতে হবে। - বাচনভঙ্গি:
ভাষনের সুষ্ঠ উপস্থাপনের জন্য আকর্ষনীয় বাচনভঙ্গির প্রয়োজন।
ধর্ম্মতত্ত্ব
ক্রোড়পত্র-ক
(মল্লিখিত “ধর্ম্মজিজ্ঞাসা” নামক প্রবন্ধ হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করা গেল।)
ধর্ম্ম শব্দের আধুনিক ব্যবহার-জাত কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন অর্থ তাহার ইংরেজি প্রতিশব্দের দ্বারা আগে নির্দ্দেশ করিতেছি, তুমি বুঝিয়া দেখ। প্রথম, ইংরেজি যাহাকে Religion বলে, আমরা তাহাকে ধর্ম্ম বলি, যেমন হিন্দুধর্ম্ম, বৌদ্ধধর্ম্ম, খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম। দ্বিতীয়, ইংরেজ যাহাকে Morality বলে, আমরা তাহাকেও ধর্ম্ম বলি, যথা-অমুক কার্য্য “ধর্ম্ম-বিরুদ্ধ” “মানবধর্ম্মশাস্ত্র,” “ধর্ম্মসূত্র” ইত্যাদি। আধুনিক বাঙ্গালায় ইহার আর একটি নাম প্রচলিত আছে-নীতি। বাঙ্গালি একালে আর কিছু পারুক আর না পারুক “নীতিবিরুদ্ধ” কথাটা চট্ করিয়া বলিয়া ফেলিতে পারে। তৃতীয়, ধর্ম্ম শব্দে Virtue বুঝায়। Virture ধর্ম্মাত্মা মনুষ্যের অভ্যস্ত গুণকে বুঝায়; নীতির বশবর্ত্তী অভ্যাসের উহার ফল। এই অর্থে আমরা বলিয়া থাকি-অমুক ব্যক্তি ধার্ম্মিক, অমুক ব্যক্তি অধার্ম্মিক। এখানে অধর্ম্মকে ইংরেজিতে Vice বলে। চতুর্থ, রিলিজন বা নীতির অনুমোদিত যে কার্য্য, তাহাকেও ধর্ম্ম বলে, তাহার বিপরীতকে অধর্ম্ম বলে। যথা-দান পরম ধর্ম্ম, অহিংসা পরম ধর্ম্ম, গুরুনিন্দা পরম অধর্ম্ম। ইহাকে সচরাচর পাপপুণ্যও বলে ইংরেজিতে এই অধর্ম্মের নাম “Sin”-পুণ্যের এক কথায় একটা নাম নাই-“good deed” বা তদ্রূপ বাগ্বাহুল্য দ্বারা সাহেবেরা অভাব মোচন করেন। পঞ্চম, ধর্ম্ম শব্দে গুণ বুঝায়, যথা-চুম্বকের ধর্ম্ম লৌহাকর্ষণ। এস্থলে যাহা অর্থান্তরে অধর্ম্ম, তাহাকেও ধর্ম্ম বলা যায়। যথা “পরনিন্দা-ক্ষুদ্রচেতাদিগের ধর্ম্ম।” এই অর্থে মনু স্বয়ং “পাষণ্ডধর্ম্মের” কথা লিখিয়াছেন, যথা-
“হিংস্রাহিংস্রে মৃদুক্রুরে ধর্ম্মাধর্ম্মাবৃতানৃতে।
যদ্যস্য সোহদধাৎ সর্গে তত্তস্য স্বয়মাবিশৎ ||”
পুনশ্চ-
“পাষণ্ডগণধর্ম্মাংশ্চ শাস্ত্রেহস্মিন্নুক্তবান্ মনুঃ।”
আর ষষ্ঠতঃ, ধর্ম্ম শব্দ তখন আচার বা ব্যবহারার্থে প্রযুক্ত হয়। মনু এই অর্থেই বলেন,-
“দেশধর্ম্মান্ জাতিধর্ম্মান্ কুলধর্ম্মাংশ্চ শাশ্বতান্।”
এই ছয়টি অর্থ লইয়া এ-দেশীয় লোক বড় গোলযোগ করিয়া থাকে। এই মাত্র এক অর্থে ধর্ম্ম শব্দ ব্যবহার করিয়া পরক্ষণেই ভিন্নার্থে ব্যবহার করে; কাজেই অপসিদ্ধান্তে পতিত হয়। এইরূপ অনিয়ম প্রয়োগের জন্য ধর্ম্ম সম্বন্ধে কোন তত্ত্বের সুমীমাংসা হয় না। গোলযোগ আজ নূতন নহে। যে সকল গ্রন্থকে আমরা হিন্দুশাস্ত্র বলিয়া নির্দ্দেশ করি, তাহাতেও এই গোলযোগ বড় ভয়ানক। মনুসংহিতার প্রথমাধ্যায়ের শেষ ছয়টি শ্লোক উহার উত্তম উদাহরণ। ধর্ম্ম কখন রিলিজনের প্রতি, কখন নীতির প্রতি, কখনও অভ্যস্ত ধর্ম্মাত্মতার এবং কখন পুণ্যকর্ম্মের প্রতি প্রযুক্ত হওয়াতে-নীতির প্রকৃতি রিলিজনে, রিলিজনের প্রকৃতি নীতিতে, অভ্যস্ত গুণের লক্ষণ কর্ম্মে, কর্ম্মের লক্ষণ অভ্যাসে ন্যস্ত হওয়াতে একটা ঘোরতর গণ্ডগোল হইয়াছে। তাহার ফল এই হইয়াছে যে, ধর্ম্ম (রিলিজন)-উপধর্ম্মসঙ্কুল, নীতি-ভ্রান্ত, অভ্যাস-কঠিন, এবং পুণ্য-দুঃখজনক হইয়া পড়িয়াছে। হিন্দুধর্ম্মের ও হিন্দুনীতির আধুনিক অবনতি তৎপ্রতি আধুনিক অনাস্থার গুরুতর এক কারণ এই গণ্ডগোল।
ক্রোড়পত্র-খ
(“ধর্ম্মজিজ্ঞাসা” নামক প্রবন্ধ হইতে উদ্ধৃত)
গুরু। রিলিজন কি?
শিষ্য। সেটা জানা কথা।
গুরু। বড় নয়-বল দেখি কি জানা আছে?
শিষ্য। যদি বলি পারলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাস।
গুরু। প্রাচীন য়ীহুদীরা পরলোকে মানিত না। য়ীহুদীদের প্রাচীন ধর্ম্ম কি ধর্ম্ম নয়?
শিষ্য। যদি বলি দেবদেবীতে বিশ্বাস।
গুরু। ইস্লাম, খ্রীষ্টীয়, য়ীহুদ, প্রভৃতি ধর্ম্মে দেবী নাই। সে সকল ধর্ম্মেে দেবও এক-ঈশ্বর। এগুলি কি ধর্ম্ম নয়?
শিষ্য। ঈশ্বরে বিশ্বাসই ধর্ম্ম?
গুরু। এমন অনেক পরম রমণীয় ধর্ম্ম আছে, তাহাতে ঈশ্বর নাই। ঋগ্বেদসংহিতার প্রাচীনতম মন্ত্রগুলি সমালোচনা করিলে বুঝা যায় যে, তৎপ্রণয়নের সমকালিক আর্য্যদিগের ধর্ম্মে অনেক দেবদেবী ছিল বটে; কিন্তু ঈশ্বর নাই। বিশ্বকর্ম্মা, প্রজাপতি, ব্রহ্ম ইত্যাদি ঈশ্বরবাচক শব্দ, ঋগ্বেদের প্রাচীনতম মন্ত্রগুলিতে নাই-যেগুলি অপেক্ষাকৃত আধুনিক, সেইগুলিতে আছে। প্রাচীন সাংখ্যেরাও অনীশ্বরবাদী ছিলেন। অথচ তাঁহারা ধর্ম্মহীন নহেন; কেন না, তাঁহারা কর্ম্মফল মানিতেন, এবং মুক্তি বা নিঃশ্রেয়স্ কামনা করিতেন। বৌদ্ধধর্ম্মও নিরীশ্বর। অতএব ঈশ্বরবাদ ধর্ম্মের লক্ষণ কি প্রকারে বলি? দেখ, কিছুই পরিষ্কার হয় নাই।
শিষ্য। তবে বিদেশী তার্কিকদিগের ভাষা অবলম্বন করিতে হইল-লোকাতীত চৈতন্যে বিশ্বাসই ধর্ম্ম।
গুরু। অর্থাৎ Supernaturalism, কিন্তু ইহাতে তুমি কোথায় আসিয়া পড়িলে দেখ। প্রেততত্ত্ববিদ্ সম্প্রদায় ছাড়া, আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের মতে লোকাতীত চৈতন্যের কোন প্রমাণ নাই। সুতরাং ধর্ম্মও নাই-ধর্ম্মের প্রয়োজনও নাই। রিলিজনকে ধর্ম্ম বলিতেছি মনে থাকে যেন।
শিষ্য। অথচ সে অর্থে ঘোর বৈজ্ঞানিকদিগের মধ্যেও ধর্ম্ম আছে। যথা Religion of Humanity.
গুরু। সুতরাং লোকাতীত চৈতন্যে বিশ্বাস ধর্ম্ম নয়।
শিষ্য। তবে আপনিই বলুন, ধর্ম্ম কাহাকে বলিব।
গুরু। প্রশ্নটা অতি প্রাচীন। “অথাতো ধর্ম্ম-জিজ্ঞাসা” মীমাংসা দর্শনের প্রথম সূত্র। এই প্রশ্নের উত্তর দানই মীমাংসা দর্শনের উদ্দেশ্য। সর্ব্বত্র গ্রাহ্য উত্তর আজ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় না। আমি যে ইহার সদুত্তর দিতে সক্ষম হইব, এমন সম্ভাবনা নাই। তবে পূর্ব্বপণ্ডিতদিগের মত তোমাকে শুনাইতে পারি। প্রথম মীমাংসাকারের উত্তর শুন। তিনি বলেন, “নোদনালক্ষণো ধর্ম্মঃ।” নোদনা, ক্রিয়ার প্রবর্ত্তক বাক্য। শুধু এইটুকু থাকিলে বলা যাইত, কথাটা বুঝি নিতান্ত মন্দ নয়; কিন্তু উহার কথা উঠিল, “নোদনা প্রবর্ত্তকো বেদবিধিরূপঃ,” তখন আমার বড় সন্দেহ হইতেছে, তুমি উহাকে ধর্ম্ম বলিয়া স্বীকার করিবে কি না।
শিষ্য। কখনই না। তাহা হইলে যতগুলি পৃথক্ ধর্ম্মগ্রন্থ, ততগুলি পৃথক্-প্রকৃতিসম্পন্ন ধর্ম্ম মানিতে হয়। খ্রীষ্টানে বলিতে পারে, বাইবেল-বিধিই ধর্ম্ম; মুসলমানও কোরাণ সম্বন্ধে ঐরূপ বলিবে। ধর্ম্মপদ্ধতি ভিন্ন হউক, ধর্ম্ম বলিয়া একটা সাধারণ সামগ্রী নাই কি? Religions আছে বলিয়া Religion বলিয়া একটা সাধারণ সামগ্রী নাই কি?
গুরু। এই এক সম্প্রদায়ের মত। লৌগাক্ষি ভাস্কর প্রভৃতি এইরূপ কহিয়াছেন যে, “বেদপ্রতিপাদ্যপ্রয়োজনবদর্থো ধর্ম্ম।” এই সকল কথার পরিমাণফল এই দাঁড়াইয়াছে যে, যাগাদিই ধর্ম্ম এবং সদাচারই ধর্ম্ম শব্দে বাচ্য হইয়া গিয়াছে-যথা মহাভারতে,
শ্রদ্ধা কর্ম্ম তপশ্চৈব সত্যমক্রোধ এবচ।
স্বেষু দারেষু সন্তোষঃ শৌচং বিদ্যানসূয়িতা ||
আত্মজ্ঞানং তিতিক্ষা চ ধর্ম্মঃ সাধারণো নৃপ ||
কেহ বলেন, “দ্রব্যক্রিয়াগুণাদীনাং ধর্ম্মত্বং” এবং কেহ বলেন, ধর্ম্ম অদৃষ্টবিশেষ। ফলতঃ আর্য্যদিগের সাধারণ অভিপ্রায় এই যে, বেদ বা লোকাচারসম্মত কার্য্যই ধর্ম্ম, যথা বিশ্বামিত্র-
যমার্য্যাঃ ক্রিয়মাণং হি শংসন্ত্যাগমবেদিনঃ
স ধর্ম্মো যং বিগর্হন্তি তমধর্ম্মং প্রচক্ষতে ||
কিন্তু হিন্দুশাস্ত্রে যে ভিন্ন মত নাই, এমত নহে। “দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্ম যদ্ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ,” ইত্যাদি শ্রুতিতে সূচিত হইয়াছে যে, বৈদিক জ্ঞান ও তদনুবর্ত্তী যাগাদি নিকৃষ্ট ধর্ম্ম, ব্রহ্মজ্ঞানই পরম ধর্ম্ম। ভগবদ্গীতার স্থূল তাৎপর্য্যই কর্ম্মাত্মক বৈদিকাদি অনুষ্ঠানের নিকৃষ্টতা এবং গীতোক্ত ধর্ম্মের উৎকর্ষ প্রতিপাদন। বিশেষতঃ হিন্দুধর্ম্মের ভিতর একটি পরম রমণীয় ধর্ম্ম পাওয়া যায়, যাহা এই মীমাংসা এবং তন্নীত হিন্দুধর্ম্মবাদের সাধারণতঃ বিরোধী। যেখানে এই ধর্ম্ম দেখি-অর্থাৎ গীতায়, কি মহাভারতের অন্যত্র, কি ভাগবতে-সর্ব্বত্রই দেখি, শ্রীকৃষ্ণই ইহার বক্তা। এই জন্য আমি হিন্দুশাস্ত্রে নিহিত এই উৎকৃষ্টতর ধর্ম্মকে শ্রীকৃষ্ণ-প্রচারিত মনে করি, এবং কৃষ্ণোক্ত ধর্ম্ম বলিতে ইচ্ছা করি। মহাভারতের কর্ণপর্ব্ব হইতে একটি বাক্য উদ্ধৃত করিয়া উহার উদাহরণ দিতেছি।
“অনেকে শ্রুতিরে ধর্ম্মের প্রমাণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। আমি তাহাতে দোষারোপ করি না। কিন্তু শ্রুতিতে সমুদয় ধর্ম্মতত্ত্ব নির্দ্দিষ্ট নাই। এই নিমিত্ত অনুমান দ্বারা অনেক স্থলে ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট করিতে হয়। প্রাণিগণের উৎপত্তির নিমিত্তই ধর্ম্ম নির্দ্দেশ করা হইয়াছে। অহিংসাযুক্ত কার্য্য করিলেই ধর্ম্মানুষ্ঠান করা হয়। হিংস্রকদিগের হিংসা নিবারণার্থেই ধর্ম্মের সৃষ্টি হইয়াছে। উহা প্রাণিগণকে ধারণ করে বলিয়াই ধর্ম্ম নাম নির্দ্দিষ্ট হইতেছে। অতএব যদ্দ্বারা প্রাণিগণের রক্ষা হয়, তাহাই ধর্ম্ম”-ইহা কৃষ্ণোক্তি। ইহার পরে বনপর্ব্ব হইতে ধর্ম্মব্যোধোক্ত ধর্ম্মব্যাখ্যা উদ্ধৃত করিতেছি। “যাহা সাধারণের একান্ত হিতজনক, তাহাই সত্য। সত্যই শ্রেয় লাভের অদ্বিতীয় উপায়। সত্যপ্রভাবেই যথার্থ জ্ঞান ও হিতসাধন হয়।” এ স্থলে ধর্ম্ম অর্থেই সত্য শব্দ ব্যবহৃত হইতেছে।
শিষ্য। এ দেশীয়েরা ধর্ম্মের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা নীতির ব্যাখ্যা বা পুণ্যের ব্যাখ্যা। রিলিজনের ব্যাখ্যা কই?
গুরু। রিলিজন শব্দে যে বিষয় বুঝায়, সে বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য আমাদের দেশের লোক কখন উপলব্ধি করেন নাই। এ বিষয়ের প্রজ্ঞা আমার মনে নাই, আমার পরিচিত কোন শব্দে কি প্রকারে তাহার নামকরণ হইতে পারে?
শিষ্য। কথাটা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।
গুরু। তবে আমার কাছে একটি ইংরেজি প্রবন্ধ আছে, তাহা হইতে একটু পড়িয়া শুনাই।
ধর্ম্মতত্ত্ব
“For religion, the ancient Hindu had no name, because his conception of it was so broad as to dispense with the necessity of a name. With other peoples, religion is only a part of life; there are things religious, and there are things lay and secular. To the Hindu, his whole life was religion. To other peoples, their relations to God and to the spiritual world are things sharply distinguished from their relations to man and to the temporal world. To the Hindu, his relations to God and his relations to man, his spiritual life and his temporal life are incapable of being so distinguished. They form one compact and harmonious whole, to separate which into its component parts is to break the entire fabric. All life to him was religion, and religion never received a name from him, because it never had for him and existence apart from all that had received a name. A department of thought which the people in whom it had its existence and thus failed to differentiate, has necessarily mixed itself inextricably with every other department of thought, and this is what makes it so difficult at the present day, to erect it into a separate entity.”*
শিষ্য। তবে রিলিজন কি, তদ্বিষয়ে পাশ্চাত্ত্য আচার্য্যদিগের মতই শুনা যাউক।
গুরু। তাহাতেও বড় গোলযোগ। প্রথমতঃ রিলিজন শব্দের যৌগিক অর্থ দেওয়া যাউক। প্রচলিত মত এই যে, re-ligare হইতে শব্দ নিষ্পন্ন হইয়াছে, অতএব ইহার প্রকৃত অর্থ বন্ধন,-ইহা সমাজের বন্ধনী। কিন্তু বড় বড় পণ্ডিতগণের এ মত নহে। রোমক পণ্ডিত কিকিরো (বা সিসিরো) বলেন যে, ইহা re-ligere হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে। তাহার অর্থ পুনরাহরণ সংগ্রহ, চিন্তা, এইরূপ। মক্ষমূলর প্রভৃতি এই মতানুযায়ী। যেটাই প্রকৃত হউক, দেখা যাইতেছে যে, এ শব্দের আদি অর্থৃ এক্ষণে আর ব্যবহৃত নহে। যেমন লোকের ধর্ম্মবুদ্ধি স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়াছে, এ শব্দের অর্থও তেমনি স্ফুরিত ও পরিবর্ত্তিত হইয়াছে।
শিষ্য। প্রাচীন অর্থে আমাদিগের প্রয়োজন নাই, এক্ষণে ধর্ম্ম অর্থাৎ রিলিজন কাহাকে বলিব, তাই বলুন।
গুরু। কেবল একটি কথা বলিয়া রাখি। ধর্ম্ম শব্দের যৌগিক অর্থ অনেকটা religio শব্দের অনুরূপ। ধর্ম্ম = ধৃ+মন্ (ধ্রিয়তে লোকো অনেন, ধরতি লোকং বা) এই জন্য আমি ধর্ম্মকে religioশব্দের প্রকৃত প্রতিশব্দ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছি।
শিষ্য। তা হৌক-এক্ষণে রিলিজনের আধুনিক ব্যাখ্যা বলুন।
গুরু। আধুনিক পণ্ডিতগণের মধ্যে জার্ম্মানেরাই সর্ব্বাগ্রগণ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি নিজে জর্ম্মান জানি না। অতএব প্রথমতঃ মক্ষমূলরের পুস্তক হইতেই জর্ম্মানদিগের মত পড়িয়া শুনাইব। আদৌ কাণ্টের মত পর্য্যালোচনা কর।
——————–
লেখক-প্রণীত কোন ইংরেজি প্রবন্ধ হইতে এইটুকু উদ্ধৃত হইল, উহা এ পর্য্য ন্ত প্রকাশিত হয় নাই। ইহার মর্ম্মার্থ বাঙ্গালায় এখানে সন্নিবেশিত করিলে করা যাইতে পারিত, কিন্তু বাঙ্গালায় এ রকমের কথা আমার অনেক পাঠকে বুঝিবেন না। যাঁহাদের জন্য লিখিতেছি, তাঁহারা না বুঝিলে, লেখা বৃথা। অতএব এই রুচিবিরুদ্ধ কার্য্যটুকু পাঠক মার্জ্জনা করিবেন। যাঁহারা ইংরেজী জানেন না, তাঁহারা এটুকু ছাড়িয়া গেলে ক্ষতি হইবে না।
——————-
“According to Kant, religion is morality. When we look upon all our moral duties as divine commands, that, he thinks, constitutes religion. And we must not forget that Kant does not consider that duties are moral duties because they rest on a divine command (that would be according to Kant merely revealed Religion); on the contrary, he tells us that because we are directly conscious of them as duties, therefore we look upon them as divine commands.”
তার পরে ফিক্তে। ফিক্তের মতে “Religion is knowledge. It gives to a man a clear insight into himself, answers the highest questions, and thus imparts to us a complete harmony with ourselves, and a thorough sanctification to our mind.” সাংখ্যাদিরও প্রায় এই মত। কেবল শব্দপ্রয়োগ ভিন্ন প্রকার। তার পর স্লিয়ের মেকর। তাঁহার মতে,-Religion consists in our consciousness of absolute dependence on something, which though it determines us, we cannot determine in our turn.” তাঁহাকে উপহাস করিয়া হীগেল বলেন,-“Religion is or ought to be perfect freedom; for it is neither more or less than the divine spirit becoming conscious of himself through the finite spirit___” এ মত কতকটা বেদান্তের অনুগামী।
শিষ্য। যাহারই অনুগামী হউক, এই চারিটির একটি ব্যাখ্যাও ত শ্রদ্ধেয় বলিয়া বোধ হইল না। আচার্য্য মক্ষমূলরের নিজের মত কি?
গুরু। বলেন, “Religion is a subjective faculty for the apprehension of the Infinite.”
শিষ্য। Faculty সর্ব্বনাশ! বরং রিলিজন বুঝিলে বুঝা যাইবে,-Faculty বুঝিব কি প্রকারে? তাহার অস্তিত্বের প্রমাণ কি?
গুরু। এখন জর্ম্মানদের ছাড়িয়া দিয়া দুই এক জন ইংরেজের ব্যাখ্যা আমি নিজে সংগ্রহ করিয়া শুনাইতেছি। টইলর সাহেব বলেন যে, যেখানে “Spiritual Beings” সম্বন্ধে বিশ্বাস আছে, সেইখানেই রিলিজন। এখানে “Spritual Beings” অর্থে কেবল ভূত প্রেত নহে-লোকাতীত চৈতন্যই অভিপ্রেত; দেবদেবী ও ঈশ্বরও তদন্তর্গত। অতএব তোমার বাক্যের সহিত ইঁহার বাক্যের ঐক্য হইল।
শিষ্য। সে জ্ঞান ত প্রমাণাধীন।
গুরু। সকল প্রমাজ্ঞানই প্রমাণাধীন, ভ্রমজ্ঞান প্রমাণাধীন নহে। সাহেব মৌসুকের বিবেচনায় রিলিজনটা ভ্রমজ্ঞান মাত্র। এক্ষণে জন্ ষ্টুয়ার্ট মিলের ব্যাখ্যা শোন।
শিষ্য। তিনি ত নীতিমাত্রবাদী, ধর্ম্মবিরোধী।
গুরু। তাঁহার শেষাবস্থার রচনা পাঠে সেরূপ বোধ হয় না। অনেক স্থানে দ্বিধাযুক্ত বটে। যাই হৌক, তাঁহার ব্যাখ্যা উচ্চশ্রেণীর ধর্ম্মসকল সম্বন্ধে বেশ খাটে।
তিনি বলেন, “The essence of Religion is the strong and earnest direction of the emotions and desires towards an ideal object recognised as of the highest excellence, and is rightfully paramount over all selfish objects of desire.”
শিষ্য। কথাটা বেশ।
গুরু। মন্দ নহে বটে। সম্প্রতি আচার্য্য সীলীর কথা শোন। আধুনিক ধর্ম্মতত্ত্বব্যাখ্যাকারদিগের মধ্যে তিনি এক জন শ্রেষ্ঠ। তাঁহার প্রণীত “Ecce Homo” এবং “Natural Relegion” অনেককেই মোহিত করিয়াছে। এ বিষয়ে তাঁহার একটি উক্তি বাঙ্গালি পাঠকদিগের নিকট সম্প্রতি পরিচিত হইয়াছে।* বাক্যটি এই-“The substance of Religion is Culture.” কিন্তু তিনি এক দল লোকের মতের সমালোচনকালে এই উক্তির দ্বারা তাঁহাদিগের মত পরিস্ফুট করিয়াছেন-এটি ঠিক তাঁহার নিজের মত নহে। তাঁহার নিজের মত বড় সর্ব্বব্যাপী। সে মতানুসারে রিলিজন “habitual and permanent admiration.” ব্যাখ্যাটি সবিস্তারে শুনাইতে হইল।
“The words Religion and Worship are commonly and conveniently appropriated to the feelings with which we regard God. But those feelings-love, awe, admiration, which together make up worship-are felt in various combinations for human beings, and even for inanimate objects. It is not exclusively but only par excellence that religion is directed towards God. When feelings of admiration are very strong and at the same time serious and permanent, they express themselves in recurring acts, and hence arises ritual, liturgy and whatever the multitude indentifies with religion. But without ritual, religion may exist in its elementary state and its elementary state of Religion is what may be described as habitual and permanent admiration.”
শিষ্য। এ ব্যাখ্যাটি অতি সুন্দর। আর আমি দেখিতেছি, মিল যে কথা বলিয়াছেন, তাহার সঙ্গে ইহার ঐক্য হইতেছে। এই “habitual and permanent admiration” যে মানসিক ভাব, তাহারই ফল, “strong and earnest direction of the emotions and desires towards and ideal object recognized as of the highest excellence.”
গুরু। এ ভাব, ধর্ম্মের একটি অঙ্গমাত্র।
যাহা হউক, তোমাকে আর পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যে বিরক্ত না করিয়া অগুস্ত কোম্তের ধর্ম্মব্যাখ্যা শুনাইয়া, নিরস্ত হইব। এটিতে বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন; কেন না, কোম্ৎ নিজে একটি অভিনব ধর্ম্মের সৃষ্টিকর্ত্তা, এবং তাঁহার এই ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি স্থাপন করিয়াই তিনি সেই ধর্ম্ম সৃষ্টি করিয়াছেন। তিনি বলেন, “Religion, in itself expresses the state, of perfect unity which is the distinctive mark of man’s existence both as an individual and in society, when all the constituent parts of his nature, moral and physical, are made habitually to converge towards one common purpose. অর্থাৎ “Religion consists in regulating one’s individual nature, and forms the rallying-point for all the separate individuals.”
যতগুলি ব্যাখ্যা তোমাকে শুনাইলাম, সকলের মধ্যে এইটি উৎকৃষ্ট বলিয়া বোধ হয়। আর যদি এই ব্যাখ্যা প্রকৃত হয়, তবে হিন্দুধর্ম্ম সকল ধর্ম্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম।
শিষ্য। আগে ধর্ম্ম কি বুঝি, তার পর পারি যদি, তবে না হয় হিন্দুধর্ম্ম বুঝিব। এই সকল পণ্ডিতগণকৃত ধর্ম্মব্যাখ্যা শুনিয়া আমার সাত কাণার হাতী দেখা মনে পড়িল।
গুরু। কথা সত্য। এমন মনুষ্য কে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, যে ধর্ম্মের পূর্ণ প্রকৃতি ধ্যানে পাইয়াছে? যেমন সমগ্র বিশ্বসংসার কোন মনুষ্য চক্ষে দেখিতে পায় না, তেমনই সমগ্র ধর্ম্ম কোন মনুষ্য ধ্যানে পায় না। অন্যের কথা দূরে থাক, শাক্যসিংহ, যীশুখ্রীষ্ট, মহম্মদ, কি চৈতন্য,-তাঁহারাও ধর্ম্মের সমগ্র প্রকৃতি অবগত হইতে পারিয়াছিলেন, এমন স্বীকার করিতে পারি না। অন্যের অপেক্ষা বেশি দেখুন, তথাপি সবটা দেখিতে পান নাই। যদি কেহ মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া ধর্ম্মের সম্পূর্ণ অবয়ব হৃদয়ে ধ্যান, এবং মনুষ্যলোকে প্রচারিত করিতে পারিয়া থাকেন, তবে সে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকার। ভগবদ্গীতার উক্তি, ঈশ্বরাবতার শ্রীকৃষ্ণের উক্তি কি কোন মনুষ্যপ্রণীত, তাহা জানি না। কিন্তু যদি কোথাও ধর্ম্মের সম্পূর্ণ প্রকৃতি ব্যক্ত ও পরিস্ফুট হইয়া থাকে, তবে সে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়।
————
* দেবী চৌধুরাণীতে।
————
ক্রোড়পত্র-গ
(অষ্টম অধ্যায় দেখ)
It, as the sequence of a malady contracted in pursuit of illegitimate gratification, an attack of iritis injuries vision, the mischief is to be counted among those entailed by immoral conduct; but if, regardless of protesting sensations, the eyes are used in study too soon after opthalmia, and there follows blindness for years or for life, entailing not only personal unhappiness but a burden on others, moralists are silent. The broken leg which a drunkard’s accident causes, counts among those miseries brought on self and family by intemperance, which from the ground for reprohating it; but if-anxiety to fulfil duties prompts the continued use of a sprained knee in spite of the pain, and brings on a chronic lameness involving lack of exercise, consequent ill health, inefficiency, anxiety, and unhappiness, it is supposed that ethics has no verdict to give in the matter. A student who is plucked because he has spent in amusement the time and money that should have gone in study, is blamed for thus making parents unhappy and preparing for himself a miserable future; but another who, thinking exclusively of claims on him, reads night after night with hot or aching head, and, breaking down, cannot take his degree, but returns home shattered in health and unable to support himself, is named with pity only, as not subject to any moral judgement; or rather, the moral judgement passed is wholly favourable.
Thus recognizing the evils caused by some kinds of conduct only, men at large, and moralists as exponents of their beliefs, ignore the suffering and death daily caused around them by disregard of that guidance which has established itself in the course of evolution. Led by the tacit assumption, common to Pagan stoics and Christian ascetics, that we are so diabolically organized that pleasures are injurious and pains beneficial, people on all sides yield examples of lives blasted by persisting in actions against which their sensations rebel. Here is one who, drenched to the skin and sitting in a cold wind pooh-poohs his shiverings and gets rheumatic fever with subsequent heart-disease, which makes worthless the short life remaining to him.Here is another who, disregarding painful feelings, works too soon after a debilitating illness, and establishes disordered health that lasts for the rest of his days, and makes him useless to himself and others.
Now the account is of the youth who, persisting in gymnastic feats spite of scarcely bearable straining, bursts a blood-vessel, and, long laid on the shelf, is permanently damaged; while now it is of a man in middle life who, pushing muscular effort to painful excess suddenly brings to hernia. In this family is Sa case of aphasia, spreading paralysis, and death, caused by eating too little and doing too much; in that, softening of the brain has been brought on by ceaseless mental efforts against which the feelings hourly protested; and in others, less serious brain-affections have been contracted by overstudy continued regardless of discomfort and the craving for fresh air and exercise.* Even without accumulating special examples, the truth is forced on us by the visible traits of classes. The careworn man of business too long at his office, the cadaverous barrister pouring half the night over the briefs, the feeble factory hands and unhealthy seamstresses passing long hours in bad air, the anæmic, flat-chested school girls, bending over many lessons and forbidden boisterous play, no less than Sheffield grinders who die of suffocating dust, and peasants crippled with rheumatism due to exposure, show us the widespread miseries caused by persevering in action repugnant to the sensations and neglecting actions which the sensations prompt. Nay the evidence is still more extensive and conspicuous. What are the puny malformed children, seen in poverty-stricken districts, but children whose appetites for food and desires for warmth have not been adequately satisfied? What are populations stunted in growth and prematurely aged, such as parts of France show us, populations injured by work in excess and food in defectঃ the one implying positive pain, the other negative pain? What is the implication of that greater mortality which occurs among people who are weakened by privations, unless it is that bodily miseries conduce to fatal illness? Or once more, what must we infer from the frightful amount of disease and death suffered by armies in the field, fed on scanty and bad provisions, lying on damp ground, exposed to extremes of heat and cold, inadequately sheltered from rain, and subject to exhausting efforts; unless it to be the terrible mischiefs caused by continuously subjecting the body to treatment which the feelings protest against?
It matters not to the argument whether the actions entailing such effects are voluntary or involuntary. It matters not from the biological point of view, whether the motives prompting them are high or low. The vital functions accept the apologies on the ground that neglect of them was unavoidable, or that the reason for neglect was noble. The direct and indirect sufferings caused by non-conformity to the laws of life, are the same whatever induces the nonconformity; and cannot be omitted in any rational estimate of conduct. If the purpose of ethical inquiry is to establish rules of right living; and if the rules of right living are those of which the total results, individual and general, direct and indirect, are most conductive to human happiness; then it is absurd to ignore the immediate results and recognize only the remote results.-Herbert Spencer: Data of Ethics, pp. 93-95.
————-
* I can count up more than a dozen such cases among those personally well known to me.
ক্রোড়পত্র-ঘ
(অনুশীলনতত্ত্বের সঙ্গে জাতিভেদ ও শ্রমজীবনের সম্বন্ধ)
“বৃত্তির সঞ্চালন দ্বারা আমরা কি করি? হয় কিছু কর্ম্ম করি, না হয় কিছু জানি। কর্ম্ম ও জ্ঞান ভিন্ন মনুষ্যের জীবনে ফল আর কিছু নাই।*
অতএব জ্ঞান ও কর্ম্ম মানুষের স্বধর্ম্ম। সকল বৃত্তিগুলি সকলেই যদি বিহিতরূপে অনুশীলিত করিত, তবে জ্ঞান ও কর্ম্ম উভয়ই সকল মনুষ্যেরই স্বধর্ম্ম হইত। কিন্তু মনুষ্যসমাজের অপরিণতাবস্থায় তাহা সাধারণতঃ ঘটিয়া উঠে না।# কেহ কেবল জ্ঞানকেই প্রধানতঃ স্বধর্ম্মস্থানীয় করেন, কেহ কর্ম্মকে ঐরূপ প্রধানতঃ স্বধর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করেন।
জ্ঞানের চরমোদ্দেশ্য ব্রহ্ম; সমস্ত জগৎ ব্রহ্মে আছে। এজন্য জ্ঞানার্জ্জন স্বধর্ম্ম, তাঁহাদিগকে ব্রাহ্মণ বলা যায়। ব্রাহ্মণ শব্দ ব্রহ্মণ্ শব্দ হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে।
কর্ম্মকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহা বুঝিতে গেলে কর্ম্মের বিষয়টা ভাল করিয়া বুঝিতে হইবে। জগতে অন্তর্বিষয় আছে ও বহির্বিষয় আছে। অন্তর্বিষয় কর্ম্মের বিষয়ীভূত হইতে পারে না; বহির্বিষয়ই কর্ম্মের বিষয়। এই বহির্বিষয়ের মধ্যে কতকগুলিই হৌক, অথবা সবই হৌক, মনুষ্যের ভোগ্য। মনুষ্যের কর্ম্ম মনুষ্যের ভোগ্য বিষয়কেই আশ্রয় করে। সেই আশ্রয় ত্রিবিধ-(১) উৎপাদন, (২) সংযোজন বা সংগ্রহ, (৩) রক্ষা। (১) যাহারা উৎপাদন করে, তাহারা কৃষিধর্ম্মী; (২) যাহারা সংযোজন বা সংগ্রহ করে, তাহারা শিল্প বা বাণিজ্যধর্ম্মী; (৩) এবং যাহারা রক্ষা করে, তাহারা যুদ্ধধর্ম্মী। ইহাদিগের নামান্তর ব্যুৎক্রমে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, এ কথা পাঠক স্বীকার করিতে পারেন কি?
স্বীকার করিবার প্রতি একটা আপত্তি আছে। হিন্দুদিগের ধর্ম্মশাস্ত্রানুসারে এবং এই গীতার ব্যবস্থানুসারে কৃষি শূদ্রের ধর্ম্ম নহে; বাণিজ্য এবং কৃষি, উভয়েই বৈশ্যের ধর্ম্ম। অন্য তিন বর্ণের পরিচর্য্যাই শূদ্রের ধর্ম্ম। এখনকার দিনে দেখিতে পাই, কৃষি প্রধানতঃ শূদ্রেরই ধর্ম্ম। কিন্তু অন্য তিন বর্ণের পরিচর্য্যাও এখনকার দিনে প্রধানতঃ শূদ্রেরই ধর্ম্ম। যখন জ্ঞানধর্ম্মী, যুদ্ধধর্ম্মী, বাণিজ্যধর্ম্মী বা কৃষিধর্ম্মীর কর্ম্মের এত বাহুল্য হয় যে, তদ্ধর্ম্মিগণ আপনাদিগের দৈহিকাদি প্রয়োজনীয় সকল কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারে না, তখন কতকগুলি লোক তাহাদিগের পরিচর্য্যায় নিযুক্ত হয়। অতএব (১) জ্ঞানার্জ্জন বা লোকশিক্ষা, (২) যুদ্ধ বা সমাজরক্ষা, (৩) শিল্প বা বাণিজ্য, (৪) উৎপাদন বা কৃষি, (৫) পরিচর্য্যা, এই পঞ্চবিধ কর্ম্ম।”
ভগবদ্গীতার টীকায় যাহা লিখিয়াছি, তাহা হইতে এই কয়টি কথা উদ্ধৃত করিলাম। এক্ষণে স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে, সর্ব্ববিধ কর্ম্মানুষ্ঠান জন্য অনুশীলন প্রয়োজনীয়। তবে কথা এই যে, যাহার যে স্বধর্ম্ম, অনুশীলন তদনুবর্ত্তী না হইলে সে স্বধর্ম্মের সুপালন হইবে না। অনুশীলন স্বধর্ম্মানুবর্ত্তী হওয়ার অর্থ এই যে, স্বধর্ম্মের প্রয়োজন অনুসারে বৃত্তিবিশেষের বিশেষ অনুশীলন চাই।
সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া বৃত্তিবিশেষের বিশেষ অনুশীলন কি প্রকারে হইতে পারে, তাহা শিক্ষাতত্ত্বের অন্তর্গত। সুতরাং এ গ্রন্থে সে বিশেষ অনুশীলনের কথা লেখা গেল না। আমি এই গ্রন্থে সাধারণ অনুশীলনের কথাই বলিয়াছি; কেন না, তাহাই ধর্ম্মতত্ত্বের অন্তর্গত; বিশেষ অনুশীলনের কথা বলি নাই; কেন না, তাহা শিক্ষাতত্ত্ব। উভয়ে কোন বিরোধ নাই ও হইতে পারে না, ইহাই আমার এখানে বলিবার প্রয়োজন।
—————
* কোম্ৎ প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য দার্শনিকগণ তিন ভাগে চিত্তপরিণতিকে বিভক্ত করে “Thought, Feeling, Action,” ইহা ন্যায্য। কিন্তু Feeling অবশেষে Thought কিম্বা Action প্রাপ্ত হয়। এই জন্য পরিণামের ফল জ্ঞান ও কর্ম্ম, এই দ্বিবিধ বলাও ন্যায্য।
# আমি ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপকেও সমাজের অপরিণতাবস্থা বলিতেছি।
০১.দুঃখ কি?
গুরু। বাচস্পতি মহাশয়ের সম্বাদ কি? তাঁর পীড়া কি সারিয়াছে?
শিষ্য। তিনি ত কাশী গেলেন।
গুরু। কবে আসিবেন?
শিষ্য। আর আসিবেন না। একবারে দেশত্যাগী হইলেন।
গুরু। কেন?
শিষ্য। কি সুখে আর থাকিবেন?
গুরু। দুঃখ কি?
শিষ্য। সবই দুঃখ-দুঃখের বাকি কি? আপনাকে বলিতে শুনিয়াছি ধর্ম্মেই সুখ। কিন্তু বাচস্পতি মহাশয় পরম ধার্ম্মিক ব্যক্তি, ইহা সর্ব্ববাদিসম্মত। অথচ তাঁহার মত দুঃখীও আর কেহ নাই, ইহাও সর্ব্ববাদিসম্মত।
গুরু। হয় তাঁর কোন দুঃখ নাই, নয় তিনি ধার্ম্মিক নন।
শিষ্য। তাঁর কোন দুঃখ নাই? সে কি কথা? তিনি চিরদরিদ্র, অন্ন চলে না। তার পর এই কঠিন রোগে ক্লিষ্ট, আবার গৃহদাহ হইয়া গেল। আবার দুঃখ কাহাকে বলে?
গুরু। তিনি ধার্ম্মিক নহেন।
শিষ্য। সে কি? আপনি কি বলেন যে, এই দারিদ্র্য, গৃহদাহ, রোগ, এ সকলই অধর্ম্মের ফল?
গুরু। তা বলি।
শিষ্য। পূর্ব্বজন্মের?
গুরু। পূর্ব্বজন্মের কাজ কি? ইহজন্মের অধর্ম্মের ফল।
শিষ্য। আপনি কি ইহাও মানেন যে, এ জন্মে আমি অধর্ম্ম করিয়াছি, বলিয়া আমার রোগ হয়?
গুরু। আমিও মানি, তুমিও মান। তুমি কি মান না যে, হিম লাগাইলে সর্দ্দি হয়, কি গুরুভোজন করিলে অজীর্ণ হয়?
শিষ্য। হিম লাগান কি অধর্ম্ম?
গুরু। অন্য ধর্ম্মের মত একটা শারীরিক ধর্ম্ম আছে। হিম লাগান তাহার বিরোধী। এই জন্য হিম লাগান অধর্ম্ম।
শিষ্য। এখানে অধর্ম্ম মানে hygiene?
গুরু। যাহা শারীরিক নিয়মবিরুদ্ধ, তাহা শারীরিক অধর্ম্ম।
শিষ্য। ধর্ম্মাধর্ম্ম কি স্বাভাবিক নিয়মানুবর্ত্তিতা আর নিয়মাতিক্রম?
গুরু। ধর্ম্মাধর্ম্ম অত সহজে বুঝিবার কথা নহে। তাহা হইলে ধর্ম্মতত্ত্ব বৈজ্ঞানিকের হাতে রাখিলেই চলিত। তবে হিম লাগান সম্বন্ধে অতটুকু বলিলেই চলিতে পারে।
শিষ্য। তাই না হয় হইল। বাচস্পতির দারিদ্র্য দুঃখ কোন্ পাপের ফল?
গুরু। দারিদ্র্য দুঃখটা আগে ভাল করিয়া বুঝা যাউক। দুঃখটা কি?
শিষ্য। খাইতে পায় না।
গুরু। বাচস্পতির সে দুঃখ হয় নাই, ইহা নিশ্চিত। কেন না, বাচস্পতি খাইতে না পাইলে এত দিন মরিয়া যাইত।
শিষ্য। মনে করুন, সপরিবারে বুকড়ি চালের ভাত আর কাঁচকলা ভাতে খায়।
গুরু। তাহা যদি শরীর পোষণ ও রক্ষার পক্ষে যথেষ্ট না হয়, তবে দুঃখ বটে। কিন্তু যদি শরীর রক্ষা ও পুষ্টির পক্ষে উহা যথেষ্ট হয়, তবে তাহার অধিক না হইলে দুঃখ বোধ করা, ধার্ম্মিকের লক্ষণ নহে, পেটুকের লক্ষণ। পেটুক অধার্ম্মিক।
শিষ্য। ছেঁড়া কাপড় পরে।
গুরু। বস্ত্রে লজ্জা নিবারণ হইলেই ধার্ম্মিকের পক্ষে যথেষ্ট। শীতকালে শীত নিবারণও চাই। তাহা মোটা কম্বলেও হয়। তাহা বাচস্পতির জুটে না কি?
শিষ্য। জুটিতে পারে। কিন্তু তাহারা আপনারা জল তুলে, বাসন মাজে, ঘর ঝাঁট দেয়।
গুরু। শারীরিক পরিশ্রম ঈশ্বরের নিয়ম। যে তাহাতে অনিচ্ছুক, সে অধার্ম্মিক। আমি এমন বলিতেছি না যে, ধনে কোন প্রয়োজন নাই। অথবা যে ধনোপার্জ্জনে যত্নবান্, সে অধার্ম্মিক। বরং যে সমাজে থাকিয়া ধনোপার্জ্জনে যথাবিহিত যত্ন না করে, তাহাকে অধার্ম্মিক বলি। আমার বলিবার উদ্দেশ্য এই যে, সচরাচর যাহারা আপনাদিগকে দারিদ্র্যপীড়িত মনে করে, তাহাদিগের নিজের কুশিক্ষা এবং কুবাসনা-অর্থাৎ অধর্ম্মে সংস্কার, তাহাদিগের কষ্টের কারণ। অনুচিত ভোগলালসা অনেকের দুঃখের কারণ।
শিষ্য। পৃথিবীতে কি এমন কেহ নাই, যাহাদের পক্ষে দারিদ্র্য যথার্থ দুঃখ?
গুরু। অনেক কোটি কোটি। যাহারা শরীর রক্ষার উপযোগী অন্নবস্ত্র পায় না-আশ্রয় পায় না-তাহারা যথার্থ দরিদ্র। তাহাদের দারিদ্র্য দুঃখ বটে!
শিষ্য। এ দারিদ্র্যও কি তাহাদের ইহজন্মকৃত অধর্ম্মের ভোগ?
গুরু। অবশ্য।
শিষ্য। কোন্ অধর্ম্মের ভোগ দারিদ্র্য?
গুরু। ধনোপার্জ্জনের উপযোগী গ্রাসাচ্ছাদন আশ্রয়াদির প্রয়োজনীয় যাহা, তাহার সংগ্রহের উপযোগী আমাদের কতকগুলি শারীরিক ও মানসিক শক্তি আছে। যাহারা তাহার সম্যক্ অনুশীলন করে নাই বা সম্যক্ পরিচালনা করে না, তাহারাই দরিদ্র।
শিষ্য। তবে, বুঝিতেছি আপনার মতে আমাদিগের সমস্ত শারীরিক ও মানসিক শক্তি অনুশীলন ও পরিচালনাই ধর্ম্ম, ও তাহার অভাবই অধর্ম্ম।
গুরু। ধর্ম্মতত্ত্ব সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর তত্ত্ব, তাহা অল্প কথায় সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু মনে করি যদি তাই বলা যায়?
শিষ্য। এ যে বিলাতী Doctrine of Culture!
গুরু। Culture বিলাতী জিনিস নহে। ইহা হিন্দুধর্ম্মের সারাংশ।
শিষ্য। সে কি কথা? Culture শব্দের একটা প্রতিশব্দও আমাদের দেশীয় কোন ভাষায় নাই।
গুরু। আমরা কথা খুঁজিয়া মরি, আসল জিনিষটা খুঁজি না, তাই আমাদের এমন দশা। দ্বিজবর্ণের চতুরাশ্রম কি মনে কর?
শিষ্য। System of Culture?
গুরু। এমন, তোমার Matthew Arnold প্রভৃতি বিলাতী অনুশীলনবাদীদের বুঝিবার সাধ্য আছে কি না সন্দেহ। সধবার পতিদেবতার উপাসনায়, বিধবার ব্রহ্মচর্য্যে, সমস্ত ব্রতনিয়মে, তান্ত্রিক অনুষ্ঠনে, যোগে, এই অনুশীলনতত্ত্ব অন্তর্নিহিত। যদি এই তত্ত্ব কখন তোমাকে বুঝাইতে পারি, তবে তুমি দেখিবে যে, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যে পরম পবিত্র অমৃতময় ধর্ম্ম কথিত হইয়াছে, তাহা এই অনুশীলনতত্ত্বের উপর গঠিত।
শিষ্য। আপনার কথা শুনিয়া আপনার নিকট অনুশীলনতত্ত্ব কিছু শুনিতে ইচ্ছা করিতেছি। কিন্তু আমি যত দূর বুঝি, পাশ্চাত্ত্য অনুশীলনতত্ত্ব ত নাস্তিকের মত। এমন কি, নিরীশ্বর কোমৎ-ধর্ম্ম অনুশীলনের অনুষ্ঠান পদ্ধতি মাত্র বলিয়াই বোধ হয়।
গুরু। এ কথা অতি যথার্থ। বিলাতী অনুশীলনতত্ত্ব নিরীশ্বর, এই জন্য উহা অসম্পূর্ণ ও অপরিণত অথবা উহা অসম্পূর্ণ বা অপরিণত বলিয়াই নিরীশ্বর,-ঠিক সেটা বুঝি না। কিন্তু হিন্দুরা পরম ভক্ত, তাহাদিগের অনুশীলনতত্ত্ব জগদীশ্বর-পাদপদ্মেই সমর্পিত।
শিষ্য। কেন না, উদ্দেশ্য মুক্তি। বিলাতী অনুশীলনতত্ত্বের উদ্দেশ্য সুখ। এই কথা কি ঠিক?
গুরু। সুখ ও মুক্তি, পৃথক্ বলিয়া বিবেচনা করা উচিত কি না? মুক্তি কি সুখ নয়?
শিষ্য। প্রথমতঃ, মুক্তি সুখ নয়-সুখ দুঃখ মাত্রেরই অভাব। দ্বিতীয়তঃ, মুক্তি যদিও সুখবিশেষ বলেন, তথাপি সুখমাত্র মুক্তি নয়। আমি দুইটা মিঠাই খাইলে সুখী হই, আমার কি তাহাতে মুক্তি লাভ হয়?
গুরু। তুমি বড় গোলযোগের কথা আনিয়া ফেলিলে। সুখ এবং মুক্তি, এই দুইটা কথা আগে বুঝিতে হইবে, নহিলে অনুশীলনতত্ত্ব বুঝা যাইবে না। আজ আর সময় নাই-আইস, একটু ফুলগাছে জল দিই, সন্ধ্যা হইল। কাল সে প্রসঙ্গ আরম্ভ করা যাইবে।
০২.সুখ কি?
শিষ্য। কাল আপনার কথায় এই পাইলাম যে, আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তি সকলের সম্যক্ অনুশীলনের অভাবই আমাদের দুঃখের কারণ। বটে?
গুরু। তার পর?
শিষ্য। বলিয়াছি যে, বাচস্পতির নির্ব্বাসনের একটি কারণ এই যে, তাঁহার ঘর পুড়িয়া গিয়াছে। আগুন কাহার দোষে কি প্রকারে লাগিল, তাহা কেহ বলিতে পারে না-কিন্তু বাচস্পতির নিজ দোষে নহে, ইহা এক প্রকার নিশ্চিত। তাঁহার কোন্ অনুশীলনের অভাবে গৃহ দগ্ধ হইল?
গুরু। অনুশীলনতত্ত্বটা না বুঝিয়াই আগে হইতে কি প্রকারে সে কথা বুঝিবে? সুখদুঃখ মানসিক অবস্থা মাত্র-সুখদুঃখের কোন বাহ্যিক অস্তিত্ব নাই। মানসিক অবস্থা মাত্রেই যে সম্পূর্ণরূপে অনুশীলনের অধীন, তাহা তুমি স্বীকার করিবে। এবং ইহাও বুঝিতে পারিবে যে, মানসিক শক্তি সকলের যথাবিহিত অনুশীলন হইলে গৃহদাহ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হইবে না।
শিষ্য। অর্থাৎ বৈরাগ্য উপস্থিত হইলে হইবে না। কি ভয়ানক!
গুরু। সচরাচর যাহাকে বৈরাগ্য বলে, তাহা ভয়ানক ব্যাপার হইলে হইতে পারে। কিন্তু তাহার কথা হইতেছে কি?
শিষ্য। হইতেছে বৈ কি? হিন্দুধর্ম্মের টান সেই দিকে। সাংখ্যকার বলেন, তিন প্রকার দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি পরমপুরুষার্থ। তার পর আর একস্থানে বলেন যে, সুখ এত অল্প যে, তাহাও দুঃখ পক্ষে নিক্ষেপ করিবে। অর্থাৎ সুখ দুঃখ সব ত্যাগ করিয়া, জড়পিণ্ডে পরিণত হও।আপনার গীতোক্ত ধর্ম্মও তাই বলেন। শীতোষ্ণ সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব সকল তুল্য জ্ঞান করিবে। যদি সুখে সুখী না হইবে-তবে জীবনে কাজ কি? যদি ধর্ম্মের উদ্দেশ্য সুখ পরিত্যাগ, তবে আমি সেই ধর্ম্ম চাই না। বরং অনুশীলনতত্ত্বের উদ্দেশ্য যদি ঈদৃশ ধর্ম্মই হয়, তবে আমি অনুশীলনতত্ত্ব শুনিতে চাই না।
গুরু। অত রাগের কথা কিছু নাই-আমার এই অনুশীলনতত্ত্বে তোমার দুইটা মিঠাই খাওয়ার পক্ষে কোন আপত্তি হইবে না-বরং বিধিই থাকিবে। সাংখ্যদর্শনকে তোমাকে ধর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিতে বলিতেছি না। শীতোষ্ণসুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব সম্বন্ধীয় যে উপদেশ, তাহারও এমন অর্থ নহে যে, মনুষ্যের সুখভোগ করা কর্ত্তব্য নহে। উহার অর্থ কি, তাহার কথায় এখন কাজ নাই। তুমি কাল বলিয়াছিলে যে, বিলাতী অনুশীলনের উদ্দেশ্য সুখ, ভারতবর্ষীয় অনুশীলনের উদ্দেশ্য মুক্তি। আমি তদুত্তরে বলি, মুক্তি সুখের অবস্থাবিশেষ। সুখের পূর্ণমাত্রা এবং চরমোৎকর্ষ। যদি এ কথা ঠিক হয়, তাহা হইলে ভারতবর্ষীয় অনুশীলনের উদ্দেশ্যও সুখ।
শিষ্য। অর্থাৎ ইহকালে দুঃখ ও পরকালে সুখ।
গুরু। না, ইহকালে সুখ ও পরকালে সুখ।
শিষ্য। কিন্তু আমার আপত্তির উত্তর হয় নাই-আমি ত বলিয়াছিলাম যে, জীব মুক্ত হইলে সে সুখদুঃখের অতীত হয়। সুখশূন্য যে অবস্থা, তাহাকে সুখ বলিব কেন?
গুরু। এই আপত্তি খণ্ডন জন্য, সুখ কি ও মুক্তি কি, তাহা বুঝা প্রয়োজন। এখন, মুক্তির কথা থাক। আগে সুখ কি, তাহা বুঝিয়া দেখা যাক।
শিষ্য। বলুন।
গুরু। তুমি কাল বলিয়াছিলে যে, দুইটা মিঠাই খাইতে পাইলে তুমি সুখী হও। কেন সুখী হও, তাহা বুঝিতে পার?
শিষ্য। আমার ক্ষুধা নিবৃত্তি হয়।
গুরু। এক মুঠা শুকনা চাউল খাইলেও তাহা হয়-মিঠাই খাইলে ও শুকনা চাল খাইলে কি তুমি তুল্য সুখী হও?
শিষ্য। না। মিঠাই খাইলে অধিক সুখ সন্দেহ নাই।
গুরু। তাহার কারণ কি?
শিষ্য। মিঠাইয়ের উপাদানের সঙ্গে মনুষ্য-রসনার এরূপ কোন নিত্য সম্বন্ধ আছে যে, সেই সম্বন্ধ জন্যই মিষ্ট লাগে।
গুরু। মিষ্ট লাগে সে জন্য বটে, কিন্তু তাহা ত জিজ্ঞাসা করি নাই। মিঠাই খাওয়ায় তোমার সুখ কি জন্য? মিষ্টতায় সকলের সুখ নাই। তুমি একজন আসল বিলাতি সাহেবকে একটা বড়বাজারের সন্দেশ কি মিহিদানা সহজে খাওয়াইতে পারিবে না। পক্ষান্তরে তুমি এক টুকরা রোষ্ট বীফ খাইয়া সুখী হইবে না। ‘রবিন্সন ক্রুশো’ গ্রন্থের ফ্রাইডে নামক বর্ব্বরকে মনে পড়ে? সেই আমমাংসভোজী বর্ব্বরের মুখে সলবণ সুসিদ্ধ মাংস ভাল লাগিত না। এই সকল বৈচিত্র্য দেখিয়া বুঝিতে পারিবে যে, তোমার মিঠাই খাওয়ার যে সুখ, তাহার রসনার সঙ্গে ঘৃতশর্করাদির নিত্য সম্বন্ধবশতঃ নহে। তবে কি?
শিষ্য। অভ্যাস।
গুরু। তাহা না বলিয়া অনুশীলন বল।
শিষ্য। অভ্যাস আর অনুশীলন কি এক?
গুরু। এক নহে বলিয়াই বলিতেছি যে, অভ্যাস না বলিয়া অনুশীলনই বল।
শিষ্য। উভয়ে প্রভেদ কি?
গুরু। এখন তাহা বুঝাইবার সময় নহে। অনুশীলনতত্ত্ব ভাল না করিয়া বুঝিলে তাহা বুঝিতে পারিবে না। তবে কিছু শুনিয়া রাখ। যে প্রত্যহ কুইনাইন খায়, তাহার কুইনাইনের স্বাদ কেমন লাগে? কখন সুখদ হয় কি?
শিষ্য। বোধ করি কখন সুখদ হয় না, কিন্তু ক্রমে তিক্ত সহ্য হইয়া যায়।
গুরু। সেইটুকু অভ্যাসের ফল। অনুশীলন, শক্তির অনুকূল; অভ্যাস, শক্তির প্রতিকূল। অনুশীলনের ফল শক্তির বিকাশ, অভ্যাসের ফল শক্তির বিকার। অনুশীলনের পরিণাম সুখ, অভ্যাসের পরিণাম সহিষ্ণুতা। এক্ষণে মিঠাই খাওয়ার কথাটা মনে কর। এখানে তোমার চেষ্টা স্বাভাবিকী রসাস্বিদিনী শক্তির অনুকূল, এ জন্য তোমার সে শক্তি অনুশীলিত হইয়াছে-মিঠাই খাইয়া তুমি সুখী হও। ঐরূপ অনুশীলনবলে তুমি রোষ্ট বীফ খাইয়াও সুখী হইতে পার। অন্যান্য ভক্ষ্য পেয় সম্বন্ধেও সেইরূপ।
এ গেল একটা ইন্দ্রিয়ের সুখের কথা। আমাদের আর আর ইন্দ্রিয় আছে, সেই সকল ইন্দ্রিয়ের অনুশীলনেও ঐরুপ সুখোৎপত্তি।
কতকগুলি শারীরিক শক্তিবিশেষের নাম দেওয়া হইয়াছে ইন্দ্রিয়। আরও অনেকগুলি শারীরিক শক্তি আছে। যথা, গীতবাদ্যের তাল বোধ হয় যে শক্তি অনুশীলনে, তাহাও শারীরিক শক্তি। সাহাবরা তাহার নাম দিয়াছেন muscular sense। এইরূপ আর আর শারীরিক শক্তি আছে। এ সকলের অনুশীলনেও ঐরূপ সুখ।
তা ছাড়া, আমাদের কতকগুলি মানসিক শক্তি আছে। সেগুলির অনুশীলনের যে ফল, তাহাও সুখ। ইহাই সুখ, ইহা ভিন্ন অন্য কোন সুখ নাই। ইহার অভাব দুঃখ। বুঝিলে?
শিষ্য। না। প্রথমতঃ শক্তি কথাটাতেই গোল পড়িতেছে। মনে করুন, দয়া আমাদিগের মনের একটি অবস্থা। তাহার অনুশীলনে সুখ আছে। কিন্তু আমি কি বলিব যে দয়া শক্তির অনুশীলন করিতে হইবে?
গুরু। শক্তি কথাটা গোলের বটে। তৎপরিবর্ত্তে অন্য শব্দের আদেশ করার প্রতি আমার কোন আপত্তি নাই। আগে জিনিসটা বুঝ, তার পর যাহা বলিবে, তাহাতেই বুঝা যাইবে। শরীর এক ও মন এক বটে, তথাপি ইহাদিগের বিশেষ বিশেষ ক্রিয়া আছে; এবং কাজেই সেই সকল বিশেষ বিশেষ ক্রিয়ার সম্পাদনকারী বিশেষ বিশেষ শক্তি কল্পনা করা অবৈজ্ঞানিক হয় না। কেন না, আদৌ এই সকল শক্তির মূল এক হইলেও, কার্য্যতঃ ইহাদিগের পার্থক্য দেখিতে পাই। যে অন্ধ, সে দেখিতে পায় না, কিন্তু শব্দ শুনিতে পায়; যে বধির, সে শব্দ শুনিতে পায় না, কিন্তু চক্ষে দেখিতে পায়। কেহ কিছু স্মরণ রাখিতে পারে না, কিন্তু সে হয়ত সুকল্পনাবিশিষ্ট কবি; আবার কেহ কল্পনায় অক্ষম, কিন্তু বড় মেধাবী। কেহ ঈশ্বরে ভক্তিশূন্য, কিন্তু লোককে দয়া করে; আবার নির্দ্দয় লোককেও ঈশ্বরে কিঞ্চিৎ ভক্তিবিশিষ্ট দেখা গিয়াছে।* সুতরাং দেহ ও মনের ভিন্ন ভিন্ন শক্তি স্বীকার করা যাইতে পারে। তবে কতকগুলি শক্তি-যথা স্নেহ, দয়া ইত্যাদিকে শক্তি বলা ভাল শুনায় না। কিন্তু অন্য ব্যবহার্য্য শব্দ কি আছে?
শিষ্য। ইংরাজি শব্দটা faculty, অনেক বাঙ্গালি লেখক বৃত্তি শব্দের দ্বারা তাহার অনুবাদ করিয়াছেন।
গুরু। পাতঞ্জল প্রভৃতি দর্শনশাস্ত্রে বৃত্তি শব্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।
শিষ্য। কিন্তু এক্ষণে সে অর্থ বাঙ্গালা ভাষায় অপ্রচলিত। বৃত্তি শব্দ চলিয়াছে।
গুরু। তবে বৃত্তিই চালাও। বুঝিলেই হইল। যখন তোমরা morals অর্থে “নীতি” শব্দ চালাইয়াছ, Science অর্থে “বিজ্ঞান” চালাইয়াছ, তখন faculty অর্থে “বৃত্তি” শব্দ চালাইলে দোষ ধরিব না।
শিষ্য। তার পর আমার দ্বিতীয় আপত্তি। আপনি বলিলেন, বৃত্তির অনুশীলন সুখ-কিন্তু জল বিনা তৃষ্ণার অনুশীলনে দুঃখ।
গুরু। রও। বৃত্তির অনুশীলনের ফল ক্রমশঃ স্ফূর্ত্তি, চরমে পরিণতাবস্থা, তার পর উদ্দিষ্ট বস্তুর সম্মিলনে পরিতৃপ্তি। এই স্ফূর্ত্তি এবং পরিতৃপ্তি উভয়ই সুখের পক্ষে আবশ্যক।
শিষ্য। ইহা যদি সুখ হয়, তবে বোধ হয়, এরূপ সুখ মনুষ্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নহে।
গুরু। কেন?
শিষ্য। ইন্দ্রিয়পর ব্যক্তির ইন্দ্রিয়বৃত্তির অনুশীলনে পরিতৃপ্তিতে সুখ। তাই কি তাহার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত?
গুরু। না। তাহা নহে। তাহা হইলেই ইন্দ্রিয় প্রবলতাহেতু মানসিক বৃত্তি সকলের অস্ফূর্ত্তি এবং ক্রমশঃ বিলোপ হইবার সম্ভাবনা। এ বিষয়ে স্থূল নিয়ম হইতেছে সামঞ্জস্যই। ইন্দ্রিয় সকলেরও এককালীন বিলোপ ধর্ম্মানুমত নহে। তাহাদের সামঞ্জস্যই ধর্ম্মানুমত। বিলোপে ও সংযমে অনেক প্রভেদ। সে কথা পশ্চাৎ বুঝাইব। এখন স্থূল কথাটা বুঝিয়া রাখ যে, বৃত্তি সকলের অনুশীলনের স্থূল নিয়ম পরস্পরের সহিত সামঞ্জস্য। এই সামঞ্জস্য কি, তাহা সবিস্তারে একদিন বুঝাইব। এখন কথাটা এই বুঝাইতেছি যে, সুখের উপাদান কি?
প্রথম। শারীরিক ও মানসিক বৃত্তি সকলের অনুশীলন। তজ্জনিত স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি।
দ্বিতীয়। সেই সকলের পরস্পর সামঞ্জস্য।
তৃতীয়। তাদৃশ অবস্থায় সেই সকলের পরিতৃপ্তি।
ইহা ভিন্ন আর কোন জাতীয় সুখ নাই। আমি সময়ান্তরে তোমাকে বুঝাইতে পারি, যোগীর যোগজনিত যে সুখ, তাহাও ইহার অন্তর্গত। ইহার অভাবই দুঃখ। সময়ান্তরে আমি তোমাকে বুঝাইতে পারি যে, বাচস্পতির গৃহদাহজনিত যে দুঃখ, অথবা তদপেক্ষাও হতভাগ্য ব্যক্তির পুত্রশোকজনিত যে দুঃখ, তাহাও এই দুঃখ আমার অবশিষ্ট কথাগুলি শুনিলে তুমি আপনি তাহা বুঝিতে পারিবে, আমাকে বুঝাইতে হইবে না।
শিষ্য। মনে করুন, তাহা যেন বুঝিলাম, তথাপি প্রধান কথাটা এখনও বুঝিলাম না। কথাটা এই হইতেছিল যে, আমি বলিয়াছিলাম যে, বাচস্পতি ধার্ম্মিক ব্যক্তি, তথাপি দুঃখী; আপনি বলিলেন যে, যখন সে দুঃখী, তখন সে কখনও ধার্ম্মিক নহে। আপনার কথা প্রমাণ করিবার জন্য, আপনি সুখ কি, তাহা বুঝাইলেন; এবং সুখ বুঝাতে বুঝিলাম যে, দুঃখ কি। ভাল, তাহাতে যেন বুঝিলাম যে, বাচস্পতি যথার্থ দুঃখী নহেন, অথবা তাঁহাকে যদি দুঃখী বলা যায়, তবে তিনি নিজের দোষে, অর্থাৎ নিজ শারীরিক বা মানসিক বৃত্তির অনুশীলনের ত্রুটি করাতে এই দুঃখ পাইতেছেন। কিন্তু তাহাতে এমন কিছুই বুঝা গেল না যে, তিনি অধার্ম্মিক। এ অনুশীলনতত্ত্বের সঙ্গে ধর্ম্মাধর্ম্মের সম্বন্ধ কি, তাহা ত কিছুই বুঝা গেল না। যদি কিছু বুঝিয়া থাকি, তবে সে এই যে, অনুশীলনই ধর্ম্ম।
গুরু। এক্ষণে তাই মনে করিতে পার। তাহা ছাড়া আরও একটা গুরুতর কথা আছে, তাহা না বুঝাইলে অনুশীলনের সঙ্গে ধর্ম্মের কি সম্বন্ধ, তাহা সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু সেটা আমাকে সর্ব্বশেষে বলিতে হইবে; কেন না, অনুশীলন কি, তাহা ভাল করিয়া না বুঝিলে সে তত্ত্ব তুমি গ্রহণ করিতে পারিবে না।
শিষ্য। অনুশীলন আবার ধর্ম্ম! এ সকল নূতন কথা।
গুরু। নূতন নহে। পুরাতনের সংস্কার মাত্র।
—————-
* উদাহরণ-বিলাতের সপ্তদশ শতাব্দীর Puritan সম্প্রদায়। অপিচ, Inquisition অধ্যক্ষেরা।
০৩.ধর্ম্ম কি?
শিষ্য। অনুশীলনকে ধর্ম্ম বলা যাইতে পারে, ইহা বুঝিতে পারিতেছি না। অনুশীলনের ফল সুখ, ধর্ম্মের ফলও কি সুখ?
গুরু। না ত কি ধর্ম্মের ফল দুঃখ? যদি তা হইত, তাহা হইলে আমি জগতের সমস্ত লোককে ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে পরামর্শ দিতাম।
শিষ্য। ধর্ম্মের ফল পরকালে সুখ হইতে পারে, কিন্তু ইহকালেও কি তাই?
গুরু। তবে বুঝাইলাম কি? ধর্ম্মের ফল ইহকালে কি পরকালে অন্য উপায় নাই।
শিষ্য। তথাপি গোল মিটিতেছে না। আমরা বলি খ্রীষ্টধর্ম্ম, বৌদ্ধধর্ম্ম, বৈষ্ণবধর্ম্ম-তৎপরিবর্ত্তে কি খ্রীষ্ট অনুশীলন, বৌদ্ধ অনুশীলন, বৈষ্ণব অনুশীলন বলিতে পারি?
গুরু। ধর্ম্ম কথাটার অর্থ উল্টাইয়া দিয়া তুমি গোলযোগ উপস্থিত করিলে। ধর্ম্ম শব্দটা নানা প্রকার অর্থে ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অর্থে আমাদিগের প্রয়োজন নাই;* তুমি যে অর্থে এমন ধর্ম্ম শব্দ ব্যবহার করিলে, উহা ইংরেজি Religion শব্দের আধুনিক তর্জমা মাত্র। দেশী জিনিস নহে।
শিষ্য। ভাল, Religion কি, তাহাই না হয় বুঝান।
গুরু। কি জন্য? Religion পাশ্চাত্ত্য শব্দ, পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতেরা ইহা নানা প্রকারে বুঝাইয়াছেন; কাহারও সঙ্গে কাহারও মত মিলে না।#
শিষ্য। কিন্তু রিলিজনের ভিতর এমন কি নিত্য বস্তু কিছুই নাই, যাহা সকল রিলিজনে পাওয়া যায়?
গুরু। আছে। কিন্তু সেই নিত্য পদার্থকে রিলিজন বলিবার প্রয়োজন নাই; তাহাকে ধর্ম্ম বলিলে আর কোন গোলযোগ হইবে না।
শিষ্য। তাহা কি?
গুরু। সমস্ত মনুষ্য জাতি-কি খ্রীষ্টিয়ান, কি বৌদ্ধ, কি হিন্দু, কি মুসলমান, সকলেরই পক্ষে যাহা ধর্ম্ম।
শিষ্য। কি প্রকারে তাহার সন্ধান পাওয়া যায়?
গুরু। মনুষ্যের ধর্ম্ম কি, তাহার সন্ধান করিলেই পাওয়া যায়।
শিষ্য। তাই ত জিজ্ঞাস্য।
গুরু। উত্তরও সহজ। চৌম্বকের ধর্ম্ম কি?
শিষ্য। লৌহাকর্ষণ।
গুরু। অগ্নির ধর্ম্ম কি?
শিষ্য। দাহকতা।
গুরু। জলের ধর্ম্ম কি?
শিষ্য। দ্রাবকতা।
গুরু। বৃক্ষের ধর্ম্ম কি?
শিষ্য। ফলে পুষ্পের উৎপাদকতা।
গুরু। মানুষের ধর্ম্ম কি?
শিষ্য। এক কথায় কি বলিব?
গুরু। মনুষ্যত্ব বল না কেন?
শিষ্য। তাহা হইলে মনুষ্যত্ব কি বুঝিতে হইবে।
গুরু। কাল তাহা বুঝাইব।
—————–
* ক চিহ্নিত ক্রোড়পত্র দেখ।
# খ চিহ্নিত ক্রোড়পত্র দেখ।
০৪.মনুষ্যত্ব কি?
গুরু। মনুষ্যত্ব বুঝিলে ধর্ম্ম সহজে বুঝিতে পারিবে। তাই আগে মনুষ্যত্ব বুঝাইতেছি। মনুষ্যত্ব বুঝিবার আগে বৃক্ষত্ব বুঝ। এই একটি ঘাস দেখিতেছ, আর এই বটগাছ দেখিতেছ-দুইটি কি এক জাতীয়?
শিষ্য। হাঁ, এক হিসাবে এক জাতীয়। উভয়েই উদ্ভিদ্।
গুরু। দুইটিকেই কি বৃক্ষ বলিবে?
শিষ্য। না, বটকেই বৃক্ষ বলিব-ওটি তৃণ মাত্র।
গুরু। এ প্রভেদ কেন?
শিষ্য। কাণ্ড, শাখা, পল্লব, ফুল, ফল, এই লইয়া বৃক্ষ। বটের এ সব আছে, ঘাসের এ সব নাই।
গুরু। ঘাসেরও সব আছে-তবে ক্ষুদ্র, অপরিণত। ঘাসকে বৃক্ষ বলিবে না?
শিষ্য। ঘাস আবার বৃক্ষ?
গুরু। যদি ঘাসকে বৃক্ষ না বল, তবে যে মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলি পরিণত হয় নাই, তাহাকেও মনুষ্য বলিতে পারা যায় না। ঘাসের যেমন উদ্ভিদত্ত্ব আছে, একজন হটেন্টট্ বা চিপেবারও সেরুপ মনুষ্যত্ব আছে। কিন্তু যে উদ্ভিদত্ত্বকে বৃক্ষত্ব বলি, সে যেমন ঘাসের নাই, তেমনি যে মনুষ্যত্ব মনুষ্যধর্ম্ম, হটেণ্টট্ বা চিপেবার সেই মনুষ্যত্ব নাই। বৃক্ষত্বের উদাহরণ ছাড়িও না, তাহা হইলেই বুঝিবে। ঐ বাঁশঝাড় দেখিতেছ-উহাকে বৃক্ষ বলিবে?
শিষ্য। বোধ হয় বলিব না। উহার কাণ্ড, শাখা ও পল্লব আছে; কিন্তু কৈ, উহার ফুল ফল হয় না; উহার সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি নাই; উহাকে বৃক্ষ বলিব না।
গুরু। তুমি অনভিজ্ঞ। পঞ্চাশ ষাট বৎসর পরে এক একবার উহার ফুল হয়। ফুল হইয়া ফল হয়, তাহা চালের মত। চালের মত, তাহাতে ভাতও হয়।
শিষ্য। তবে বাঁশকে বৃক্ষ বলিব।
গুরু। অথচ বাঁশ তৃণ মাত্র। একটি ঘাস উপড়াইয়া লইয়া গিয়া বাঁশের সহিত তুলনা করিয়া দেখ-মিলবে। উদ্ভিত্তত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরাও বাঁশকে তৃণশ্রেণীর মধ্যে গণ্য করিয়া গিয়াছেন। অতএব দেখ, স্ফূর্ত্তিগুণে তৃণে তৃণে কত তফাৎ। অথচ বাঁশের সর্ব্বাঙ্গীণ স্ফূর্ত্তি নাই। যে অবস্থায় মনুষ্যের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি সম্পূর্ণ হয়, সেই অবস্থাকেই মনুষ্যত্ব বলিতেছি।
শিষ্য। এরূপ পরিণতি কি ধর্ম্মের আয়ত্ত?
গুরু। উদ্ভিদের এইরূপ উৎকর্ষে পরিণতি, কতকগুলি চেষ্টার ফল; লৌকিক কথায় তাহাকে কর্ষণ বা পাট বলে। এই কর্ষণ কোথাও মনুষ্য কর্ত্তৃক হইতেছে, কোথাও প্রকৃতির দ্বারা হইতেছে। একটা সামান্য উদাহরণে বুঝাইব। তোমাকে যদি কোন দেবতা আসিয়া বলেন যে, বৃক্ষ আর ঘাস, এই দুইই একত্র পৃথিবীতে রাখিব না। হয় সব বৃক্ষ নষ্ট করিব, নয় সব তৃণ নষ্ট করিব। তাহা হইলে তুমি কি চাহিবে? বৃক্ষ রাখিতে চাহিবে, না ঘাস রাখিতে চাহিবে?
শিষ্য। বৃক্ষ রাখিব, তাহাতে সন্দেহ কি? ঘাস না থাকিলে ছাগল গোরুর কিছু কষ্ট হইবে, কিন্তু বৃক্ষ না থাকিলে, আম, কাঁঠাল প্রভৃতি উপাদেয় ফলে বঞ্চিত হইব।
গুরু। মূর্খ! তৃণ জাতি পৃথিবী হইতে অন্তর্হিত হইলে অন্নাভাবে মারা যাইবে যে? জান না যে, ধানও তৃণজাতীয়? যে ভাঁটুই দেখিতেছ, উহা ভাল করিয়া দেখিয়া আইস। ধানের পাট হইবার পূর্ব্বে ধানও ঐরূপ ছিল। কেবল কর্ষণ জন্য জীবনদায়িনী লক্ষ্মীর তুল্য হইয়াছে। গমও ঐরূপ। যে ফুলকপি দিয়া অন্নের রাশি সংহার কর, তাহাও আদিম অবস্থায় সমুদ্রতীরবাসী তিক্তস্বাদ কদর্য্য উদ্ভিদ্ ছিল- কর্ষণে এই অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইয়াছে। উদ্ভিদের পক্ষে কর্ষণ যাহা, মনুষ্যের পক্ষে স্বীয় বৃত্তিগুলির অনুশীলন তাই; এজন্য ইংরেজিতে উভয়ের নাম, CULTURE! এই জন্য কথিত হইয়াছে, যে, “The Substance of Religion is Culture.” “মানববৃত্তির উৎকর্ষণেই ধর্ম্ম।”
শিষ্য। তাহা হউক। স্থূল কথাও কিছুই বুঝিতে পারি নাই-মনুষ্যের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি কাহাকে বলে?
গুরু। অঙ্কুরের পরিণাম, মহামহীরুহ। মাটি খোঁজ, হয়ত একটি অতি ক্ষুদ্র, প্রায় অদৃশ্য, অঙ্কুর দেখিতে পাইবে। পরিণামে সেই অঙ্কুর সেই প্রকাণ্ড বটবৃক্ষের মত বৃক্ষ হইবে। কিন্তু তজ্জন্য ইহার কর্ষণ-কৃষকেরা যাহাকে গাছের পাট বলে, তাহা চাই। সরস মাটি চাই-জল না পাইলে হইবে না। রৌদ্র চাই, আওতায় থাকিলে হইবে না। যে সামগ্রী বৃক্ষশরীরের পোষণজন্য প্রয়োজনীয়, তাহা মৃত্তিকায় থাকা চাই-বৃক্ষের জাতিবিশেষে মাটিতে সার দেওয়া চাই। ঘেরা চাই। ইত্যাদি। তাহা হইলে অঙ্কুর সুবৃক্ষত্ব প্রাপ্ত হইবে। মনুষ্যেরও এইরূপ যে শিশু দেখিতেছ, ইহা মনুষ্যের অঙ্কুর। বিহিত কর্ষণে অর্থাৎ অনুশীলনে উহা প্রকৃত মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হইবে। পরিণামে সর্ব্বগুণযুক্ত, সর্ব্ব-সুখ-সম্পন্ন মনুষ্য হইতে পারিবে। ইহাই মনুষ্যের পরিণতি।
শিষ্য। কিছুই বুঝিলাম না। সর্ব্বসুখী সর্ব্বগুণযুক্ত কি সকল মনুষ্য হইতে পারে? গুরু। কখন হইতে পারিবে কি না, সে কথা এখন তুলিয়া কাজ নাই। সে অনেক বিচার। তবে ইহা স্বীকার করিব যে, এ পর্য্যন্ত কেহ কখন হয় নাই। আর সহসা কেহ হইবারও সম্ভাবনা নাই। তবে আমি যে ধর্ম্মের ব্যাখ্যানে প্রবৃত্ত, তাহার বিহিত অবলম্বনে ইহাই হইবে যে, লোকে সর্ব্বগুণ অর্জ্জনের জন্য যত্নে বহুগুণসম্পন্ন হইতে পারিবে; সর্ব্বসুখ লাভের চেষ্টায় বহু সুখ লাভ করিতে পারিবে।
শিষ্য। আমাকে ক্ষমা করুন-মনুষ্যের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি কাহাকে বলে, তাহা এখনও ভাল করিয়া বুঝিতে পারিলাম না।
গুরু। চেষ্টা কর। মনুষ্যের দুইটি অঙ্গ, এক শরীর, আর এক মন। শরীরের আবার কতকগুলি প্রত্যঙ্গ আছে; যথা-হস্ত পদাদি কর্ম্মেন্দ্রিয়, চক্ষু কর্ণাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়; মস্তিষ্ক, হৃৎ, বায়ুকোষ, অন্ত্র প্রভৃতি জীবনসঞ্চালক প্রত্যঙ্গ; অস্থি, মজ্জা, মেদ, মাংস, শোণিত প্রভৃতি শারীরিক উপাদান, এবং ক্ষুৎপিপাসাদি শারীরিক বৃত্তি। এ সকলের বিহিত পরিণতি চাই। আর মনেরও কতকগুলি প্রত্যঙ্গ-
শিষ্য। মনের কথা পশ্চাৎ শুনিব; এখন শারীরিক পরিণতি ভাল করিয়া বুঝান। শারীরিক প্রত্যঙ্গ সকলের কি প্রকারে পরিণতি সাধিত হইবে? শিশুর এই ক্ষুদ্র দুর্ব্বল বাহু বয়োগুণে আপনিই বর্দ্ধিত ও বলশালী হইবে। তাহা ছাড়া আবার কি চাই?
গুরু। তুমি যে স্বাভাবিক পরিণতির কথা বলিতেছ, তাহার দুইটি কারণ। আমিও সেই দুইটির উপর নির্ভর করিতেছি। সেই দুইটি কারণ-পোষণ ও পরিচালনা। তুমি কোন শিশুর একটি বাহু, কাঁধের কাছে দৃঢ় বন্ধনীর দ্বারা বাঁধিয়া রাখ, বাহুতে আর রক্ত না যাইতে পারে। তাহা হইলে ঐ বাহু আর বাড়িবে না, হয়ত অবশ, নয় দুর্ব্বল ও অকর্ম্মণ্য হইয়া যাইবে। কেন না, যে শোণিতে বাহুর পুষ্টি হইত, তাহা আর পাইবে না। আবার, বাঁধিয়া কাজ নাই, কিন্তু এমন কোন বন্দোবস্ত কর যে, শিশুর কখনও আর হাত নাড়িতে না পারে। তাহা হইলে ঐ হাত অবশ ও অকর্ম্মণ্য হইয়া যাইবে, অন্ততঃ হস্ত সঞ্চালনে যে ক্ষিপ্রকারিতা জৈব কার্য্যে প্রয়োজনীয়, তাহা কখনও যাইবে না। ঊর্দ্ধ্ববাহুদিগের বাহু দেখিয়াছ ত?
শিষ্য। বুঝিলাম, অনুশীলন গুণে শিশুর কোমল ক্ষুদ্র বাহু পরিণতবয়স্ক মানুষের বাহুর বিস্তার, বল ও ক্ষিপ্রকারিতা প্রাপ্ত হয়। কিন্তু এ ত সকলেরই সহজেই হয়। আর কি চাই?
গুরু। তোমার বাহুর সঙ্গে এই বাগানের মালীর বাহু তুলনা করিয়া দেখ। তুমি তোমার বাহুস্থিত অঙ্গুলিগুলিকে অনুশীলনে এরূপ পরিণত করিয়াছ যে, এখনই পাঁচ মিনিটে তুমি দুই পৃষ্ঠা কাগজে লিখিয়া ফেলিবে, কিন্তু ঐ মালী দশ দিন চেষ্টা করিয়া তোমার মত একটি “ক” লিখিতে পারিবে না। তুমি যে না ভাবিয়া, না যত্ন করিয়া অবহেলায় যেখানে যে আকারের যে অক্ষরের প্রয়োজন, তাহা লিখিয়া যাইতেছ, ইহা উহার পক্ষে অতিশয় বিস্ময়কর, ভাবিয়া সে কিছু বুঝিতে পারে না। সচরাচর অনেকেই লিখিতে জানে, এই জন্য সভ্য সমাজে লিপিবিদ্যা বিস্ময়কর অনুশীলন বলিয়া লোকের বোধ হয় না। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এই লিপিবিদ্যা ভোজবাজির অপেক্ষা আশ্চর্য্য অনুশীলনফল। দেখ, একটি শব্দ লিখিতে গেলে, মনে কর এই অনুশীলন শব্দ লিখিতে গেলে,-প্রথমে এই শব্দটির বিশ্লেষণ করিয়া উহার উপাদানভূত বর্ণগুলি স্থির করিতে হইবে-বিশ্লেষণে পাইতে হইবে, অ, ন, উ, শ, ঈ, ল, ন। ইহা প্রথমে কেবল কর্ণে, তাহার পর প্রত্যেকের চাক্ষুষ দ্রষ্টব্য অবয়ব ভাবিয়া মনে আনিতে হইবে। এক একটি অবয়ব মনে পড়িবে, আবার এক একটি কাগজে আঁকিতে হইবে। অথচ তুমি এত শীঘ্র লিখিবে যে, তাহাতে বুঝাইবে যে, তুমি কোন প্রকার মানসিক চিন্তা করিতেছ না। অনুশীলন গুণে অনেকেই এই, অসাধারণ কৌশলে কুশলী। অনুশীলনজনিত আরও প্রভেদ এই মালীর তুলনাতেই দেখ। তুমি যেখানে পাঁচ মিনিটে দুই পৃষ্ঠা কাগজে লিখিবে, মালী তেমনি পাঁচ মিনিটে এক কাঠা জমিতে কোদালি দিবে। তুমি দুই ঘণ্টায়, হয়ত দুই প্রহরেও তাহা পারিয়া উঠিবে না। এ বিষয়ে তোমার বাহু উপযুক্তরূপে চালিত অর্থাৎ অনুশীলিত হয় নাই, সমুচিত পরিণতি প্রাপ্ত হয় নাই। অতএব তোমার ও মালীর উভয়েরই হস্ত কিয়দংশে অপরিণত; সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি প্রাপ্ত হয় নাই। আবার এক জন শিক্ষিত গায়কের সঙ্গে তোমার নিজের তুলনা করিয়া দেখ। হয়ত শৈশবে তোমার কণ্ঠ ও গায়কের কণ্ঠে বিশেষ তারতম্য ছিল না; অনেক গায়ক সচরাচর স্বভাবতঃ সুকণ্ঠ নহে। কিন্তু অনুশীলন গুণে গায়ক সুকণ্ঠ হইয়াছে, তাহার কণ্ঠের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি হইয়াছে। আবার দেখ,-বল দেখি, তুমি কয় ক্রোশ পথ হাঁটিতে পার?
শিষ্য। আমি বড় হাঁটিতে পারি না; বড় জোর এক ক্রোশ।
গুরু। তোমার পদদ্বয়ের সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি হয় নাই। দেখ তোমার হাত, পা, গলা, তিনেরই সহজ পুষ্টি ও পরিণতি হইয়াছে-কিন্তু একের ও সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি হয় নাই। এইরূপ আর সকল শারীরিক প্রত্যঙ্গের বিষয়ে দেখিবে। শারীরিক প্রত্যঙ্গ মাত্রেরই সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি না হইলে শারীরিক সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি হইয়াছে বলা যায় না; কেন না, ভগ্নাংশগুলির পূর্ণতাই ষোল আনার পূর্ণতা। এক আনায় আধ পয়সা কম হইলে, পূরা টাকাতেই কম্তি হয়। যেমন শরীর সম্বন্ধে বুঝাইলাম, এমনই মন সম্বন্ধে জানিবে। মনেরও অনেকগুলি প্রত্যঙ্গ আছে, সেগুলিকে বৃত্তি বলা গিয়াছে। কতকগুলির কাজ জ্ঞানার্জ্জন ও বিচার। কতকগুলির কাজ কার্য্যে প্রবৃত্তি দেওয়া-যথা ভক্তি, প্রীতি, দয়াদি। আর কতকগুলির কাজ আনন্দের উপভোগ, সৌন্দর্য্য, হৃদয়ে গ্রহণ, রসগ্রহণ, চিত্তবিনোদন। এই ত্রিবিধ মানসিক বৃত্তিগুলির সকলের পুষ্টি ও সম্পূর্ণ বিকাশই সর্ব্বাঙ্গীন পরিণতি।
শিষ্য, অর্থাৎ জ্ঞানে পান্ডিত্য, বিচার দক্ষতা, কার্য্যে তৎপরতা,চিত্তে ধর্ম্মাত্মা এবং সুরসে রসিকতা, এই সকল হইলে, তবে মানসিক সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি হইবে। আবার তাহার উপর শারীরিক সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতি আছে অর্থাৎ শারীর বলিষ্ঠ সুস্থ, এবং সর্ব্ববিধ শারীরীক ক্রিয়ায় সুদক্ষ হওয়া চাই। কৃষ্ণার্জ্জুন আর শ্রীরাম লক্ষণ ভিন্ন আর কেহ কখন এরুপ হইয়াছিল কি না, তাহা শুনি নাই।
গুরু। যাহারা মনুষ্যজাতির মধ্যে উৎকৃষ্ট, তাহারা চেষ্টা করিলে যে সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যত্ব লাভ করিতে পারিবে না, এমত কথা স্বীকার করা যায় না। আমার এমনও ভরসা আছে, যুগান্তরে যখন মনুষ্যজাতি প্রকৃত উন্নতি প্রাপ্ত হইবে, তখন অনেক মনুষ্যই এই আদর্শানুযায়ী হইবে। সংস্কৃত গ্রন্থে প্রাচীন ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয় রাজগণের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহাতে দেখা যায়, সেই রাজগণ সম্পূর্ণরূপে এই মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।সে বর্ণনাগুলি যে অনেকটা লেখকদিগের কপোলকল্পিত, তাহাতে সম্দেহ নাই। কিন্তু এরূপ রাজগুণবর্ণনা যে স্থলে সাধারণ, সে স্থলে ইহাই অনুমেয় যে, এইরূপ একটা আদর্শ সে কালের ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দিগের সম্মুখে ছিল। আমিও সেইরূপ আদর্শ তোমার সম্মুখে স্থাপন করিতেছি। যে যাহা হইতে চায়, তাহার সম্মুখে তাহার সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন আদর্শ চাই। সে ঠিক আদর্শানুরূপ না হউক, তাহার নিকটবর্ত্তী হইবে। ষোল আনা কি, তাহা না জানিলে আট আনা পাইবার কেহ কামনা করে না। যে শিশু টাকায় ষোল আনা, ইহা বুঝে না, সে টাকার মূল্যস্বরূপ চারিটি পয়সা লইয়া সন্তুষ্ট হইতে পারে।
শিষ্য। এরূপ আদর্শ কোথায় পাইব? এরূপ মানুষ ত দেখি না।
গুরু। মনুষ্য না দেখ, ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বরই সর্ব্বগুণের সর্ব্বাঙ্গীণ স্ফূর্ত্তির ও চরম পরিণতির একমাত্র উদাহরণ। এই জন্য বেদান্তের নির্গুণ ঈশ্বরে, ধর্ম্ম, সম্যক্ ধর্ম্মত্ব প্রাপ্ত হয় না; কেন না, যিনি নির্গুণ তিনি আমাদের আদর্শ হইতে পারে না। অদ্বৈতবাদীদিগের “একমেবাদ্বিতীয়তম্” চৈতন্য অথবা যাহাকে হর্বর্ট স্পেন্সর “Inscrutable Power in Nature” বলিয়া ঈশ্বরস্থানে সংস্থাপিত করিয়াছেন -অর্থাৎ যিনি কেবল দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক ঈশ্বর, তাঁহার উপাসনায় ধর্ম্ম সম্পূর্ণ হয় না। আমাদের পুরাণেতিহাসে কথিত বা খ্রীষ্টিয়ানের ধর্ম্মপুস্তকে কথিত সগুণ ঈশ্বরের উপাসনাই ধর্ম্মের মূল, কেন না, তিনিই আমাদের আদর্শ হইতে পারেন। যাঁহাকে “Impersonal God” বলি, তাঁহার উপাসনাই নিস্ফল; যাঁহাকে ‘Permonal God’ বলি তাঁহার উপাসনাই সফল।
শিষ্য। মানিলাম সগুণ ঈশ্বরকে আদর্শ স্বরূপ মানিতে হইবে। কিন্তু উপাসনার প্রয়োজন কি?
গুরু। ঈশ্বরকে আমরা দেখিতে পাই না। তাঁহাকে দেখিয়া দেখিয়া চলিব, সে সম্ভাবনা নাই। কেবল তাঁহাকে মনে ভাবিতে পারি। সেই ভাবাই উপাসনা। তবে বেগার টালা রকম ভাবিলে কোন ফল নাই। সন্ধ্যা কেবল আওড়াইলে কোন ফল নাই। তাঁহার সর্ব্বগুণসম্পন্ন বিশুদ্ধ স্বভাবের উপর চিত্ত স্থির করিতে হইবে, ভক্তিভাবে তাঁহাকে হৃদয়ে ধ্যান করিতে হইবে। প্রীতির সহিত হৃদয়কে তাঁহার সম্মুখীন করিতে হইবে। তাঁহার স্বভাবের আদর্শে আমাদের স্বভাব গঠিত হইতে থাকুক,মনে এ ব্রত দৃঢ় করিতে হইবে; – তাহা হইলে সেই পবিত্র চরিত্রের বিমল জ্যোতি আমাদের চরিত্রে পড়িবে।তাঁহার নির্ম্মলতার মত নির্ম্মলতা, তাঁহার শক্তির অনুকারী সর্ব্বত্র-মঙ্গলময় শক্তি কামনা করিতে হইবে। তাঁহাকে সর্ব্বদা নিকটে দেখিতে হইবে, তাঁহার স্বভাবের সঙ্গে একস্বভাব হইবার চেষ্টা করিতে হইবে। অর্থাৎ তাঁহার সামীপ্য, সালোক্য, সারূপ্য, সাযুজ্য কামনা করিতে হইবে। তাহা হইলেই আমরা ক্রমে ঈশ্বরের নিকট হইব। আর্য্য ঋষিরা বিশ্বাস করিতেন যে, তাহা হইলে আমরা ক্রমে সারূপ্য সাযুজ্য প্রাপ্ত হইব,-ঈশ্বরের সঙ্গে এক হইব, ঈশ্বরেই লীন হইব। ইহাকেই মোক্ষ বলে। মোক্ষ আর কিছুই নয়, ঐশ্বরিক আদর্শ-নীত ঈশ্বরানুকৃত স্বভাবপ্রাপ্তি। তাহা পাইলেই দুঃখ হইতে মুক্তি হওয়া গেল, এবং সকল সুখের অধিকারী হওয়া গেল।
শিষ্য। আমি এত দিন বুঝিতাম, ঈশ্বর একটা সমুদ্র, আমি এক ফোঁটা জল, তাহাতে গিয়া মিশিব।
গুরু। উপাসনা-তত্ত্বের সার মর্ম্ম হিন্দুরা যেমন বুঝিয়াছিলেন এমন আর কোন জাতিই বুঝে নাই। এখন সে পরম রমণীয় ও সুসার উপাসনাপদ্ধতি এক দিকে আত্মপীড়নে, আর এক দিকে রঙ্গদারিতে পরিণত হইয়াছে।
শিষ্য। এখন আমাকে আর একটা কথা বুঝান। মনুষ্যে প্রকৃত মনুষ্যত্বের, অর্থাৎ সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন স্বভাবের আদর্শ নাই, এজন্য ঈশ্বরকে ধ্যান করিতে হইবে। কিন্তু ঈশ্বর অনন্তপ্রকৃতি। আমরা ক্ষুদ্রপ্রকৃতি। তাঁহার গুণগুলি সংখ্যায় অনন্ত, বিস্তারেও অনন্ত। যে ক্ষুদ্র, অনন্ত তাহার আদর্শ হইবে কি প্রকারে? সমুদ্রের আদর্শে কি পুকুর কাটা যায়, না আকাশের অনুকরণে চাঁদোয়া খাটান যায়?
গুরু। এই জন্য ধর্ম্মেতিহাসের প্রয়োজন। ধর্ম্মেতিহাসের প্রকৃত আদর্শ নিউ টেষ্টেমেণ্টের, এবং আমাদের পুরাণেতিহাসের প্রক্ষিপ্তাংশ বাদে সারভাগ। ধর্ম্মেতিহাসে (Religious History) প্রকৃত ধার্ম্মিকদিগের চরিত্র ব্যাখ্যাত থাকে। অনন্তপ্রকৃতি ঈশ্বর উপাসকের প্রথমাবস্থায় তাহার আদর্শ হইতে পারেন না, ইহা সত্য, কিন্তু ঈশ্বরের অনুকারী মনুষ্যেরা, অর্থাৎ যাঁহাদিগের গুণাধিক্য দেখিয়া ঈশ্বরাংশ বিবেচনা করা যায়, অথবা যাঁহাদিগকে মানবদেহধারী ঈশ্বর মনে করা যায়, তাঁহারাই সেখানে বাঞ্ছনীয় আদর্শ হইতে পারেন। এই জন্য যীশুখৃষ্ট খ্রীষ্টিয়ানের আদর্শ, শাক্যসিংহ বৌদ্ধের আদর্শ । কিন্তু এরূপ ধর্ম্মপরিবর্দ্ধক আদর্শ যেমন হিন্দুশাস্ত্রে আছে, এমন আর পৃথিবীর কোন ধর্ম্মপুস্তকে নাই-কোন জাতির মধ্যে প্রসিদ্ধ নাই। জনকাদি রাজর্ষি, নারদাদি দেবর্ষি, বশিষ্ঠাদি ব্রহ্মর্ষি, সকলেই অনুশীলনের চরমাদর্শ। তাহার উপর শ্রীরামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির, অর্জ্জুন, লক্ষ্মণ, দেবব্রত ভীষ্ম প্রভৃতি ক্ষত্রিয়গণ, আরও সম্পূর্ণতা-প্রাপ্ত আদর্শ। খৃষ্ট শাক্যসিংহ কেবল উদাসীন, কৌপীনধারী নির্ম্মম ধর্ম্মবেত্তা। কিন্তু ইঁহারা তা নয়। ইঁহারা সর্ব্বগুণবিশিষ্ট-ইঁহাদিগেতেই সর্ব্ববৃত্তি সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন স্ফূর্ত্তি পাইয়াছে। ইঁহারা সিংহাসনে বসিয়াও উদাসীন; কার্ম্মুকহস্তেও ধর্ম্মবেত্তা; রাজা হইয়াও পণ্ডিত; শক্তিমান্ হইয়াও সর্ব্বজনে প্রেমময়। কিন্তু এই সকল আদর্শের উপর হিন্দুর আর এক আদর্শ আছে, যাঁহার কাছে আর সকল আদর্শ খাটো হইয়া যায়-যুধিষ্ঠির যাঁহার কাছে ধর্ম্ম শিক্ষা করেন, স্বয়ং অর্জ্জুন যাঁহার শিষ্য, রাম ও লক্ষ্মণ যাঁহার অংশ মাত্র, যাঁহার তুল্য মহামহিমাময় চরিত্র কখন মনুষ্যভাষায় কীর্ত্তিত হয় নাই। আইস, আজ তোমাকে কৃষ্ণোপাসনায় দীক্ষিত করি।
শিষ্য। সে কি? কৃষ্ণ!
গুরু। তোমরা কেবল জয়দেবের কৃষ্ণ বা যাত্রার কৃষ্ণ চেন-তাই শিহরিতেছ। তাহারও সম্পূর্ণ অর্থ বুঝ না। তাহার পশ্চাতে, ঈশ্বরের সর্ব্বগুণসম্পন্ন যে কৃষ্ণচরিত্র কীর্ত্তিত আছে, তাহার কিছুই জান না। তাঁহার শারীরিক বৃত্তিসকল সর্বাঙ্গীণ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া অননুভবনীয় সৌন্দর্য্যে এবং অপরিমেয় বলে পরিণত; তাঁহার মানসিক বৃত্তিসকল সেইরূপ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া সর্ব্বলোকাতীত বিদ্যা, শিক্ষা, বীর্য্য এবং জ্ঞানে পরিণত, এবং প্রীতিবৃত্তির তদনুরূপ পরিণতিতে তিনি সর্ব্বলোকের সর্ব্বহিতে রত। তাই তিনি বলিয়াছেন-
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম্মসংরক্ষণার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে ||
যিনি বাহুবলে দুষ্টের দমন করিয়াছেন, বুদ্ধিবলে ভারতবর্ষ একীভূত করিয়াছেন, জ্ঞানবলে অপূর্ব্ব নিষ্কাম ধর্ম্মের প্রচার করিয়াছেন, আমি তাঁহাকে নমস্কার করি। যিনি কেবল প্রেমময় বলিয়া নিষ্কাম হইয়া এই সকল মনুষ্যের দুষ্কর কাজ করিয়াছেন, যিনি বাহুবলে সর্ব্বজয়ী এবং পরের সাম্রাজ্য স্থাপনের কর্ত্তা হইয়াও আপনি সিংহাসনে আরোহণ করেন নাই, যিনি শিশুপালের শত অপরাধ ক্ষমা করিয়া ক্ষমাগুণ প্রচার করিয়া, তার পর কেবল দণ্ডপ্রণেতৃত্ব প্রযুক্তই তাহার দণ্ড করিয়াছিলেন, যিনি সেই বেদপ্রবল দেশে, বেদপ্রবল সময়ে, বলিয়াছিলেন, “বেদে ধর্ম্ম নহে-ধর্ম্ম লোকহিতে”-তিনি ঈশ্বর হউন বা না হউন, আমি তাঁহাকে নমস্কার করি। যিনি একাধারে শাক্যসিংহ, যীশুখৃষ্ট, মহম্মদ ও রামচন্দ্র; যিনি সর্ব্ববলাধার, সর্ব্বগুণাধার, সর্ব্বধর্ম্মবেত্তা, সর্ব্বত্র প্রেমময়, তিনি ঈশ্বর হউন বা না হউন, আমি তাঁহাকে নমস্কার করি।
নমো নমস্তেহস্তু সহস্রকৃত্বঃ।
পুনশ্চ ভূয়োহপি নমো মনস্তে ||
০৫.অনুশীলন
শিষ্য। অদ্য অবশিষ্ট কথা শ্রবণের বাসনা করি।
গুরু। সকল কথাই অবশিষ্টের মধ্যে। এখন আমরা পাইয়াছি কেবল দুইটা কথা। (১) মানুষের সুখ, মনুষ্যত্বে; (২) এই মনুষ্যত্ব, সকল বৃত্তিগুলির উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি, পরিণত ও সামঞ্জস্যের সাপেক্ষ। এক্ষণে, এই বৃত্তিগুলি কি প্রকার, তাহার কিছু পর্য্যালোচনার প্রয়োজন।
বৃত্তিগুলিকে সাধারণতঃ দুই ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে। (১) শারীরিক ও (২) মানসিক। মানসিক বৃত্তিগুলির মধ্যে কতকগুলি জ্ঞান উপার্জ্জন করে, কতকগুলি কাজ করে, বা কার্য্যে প্রবৃত্তি দেয়, আর কতকগুলি জ্ঞান উপার্জ্জন করে না, কোন বিশেষ কার্য্যের প্রবর্ত্তকও নয়, কেবল আনন্দ অনুভূত করে। যেগুলির উদ্দেশ্য জ্ঞান, সেগুলিকে জ্ঞানার্জ্জনী বলিব।যেগুলির প্রবর্ত্তনায় আমরা কার্য্যে প্রবৃত্ত হই, বা হইতে পারি, সেগুলিকে কার্য্যকারিণী বৃত্তি বলিব। কেবল আনন্দ অনুভূত করায়, সেগুলিকে আহ্লাদিনী বা চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি বলা যাউক। জ্ঞান, কর্ম্ম, আনন্দ, এ ত্রিবিধবৃত্তির ত্রিবিধ ফল। সচ্চিদানন্দ এই ত্রিবিধ বৃত্তির প্রাপ্য।
শিষ্য। এই বিভাগ কি বিশুদ্ধ? সকল বৃত্তির পরিতৃপ্তিতেই ত আনন্দ।
গুরু। তা বটে। কিন্তু এমন কতকগুলি বৃত্তি আছে। যাহাদিগের পরিতৃপ্তির ফল কেবল আনন্দ-আনন্দ ভিন্ন অন্য ফল নাই। জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির মুখ্য ফল জ্ঞানলাভ, গৌণ ফল আনন্দ। কার্য্যকারিণী বৃত্তির মুখ্য ফল কার্য্যে প্রবৃত্তি, গৌণ ফল আনন্দ। কিন্তু এগুলির মুখ্য ফলই আনন্দ-অন্য ফল নাই। পাশ্চাত্ত্যেরা ইহাকে Æsthetic Faculties বলেন।
শিষ্য। পাশ্চাত্ত্যেরা Æsthetic ত Intellectual বা Emotional মধ্যে ধরেন, কিন্তু আপনি চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তি পৃথক করিলেন।
গুরু। আমি ঠিক পাশ্চাত্ত্যদিগের অনুসরণ করিতেছি না। ভরসা করি, অনুসরণ করিতে বাধ্য নহি। সত্যের অনুসরণ করিলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে। এখন মনুষ্যের সমুদায় শক্তিগুলিকে চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা গেল। (১) শারীরিকী, (২) জ্ঞানার্জ্জনী, (৩) কার্য্যকারিণী, (৪) চিত্তরঞ্জিনী। এই চতুর্ব্বিধ বৃত্তিগুলির উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যই মনুষ্যত্ব।
শিষ্য। ক্রোধাদি কার্য্যকারিণী বৃত্তি, এবং কামাদি শারীরিক বৃত্তি। এগুলিরও সম্যক্ স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি কি মনুষ্যত্বের উপাদান?
গুরু। এই চারি প্রকার বৃত্তির অনুশীলন সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলিয়া সে আপত্তির মীমাংসা করিতেছি।
শিষ্য। কিন্তু অন্য প্রকার আপত্তিও আছে। আপনি যাহা বলিলেন, তাহাতে ত নূতন কিছু পাইলাম না। সকলেই বলে, ব্যামাদি দ্বারা শারীরিকী বৃত্তিগুলির পুষ্টি হয়। অনেকেই তাহা করে। আর যাহারা সক্ষম, তাহারা পোষ্যগণকে সুশিক্ষা দিয়া জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির স্ফূর্ত্তির জন্য যথেষ্ট যত্ন করিয়া থাকে-তাই সভ্য জগতে এত বিদ্যালয়। তৃতীয়তঃ-কার্য্যকারিণী বৃত্তির রীতিমত অনুশীলন যদিও তাদৃশ ঘটিয়া উঠে না বটে, তবু তাহার ঔচিত্য সকলেই স্বীকার করে। চতুর্থ চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির স্ফুরণও কতক বাঞ্ছনীয় বলিয়া যে জ্ঞান আছে, তাহার প্রমাণ সাহিত্য ও সূক্ষ্ম শিল্পের অনুশীলন। নূতন আমাকে কি শিখাইলেন?
গুরু। এ সংসারে নূতন কথা বড় অল্পই আছে। বিশেষ, আমি যে কোন নূতন সম্বাদ লইয়া স্বর্গ হইতে সদ্য নামিয়া আসি নাই, ইহা তুমি এক প্রকার মনে স্থির করিয়া রাখিতে পার। আমার সব কথাই পুরাতন। নূতনে আমার নিজের বড় অবিশ্বাস। বিশেষ, আমি ধর্ম্মব্যখ্যায় প্রবৃত্ত। ধর্ম্ম পুরাতন, নূতন নহে। আমি নূতন ধর্ম্ম কোথায় পাইব?
শিষ্য। তবে শিক্ষাকে যে আপনি ধর্ম্মের অংশ বলিয়া খাড়া করিতেছেন, ইহাই দেখিতেছি নূতন।
গুরু। তাহাও নূতন নহে। শিক্ষা যে ধর্ম্মের অংশ, ইহা চিরকাল হিন্দুধর্ম্মে আছে এই জন্য সকল হিন্দুধর্ম্মশাস্ত্রেই শিক্ষাপ্রণালী বিশেষ প্রকারে বিহিত হইয়াছে। হিন্দুর ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের বিধি, কেবল পাঠ্যাবস্থার শিক্ষার বিধি। কত বৎসর ধরিয়া অধ্যয়ন করিতে হইবে। কি প্রণালীতে অধ্যয়ন করিতে হইবে, কি অধ্যয়ন করিতে হইবে, তাহার বিস্তারিত বিধান হিন্দু ধর্ম্মশাস্ত্রে আছে। ব্রহ্মচর্য্যের পর গার্হস্থ্যাশ্রমও শিক্ষানবিশী মাত্র। ব্রহ্মচর্য্যে জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিসকলের অনুশীলন; গার্হস্থ্যে কার্য্যকারিণী বৃত্তির অনুশীলন। এই দ্বিবিধ শিক্ষার বিধি সংস্থাপনের জন্য হিন্দুশাস্ত্রকারেরা ব্যস্ত। আমিও সেই আর্য্য ঋষিদিগের পদারবিন্দ ধ্যানপূর্ব্বক, তাঁহাদিগের প্রদর্শিত পথেই যাইতেছি। তিন চারি হাজার বৎসর পূর্ব্বে ভারতবর্ষের জন্য যে বিধি সংস্থাপিত হইয়াছিল, আজিকার দিনে ঠিক সেই বিধিগুলি অক্ষরে অক্ষরে মিলাইয়া চালাইতে পারা যায় না। সেই ঋষিরা যদি আজ ভারতবর্ষে বর্ত্তমান থাকিতেন, তবে তাঁহারাই বলিতেন “না, তাহা চলিবে না। আমাদিগের বিধিগুলির সর্ব্বাঙ্গ বজায় রাখিয়া এখন যদি চল, তবে আমাদের প্রচারিত ধর্ম্মের মর্ম্মের বিপরীতাচরণ হইবে।” হিন্দুধর্মের সেই মর্ম্মভাগ অমর; চিরকাল চলিবে, মনুষ্যের হিত সাধন করিবে; কেন না, মানবপ্রকৃতি তাহার ভিত্তি। তবে বিশেষ বিধি সকল, সকল ধর্ম্মেই সময়োচিত হয়। তাহা কালভেদে পরিহার্য্য বা পরিবর্ত্তনীয়। হিন্দুধর্ম্মের নব সংস্কারের এই স্থূল কথা।
শিষ্য। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, আপনি ইহার ভিতর অনেক বিলাতী কথা আনিয়া ফেলিতেছেন। শিক্ষা যে ধর্ম্মের অংশ, ইহা কোম্তের মত।
গুরু। হইতে পারে। এখন, হিন্দুধর্ম্মের কোন অংশের সঙ্গে যদি কোম্ত মতের কোথাও কোন সাদৃশ্য ঘটিয়া থাকে, তবে যবনস্পর্শদোষ ঘটিয়াছে বলিয়া হিন্দুধর্ম্মের সেটুকু ফেলিয়া দিতে হইবে কি? খ্রীষ্টধর্ম্মে ঈশ্বরোপাসনা আছে বলিয়া, হিন্দুদিগকে ঈশ্বরোপাসনা পরিত্যাগ করিতে হইবে কি? এসে দিন নাইণ্টীন্থ সেঞ্চুরিতে হর্বর্ট স্পেন্সর কোম্ত মত প্রতিবাদে ঈশ্বর সম্বন্ধে যে মত প্রচার করিয়াছেন, তাহা মর্ম্মতঃ বেদান্তের অদ্বৈতবাদ ও মায়াবাদ। স্পিনোজার মতের সঙ্গেও বেদান্ত মতের সাদৃশ্য আছে। বেদান্তের সঙ্গে হর্বর্ট স্পেন্সরের স্পিনোজার মতের সাদৃশ্য ঘটিল বলিয়া বেদান্তটা হিন্দুয়ানির বাহির করিয়া ফেলিয়া দিতে হইবে কি? আমি স্পেন্সরি স্পিনোজীয় বলিয়া বেদান্ত ত্যাগ করিব না-বরং স্পিনোজা বা স্পেন্সরকে ইউরোপীয় হিন্দু বলিয়া হিন্দুমধ্যে গণ্য করিব। হিন্দুধর্ম্মের যাহা স্থূল ভাগ, ইউরোপ হাতড়াইয়া হাতড়াইয়া তাহার একটু আধটু ছুঁইতে পারিতেছেন, হিন্দুধর্ম্মের শ্রেষ্ঠতার ইহা সামান্য প্রমাণ নহে।
শিষ্য। যাই হউক। গণিত বা ব্যায়াম শিক্ষা যদি ধর্ম্মের শাসনাধীন হইল, তবে ধর্ম্ম ছাড়া কি?
গুরু। কিছুই ধর্ম্ম ছাড়া নহে। ধর্ম্ম যদি যথার্থ সুখের উপায় হয়, তবে মনুষ্যজীবনের সর্ব্বাংশই ধর্ম্ম কর্ত্তৃক শাসিত হওয়া উচিত। ইহাই হিন্দুধর্ম্মের প্রকৃত মর্ম্ম। অন্য ধর্ম্মে তাহা হয় না, এজন্য এছাড়া অন্য ধর্ম্ম অসম্পূর্ণ; কেবল হিন্দুধর্ম্ম সম্পূর্ণ ধর্ম্ম। অন্য জাতির বিশ্বাস যে, কেবল ঈশ্বর ও পরকাল লইয়া ধর্ম্ম। হিন্দুর কাছে, ইহকাল, ঈশ্বর, মনুষ্য, সমস্ত জীব, সমস্ত জগৎ-সকল লইয়া ধর্ম্ম। এমন সর্ব্বব্যাপী সর্ব্বসুখময়, পবিত্র ধর্ম্ম কি আর আছে?
০৬.সামঞ্জস্য
শিষ্য। বৃত্তির অনুশীলন কি, তাহা বুঝিলাম। এখন সে সকলের সামঞ্জস্য কি, তাহা শুনিতে ইচ্ছা করি। শারীরিক প্রভৃতি বৃত্তিগুলি কি সকলই তুল্যরূপে অনুশীলিত করিতে হইবে? কাম, ক্রোধ, বা লোভের যেরুপ অনুশীলন, ভক্তি, প্রীতি, দয়ারও কি সেইরুপ অনুশীলন করিব ? পূর্ব্বগামী ধর্ম্মবের্ত্তৃগণ বলিয়া থাকেন যে, কাম ক্রোধাদির দমন করিবে, এবং ভক্তিপ্রীতিদয়াদির অপরিমিত অনুশীলন করিবে। তাহা যদি সত্য হয়, তবে সামঞ্জস্য কোথায় রহিল?
গুরু। ধর্ম্মবের্ত্তৃগণ যাহা বলিয়া আসিয়াছেন, তাহা সুসঙ্গত, এবং তাহার বিশেষ কারণ আছে। ভক্তিপ্রীতি প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ বৃত্তিগুলির সম্প্রসারণশক্তি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক, এবং এই বৃত্তিগুলির অধিক সম্প্রসারণেই অন্য বৃত্তিগুলির সামঞ্জস্য ঘটে।সমুচিত স্ফূর্ত্তি ও সামঞ্জস্য যাহাকে বলিয়াছি, তাহার এমন তাৎপর্য্য নহে যে, সকল বৃত্তিগুলিই তুল্যরূপে স্ফূরিত ও বর্দ্ধিত হইবে। সকল শ্রেণীর বৃক্ষের সমুচিত বৃদ্ধি ও সামঞ্জস্যে সুরম্য উদ্যান হয়। কিন্তু এখানে সমুচিত বৃদ্ধির এমন অর্থ নহে যে, তাল ও নারিকেল বৃক্ষ যত বড় হইবে মল্লিকা বা গোলাপের তত বড় আকার হওয়া চাই। যে বৃক্ষের যেমন সম্প্রসারণশক্তি, সে ততটা বাড়িবে। এক বৃক্ষের অধিক বৃদ্ধির জন্য যদি অন্য বৃক্ষ সমুচিত বৃদ্ধি না পায়, যদি তেঁতুলের আওতায় গোলাপের কেয়ারি শুকাইয়া যায়, তবে সামঞ্জস্যের হানি হইল। মনুষ্যচরিত্রেও সেইরূপ। কতকগুলি বৃত্তি-যথা ভক্তি, প্রীতি, দয়া-ইহাদিগের সম্প্রসারণশক্তি অন্যান্য বৃত্তির অপেক্ষা অধিক; এবং এইগুলির অধিক সম্প্রসারণই সমুচিত স্ফূর্ত্তি, ও সকল বৃত্তির সামঞ্জস্যের মূল। পক্ষান্তরে আরও কতকগুলি বৃত্তি আছে; প্রধানতঃ কতকগুলি শারীরিক বৃত্তি,-সেগুলিও অধিক সম্প্রসারণশক্তিশালিনী। কিন্ত সেগুলির অধিক সম্প্রসারণে অন্যান্য বৃত্তির সমুচিত স্ফূর্ত্তির বিঘ্ন হয়। সুতরাং সেগুলি যত দূর স্ফূর্ত্তি পাইতে পারে, তত দূর স্ফূর্ত্তি পাইতে দেওয়া অকর্ত্তব্য। যেগুলি তেঁতুলগাছ, তাহার আওতায় গোলাপের কেয়ারি মরিয়া যাইতে পারে। আমি এমন বলিতেছি না যে, সেগুলি বাগান হইতে উচ্ছেদ করিয়া ফেলিয়া দিবে। তাহা অকর্ত্তব্য; কেন না, অম্লে প্রয়োজন আছে-নিকৃষ্ট বৃত্তিতেও প্রয়োজন আছে। সে সকল কথা সবিস্তারে পরে বলিতেছি। তেঁতুলগাছ বাগান হইতে উচ্ছেদ করিবে না বটে, কিন্তু তাহার স্থান এক কোণে। বড় বাড়িতে না পায়-বাড়িলেই ছাঁটিয়া দিবে। দুই-একখানা তেঁতুল ফলিলেই হইল-তার বেশী আর না বাড়িতে পারে। নিকৃষ্ট বৃত্তির সাংসারিক প্রয়োজনসিদ্ধির উপযোগী স্ফূর্ত্তি হইলেই হইল-তাহার বেশী আর বৃদ্ধি যেন না পায়। ইহাকেই সমুচিত বৃদ্ধি ও সামঞ্জস্য বলিয়াছি।
শিষ্য। তবেই বুঝিলাম যে, এমন কতকগুলি বৃত্তি আছে-যথা কামাদি, যাহার দমনই সমুচিত স্ফূর্ত্তি।
গুরু। দমন অর্থে যদি ধ্বংস বুঝ, তবে এ কথা ঠিক নহে। কামের ধ্বংসে মনুষ্য জাতির ধ্বংস ঘটিবে। সুতরাং এই অতি কদর্য্য বৃত্তিরও ধ্বংস ধর্ম্ম নহে–অধর্ম্ম। আমাদের পরম রমণীয় হিন্দু ধর্ম্মেরও এই বিধি। হিন্দু শাস্ত্রকারেরা ইহার ধ্বংস বিহিত করেন নাই বরং ধর্ম্মার্থ তাহার নিয়োগই বিহিত করিয়াছেন। হিন্দুশাস্ত্রানুসারে পুত্রোৎপাদন এবং বংশরক্ষা ধর্ম্মের অংশ। তবে ধর্ম্মের প্রয়োজনাতিরিক্ত এই বৃত্তির যে স্ফূর্ত্তি, তাহা হিন্দুশাস্ত্রানুসারেও নিষিদ্ধ-এবং তদনুগামী এই ধর্ম্মব্যখ্যা যাহা তোমাকে শুনাইতেছি, তাহাতেও নিষিদ্ধ হইতেছে। কেন না, বংশরক্ষা ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়োজনীয়, তাহার অতিরিক্ত যে স্ফূর্ত্তি, তাহা সামঞ্জস্যের বিঘ্নকর, এবং উচ্চতর বৃত্তিসকলের স্ফূর্ত্তিরোধক। যদি অনুচিত স্ফূর্ত্তিরোধকে দমন বল, তবে এ সকল বৃত্তির দমনই সমুচিত অনুশীলন। এই অর্থে ইন্দ্রিয় দমনই পরম ধর্ম্ম।
শিষ্য। এই বৃত্তিটার লোকরক্ষার্থ একটা প্রয়োজন আছে বটে, এই জন্য আপনি এ সকল কথা বলিতে পারিলেন, কিন্তু অপরাপর অপকৃষ্ট বৃত্তি সম্বন্ধে এ সকল কথা খাটে না।
গুরু। সকল অপকৃষ্ট বৃত্তি সম্বন্ধে এই কথা খাটিবে। কোন্টির সম্বন্ধে খাটে না?
শিষ্য। মনে করুন ক্রোধ। ক্রোধের উচ্ছেদের আমি ত কোন অনিষ্ট দেখি না।
গুরু। ক্রোধ আত্মরক্ষা ও সমাজরক্ষার মূল। দণ্ডনীতি-বিধিবদ্ধ সামাজিক ক্রোধ। ক্রোধের উচ্ছেদে দণ্ডনীতির উচ্ছেদ হইবে। দণ্ডনীতির উচ্ছেদ সমাজের উচ্ছেদ।
শিষ্য। দণ্ডনীতি ক্রোধমূলক বলিয়া আমি স্বীকার করিতে পারিলাম না, বরং দয়ামূলক বলা ইহার অপেক্ষা ভাল হইতে পারে। কেন না, সর্ব্বলোকের মঙ্গল কামনা করিয়াই, দণ্ডশাস্ত্রপ্রণেতারা দণ্ডবিধি উদ্ভূত করিয়াছেন। এবং সর্ব্বলোকের মঙ্গল কামনা করিয়া রাজা দণ্ড প্রণয়ন করিয়া থাকেন।
গুরু। আত্মরক্ষার কথাটা বুঝিয়া দেখ। অনিষ্টকারীকে নিবারণ করিবার ইচ্ছাই ক্রোধ। সেই ক্রোধের বশীভূত হইয়াই আমরা অনিষ্টকারীর বিরোধী হই। এই বিরোধই আত্মরক্ষার চেষ্টা। হইতে পারে যে, আমরা কেবল বুদ্ধিবলেই স্থির করিতে পারি যে, অনিষ্টকারীর নিবারণ করা উচিত। কিন্তু কেবল বুদ্ধি দ্বারা কার্য্যে প্রেরিত হইলে, ক্রুদ্ধের যে ক্ষিপ্রকারিতা এবং আগ্রহ, তাহা আমরা কদাচ পাইব না। তার পর যখন মনুষ্য পরকে আত্মবৎ দেখিতে চেষ্টা করে, তখন এই আত্মরক্ষা ও পররক্ষা তুল্যরূপেই ক্রোধের ফল হইয়া দাঁড়ায়। পররক্ষায় চেষ্টিত যে ক্রোধ, তাহা বিধিবদ্ধ হইলে দণ্ডনীতি হইল।
শিষ্য। লোভে ত আমি কিছু ধর্ম্ম দেখি না।
গুরু। যে বৃত্তির অনুচিত স্ফূর্ত্তিকে লোভ বলা যায়, তাহার উচিত এবং সমঞ্জসীভূত স্ফূর্ত্তি-ধর্ম্মসঙ্গত অর্জ্জনস্পৃহা। আপনার জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের জন্য যাহা যাহা প্রয়োজনীয় এবং আমার উপর যাহাদের রক্ষার ভার আছে, তাহাদের জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের জন্য যাহা যাহা প্রয়োজনীয়, তাহার সংগ্রহ অবশ্য কর্ত্তব্য। এইরূপ পরিমিত অর্জ্জনে-কেবল ধনার্জ্জনের কথা বলিতেছি না, ভোগ্য বস্তু মাত্রেরই অর্জ্জনের কথা বলিতেছি-কোন দোষ নাই। সেই পরিমিত মাত্রা ছাপাইয়া উঠিলেই এই সদ্বৃত্তি লোভে পরিণত হইল। অনুচিত স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইল বলিয়া উহা তখন মহাপাপ হইয়া দাঁড়াইল। দুইটি কথা বুঝ। যেগুলিকে আমরা নিকৃষ্ট বৃত্তি বলি, তাহাদের সকলগুলিই উচিত মাত্রায় ধর্ম্ম, অনুচিত মাত্রায় অধর্ম্ম। আর এই বৃত্তিগুলি এমনই তেজস্বিনী যে, যত্ন না করিলে এগুলি সচরাচর উচিত মাত্রা অতিক্রম করিয়া উঠে, এ জন্য দমনই এগুলি সম্বন্ধে প্রকৃত অনুশীলন। এই দুটি কথা বুঝিলেই তুমি অনুশীলনতত্ত্বের এ অংশ বুঝিলে। দমনই প্রকৃত অনুশীলন, কিন্তু উচ্ছেদ নহে। মহাদেব, মন্মথের অনুচিত স্ফূর্ত্তি দেখিয়া তাহাকে ধ্বংস করিয়াছিলেন, কিন্তু লোকহিতার্থ আবার তাহাকে পুনর্জ্জীবিত করিতে হইল।* শ্রীমদ্ভবদ্গীতায় কৃষ্ণের যে উপদেশ, তাহাতেও ইন্দ্রিয়ের উচ্ছেদ উপদিষ্ট হয় নাই, দমনই উপদিষ্ট হইয়াছে। সংযত হইলে সে সকল আর শান্তির বিঘ্নকর হইতে পারে না, যথা-
রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মবশৈর্ব্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিচ্ছতি || ২। ৬৪।
শিষ্য। যাই হউক, এ তত্ত্ব লইয়া আর অধিক কালহরণের প্রয়োজন নাই। ভক্তি, প্রীতি, দয়া প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ বৃত্তিসকলের অনুশীলন সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করুন।
গুরু। এ বিষয়ে এত কথা বলিবার আমারও ইচ্ছা ছিল না। দুই কারণে বলিতে বাধ্য হইলাম। প্রথম তোমার আপত্তি খণ্ডন করিতে হইল। আর আজকাল যোগধর্ম্মের একটা হুজুক উঠিয়াছে, তাহাতে কিছু বিরক্ত হইয়াছি। এই ধর্ম্মের ফলাফল সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। ইহার যে সুমহৎ ফল আছে, তাহাতে সন্দেহ কি? তবে যাঁহারা এই হুজুক লইয়া বেড়ান, তাঁহাদের মত এই দেখিতে পাই যে, কতকগুলি বৃত্তির সর্ব্বাঙ্গীণ উচ্ছেদ, কতকগুলির প্রতি অমনোযোগ, এবং কতকগুলির সমধিক সম্প্রসারণ-ইহাই যোগের উদ্দেশ্য। এখন যদি সকল বৃত্তির উচিত স্ফূর্ত্তি ও সামঞ্জস্য ধর্ম্ম হয়, তবে তাঁহাদিগের এই ধর্ম্ম অধর্ম্ম। বৃত্তি নিকৃষ্ট হউক বা উৎকৃষ্ট হউক, উচ্ছেদমাত্র অধর্ম্ম। লম্পট বা পেটুক অধার্ম্মিক; কেন না, তাহারা আর সকল বৃত্তির প্রতি অমনোযোগী হইয়া দুই একটির সমধিক অনুশীলনে নিযুক্ত। যোগীরাও অধার্ম্মিক; কেন না, তাঁহারাও আর সকল বৃত্তির প্রতি অমনোযোগী হইয়া, দুই একটির সমধিক অনুশীলন করেন। নিকৃষ্ট উৎকৃষ্ট বৃত্তিভেদে না হয় লম্পট বা উদরম্ভরীকে নীচ শ্রেণীর অধার্ম্মিক বলিলাম এবং যোগীদিগকে উচ্চশ্রেণীর অধার্ম্মিক বলিলাম, কিন্তু উভয়কেই অধার্ম্মিক বলিব। আর আমি কোন বৃত্তিকে নিকৃষ্ট ও অনিষ্টকর বলিতে সম্মত নহি। আমাদের দোষে অনিষ্ট ঘটে বলিয়া সেগুলিকে নিকৃষ্ট কেন বলিব? জগদীশ্বর আমাদিগকে নিকৃষ্ট কিছুই দেন নাই। তাঁহার কাছে নিকৃষ্ট উৎকৃষ্ট ভেদ নাই। তিনি যাহা করিয়াছেন, তাহা স্ব স্ব কার্য্যোপযোগী করিয়াছেন। কার্য্যোপযোগী হইলেই উৎকৃষ্ট হইল। সত্য বটে জগতে অমঙ্গল আছে। কিন্তু সে অমঙ্গল, মঙ্গলের সঙ্গে এমন সম্বন্ধবিশিষ্ট, যে তাহাকে মঙ্গলের অংশ বিবেচনা করাই কর্ত্তব্য। আমাদের সকল বৃত্তিগুলিই মঙ্গলময়। যখন তাহাতে অমঙ্গল হয়, সে আমাদেরই দোষে। জগত্তত্ত্ব যতই আলোচনা করা যাইবে, ততই বুঝিবে যে, আমাদের মঙ্গলের সঙ্গেই জগৎ সম্বন্ধ। নিখিল বিশ্বের সর্ব্বাংশই মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলিরই অনুকূল। প্রকৃতি আমাদের সকল বৃত্তিগুলিরই সহায়। তাই যুগপরম্পরায় মনুষ্যজাতির মোটের উপর নাস্তিক আমাদের সকল বৃত্তিগুলিরই সহায়। তাই যুগপরম্পরায় মনুষ্যজাতির মোটের উপর উন্নতিই হইয়াছে, মোটের উপর অবনতি নাই। ধর্ম্মই এই উন্নতির কারণ। যে বৈজ্ঞানিক নাস্তিক ধর্ম্মকে উপহাস করিয়া বিজ্ঞানই এই উন্নতির কারণ বলেন, তিনি জানেন যে, তাঁহার বিজ্ঞানও এই ধর্ম্মের এক অংশ, তিনিও একজন ধর্ম্মের আচার্য্য। তিনি যখন “Law”র মহিমা কীর্ত্তন করেন, আর আমি যখন হরিনাম করি, দুই জন একই কথা বলি। দুই জনে একই বিশ্বেশ্বরের মহিমা কীর্ত্তন করি। মনুষ্যমধ্যে ধর্ম্ম লইয়া এত বিবাদ বিসম্বাদ কেন, আমি বুঝিতে পারি না।
————–
* মন্মথ ধ্বংস হইল, অথচ রতি হইতে জীবলোক রক্ষা পাইতে পারে না, রক্ষা পাইতে পারে না, এজন্য মন্মথের পুনর্জ্জীবন। পক্ষান্তরে আবার রতি কর্ত্তৃক পুনর্জ্জন্মলব্ধ কাম প্রতিপালিত হইলেন। এ কথাটাও যেন মনে থাকে। অনুচিত করিতে পারিলে পৌরাণিক উপাখ্যানগুলির এইরূপ নাচ তাৎপর্য্য অনুভূত করিতে পারিলে পৌরাণিক হিন্দুধর্ম্ম আর উপধর্ম্মসঙ্কুল বা “Silly” বলিয়া বোধ হইবে না। সময়ান্তরে দুই একটা উদাহরণ দিব।
০৭.সামঞ্জস্য ও সুখ
গুরু। এক্ষণে নিকৃষ্ট কার্য্যকারিণী বৃত্তির কথা ছাড়িয়া দিয়া, যাহাকে উৎকৃষ্ট বৃত্তি বল, সে সকলের কথা বলি শুন।
শিষ্য। আপনি বলিয়াছেন, কতকগুলি কার্য্যকারিণী বৃত্তি, যথা ভক্ত্যাদি অধিক সম্প্রসারণে সক্ষম, এবং তাহাদিগের অধিক সম্প্রসারণেই সকল বৃত্তির সামঞ্জস্য। আর কতকগুলি বৃত্তি আছে, যথা কামাদি, সেগুলিও অধিক সম্প্রসারণে সক্ষম, সেগুলির অধিক সম্প্রসারণে সামঞ্জস্যের ধ্বংস। কতকগুলির আধিক্যে সামঞ্জস্য, কতকগুলির সম্প্রসারণের আধিক্যে অসামঞ্জস্য, এমন ঘটে কেন, তাহা বুঝান নাই। আপনি বলিয়াছেন যে, কামাদির অধিক স্ফুরণে, অন্যান্য বৃত্তি, যথা ভক্তি প্রীতি দয়া, এ সকলের উত্তম স্ফূর্ত্তি হয় না, এই জন্য অসামঞ্জস্য ঘটে। কিন্তু ভক্তি প্রীতি দয়াদির অধিক স্ফুরণেও কাম ক্রোধাদির উত্তম স্ফূর্ত্তি হয় না; ইহাতে অসাঞ্জস্য ঘটে না কেন?
গুরু। যেগুলি শারীরিক বৃত্তি বা পাশব বৃত্তি, যাহা পশুদিগেরও আছে এবং আমাদিগেরও আছে, সেগুলি জীবনরক্ষা বা বংশরক্ষা জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয়। ইহাতে সহজেই বুঝা যায়, সেগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত-অনুশীলনসাপেক্ষ নহে। আমাদিগকে অনুশীলন করিয়া ক্ষুধা আনিতে হয় না, অনুশীলন করিয়া ঘুমাইবার শক্তি অর্জ্জন করিতে হয় না। দেখিও, স্বতঃস্ফূর্ত্তে ও সহজে গোল করিও না। যাহা আমাদের সঙ্গে জন্মিয়াছে, তাহা সহজ। সকল বৃত্তিই সহজ। কিন্তু সকল বৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে। যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত, তাহা অন্য বৃত্তির অনুশীলনে বিলুপ্ত হইতে পারে না।
শিষ্য। কিছুই বুঝিলাম না। যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে, তাহাই বা অন্য বৃত্তির অনুশীলনে বিলুপ্ত হইবে কেন?
গুরু। অনুশীলন জন্য তিনটি সামগ্রী প্রয়োজনীয়। (১) সময়, (২) শক্তি (Energy), (৩) যাহা লইয়া বৃত্তির অনুশীলন করিব-অনুশীলনের উপাদান। এখন আমাদিগের সময় ও শক্তি উভয় সঙ্কীর্ণ। মনুষ্যজীবন কয়েক বৎসর মাত্র পরিমিত। জীবিকানির্ব্বাহের কার্য্যের পর বৃত্তির অনুশীলন জন্য যে সময় অবশিষ্ট থাকে, তাহার কিছুমাত্র অপব্যয় হইলে সকল বৃত্তির সমুচিত অনুশীলনের উপযোগী সময় পাওয়া যাইবে না। অপব্যয় না হয়, তাহার জন্য এই নিয়ম করিতে হয় যে, যে বৃত্তি অনুশীলনসাপেক্ষ নহে, অর্থাৎ স্বতস্ফুর্ত্ত, তাহার অনুশীলনের জন্য সময় দিব না; যাহা অনুশীলনসাপেক্ষ, তাহার অনুশীলনে সকল সময়টুকু দিব। যদি তাহা না করিয়া, স্বতঃস্ফূর্ত্ত বৃত্তির অনাবশ্যক অনুশীলনে সময় হরণ করি, তবে সময়াভাব অন্য বৃত্তিগুলির উপযুক্ত অনুশীলন হইবে না। কাজেই সে সকলের খর্ব্বতা বা বিলোপ ঘটিবে। দ্বিতীয়তঃ শক্তি সম্বন্ধেও ঐ কথা খাটে। আমাদের কাজ করিবার মোট যে শক্তিটুকু আছে, তাহাও পরিমিত। জীবিকানির্ব্বাহের পর যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত বৃত্তির অনুশীলন জন্য বড় বেশী থাকে না। বিশেষ, পাশব বৃত্তির সমধিক অনুশীলন, শক্তিক্ষয়কারী। তৃতীয়তঃ, স্বতঃস্ফূর্ত্ত পাশব বৃত্তির অনুশীলনের উপাদান ও মানসিক বৃত্তির অনুশীলনের উপাদান পরস্পর বড় বিরোধী।
যেখানে ওগুলি থাকে, সেখানে এগুলি থাকিতে পায় না।
বিলাসিনীমণ্ডলমধ্যবর্ত্তীর হৃদয়ে ঈশ্বরের বিকাশ অসম্ভব এবং ক্রুদ্ধ অস্ত্রধারীর নিকট ভিক্ষার্থীর সমাগম অসম্ভব। আর শেষ কথা এই যে, পাশব বৃত্তিগুলি শরীর ও জাতি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বলিয়া, পুরুষপরম্পরাগত স্ফূর্ত্তিজন্যই হউক, বা জীবরক্ষাভিলাষী ঈশ্বরের ইচ্ছায়ই হউখ, এমন বলবতী যে, অনুশীলনে তাঁহার সমস্ত হৃদয় পরিব্যাপ্ত করে, আর কোন বৃত্তিরই স্থান হয় না। এইটি বিশেষ কথা।
পক্ষান্তরে, যে বৃত্তিগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে, তাহার অনুশীলনে আমাদের সমস্ত অবসর ও জীবিকানির্ব্বাহবিশিষ্ট শক্তির নিয়োগ করিলে, স্বতঃস্ফূর্ত্ত বৃত্তির আবশ্যকীয় স্ফূর্ত্তির কোন বিঘ্ন হয় না। কেন না, সেগুলি স্বতঃস্ফূর্ত্ত। কিন্তু উপাদানবিরোধহেতু তাহাদের দমন হইতে পারে বটে। কিন্তু ইহা দেখা গিয়াছে যে, এ সকলের দমনই যথার্থ অনুশীলন।
শিষ্য। কিন্তু যোগীরা অন্য বৃত্তির সম্প্রসারণ দ্বারা-কিম্বা উপায়ান্তরের দ্বারা, পাশব বৃত্তিগুলির ধ্বংস করিয়া থাকেন, এ কথা কি সত্য নয়?
গুরু। চেষ্টা করিলে যে কামাদির উচ্ছেদ করা যায় না, এমত নহে। সে ব্যবস্থা অনুশীলন ধর্ম্মের নহে, সন্ন্যাসকে আমি ধর্ম্ম বলি না-অন্ততঃ সম্পূর্ণ ধর্ম্ম বলি না। অনুশীলন প্রবৃত্তিমার্গ-সন্ন্যাস নিবৃত্তিমার্গ। সন্ন্যাস অসম্পূর্ণ ধর্ম্ম। ভগবান্ স্বয়ং কর্ম্মেরই শ্রেষ্ঠতা কীর্ত্তন করিয়াছেন; অনুশীলন কর্ম্মাত্মক।
শিষ্য। যাক্। তবে আপনার সামঞ্জস্য তত্ত্বের স্থূল নিয়ম একটা এই বুঝিলাম যে, যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত, তাহা বাড়িতে দিব না, যে বৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে, তাহা বাড়িতে দিতে পারি। কিন্তু ইহাতে একটা গোলযোগ ঘটে। প্রতিভা (Genius) কি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে? প্রতিভা একটি কোন বিশেষ বৃত্তি নহে, তাহা আমি জানি। কিন্তু কোন বিশেষ মানসিক বৃত্তি স্বতঃস্ফূর্ত্তিমতী বলিয়া তাহাকে কি বাড়িতে দিব না? তাহার অপেক্ষা আত্মহত্যা ভাল।
গুরু। ইহা যথার্থ।
শিষ্য। ইহা যদি যথার্থ হয়, এই বৃত্তিকে বাড়িতে দিতে পারি, আর এই বৃত্তিকে বাড়িতে দিতে পারি না, ইহা কোন্ লক্ষণ দেখিয়া নির্ব্বাচন করিব? কোন্ কষ্টিপাথরে ঘষিয়া ঠিক করিব যে, এইটি সোনা, এইটি পিতল।
গুরু। আমি বলিয়াছি যে, সুখের উপায় ধর্ম্ম, আর মনুষ্যত্বেই সুখ। অতএব সুখই সেই কষ্টিপাথর।
শিষ্য। বড় ভয়ানক কথা। আমি যদি বলি, ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিই সুখ?
গুরু। তাহা বলিতে পার না। কেন না, সুখ কি, তাহা বুঝাইয়াছি। আমাদের সমুদায় বৃত্তিগুলির স্ফূর্ত্তি, সামঞ্জস্য এবং উপযুক্ত পরিতৃপ্তিই সুখ।
শিষ্য। সে কথাটা এখনও আমার ভাল করিয়া বুঝা হয় নাই। সকল বৃত্তির স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তির সমবায় সুখ? না প্রত্যেক ভিন্ন ভিন্ন স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তিই সুখ।
গুরু। সমবায়ই সুখ। ভিন্ন ভিন্ন বৃত্তির স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তি সুখের অংশ মাত্র।
শিষ্য। তবে কষ্টিপাথর কোন্টা? সমবায় না অংশ?
গুরু। সমবায়ই কষ্টিপাথর?
শিষ্য। এ ত বুঝিতে পারিতেছি না। মনে করুন, আমি ছবি আঁকিতে পারি। কতকগুলি বৃত্তিবিশেষের পরিমার্জ্জনে এ শক্তি জন্মে। কথাটা এই যে, সেই বৃত্তিগুলির সমধিক সম্প্রসারণ আমার কর্ত্তব্য কি না, আপনাকে এ প্রশ্ন করিলে আপনি বলিবেন, “সকল বৃত্তির উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি ও চরিতার্থতার সমবায় যে সুখ, তাহার কোন বিঘ্ন হইবে কি না, এ কথা বুঝিয়া তবে চিত্রবিদ্যার অনুশীলন কর।” অর্থাৎ আমার তুলি ধরিবার আগে আমাকে গণনা করিয়া দেখিতে হইবে যে, ইহাতে আমার মাংসপেশীয় বল, শিরা ধমনীর স্বাস্থ্য, চক্ষের দৃষ্টি, শ্রবণের শ্রুতি-আমার ঈশ্বরে ভক্তি, মনুষ্যে প্রীতি, দীনে দয়া, সত্যে অনুরাগ-আমার অপত্যে স্নেহ, শত্রুতে ক্রোধ,-কোন বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি, দার্শনিক ধৃতি,-আমার কাব্যের কল্পনা, সাহিত্যের সমালোচনা-কোন দিকে কিছুর বিঘ্ন হয় কি না। ইহাও কি সাধ্য?
গুরু। কঠিন বটে নিশ্চিত জানিও। ধর্ম্মাচরণ ছেলেখেলা নহে। ধর্ম্মাচরণ অতি দুরূহ ব্যাপার। প্রকৃত ধার্ম্মিক যে পৃথিবীতে এত বিরল, তাহার কারণই তাই। ধর্ম্ম সুখের উপায় বটে, কিন্তু বড় আয়াসলভ্য। সাধনা অতি দুরূহ। দুরূহ, কিন্তু অসাধ্য নহে।
শিষ্য। কিন্তু ধর্ম্ম ত সর্ব্বসাধারণের উপযোগী হওয়া উচিত।
গুরু। ধর্ম্ম, যদি তোমার আমার গড়িবার সামগ্রী হইত, ত না হয়, তুমি যাহাকে সাধারণের উপযোগী বলিতেছ, সেইরূপ করিয়া গড়িতাম। ফরমায়েস মত জিনিস গড়িয়া দিতাম। কিন্তু ধর্ম্ম তোমার আমার গড়িবার নহে। ধর্ম্ম ঐশিক নিয়মাধীন। যিনি ধর্ম্মের প্রণেতা, তিনি ইহাকে যেরূপ করিয়াছেন, সেইরূপ আমাকে বুঝাইতে হইবে। তবে ধর্ম্মকে সাধারণের অনুপযোগীও বলা উচিত নহে। চেষ্টা করিলে, অর্থাৎ অনুশীলনের দ্বারা সকলেই ধার্ম্মিক হইতে পারে। আমার বিশ্বাস যে, এক সময়ে সকল মনুষ্যই ধার্ম্মিক হইবে। যত দিন তাহা না হয়, তত দিন তাহারা আদর্শের অনুসরণ করুক। আদর্শ সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। তাহা হইলেই তোমার এ আপত্তি খণ্ডিত হইবে।
শিষ্য। আমি যদি বলি যে, আপনার ওরূপ একটা পারিভাষিক এবঞ্চ দুষ্প্রাপ্য সুখ মানি না, আমার ইন্দ্রিয়াদির পরিতৃপ্তিই সুখ?
গুরু। তাহা হইলে আমি বলিব, সুখের উপায় ধর্ম্ম নহে, সুখের উপায় অধর্ম্ম।
শিষ্য। ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি কি সুখ নহে? ইহাও বৃত্তির স্ফূরণ ও চরিতার্থতা বটে। আমি ইন্দ্রিয়গণকে খর্ব্ব করিয়া, কেন দয়া দাক্ষিণ্যাদির সমধিক অনুশীলন করিব, আপনি তাহার উপযুক্ত কোন কারণ দেখান নাই। আপনি ইহা বুঝাইয়াছেন বটে যে, ইন্দ্রয়াদির অধিক অনুশীলনে দয়া দাক্ষিণ্যাদির ধ্বংস সম্ভাবনা-কিন্তু তদুত্তরে আমি যদি বলি যে, ধ্বংস হউক, আমি ইন্দ্রিয়সুখে বঞ্চিত হই কেন?
গুরু। তাহা হইলে আমি বলিব, তুমি কিষ্কিন্ধ্যা হইতে পথ ভুলিয়া আসিয়াছ। যাহা হউক, তোমার কথার আমি উত্তর দিব। ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি সুখ? ভাল, তাই হউক। আমি তোমাকে অবাধে ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্ত করিতে অনুমতি দিতেছি। আমি খত লিখিয়া দিতেছি যে, এই ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিতে কখন কেহ কোন বাধা দিবে না, কেহ নিন্দা করিবে না,-যদি কেহ করে, আমি গুণাগারি দিব। কিন্তু তোমাকেও একখানি খত লিখিয়া দিতে হইবে। তুমি লিখিয়া দিবে যে, “আর ইহাতে সুখ নাই” বলিয়া তুমি ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি ছাড়িয়া দিবে না। শ্রান্তি, ক্লান্তি, রোগ, মনস্তাপ, আয়ুক্ষয়, পশুত্বে অধঃপতন প্রভৃতি কোনরূপ ওজর আপত্তি করিয়া ইহা কখন ছাড়িতে পারিবে না। কেমন, রাজি আছ?
শিষ্য। দোহাই মহাশয়ের! আমি নই। কিন্তু এমন লোক কি সর্ব্বদা দেখা যায় না, যাহারা যাবজ্জীবন ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তিই সার করে? অনেক লোকই ত এইরূপ?
গুরু। আমারা মনে করি বটে, এমন লোক অনেক। কিন্তু ভিতরের খবর রাখি না। ভিতরের খবর এই-যাহাদিগকে যাবজ্জীবন ইন্দ্রিয়পরায়ণ দেখি, তাহাদিগের ইন্দ্রিয়-পরিতৃপ্তি চেষ্টা বড় প্রবল বটে, কিন্তু তেমন পরিতৃপ্তি ঘটে নাই। যেরূপ তৃপ্তি ঘটিলে ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দুঃখটা বুঝা যায়, সে তৃপ্তি ঘটে নাই। তৃপ্তি ঘটে নাই বলিয়াই চেষ্টা এত প্রবল। অনুশীলনের দোষে, হৃদয়ে আগুন জ্বলিয়াছে,-দাহ নিবারণের জন্য তারা জল খুঁজিয়া বেড়ায়; জানে না যে, অগ্নিদগ্ধের ঔষধ জল নয়।
শিষ্য। কিন্তু এমনও দেখি যে, অনেক লোক অবাধে অনুক্ষণ ইন্দ্রিয়বিশেষ চরিতার্থ করিতেছে, বিরাগও নাই। মদ্যপ ইহার উৎকৃষ্ট উদারহণস্থল। অনেক মাতাল আছে, সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত মদ খায়, কেবল নিদ্রিত অবস্থায় ক্ষান্ত। কই, তাহারা ত মদ ছাড়ে না-ছাড়িতে চায় না।
গুরু। একে একে বাপু। আগে “ছাড়ে না” কথাটাই বুঝ। ছাড়ে না, তাহার কারণ আছে। ছাড়িতে পারে না, কেন না, এটি ইন্দ্রিয়-তৃপ্তির লালসা মাত্র নহে-এ একটি পীড়া। ডাক্তারেরা ইহাকে Dipsomania বলে। ইহা ঔষধ আছে-চিকিৎসা আছে। রোগী মনে করিলেই রোগ ছাড়িতে পারে না। সেটা চিকিৎসকের হাত। চিকিৎসা নিষ্ফল হইলে রোগের যে অবশ্যম্ভাবী পরিণাম, তাহা ঘটে;-মৃত্যু আসিয়া রোগ হইতে মুক্ত করে। ছাড়ে না, তাহার কারণ এই। “ছাড়িতে চায় না”-এ কথা সত্য নয়। যে মুখে যাহা বলুক, তুমি যে শ্রেণীর মাতালের কথা বলিলে, তাহাদিগের মধ্যে এমন কেহই নাই যে, মদ্যের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য মনে মনে অত্যন্ত কাতর নহে। যে মাতাল সপ্তাহে এক দিন মদ খায়, সেই আজিও বলে “মদ ছাড়িব কেন?” তাহার মদ্যপানের আকাঙ্ক্ষা আজিও পরিতৃপ্ত হয় নাই-তৃষ্ণা বলবতী আছে। কিন্তু যাহার মধ্যে পূর্ণ হইয়াছে, সে জানে যে, পৃথিবীতে যত দুঃখ আছে, মদ্যপানের অপেক্ষা বড় দুঃখ বুঝি আর নাই। এ সকল কথা মদ্যপ সম্বন্ধেই যে খাটে, এমত নহে। সর্ব্বপ্রকার ইন্দ্রিয়পরায়ণের পক্ষে খাটে। কামুকের অনুচিত অনুশীলনের ফলও একটি রোগ। তাহারও চিকিৎসা আছে এবং পরিণামে অকালমৃত্যু আছে। এইরুপ একটি রোগীর কথা আমি আমার কোন চিকিৎসক বন্ধুর কাছে এইরুপ শুনিলাম যে, তাহাকে হাসপাতালে লইয়া গিয়া তাহার হাত পা বাঁধিয়া রাখিতে হইয়াছিল, এবং সে ইচ্ছামত অঙ্গ সঞ্চালন করিতে না পারে, এজন্য লাইকরলিটি দিয়া তাহার অঙ্গের স্থানে স্থানে ঘা করিয়া দিতে হইয়াছিল। ঔদরিকের কথা সকলেই জানে। আমার নিকট এক জন ঔদরিক বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তিনি ঔদরিকতার অনুচিত অনুশীলনের ও পরিতৃপ্তির জন্য গ্রহণী রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন। তিনি বেশ জানিতেন যে, দুষ্পচনীয় দ্রব্য আহার করিলেই তাঁহার পীড়া বৃদ্ধি হইবে। সে জন্য লোভ সম্বরণের যথেষ্ট চেষ্টা করিতেন, কিন্তু কোন মতেই কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। বলা বাহুল্য যে, তিনি অকালে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইলেন। বাপু হে! এই সকল কি সুখ? ইহার আবার প্রমাণ প্রয়োগ চাই?
শিষ্য। এখন বোধ হয়, আপনি যাহাকে সুখ বলিতেছেন, তাহা বুঝিয়াছি। ক্ষণিক যে সুখ, তাহা সুখ নহে।
গুরু। কেন নহে? আমি জীবনের মধ্যে যদি একবার একটি গোলাপ ফুল দেখি, কি একটা গান শুনি, আর পরক্ষণেই সব ভুলিয়া যাই, তবে সে সুখ বড় ক্ষণিক সুখ, কিন্তু সে সুখ কি সুখ নহে? তাহা সত্যই সুখ।
শিষ্য। যে সুখ ক্ষণিক অথচ যাহার পরিণাম স্থায়ী দুঃখ, তাহা সুখ নহে, দুঃখের প্রথমাবস্থা মাত্র। এখন বুঝিয়াছি কি?
গুরু। এখন পথে আসিয়াছ। কিন্তু এ ব্যাখ্যা ত ব্যতিরেকী। কেবল ব্যতিরেকী ব্যাখ্যার সবটুকু পাওয়া যাইবে না। সুখ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে-(১) স্থায়ী, (২) ক্ষণিক। ইহার মধ্যে-
শিষ্য। স্থায়ী কাহাকে বলে? মনে করুন, কোন ইন্দ্রিয়াসক্ত ব্যক্তি পাঁচ বৎসর ধরিয়া ইন্দ্রিয়-সুখ ভোগ করিতেছে। কথাটা নিতান্ত অসম্ভব নহে। তাহার সুখ কি ক্ষণিক?
গুরু। প্রথমতঃ, সমস্ত জীবনের তুলনায় পাঁচ বৎসর মুহূর্ত্ত মাত্র। তুমি পরকাল মান, না মান, আমি মানি। অনন্ত কালের তুলনায় পাঁচ বৎসর কতক্ষণ? কিন্তু আমি পরকালের ভয় দেখাইয়া কাহাকেও ধার্ম্মিক করিতে চাহি না। কেন না, অনেক লোক পরকাল মানে না-মুখে মানে ত হৃদয়ের ভিতর মানে না; মনে করে, ছেলেদের জুজুর ভয়ের মত মানুষকে শান্ত করিবার একটা প্রাচীন কথা মাত্র। তাই আজিকালি অনেক লোক পরকালের ভয়ে ভয় পায় না। পরকালের দুঃখের ভয়ের উপর যে ধর্ম্মের ভিত্তি, তাহা এই জন্য সাধারণ লোকের হৃদয়ে সর্ব্বত্র বলবানই হয় না। “আজিকার দিনে” বলিতেছি; কেন না, একসময়ে এদেশে সে ধর্ম্ম বড় বলবান ছিল বটে। এক সময়ে, ইউরোপেও বড় বলবান্ ছিল বটে, কিন্তু এখন বিজ্ঞানময়ী ঊনবিংশ শতাব্দী। সেই রক্তমাংস-পূতিগন্ধ-শালিনী, কামান-গোলা-বারুদ-ব্রীচ্লোডর-টর্পীডো প্রভৃতিতে শোভিতা রাক্ষসী,-এক হাতে শিল্পীর কল চালাইতেছে, আর এক হাতে ঝাঁটা ধরিয়া, যাহা প্রাচীন, যাহা পবিত্র, যাহা সহস্র সহস্র বৎসরের যত্নের ধন, তাহা ঝাঁটাইয়া ফেলিয়া দিতেছে। সেই পোড়ারমুখী, এদেশে আসিয়াও কালা মুখ দেখাইতেছে। তাহার কুহকে পড়িয়া, তোমার মত সহস্র সহস্র শিক্ষিত, অশিক্ষিত, এবং অর্দ্ধশিক্ষিত বাঙ্গালী পরকাল আর মানে না। তাই আমি এই ধর্ম্মব্যাখ্যায় যত পারি, পরকালকে বাদ দিতেছি। তাহার কারণ এই যে, যাহা তোমাদের হৃদয়ক্ষেত্রে নাই, তাহার উপর ভিত্তি সংস্থাপন করিয়া আমি ধর্ম্মের মন্দির গড়িতে পারিব না। আর আমার বিবেচনায়, পরকাল বাদ দিলেই ধর্ম্ম ভিত্তিশূন্য হইল না। কেন না,ইহলোকের সুখও কেবল ধর্ম্মমূলক, ইহকালের দুঃখও কেবল অধর্ম্মমূলক। এখন ইহকালের দুঃখকে সকলেই ভয় করে, সুখ সকলেই কামনা করে। এজন্য ইহকালের সুখ দুঃখের উপরও ধর্ম্ম সংস্থাপিত হইতে পারে। এই দুই কারণে, অর্থাৎ ইহকাল সর্ব্ববাদিসম্মত, এবং পরকাল সর্ব্ববাদিসম্মত নহে বলিয়া, আমি কেবল ইহকালের উপরই ধর্ম্মের ভিত্তি সংস্থাপন করিতেছি। কিন্তু “স্থায়ী সুখ কি?” এখন এ প্রশ্ন উঠিল, তখন ইহার প্রথম উত্তরে অবশ্য বলিতে হয় যে, অনন্তকালস্থায়ী যে সুখ, ইহকাল পরকাল উভয় কালব্যাপী যে সুখ, সেই সুখ স্থায়ী সুখ। কিন্তু ইহার দ্বিতীয় উত্তর আছে।
শিষ্য। দ্বিতীয় উত্তর পরে শুনিব, এক্ষণে আর একটা কথার মীমাংসা করুন। মনে করুন, বিচারার্থ পরকাল স্বীকার করিলাম। কিন্তু ইহকালে যাহা সুখ, পরকালেও কি তাই সুখ? ইহকালে যাহা দুঃখ, পরকালেও কি তাই দুঃখ? আপনি বলিতেছেন, ইহকালপরকালব্যাপী যে সুখ, তাহাই সুখ-একজাতীয় সুখ কি উভয়কালব্যাপী হইতে পারে?
গুরু। অন্য প্রকার বিবেচনা করিবার কোন কারণ আমি অবগত নহি। কিন্তু এ কথার উত্তর জন্য দুই প্রকার বিচার আবশ্যক। যে জন্মান্তর মানে, তাহার পক্ষে এক প্রকার আর যে জন্মান্তর মানে না, তাহার পক্ষে আর এক প্রকার। তুমি কি জন্মান্তর মান?
শিষ্য। না।
গুরু। তবে, আইস। যখন পরকাল স্বীকার করিলে অথচ জন্মান্তর মানিলে না, তখন দুইটি কথা স্বীকার করিলে;-প্রথম এই শরীর থাকিবে না, সুতরাং শারীরিকী বৃত্তিনিচয়জনিত যে সকল সুখ দুঃখ, তাহা পরকালে থাকিবে না। দ্বিতীয় শরীর ব্যতিরিক্ত যাহা, তাহা থাকিবে, অর্থাৎ ত্রিবিধ মানসিক বৃত্তিগুলি থাকিবে, সুতরাং মানসিক বৃত্তিজনিত যে সকল সুখ দুঃখ, তাহা পরকালেও থাকিবে। পরকালে এইরূপ সুখের আধিক্যকে স্বর্গ বলা যাইতে পার, এইরূপ দুঃখের আধিক্যকে নরক বলা যাইতে পারে।
শিষ্য। কিন্তু যদি পরকাল থাকে, তবে ইহা ধর্ম্মব্যাখ্যার অতি প্রধান উপাদান হওয়াই উচিত। তজ্জন্য অন্যান্য ধর্ম্মব্যাখ্যায় ইহাই প্রধানত্ব লাভ করিয়াছে। আপনি পরকাল মানিয়াও যে, উহা ধর্ম্মব্যাখ্যায় বর্জ্জিত করিয়াছেন, ইহাতে আপনার ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত হইয়াছে বিবেচনা করি।
গুরু। অসম্পূর্ণ হইতে পারে। সে কথাতেও কিছু সন্দেহ আছে। অসম্পূর্ণ হউক বা না হউক, কিন্তু ভ্রান্ত নহে। কেন না, সুখের উপায় যদি ধর্ম্ম হইল, আর ইহকালেও যে সুখ, পরকালেও যদি সেই সুখই সুখ হইল, তবে ইহকালেরও যে ধর্ম্ম, পরকালেরও সেই ধর্ম্ম। পরকাল নাই মান, কেবল ইহলোকে সার করিয়াও সম্পূর্ণরূপে ধার্ম্মিক হওয়া যায়। ধর্ম্ম নিত্য। ধর্ম্ম ইহকালেও সুখপ্রদ, পরকালেও সুখপ্রদ। তুমি পরকাল মান আর না মান- ধর্ম্মাচরণ করিও তাহা হইলে ইহলোকেও সুখী হইবে, পরকালেও সুখী হইবে।
শিষ্য। আপনি নিজে পরকাল মানেন-কিছু প্রমাণ আছে বলিয়া মানেন, না, কেবল মানিতে ভাল লাগে, তাই মানেন?
গুরু। যাহার প্রমাণাভাব, তাহা আমি মানি না। পরকালের প্রমাণ আছে বলিয়াই পরকাল মানি।
শিষ্য। যদি পরকালের প্রমাণ আছে, যদি আপনি নিজে পরকালে বিশ্বাসী, তবে আমাকে তাহা মানিতে উপদেশ দিতেছেন না কেন? আমাকে সে সকল প্রমাণ বুঝাইতেছেন না কেন?
গুরু। আমাকে ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, সে প্রমাণগুলি বিবাদের স্থল। প্রমাণগুলির এমন কোন দোষ নাই যে, সে সকল বিবাদের সুমীমাংসা হয় না, বা হয় নাই।তবে আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের কুসংস্কারবশতঃ বিবাদ মিটে না। বিবাদের ক্ষেত্রে অবতরণ করিতে আমার ইচ্ছা নাই এবং প্রয়োজনও নাই। প্রয়োজন নাই, এই জন্য বলিতেছি যে, আমি তোমাকে উপদেশ দিতেছি যে, পবিত্র হও, শুদ্ধচিত্ত হও, ধর্ম্মাত্মা হও। ইহাই যথেষ্ট। আমরা এই ধর্ম্ম ব্যাখ্যার ভিতর যত প্রবেশ করিব, ততই দেখিব যে, এক্ষণে যাহাকে সমুদায় চিত্তবৃত্তির সর্ব্বাঙ্গীণ স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি বলিতেছি, তাহার শেষ ফল পবিত্রতা-চিত্তশুদ্ধি।* তুমি পরকাল যদি নাও মান, তথাপি শুদ্ধচিত্ত ও পবিত্রাত্মা হইলে নিশ্চয়ই তুমি পরকালে সুখী হইবে। যদি চিত্ত শুদ্ধ হইল, তবে ইহলোকই স্বর্গ হইল, তখন পরলোকে স্বর্গের প্রতি আর সন্দেহ কি? যদি তাই হইল, তবে পরকাল মানা-না-মানাতে বড় আসিয়া গেল না। যাহারা পরকাল মানে না, ইহাতে ধর্ম্ম তাহাদের পক্ষ সহজ হইল ; যে ধর্ম্ম তাহার পরকালমূলক বলিয়া এত দিন অগ্রাহ্য করিত, তাহার এখন সেই ধর্ম্মকে ইহকালমূলক বলিয়া অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারিবে। আর যাহারা পরকালে বিশ্বাস করে, তাহাদের বিশ্বাসের সঙ্গে এ ব্যাখ্যার কোন বিবাদ নাই। তাহাদের বিশ্বাস দিন দিন দৃঢ়তর হউক, বরং ইহাই আমি কামনা করি।
শিষ্য। আপনি বলিয়াছিলেন যে, ইহকাল-পরকালব্যাপী যে সুখ, তাহাই সুখ। একজাতীয় সুখ উভয় কালব্যাপী হইতে পারে। যে জন্মান্তর মানে না, তাহার পক্ষে এই তত্ত্ব যে কারণে গ্রাহ্য, তাহা বুঝাইলেন। যে জন্মান্তর মানে, তাহার পক্ষে কি?
গুরু। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি, অনুশীলনের সম্পূর্ণতায় মোক্ষ। অনুশীলনের পূর্ণমাত্রায় আর পুনর্জ্জন্ম হইবে না। ভক্তিতত্ত্ব যখন বুঝাইব, তখন এ কথা আরও স্পষ্ট বুঝিবে।
শিষ্য। কিন্তু অনুশীলনের পূর্ণমাত্রা ত সচরাচর কাহার কপালে ঘটা সম্ভব নহে। যাহাদের অনুশীলনের সম্পূর্ণতা ঘটে নাই, তাহাদের পুনর্জ্জন্ম ঘটিবে। এই জন্মের অনুশীলনের ফলে তাহারা কি পরজন্মের কোন সুখ প্রাপ্ত হইবে?
গুরু। জন্মান্তরবাদের স্থূল মর্ম্মই এই যে, এ জন্মের কর্ম্মফল পরজন্মে পাওয়া যায়। সমস্ত কর্ম্মের সমবায় অনুশীলন। অতএব এ জন্মের অনুশীলনের যে শুভ ফল, তাহা অনুশীলনবাদীর মতে পরজন্মে অবশ্য পাওয়া যাইবে। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এ কথা অর্জ্জুনকে বলিয়াছেন।
“তত্র তং বুদ্ধিসংযোগং লভতে পৌর্ব্যদেহিকম্” ইত্যাদি।
গীতা। ৪৩। ৬।
শিষ্য। এক্ষণে আমরা মূল কথা হইতে অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়াছি। কথাটা হইতেছিল, স্থায়ী সুখ কী? তাহার প্রথম উত্তরে আপনি বলিয়াছেন যে, ইহকালে ও পরকালে চিরস্থায়ী যে সুখ, তাহাই তাহার স্থায়ী সুখ। ইহার দ্বিতীয় উত্তর আছে বলিয়াছেন। দ্বিতীয় উত্তর কি?
গুরু। দ্বিতীয় উত্তর যাহারা পরকাল মানে না, তাহাদের জন্য। ইহজীবনই যদি সব হইল, মৃত্যুই যদি জীবনের অন্ত হইল, যে সুখ সেই অন্তকাল পর্য্যন্ত থাকিবে, তাহাই স্থায়ী সুখ। যদি পরকাল না থাকে, তবে ইহজীবনে যাহা চিরকাল থাকে, তাহাই স্থায়ী সুখ।তুমি বলিতেছিলে, পাঁচ সাত দশ বৎসর ধরিয়া কেহ কেহ ইন্দ্রিয়সুখে নিমগ্ন থাকে। কিন্তু পাঁচ সাত দশ বৎসর কিছু চিরজীবন নহে। যে পাঁচ সাত দশ বৎসর ধরিয়া ইন্দ্রিয় পরিতর্পণে নিযুক্ত আছে, তাহারও মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত সে সুখ থাকিবে না। তিনটির একটি না একটি কারণে অবশ্য অবশ্য তাহার সে সুখের স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া যাইবে। (১) অতিভোগজনিত গ্লানি বা বিরাগ-অতিতৃপ্তি; কিম্বা (২) ইন্দ্রিয়াসক্তি-জনিত অবশ্যম্ভাবী রোগ বা অসমার্থ্য; অথবা (৩) বয়োবৃদ্ধি। অতএব এ সকল সুখের ক্ষণিকত্ব আছেই আছে।
শিষ্য। আর যে সকল বৃত্তিগুলিকে উৎকৃষ্ট বৃত্তি বলা যায়, সেগুলির অনুশীলনে যে সুখ, তাহা কি হইজীবনে চিরস্থায়ী?
গুরু। তদ্বিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। একটা সামান্য উদাহরণের দ্বারা বুঝাইব। মনে কর, দয়াবৃত্তির কথা হইতেছে। পরোপকারে ইহার অনুশীলন ও চরিতার্থতা। এ বৃত্তির দোষ এই যে, যে ইহার অনুশীলন আরম্ভ করে নাই, সে ইহার অনুশীলনের সুখ বিশেষরুপে অনুভব করিতে পারে না। কিন্তু ইহা যে অনুশীলিত করিয়াছে, সে জানে, দয়ার অনুশীলন ও চরিতার্থতায়, অর্থাৎ পরোপকারে এমন তীব্র সুখ আছে যে, নিকৃষ্ট শ্রেণীর ঐন্দ্রিয়িকেরা সর্ব্বলোকসুন্দরীগণের সমাগমেও সেরুপ তীব্র সুখ অনুভূত করিতে পারে না। এ বৃত্তি যত অনুশীলিত করিবে, ততই ইহার সুখজনকতা বাড়িবে। নিকৃষ্ট বৃত্তির ন্যায় ইহাতে গ্লানি জন্মে না, অতিতৃপ্তিজনিত বিরাগ জন্মে না, বৃত্তির অসমার্থ্য বা দৌর্ব্বল্য জন্মে না, বল ও সমার্থ্য বরং বাড়িতে থাকে। ইহার নিয়ত অনুশীলন পক্ষে কোন ব্যাঘাত নাই। ঔদরিক দিবসে দুই বার, তিন বার, না হয় চারি বার আহার করিতে পারে। অন্যান্য ঐন্দ্রয়িকের ভোগেরও সেইরূপ সীমা আছে। কিন্তু পরোপকার দণ্ডে দণ্ডে, পলকে পলকে করা যায়। মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত ইহার অনুশীলন চলে। অনেক লোক মরণকালেও একটি কথা বা একটি ইঙ্গিতের দ্বারা লোকের উপকার করিয়া গিয়াছেন। আডিসন মৃত্যুকালেও কুপথাবলম্বী যুবাকে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন, “দেখ ধার্ম্মিক (Christian) কেমন সুখে মরে!”
তার পর, পরকালের কথা বলি। যদি জন্মান্তর না মানিয়া পরকাল স্বীকার করা যায়, তবে ইহা বলিতে হইবে যে পরকালেও আমাদের মানসিক বৃত্তিগুলি থাকিবে, সুতরাং এ দয়া বৃত্তিটিও থাকিবে। আমি ইহাকে যেরূপ অবস্থায় লইয়া যাইব, পারলৌকিক প্রথমাবস্থায় ইহার সেই অবস্থায় থাকা সম্ভব; কেন না, হঠাৎ অবস্থান্তরের উপযুক্ত কোন কারণ দেখা যায় না। আমি যদি ইহা উত্তমরূপে অনুশীলিত ও সুখপ্রদ অবস্থায় লইয়া যাই, তবে ইহা পরলোকেও আমার পক্ষে সুখপ্রদ হইবে। সেখানে আমি ইহা অনুশীলিত ও চরিতার্থ করিয়া ইহলোকের অপেক্ষা অধিকতর সুখী হইব।
শিষ্য। এ সকল সুখ-স্বপ্ন মাত্র-অতি অশ্রদ্ধেয় কথা। দয়ার অনুশীলন ও চরিতার্থতা কর্ম্মাধীন। পরোপকার কর্ম্মমাত্র। আমার কর্ম্মেন্দ্রিয়গুলি, আমি শরীরের সঙ্গে এখানে রাখিয়া গেলাম, সেখানে কিসের দ্বারা কর্ম্ম করিব?
গুরু। কথাটা কিছু নির্ব্বোধের মত বলিলে। আমরা ইহাই জানি যে, যে চৈতন্য শরীরবদ্ধ, সেই চৈতন্যের কর্ম্ম কর্ম্মেন্দ্রিয়সাধ্য। কিন্তু যে চৈতন্য শরীরে বদ্ধ নহে, তাহারও কর্ম্ম যে কর্ম্মেন্দ্রিয়সাপেক্ষ, এমত বিবেচনা করিবার কোন কারণ নাই। ইহা যুক্তিসঙ্গত নহে।
শিষ্য। ইহাই যুক্তিসঙ্গত। অন্যথা-সিদ্ধি-শূন্যস্য নিয়তপূর্ব্ববর্ত্তিতা কারণত্বং। কর্ম্ম অন্যথা-সিদ্ধি-শূন্য। কোথাও আমরা দেখি নাই যে, কর্ম্মেন্দ্রিয়শূন্য যে, সে কর্ম্ম করিয়াছে।
গুরু। ঈশ্বরে দেখিতেছ। যদি বল ঈশ্বর মানি না, তোমার সঙ্গে আমার বিচার ফুরাইল। আমি পরকাল হইতে ধর্ম্মকে বিযুক্ত করিয়া বিচার করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু ঈশ্বর হইতে ধর্ম্মকে বিযুক্ত করিয়া বিচার করিতে প্রস্তুত নহি। আর যদি বল, ঈশ্বর সাকার, তিনি শিল্পকারের মত হাতে করিয়া জগৎ গড়িয়াছেন, তাহা হইলেও তোমার সঙ্গে বিচার ফুরাইল। কিন্তু ভরসা করি, তুমি ঈশ্বর মান এবং ঈশ্বরকে নিরাকার বলিয়াও স্বীকার কর। যদি তাহা কর, তবে কর্ম্মেন্দ্রিয়শূন্য নিরাকারের কর্ম্মকর্ত্তৃত্ব স্বীকার করিলে। কেন না, ঈশ্বর সর্ব্বকর্ত্তা, সর্ব্বস্রষ্টা।
পরলোকে জীবনের অবস্থা স্বতন্ত্র। অতএব প্রয়োজনও স্বতন্ত্র। ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজন না হওয়াই সম্ভব।
শিষ্য। হইলে হইতে পারে। কিন্তু এ সকল আন্দাজি কথা। আন্দাজি কথার প্রয়োজন নাই।
গুরু। আন্দাজি কথা, ইহা আমি স্বীকার করি। বিশ্বাস করা, না করার পক্ষে তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে, ইহাও আমি স্বীকার করি। আমি যে দেখিয়া আসি নাই, ইহা বোধ করি বলা বাহুল্য। কিন্তু এ সকল আন্দাজি কথার একটু মূল্য আছে। যদি পরকাল থাকে, আর যদি Law of Continuity অর্থাৎ মানসিক অবস্থার ক্রমান্বয় ভাব সত্য হয়, তবে পরকাল সম্বন্ধে যে অন্য কোনরূপ সিদ্ধান্ত করিতে পার, আমি এমন পথ দেখিতেছি না। এই ক্রমান্বয় ভাবটির প্রতি বিশেষ মনোযোগ করিবে। হিন্দু, খৃষ্টীয়, বা ইস্লামী যে স্বর্গনরক, তাহা এই নিয়মের বিরুদ্ধ।
শিষ্য। যদি পরকাল মানিতে পারি, তবে এটুকুও না হয় মানিয়া লইব। যদি হাতীটা গিলিতে পারি, তবে হাতীর কানের ভিতর যে মশাটা ঢুকিয়াছে, তাহা গলায় বাধিবে না। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, এ পরকালের শাসনকর্ত্তৃত্ব কই?
গুরু। যাহারা স্বর্গের দণ্ডধর গড়িয়াছে, তাহারা পরকালের শাসনকর্ত্তা গড়িয়াছে। আমি কিছুই গড়িতে বসি নাই। আমি মনুষ্যজীবনের সমালোচনা করিয়া, ধর্ম্মের যে স্থূল মর্ম্ম বুঝিয়াছি, তাহাই তোমাকে বুঝাইতেছি। কিন্তু একটা কথা বলিয়া রাখায় ক্ষতি নাই। যে পাঠশালায় পড়িয়াছে, সে যে দিন পাঠশালা ছাড়িল, সেই দিনই একটা মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতে পরিণত হইল না। কিন্তু সে কালক্রমে সে একটা মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতে পরিণত হইতে পারে, এমত সম্ভাবনা রহিল। আর যে একেবারে পাঠশালায় পড়ে নাই, জন ষ্টুয়ার্ট মিলের মত পৈতৃক পাঠশালাতেও পড়ে নাই, তাহার পণ্ডিত হইবার কোন সম্ভাবনা নাই। ইহলোককে আমি তেমনি একটি পাঠশালা মনে করি। সে এখান হইতে সদ্বৃত্তিগুলি মার্জ্জিত ও অনুশীলিত করিয়া লইয়া যাইবে, তাহার সেই বৃত্তিগুলি ইহলোকের কল্পনাতীত স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হইয়া সেখানে তাহার অনন্ত সুখের কারণ হইবে, এমন সম্ভব। আর যে সদ্বৃত্তিগুলির অনুশীলন অভাবে অপক্কাবস্থায় পরলোকে লইয়া যাইবে, তাহার পরলোকে কোন সুখেরই সম্ভাবনা নাই। আর যে কেবল অসদ্বৃত্তিগুলি স্ফূরিত করিয়া পরলোকে যাইবে, তাহার অনন্ত দুঃখ। জন্মান্তর যদি না মানা যায়, তবে এইরূপ স্বর্গ নরক মানা যায়। কৃমি-কীট-সঙ্কুল অবর্ণনীয় হ্রদরূপ নরক বা অপ্সরোকণ্ঠ-নিনাদ-মধুরিত, উর্ব্বশী মেনকা রম্ভাদির নৃত্যসমাকুলিত, নন্দনকানন-কুসুম-সুবাস-সমুল্লাসিত স্বর্গ মানি না। হিন্দুধর্ম্ম মানি, হিন্দুধর্ম্মের “বখামি”গুলা মানি না। আমার শিষ্যদিগেরও মানিতে নিষেধ করি।
শিষ্য। আমার মত শিষ্যের মানিবার কোন সম্ভাবনা দেখি না। সম্প্রতি পরকালের কথা ছাড়িয়া দিয়া, ইহকাল লইয়া সুখের যে ব্যাখ্যা করিতেছিলেন, তাহার সূত্র পুনর্গ্রহণ করুন।
গুরু। বোধ হয় এতক্ষণে বুঝাইয়া থাকিব যে, পরকাল বাদ দিয়া কথা কহিলেও, কোন কোন সুখকে স্থায়ী, কোন কোন সুখের স্থায়িত্বাভাবে তাহাকে ক্ষণিক বলা যাইতে পারে।
শিষ্য। বোধ হয় কথাটা এখনও বুঝি নাই। আমি একটা টপ্পা শুনিয়া আসিলাম, কি একখানা নাটকের অভিনয় দেখিয়া আসিলাম। তাহাতে কিছু আনন্দ লাভও করিলাম। সে সুখ স্থায়ী না ক্ষণিক?
গুরু। যে আনন্দের কথা তুমি মনে ভাবিতেছ, বুঝিতে পারিতেছি, তাহা ক্ষণিক বটে, কিন্তু চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির সমুচিত অনুশীলনের যে ফল, তাহা স্থায়ী সুখ। সেই স্থায়ী সুখের অংশ বা উপাদান বলিয়া, ঐ আনন্দটুকুকে স্থায়ী সুখের মধ্যে ধরিয়া লইতে হইবে। সুখ যে বৃত্তির অনুশীলনের ফল, এ কথাটা যেন মনে থাকে। এখন বলিয়াছি যে, কতকগুলি বৃত্তির অনুশীলনজনিত যে সুখ, তাহা অস্থায়ী। শেষোক্ত সুখও আবার দ্বিবিধ; (১) যাহার পরিণামে দুঃখ, (২) যাহা ক্ষণিক হইলেও পরিণামে দুঃখশূন্য। ইন্দ্রিয়াদি নিকৃষ্ট বৃত্তি সম্বন্ধে পূর্ব্বে যাহা বলা হইয়াছে, তাহাতে উহা অবশ্য বুঝিয়াছ যে, এই বৃত্তিগুলির পরিমিত অনুশীলনে দুঃখশূন্য সুখ, এবং এই সকলের অসমুচিত অনুশীলনে যে সুখ, তাহারই পরিণাম দুখ। অতএব সুখ ত্রিবিধ-
(১) স্থায়ী।
(২) ক্ষণিক, কিন্তু পরিণামে দুঃখশূন্য।
(৩) ক্ষণিক, কিন্তু পরিণামে দুঃখের কারণ।
শেষোক্ত সুখকে সুখ বলা অবিধেয়,-উহা দুঃখের প্রথমাবস্থা মাত্র। সুখ তবে, (১) হয়, যাহা স্থায়ী, (২) নয়, যাহা অস্থায়ী অথচ পরিণামে দুঃখশূন্য। আমি যখন বলিয়াছি যে, সুখের উপায় ধর্ম্ম, তখন এই অর্থেই সুখ শব্দ ব্যবহার করিয়াছি। এই ব্যবহারই এই শব্দের যথার্থ ব্যবহার, কেন না, যাহা বস্তুতঃ দুঃখের প্রথমাবস্থা, তাহাকে ভ্রান্ত বা পশুবৃত্তদিগের মতাবলম্বী হইয়া সুখের মধ্যে গণনা করা যাইতে পারে না। যে জলে পড়িয়া ডুবিয়া মরে, জলের স্নিগ্ধতাবশতঃ তাহার প্রথম নিমজ্জনকালে কিছু সুখোপলব্ধি হইতে পারে। কিন্তু সে অবস্থা তাহার সুখের অবস্থা নহে, নিমজ্জনদুঃখের প্রথমাবস্থা মাত্র। তেমনি দুঃখপরিণাম সুখও দুঃখের প্রথমাবস্থা-নিশ্চয়ই তাহা সুখ নহে।
এখন তোমার প্রশ্নের উত্তর শোন। তুমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, “এই বৃত্তিকে বাড়িতে দিতে পারি, আর এই বৃত্তিকে বাড়িতে দিতে পারি না, ইহা কোন্ লক্ষণ দেখিয়া নির্ব্বাচন করিব? কোন্ কষ্টিপাথরে ঘষিয়া ঠিক করিব যে, এইটি পিতল?” এই প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া গেল। যে বৃত্তিগুলির অনুশীলনে স্থায়ী সুখ, তাহাকে অধিক বাড়িতে দেওয়াই কর্ত্তব্য-যথা ভক্তি, প্রীতি, দয়াদি। আর যেগুলির অনুশীলনে ক্ষণিক সুখ, তাহা বাড়িতে দেওয়া অকর্ত্তব্য, কেন না, এ সকল বৃত্তির অধিক অনুশীলনের ক্ষণিক সুখ, তাহা বাড়িতে দেওয়া অকর্ত্তব্য, কেন না, এ সকল বৃত্তির অধিক অনুশীলনের পরিণাম সুখ নহে। যতক্ষণ ইহাদের অনুশীলন পরিমিত, ততক্ষণ ইহা অবিধেয় নহে-কেন না, তাহাতে পরিণামে দুঃখ নাই। তার পর আর নহে। অনুশীলনের উদ্দেশ্য সুখ; যেরূপ অনুশীলনে সুখ জন্মে, দুঃখ নাই, তাহাই বিহিত। অতএব সুখই সেই কষ্টিপাথর।
——————–
* সকল কথা ক্রমে পরিস্ফুট হইবে।
০৮.শারীরিকী বৃত্তি
শিষ্য। যে পর্য্যন্ত কথা হইয়াছে, তাহাতে বুঝিয়াছি, অনুশীলন কি। আর বুঝিয়াছি সুখ কি। বুঝিয়াছি অনুশীলনের উদ্দেশ্য সেই সুখ; এবং সামঞ্জস্য তাহার সীমা। কিন্তু বৃত্তিগুলির অনুশীলন সম্বন্ধে বিশেষ উপদেশ কিছু এখনও পাই নাই। কোন্ বৃত্তি কি প্রকার অনুশীলন করিতে হইবে, তাহার কিছু উপদেশের প্রয়োজন নাই কি?
গুরু। ইহা শিক্ষাতত্ত্ব। শিক্ষাতত্ত্ব ধর্ম্মতত্ত্বের অন্তর্গত। আমাদের এই কথাবার্ত্তার প্রধান উদ্দেশ্য তাহা নহে। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য এই যে, ধর্ম্ম কি তাহা বুঝি। তজ্জন্য যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই আমি বলিব।
বৃত্তি চতুর্ব্বিধ বলিয়াছি; (১) শারীরিকী, (২) জ্ঞানার্জ্জনী, (৩) কার্য্যকারিণী, (৪) চিত্তরঞ্জিনী। আগে শারীরিকী বৃত্তির কথা বলিব-কেন না, উহাই সর্ব্বাগ্রে স্ফূরিত হইতে থাকে। এ সকলের স্ফূর্ত্তি ও পরিতৃপ্তিতে যে সুখ আছে, ইহা কাহাকেও বুঝাইতে হইবে না। কিন্তু ধর্ম্মের সঙ্গে এ সকলের কোন সম্বন্ধ আছে, এ কথা কেহ বিশ্বাস করে না।
শিষ্য। তাহার কারণ বৃত্তির অনুশীলনকে ধর্ম্ম কেহ বলে না।
গুরু। কোন কোন ইউরোপীয় অনুশীলনবাদী বৃত্তির অনুশীলনকে ধর্ম্ম বা ধর্ম্মস্থানীয় কোন একটা জিনিস বিবেচনা করেন, কিন্তু তাঁহারা এমন কথা বলেন না যে, শারীরিকী বৃত্তির অনুশীলন তাহার পক্ষে প্রয়োজনীয়।*
শিষ্য। আপনি কেন বলেন?
গুরু। যদি সকল বৃত্তির অনুশীলন মনুষ্যের ধর্ম্ম হয়, তবে শারীরিক বৃত্তির অনুশীলনও অবশ্য ধর্ম্ম। কিন্তু সে কথা না হয় ছাড়িয়া দাও। লোকে সচরাচর যাহাকে ধর্ম্ম বলে তাহার মধ্যে যে কোন প্রচলিত মত গ্রহণ কর, তথাপি দেখিবে যে, শারীরিক বৃত্তির অনুশীলন প্রয়োজনীয়। যদি যাগযজ্ঞ ব্রতানুষ্ঠান ক্রিয়াকলাপকে ধর্ম্ম বল; যদি দয়া, দাক্ষিণ্য, পরোপকারকে ধর্ম্ম বল; যদি কেবল দেবতার উপাসনা বা ঈশ্বরোপাসনাকে ধর্ম্ম বল; না হয় খৃষ্টধর্ম্ম, বৌদ্ধধর্ম্ম, ইস্লামধর্ম্মকে ধর্ম্ম বল, সকল ধর্ম্মের জন্যই শারীরিকী বৃত্তির অনুশীলন প্রয়োজনীয়। ইহা কোন ধর্ম্মেরই মুখ্য উদ্দেশ্য নহে বটে, কিন্তু সকল ধর্ম্মের বিঘ্ননাশের জন্য ইহার বিশেষ প্রয়োজন। এই কথাটা কখনও কোন ধর্ম্মবেত্তা স্পষ্ট করিয়া বলেন নাই, কিন্তু এখন এ দেশে সে কথা বিশেষ করিয়া বলিবার প্রয়োজন হইয়াছে।
শিষ্য। ধর্ম্মের বিঘ্ন বা কিরূপ, এবং শারীরিক বৃত্তির অনুশীলনে কিরূপে তাহার বিনাশ, ইহা বুঝাইয়া দিন।
গুরু। প্রথম ধর, রোগ। রোগ ধর্ম্মের বিঘ্ন। যে গোঁড়া হিন্দু রোগে পড়িয়া আছে, সে যাগযজ্ঞ, ব্রতনিয়ম, তীর্থদর্শন, কিছুই করিতে পারে না। যে গোঁড়া হিন্দু নয়, কিন্তু পরোপকার প্রভৃতি সদনুষ্ঠানকে ধর্ম্ম বলিয়া মানে, রোগ তাহারও ধর্ম্মের বিঘ্ন। রোগে যে নিজে অপটু, সে কাহার কি কার্য্য করিবে? যাহার বিবেচনায় ধর্ম্মের জন্য এ সকল কিছুরই প্রয়োজন নাই, কেবল ঈশ্বরের চিন্তাই ধর্ম্ম, রোগ তাহারও ধর্ম্মের বিঘ্ন। কেন না, রোগের যন্ত্রণাতে ঈশ্বরে মন নিবিষ্ট হয় না; অন্ততঃ একাগ্রতা থাকে না; কেন না, চিত্তকে শারীরিক যন্ত্রণায় অভিভূত করিয়া রাখে, মধ্যে মধ্যে বিচলিত করে; রোগ কর্ম্মীর কর্ম্মের বিঘ্ন, যোগীর যোগের বিঘ্ন, ভক্তের ভক্তির সাধনের বিঘ্ন। রোগ ধর্ম্মের পরম বিঘ্ন।
এখন তোমাকে বুঝাইতে হইবে না যে, শারীরিক বৃত্তি সকলের সমুচিত অনুশীলনের অভাবই প্রধানত রোগের কারণ।
————-
* Herbert Spencer বলেন। গ চিহ্নিত ক্রোড়পত্র দেখ।
————-
শিষ্য। যে হিম লাগান কথাটা গোড়ায় উঠিয়াছিল, তাহাও কি অনুশীলনের অভাব?
গুরু। ত্বগিন্দ্রিয়ের স্বাস্থ্যকর অনুশীলনের ব্যাঘাত। শারীরতত্ত্ববিদ্যাতে তোমার কিছুমাত্র অধিকার থাকিলেই তাহা বুঝিতে পারিবে।
শিষ্য। তবে দেখিতেছি যে, জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির সমুচিত অনুশীলন না হইলে, শারীরিকী বৃত্তির অনুশীলন হয় না।
গুরু। না, তা হয় না। সমস্ত বৃত্তিগুলির যথাযথ অনুশীলন পরস্পরের অনুশীলনের সাপেক্ষ। কেবল শারীরিকী বৃত্তির অনুশীলন জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির সাপেক্ষ, এমত নহে। কার্য্যকারিণী বৃত্তিগুলিও তৎসাপেক্ষ। কোন্ কার্য্য কি উপায়ে করা উচিত, কোন্ বৃত্তির কিসে অনুশীলন হইবে, কিসে অনুশীলনের অবরোধ হইবে, ইহা জ্ঞানের দ্বারা জানিতে হইবে। জ্ঞান ভিন্ন তুমি ঈশ্বরকেও জানিতে পারিবে না। কিন্তু সে কথা এখন থাক।
শিষ্য। এখন থাকিলে চলিবে না। যদি বৃত্তিগুলির অনুশীলন পরস্পর সাপেক্ষ, তবে কোন্গুলির অনুশীলন আগে আরম্ভ করিব?
গুরু। সকলগুলিরই যথাসাধ্য অনুশীলন এককালেই আরম্ভ করিতে হইবে; অর্থাৎ শৈশবে।
শিষ্য। আশ্চর্য্য কথা! শৈশবে আমি জানি না যে, কি প্রকারে কোন্ বৃত্তির অনুশীলন করিতে হইবে। তবে কি প্রকারে সকল বৃত্তির অনুশীলন করিতে প্রবৃত্ত হইব?
গুরু। এই জন্য শিক্ষকের সহায়তা আবশ্যক। শিক্ষক এবং শিক্ষা ভিন্ন কখনই মনুষ্য মনুষ্য হয় না। সকলেরই শিক্ষকের আশ্রয় লইয়া কর্ত্তব্য। কেবল শৈশবে কেন, চিরকালই আমাদের পরের কাছে শিক্ষার প্রয়োজন। এই জন্য হিন্দুধর্ম্মের গুরুর এত মান। আর গুরু নাই, গুরুর সম্মান নাই, কাজেই উন্নতি হইতেছে না। ভক্তিবৃত্তির অনুশীলনের কথা যখন বলিব, তখন এ কথা মনে থাকে যেন। যখন যাহা বলিতেছিলাম, তাহা বলি।
(২) বৃত্তি সকলের এইরূপ পরস্পর সাপেক্ষতা হইতে শারীরিকী বৃত্তি অনুশীলনের দ্বিতীয় প্রয়োজন, অথবা ধর্মের দ্বিতীয় বিঘ্নের কথা পাওয়া যায়। যদি অন্যান্য বৃত্তিগুলি শারীরিক বৃত্তির সাপেক্ষ হইল, তবে জ্ঞানার্জ্জনী প্রভৃতি বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলনের জন্য শারীরিকী বৃত্তি সকলের সম্যক্ অনুশীলন চাই। বাস্তবিক, ইহা প্রসিদ্ধ যে, শারীরিক শক্তি সকল বলিষ্ঠ ও পুষ্ট না থাকিলে মানসিক শক্তি সকল বলিষ্ঠ ও পুষ্ট হয় না, অথবা অসম্পূর্ণ স্ফূর্ত্তি প্রাপ্ত হয়। শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজন, ইউরোপীয় বিজ্ঞানবিদ্ পণ্ডিতেরা শরীর ও মনের এই সম্বন্ধ উত্তমরূপে প্রমাণীকৃত করিয়াছেন। আমাদের দেশে এক্ষণে যে কালেজি শিক্ষাপ্রণালী প্রচলিত, তাহার প্রধান নিন্দাবাদ এই যে, ইহাতে শিক্ষার্থীদিগের শারীরিক স্ফূর্ত্তির প্রতি কিছু মাত্র দৃষ্টি থাকে না, এজন্য কেবল শারীরিক নহে,অকালে মানসিক অধঃপতনও উপস্থিত হয়।ধর্ম্ম মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করে; কাজে কাজেই ধর্ম্মেরও অধোগতি ঘটে।
(৩) কিন্তু এ সম্বন্ধে তৃতীয় তত্ত্ব, বা তৃতীয় বিঘ্ন আরও গুরুতর। যাহার শারীরিক বৃত্তি সকলের সমুচিত অনুশীলন হয় নাই, সে আত্মরক্ষায় অক্ষম। যে আত্মরক্ষায় অক্ষম, তাহার নির্ব্বিঘ্নে ধর্ম্মাচরণ কোথায়? সকলেরই শত্রু আছে। দস্যু আছে। ইহারা সর্ব্বদা ধর্ম্মাচরণের বিঘ্ন করে। তদ্ভিন্ন অনেক সময়ে যে বলে শত্রুদমন করিতে না পারে, সে বলাভাব হেতুই আত্মরক্ষার্থ অধর্ম্ম অবলম্বন করে। আত্মরক্ষা এমন অলঙ্ঘনীয় যে, পরম ধার্ম্মিকও এমন অবস্থায় অধর্ম্ম অবলম্বন পরিত্যাগ করিতে পারে না। মহাভারতকার, “অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ” ইতি উপন্যাসে ইহার উত্তম উদারহণ কল্পনা করিয়াছেন। বলে দ্রোণাচার্য্যকে পরাভব করিতে অক্ষম হইয়া যুধিষ্ঠিরের ন্যায় পরম ধার্ম্মিকও মিথ্যা প্রবঞ্চনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন।
শিষ্য। প্রাচীন কালের পক্ষে এ সকল কথা খাটিলে খাটিতে পারে, কিন্তু এখনকার সভ্য সমাজে রাজাই সকলের রক্ষা করেন। এখন কি আত্মরক্ষায় সকলের সক্ষম হওয়া তাদৃশ প্রয়োজনীয়?
গুরু। রাজা সকলকে রক্ষা করিবেন। এইটা আইন বটে। কিন্তু কার্য্যতঃ তাহা ঘটে না। রাজা সকলকে রক্ষা করিয়া উঠিতে পারেন না। পারিলে এত খুন, জখম, চুরি, ডাকাতি, দাঙ্গা মারামারি প্রত্যহ ঘটিত না। পুলিসের বিজ্ঞাপন সকল পড়িলে জানিতে পারিবে যে, যাহারা আত্মরক্ষায় অক্ষম, সচরাচর তাহাদের উপরেই এই সকল অত্যাচার ঘটে। বলবানের কাছে কেহ আগু হয় না।কিন্তু আত্মরক্ষার কথা তুলিয়া কেবল আপনার শরীর বা সম্পত্তির রক্ষা কথা আমি বলিতেছিলাম না, ইহাও তোমার বুঝা কর্ত্তব্য। যখন তোমাকে শরীর বা সম্পত্তি রক্ষার কথা কথা বলিব, তখন বুঝিব যে, আত্মরক্ষা যেমন আমাদের অনুষ্ঠেয় ধর্ম্ম; আপনার স্ত্রীপুত্র পরিবার স্বজন কুটুম্ব প্রতিবাসী রক্ষাও তাদৃশ আমাদের অনুষ্ঠেয় ধর্ম্ম। যে ইহা করে না, সে পরম অধার্ম্মিক। অতএব যাহার তদুপযোগী বল বা শারীরিক শিক্ষা হয় নাই, সেও অধার্ম্মিক।
(৪) আত্মরক্ষা, বা স্বজনরক্ষার এই কথা হইতে ধর্ম্মের চতুর্থ বিঘ্নের কথা উঠিতেছে। এই তত্ত্ব অত্যন্ত গুরুতর; ধর্ম্মের অতি প্রধান অংশ। অনেক মহাত্মা এই ধর্ম্মের জন্য, প্রাণ পর্য্যন্ত, প্রাণ কি, সর্ব্বসুখ পরিত্যাগ করিয়াছেন। আমি স্বদেশরক্ষার কথা বলিতেছি।
যদি আত্মরক্ষা এবং স্বজনরক্ষা ধর্ম্ম হয়, তবে স্বদেশরক্ষাও ধর্ম্ম। সমাজস্থ এক এক ব্যক্তি যেমন অপর ব্যক্তির সর্ব্বস্ব অপহরণ মানসে আক্রমণ করে, এক এক সমাজ বা দেশও অপর সমাজকে সেইরূপ আক্রমণ করে। মনুষ্য যতক্ষণ না রাজার শাসনে বা ধর্ম্মের শাসনে নিরুদ্ধ হয়, ততক্ষণ কাড়িয়া খাইতে পারিলে ছাড়ে না। যে সমাজে রাজশাসন নাই, সে সমাজের ব্যক্তিগণ যে যার পারে, সে তার কাড়িয়া খায়। তেমনি, বিবিধ সমাজের উপর কেহ এক জন রাজা না থাকাতে, যে সমাজ বলবান্, সে দুর্ব্বল সমাজের কাড়িয়া খায়। অসভ্য সমাজের কথা বলিতেছিনা, সভ্য ইউরোপের এই প্রচলিত রীতি। আজ ফ্রান্স জর্ম্মানির কাড়িয়া খাইতেছে, কাল জর্ম্মানি ফ্রান্সের কাড়িয়া খাইতেছে; আজ তুর্ক গ্রীসের কাড়িয়া খায়, কাল রূস তুর্কের কাড়িয়া খায়। আজ Rhenish Frontier, কাল পোলাণ্ড, পরশু বুল্গেরিয়া, আজ মিশর, কাল টঙ্কুইন। এই সকল ইউরোপীয় সভ্য জাতিগণ কুকুরের মত হুড়াহুড়ি কামড়াকামড়ি করিয়া থাকেন। যেমন হাটের কুকুরেরা যে যার পায়, সে তার কাড়িয়া খায়, কি সভ্য কি অসভ্য জাতি তেমনি পরের পাইলেই কাড়িয়া খায়। দুর্ব্বল সমাজকে বলবান্ সমাজ আক্রমণ করিবার চেষ্টায় সর্ব্বদাই আছে। অতএব আপনার দেশরক্ষা ভিন্ন আত্মরক্ষা নাই। আত্মরক্ষা ও স্বজনরক্ষা যদি ধর্ম্ম হয়, তবে দেশরক্ষাও ধর্ম্ম। বরং আরও গুরুতর ধর্ম্ম; কেন না, এস্থলে আপন ও পর, উভয়ের রক্ষার কথা।
সামাজিক কতকগুলি অবস্থা ধর্ম্মের উপযোগী আর কতকগুলি অনুপযোগী। আর কতকগুলি অনুপযোগী। কতকগুলি অবস্থা সমস্ত বৃত্তির অনুশীলনের ও পরিতৃপ্তির অনুকূল। আবার কোন কোন সামাজিক অবস্থা কতকগুলি বৃত্তির অনুশীলন ও পরিতৃপ্তির প্রতিকূল। অধিকাংশ সময়ে এই প্রতিকূলতা রাজা বা রাজপুরুষ হইতেই ঘটে। ইউরোপের যে অবস্থায়, প্রটেষ্টাণ্টদিগকে রাজা পুড়াইয়া মারিতেন, সেই অবস্থা ইহার একটি উদাহরণ; ঔরঙ্গজেবের হিন্দুধর্ম্মের বিদ্বেষ আর একটি উৎপীড়ন। সমাজের যে অবস্থা ধর্ম্মের অনুকূল, তাহাকে স্বাধীনতা বলা যায়। স্বাধীনতা দেশী কথা নহে, বিলাতী আমদানি। লিবার্টি শব্দের অনুবাদ। ইহার এমন তাৎপর্য্য নহে যে, রাজা স্বদেশীয় হইতে হইবে। স্বদেশীয় রাজা অনেক সময়ে স্বাধীনতার শত্রু, বিদেশীয় রাজা অনেক সময়ে স্বাধীনতার মিত্র। ইহার অনেক উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। ইহা ধর্ম্মোন্নতির পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়। অতএব আত্মরক্ষা, স্বজনরক্ষা, এবং স্বদেশরক্ষার জন্য যে শারীরিক বৃত্তির অনুশীলন, তাহা সকলেরই কর্ত্তব্য।
শিষ্য। অর্থাৎ সকলেরই যোদ্ধা হওয়া চাই।
গুরু। তাহার অর্থ এমন নহে যে, সকলকে যুদ্ধব্যবসায় অবলম্বন করিতে হইবে। কিন্তু সকলেরই প্রয়োজনানুসারে যুদ্ধে সক্ষম হওয়া কর্ত্তব্য। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে সকল বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষকেই যুদ্ধব্যবসায়ী হইতে হয়, নহিলে সেনাসংখ্যা এত অল্প হয় যে, বৃহৎ রাজ্য সে সকল ক্ষুদ্র রাজ্য অনায়াসে গ্রাস করে। প্রাচীন গ্রীকনগরী সকলে সকলকেই এই জন্য যুদ্ধ করিতে হইত। বৃহৎ রাজ্যে বা সমাজে, যুদ্ধ শ্রেণীবিশেষের কাজ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট থাকে। প্রাচীন ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয়, এবং মাধ্যকালিক ভারতবর্ষের রাজপুতেরা ইহার উদাহরণ। কিন্তু তাহার ফল এই হয় যে, সেই শ্রেণীবিশেষ আক্রমণকারী কর্ত্তৃক বিজিত হইলে, দেশের আর রক্ষা থাকে না। ভারতবর্ষের রাজপুতেরা পরাভূত হইবামাত্র, ভারতবর্ষ মুসলমানের অধিকারভুক্ত হইল। কিন্তু রাজপুত ভিন্ন ভারতবর্ষের অন্য জাতি সকল যদি যুদ্ধে সক্ষম হইত, তাহা হইলে ভারতবর্ষে সে দুর্দ্দশা হইত না। ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সের সমস্ত বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষ অস্ত্রধারণ করিয়া সমবেত ইউরোপকে পরাভূত করিয়াছিল। যদি তাহা না করিত, তবে ফ্রান্সের বড় দুর্দ্দশা হইত।
শিষ্য। কি প্রকার শারীরিক অনুশীলনের দ্বারা এই ধর্ম্ম সম্পূর্ণ হইতে পারে?
গুরু। কেবল বলে নহে। চুয়াড়ের সঙ্গে যুদ্ধে কেবল শারীরিক বলই যথেষ্ট, কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে শারীরিক বল অপেক্ষা শারীরিক শিক্ষাই বিশেষ প্রয়োজনীয়। এখনকার দিনে প্রথমতঃ শারীরিক বলের ও অস্থি মাংসপেশী প্রভৃতির পরিপুষ্টির জন্য ব্যায়াম চাই। এদেশে ডন, কুস্তী, মুগুর প্রভৃতি নানা প্রকার ব্যায়াম প্রচলিত ছিল। ইংরেজি সভ্যতা শিখিতে গিয়া আমরা কেন এ সকল ত্যাগ করিলাম, তাহা বুঝিতে পারি না। আমাদের বর্ত্তমান বুদ্ধিবিপর্য্যয়ের ইহা একটি উদাহরণ।
দ্বিতীয়তঃ এবং প্রধানতঃ অস্ত্রশিক্ষা। সকলেরই সর্ব্ববিধ অস্ত্রপ্রয়োগে সক্ষম হওয়া উচিত।
শিষ্য। কিন্তু এখনকার আইন অনুসারে আমাদের অস্ত্রধারণ নিষিদ্ধ।
গুরু। সেটা একটা আইনের ভুল। আমরা মহারাণীর রাজভক্ত-প্রজা, আমরা অস্ত্রধারণ করিয়া তাঁহার রাজ্য রক্ষা করিব, ইহাই বাঞ্ছনীয়। আইনের ভুল পশ্চাৎ সংশোধিত হইতে পারে।
তার পর তৃতীয়তঃ অস্ত্রশিক্ষা ভিন্ন আর কতকগুলি শারীরিক শিক্ষা শারীরিক ধর্ম্ম সম্পূর্ণ জন্য প্রয়োজনীয়। যথা অশ্বারোহণ। ইউরোপে যে অশ্বারোহণ করিতে পারে না এবং যাহার অস্ত্রশিক্ষা নাই, সে সমাজের উপহাসাস্পদ। বিলাতী স্ত্রীলোকদিগেরও এ সকল শক্তি হইয়া থাকে। আমাদের কি দুর্দ্দশা!
অশ্বারোহণ যেমন শারীরিক ধর্ম্মশিক্ষা, পদব্রজে দূরগমন এবং সন্তরণও তাদৃশ। যোদ্ধার পক্ষে ইহা নহিলেই নয়, কিন্তু কেবল যোদ্ধার পক্ষে ইহা প্রয়োজনীয়, এমন বিবেচনা করিও না। যে সাঁতার না জানে, সে জল হইতে আপনার রক্ষায় ও পরের রক্ষায় অপটু। যুদ্ধে কেবল জল হইতে আত্মরক্ষা ও পরের রক্ষার জন্য ইহা প্রয়োজনীয় এমন নহে, আক্রমণ, নিষ্ক্রমণ, ও পলায়ন জন্য অনেক সময়ে ইহার প্রয়োজন হয়। পদব্রজে দূরগমন আরও প্রয়োজনীয়, ইহা বলা বাহুল্য। মনুষ্য মাত্রের পক্ষেই ইহা নিতান্ত প্রয়োজনীয়।
শিষ্য। অতএব যে শারীরিক বৃত্তির অনুশীলন করিবে, কেবল তাহার শরীর পুষ্ট ও বলশালী হইলেই হইবে না। সে ব্যায়ামে সুপটু-
গুরু। এই ব্যায়াম মধ্যে মল্লযুদ্ধটা ধরিয়া লইবে। ইহা বিশেষ বলকারক। আত্মরক্ষার ও পরোপকারের বিশেষ অনুকূল।*
————
* লেখক-প্রণীত ‘দেবী চৌধুরাণী’ নামক গ্রন্থে প্রফুল্লকুমারীকে অনুশীলনের উদাহরণ স্বরূপ প্রতিকৃত করা হইয়াছে। এজন্য সে স্ত্রীলোক হইলেও মল্লযুদ্ধ শিক্ষা করান হইয়াছে।
———-
শিষ্য। অতএব, চাই শরীরপুষ্টি, ব্যায়াম, মল্লযুদ্ধ, অস্ত্রশিক্ষা, অশ্বারোহণ, সন্তরণ, পদব্রজে দূরগমন-
গুরু। আরও চাই সহিষ্ণুতা। শীত, গ্রীষ্ম, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শ্রান্তি, সকলই সহ্য করিতে পারা চাই। ইহা ভিন্ন যুদ্ধার্থীর আরও চাই। প্রয়োজন হইলে মাটি কাটিতে পারিবে-ঘট বাঁধিতে পারিবে-মোট বহিতে পারিবে। অনেক সময়ে যুদ্ধার্থীকে দশ বার দিনের খাদ্য আপনার পিঠে বহিয়া লইয়া যাইতে হইয়াছে। স্থূল কথা, যে কর্ম্মকারক আপনার কর্ম্ম জানে, সে যেমন অস্ত্রখানি তীক্ষ্ণাধার ও শাণিত করিয়া, সকল দ্রব্য ছেদনের উপযোগী করে, দেহকে সেইরূপ একখানি শাণিত অস্ত্র করিতে হইবে-যেন তদ্দ্বারা সর্ব্বকর্ম্ম সিদ্ধ হয়।
শিষ্য। কি উপায়ে ইহা হইতে পারে?
গুরু। ইহার উপায় (১) ব্যায়াম, (২) শিক্ষা, (৩) আহার, (৪) ইন্দ্রিয়সংযম। চারিটিই অনুশীলন।
শিষ্য। ইহার মধ্যে ব্যায়াম ও শিক্ষা সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন শুনিয়াছি। কিন্তু আহার সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। বাচস্পতি মহাশয়ের সেই কাঁচকলা ভাতে ভাতের কথাটা স্মরণ করুন। ততটুকু মাত্র আহার করাই কি ধর্ম্মানুমত? তাহার বেশী আহার কি অধর্ম্ম? আপনি ত এইরূপ কথা বলিয়াছিলেন।
গুরু। আমি বলিয়াছি শরীর রক্ষা ও পুষ্টির জন্য যদি তাহাই যথেষ্ট হয়, তবে তাহার অধিক কামনা করা অধর্ম্ম। শরীর রক্ষা ও পুষ্টির জন্য কিরূপ আহার প্রয়োজনীয়, তাহা বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিতেরা বলিবেন, ধর্ম্মপদেষ্টার সে কাজ নহে। বোধ করি তাঁহারা বলিবেন যে, কাঁচকলা ভাতে ভাত শরীর রক্ষা ও পুষ্টির জন্য যথেষ্ট নহে। কেহ বা বলিতে পারেন, বাচস্পতির ন্যায়, যে ব্যক্তি কেবল বসিয়া বসিয়া দিন কাটায়, তাহার পক্ষে ইহাই যথেষ্ট। সে তর্কে আমাদের প্রয়োজন নাই-বৈজ্ঞানিকের কর্ম্ম বৈজ্ঞানিক করুক। আহার সম্বন্ধে যাহা প্রকৃত ধর্ম্মোপদেশ-যাহা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মুখনির্গত-গীতা হইতে তাহাই তোমাকে শুনাইয়া আমি নিরস্ত হইব।
আয়ুঃসত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবিবর্দ্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ || ৮।১৭
যে আহার আয়ুর্বৃদ্ধিকারক, উৎসাহবৃদ্ধিকারক, বলবৃদ্ধিকারক, স্বাস্থ্যবৃদ্ধি-কারক, সুখ বা চিত্তপ্রসাদ বৃদ্ধিকারক, এবং রুচিবৃদ্ধিকারক, যাহা রসযুক্ত, স্নিগ্ধ, যাহার সারাংশ দেহে থাকিয়া যায় (অর্থাৎ Nutritious) এবং যাহা দেখিলে খাইতে ইচ্ছা করে, তাহাই সাত্ত্বিকের প্রিয়।
শিষ্য। ইহাতে মদ্য, মাংস, মৎস্য বিহিত, না নিষিদ্ধ হইল?
গুরু। তাহা বৈজ্ঞানিকের বিচার্য্য। শরীরতত্ত্ববিদ্ বা চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করিও যে, ইহা আয়ু সত্ত্ব বলারোগ্য সুখপ্রীতিবর্দ্ধন, ইত্যাদি গুণযুক্ত কি না।
শিষ্য। হিন্দুশাস্ত্ররকারেরা ত এ সকল নিষিদ্ধ করিয়াছেন।
গুরু। আমার বিবেচনায় বৈজ্ঞানিকের বা চিকিৎসকের আসনে অবতরণ করা ধর্ম্মোপদেশকের বা ব্যবস্থাপকের উচিত নহে। তবে হিন্দুশাস্ত্রকারেরা মদ্য, মাংস, মৎস্য নিষেধ করিয়া যে মন্দ করিয়াছেন, এমন বলিতেও পারি না। বরং অনুশীলনতত্ত্ব তাঁহাদের বিধি সকলের মূল ছিল, তাহা বুঝা যায়। মদ্য যে অনিষ্টকারী, অনুশীলনের হানিকর, এবং যাহাকেই তুমি ধর্ম্ম বল, তাহারই বিঘ্নকর, একথা বোধ করি তোমাকে কষ্ট পাইয়া বুঝাইতে হইবে না। মদ্য নিষেধ করিয়া হিন্দুশাস্ত্রকারেরা ভালই করিয়াছেন।
শিষ্য। কোন অবস্থাতেই কি মদ্য ব্যবহার্য্য নহে?
গুরু। যে পীড়িত ব্যক্তির পীড়া মদ্য ভিন্ন উপশমিত হয় না, তাহার পক্ষে ব্যবহার্য্য হইতে পারে। শীতপ্রধান দেশে, বা অন্য দেশে শৈত্যাধিক্য নিবারণ জন্য ব্যবহার্য্য হইলে হইতে পারে। অত্যন্ত শারীরিক ও মানসিক অবসাদকালে ব্যবহার্য্য হইলে হইতে পারে। কিন্তু এ বিধিও চিকিৎসকের নিকট লইতে হইবে-ধর্ম্মোপদেষ্টার নিকট নহে। কিন্তু একটি এমন অবস্থা আছে যে, সে সময়ে বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসকের কথার অপেক্ষা বা কাহারও বিধির অপেক্ষা না করিয়া পরিমিত মদ্য সেবন করিতে পার।
শিষ্য। এমন কি অবস্থা আছে?
গুরু। যুদ্ধ। যুদ্ধকালে মদ্য সেবন করা ধর্ম্মানুমত বটে। তাহার কারণ এই যে, যে সকল বৃত্তির বিশেষ স্ফূর্ত্তিতে যুদ্ধে জয় ঘটে, পরিমিত মদ্য সেবনে সে সকলের বিশেষ স্ফূর্ত্তি জন্মে। এ কথা হিন্দুধর্ম্মের অননুমোদিত নহে। মহাভারতে আছে যে, জয়দ্রথ বধের দিন, অর্জ্জুন একাকী ব্যূহ ভেদ করিয়া শত্রুসেনামধ্যে প্রবেশ করিলে, যুধিষ্ঠির সমস্ত দিন তাঁহার কোন সম্বাদ না পাইয়া ব্যাকুল হইয়াছিলেন। সাত্যকি ভিন্ন আর কেহই এমন বীর ছিল না, সে ব্যূহ ভেদ করিয়া তাঁহার অনুসন্ধানে যায়। এ দুষ্কর কার্য্যে যাইতে যুধিষ্ঠির সাত্যকিকে অনুমতি করিলেন। তদুত্তরে সাত্যকি উত্তম মদ্য চাহিলেন। যুধিষ্ঠির তাঁহাকে প্রচুর পরিমাণে উত্তম মদ্য দিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণে পড়া যায় যে, স্বয়ং কালিকা অসুর বধকালে সুরাপান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
সিপাহী-বিদ্রোহের সময়ে চিন্হটের যুদ্ধে ইংরেজসেনা হিন্দু মুসলমান কর্ত্তৃক পরাভূত হয়। স্বয়ং Sir Henry Lawrence সে যুদ্ধে ইংরেজসেনার নায়ক ছিলেন, তথাপি ইংরেজের পরাজয় ঘটিয়াছিল। ইংরেজ ইতিহাস-লেখক সর্ জন্ কে ইহার একটি কারণ এই নির্দ্দেশ করেন যে, ইংরেজসেনা সে দিন মদ্য পায় নাই। অসম্ভব নহে।
যাই হৌক, মদ্য সেবন সম্বন্ধে আমার মত এই যে, (১) যুদ্ধকালে পরিমিত মদ্য সেবন করিতে পার, (২) পীড়াদিতে সুচিকিৎসকের ব্যবস্থানুসারে সেবন করিতে পার, (৩) অন্য কোন সময় সেবন করা অবিধেয়।
শিষ্য। মৎস্য মাংস সম্বন্ধে আপনার কি মত?
গুরু। মৎস্য মাংস শরীরের অনিষ্টকারী, এমন বিবেচনা করিবার কোন কারণ নাই। বরং উপকারী হইতে পারে। কিন্তু সে বিচার বৈজ্ঞানিকের হাতে। ধর্ম্মবেত্তার বক্তব্য এই যে, মৎস্য মাংস, প্রীতিবৃত্তির অনুশীলনের কিয়ৎপরিমাণে বিরোধী। সর্ব্বভূতে প্রীতি হিন্দুধর্ম্মের সারতত্ত্ব। অনুশীলনতত্ত্বেও তাই। অনুশীলন হিন্দুধর্ম্মের অন্তর্নিহিত-ভিন্ন নহে। এই জন্যই বোধ হয় হিন্দুশাস্ত্রকারেরা মৎস্য মাংস ভক্ষণ নিষেধ করিয়াছেন। কিন্তু ইহার ভিতর আর একটা কথা আছে। মৎস্য মাংস বর্জ্জিত করিলে শারীরিক বৃত্তি সকলের সমুচিত স্ফূর্ত্তি রোধ হয় কি না? এ কথা বিজ্ঞানবিদের বিচার্য্য। কিন্তু যদি বিজ্ঞানশাস্ত্র বলে যে, সমুচিত স্ফূর্ত্তি রোধ হয় বটে, তাহা হইলে প্রীতিবৃত্তির অনুচিত সম্প্রসারণ ঘটিল, সামঞ্জস্য বিনষ্ট হইল। এমত অবস্থায় মৎস্য মাংস ব্যবহার্য্য। কথাটা বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করে। ধর্ম্মোপদেষ্টার বৈজ্ঞানিকের আসন গ্রহণ করা উচিত নহে, পূর্ব্বে বলিয়াছি।
শারীরিক বৃত্তির অনুশীলনের প্রয়োজনীয় মধ্যে, (১) ব্যায়াম, (২) শিক্ষা, এবং (৩) আহারের কথা বলিলাম, এক্ষণে, (৪) ইন্দ্রিয় সংযম সম্বন্ধেও একটা কথা বলা আবশ্যক। শারীরিক বৃত্তির সদনুশীলনজন্য ইন্দ্রিয় সংযম যে নিতান্ত প্রয়োজনীয়, বোধ করি, বুঝাইতে হইবে না। ইন্দ্রিয় সংযমন ব্যতীত শরীরের পুষ্টি নাই, বল নাই, ব্যায়ামের সম্ভাবনা থাকে না, শিক্ষা নিষ্ফল হয়, আহার বৃথা হয়, তাহার পরিপাকও হয় না। আর ইন্দ্রিয়ের সংযমই যে ইন্দ্রিয়ের উপযুক্ত অনুশীলন, ইহাও তোমাকে বুঝাইয়াছি। এক্ষণে তোমাকে স্মরণ করিতে বলি যে, ইন্দ্রিয় সংযম মানসিক বৃত্তির অনুশীলনের অধীন; মানসিক শক্তি ভিন্ন ইহা ঘটে না। অতএব যেমন ইতিপূর্ব্বে দেখিয়াছ যে, মানসিক বৃত্তির উচিত অনুশীলন শারীরিক বৃত্তির অনুশীলনের উপর নির্ভর করে, তেমনি এখন দেখিতেছ যে, শারীরিক বৃত্তির উচিত অনুশীলন আবার মানসিক বৃত্তির উপর নির্ভর করে। শারীরিক ও মানসিক বৃত্তিগুলি এইরূপ সম্বন্ধবিশিষ্ট; একের অনুশীলনের অভাবে অন্যের অনুশীলনের অভাব ঘটে।অতয়েব যে সকল ধর্ম্মোপদেষ্টা কেবল মানসিক বৃত্তির অনুশীলনের উপদেশ দিয়াই ক্ষান্ত, তাঁহাদের কথিত ধর্ম্ম অসম্পূর্ণ। যে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল জ্ঞানোপার্জ্জন, সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ, সুতরাং ধর্ম্মবিরুদ্ধ। কালেজে ছেলে পড়াইলেই ছেলে মানুষ হয় না এবং কতকগুলা বহি পড়িলে পণ্ডিত হয় না। পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে এই প্রথাটা বড় অনিষ্টকারী হইয়া উঠিয়াছে।
০৯.জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি
শিষ্য। শারীরিক বৃত্তির অনুশীলন সম্বন্ধে কিছু উপদেশ পাইয়াছি, এক্ষণে জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির অনুশীলন সম্বন্ধে কিছু শুনিতে ইচ্ছা করি। আমি যত দূর বুঝিয়াছি, তাহা এই যে, অন্যান্য বৃত্তির ন্যায় এ সকল বৃত্তির অনুশীলনে সুখ, ইহাই ধর্ম্ম। অতএব জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের অনুশীলন এবং জ্ঞানোপার্জ্জন করিতে হইবে।
গুরু। ইহা প্রথম প্রয়োজন। দ্বিতীয় প্রয়োজন, জ্ঞানোপার্জ্জন ভিন্ন অন্য বৃত্তির সম্যক্ অনুশীলন করা যায় না। শারীরিক বৃত্তির উদাহরণদ্বারা ইহা বুঝাইয়াছি। ইহা ভিন্ন তৃতীয় প্রয়োজন আছে। তাহা বোধ হয়, সর্ব্বাপেক্ষা গুরুতর। জ্ঞান ভিন্ন ঈশ্বরকে জানা যায় না। ঈশ্বরের বিধিপূর্ব্বক উপাসনা করা যায় না।
শিষ্য। তবে কি মূর্খের ঈশ্বরোপাসনা নাই? ঈশ্বর কি কেবল পণ্ডিতের জন্য?
গুরু। মূর্খের ঈশ্বরোপাসনা নাই। মূর্খের ধর্ম্ম নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। পৃথিবীতে যত জ্ঞানাকৃত পাপ দেখা যায়, সকলই প্রায় মূর্খের কৃত। তবে একটা ভ্রম সংশোধন করিয়া দিই। যে লেখাপড়া জানে না, তাহাকেই মূর্খ বলিও না। আর যে লেখাপড়া করিয়াছে তাহাকেই জ্ঞানী বলিও না। জ্ঞান পুস্তকপাঠ ভিন্ন অন্য প্রকারে উপার্জ্জিত হইতে পারে; জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির অনুশীলন বিদ্যালয় ভিন্ন অন্যত্র হইতে পারে। আমাদের দেশের প্রাচীন স্ত্রীলোকেরা ইহার উত্তম উদারহণস্থল। তাঁহারা প্রায় কেহই লেখাপড়া জানিতেন না, কিন্তু তাঁহাদের মত ধার্ম্মিকও পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু তাঁহারা বহি না পড়ুন, মূর্খ ছিলেন না। আমাদের দেশে জ্ঞানোপার্জ্জনের কতকগুলি উপায় ছিল, যাহা এক্ষণে লুপ্তপ্রায় হইয়াছে। কথকতা ইহার মধ্যে একটি। প্রাচীনেরা কথকের মুখে পুরাণেতিহাস শ্রবণ করিতেন। পুরাণেতিহাসের মধ্যে অনন্ত জ্ঞানভাণ্ডার নিহিত আছে। তচ্ছ্রবণে তাঁহাদিগের জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকল পরিমার্জ্জিত ও পরিতৃপ্ত হইত। তদ্ভিন্ন আমাদিগের দেশে হিন্দুধর্ম্মের মাহাত্ম্যে পুরুষপরম্পরায় একটি অপূর্ব্ব জ্ঞানের স্রোত চলিয়া আসিতেছিল। তাঁহারা তাহার অধিকারিণী ছিলেন। এই সকল উপায়ে তাঁহারা শিক্ষিত বাবুদিগের অপেক্ষা অনেক বিষয় ভাল বুঝিতেন। উদাহরণস্বরূপ অতিথিসৎকারের কথাটা ধর। অতিথিসৎকারের মাহাত্ম্য জ্ঞানলভ্য; জাগতিক সত্যের সঙ্গে ইহা সম্বন্ধবিশিষ্ট। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় অতিথির নামে জ্বলিয়া উঠেন; ভিখারী দেখিলে লাঠি দেখান। কিন্তু যে জ্ঞান ইহাদের নাই, প্রাচীনাদের ছিল; তাঁহারা অতিথিসৎকারের মাহাত্ম্য বুঝিতেন। এমনই আর শত শত উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। সে সকল বিষয়ে নিরক্ষর প্রাচীনারাই জ্ঞানী, এবং আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায় অজ্ঞানী, ইহাই বলিতে হইবে।
শিষ্য। ইহা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের দোষ নহে, বোধ হয় ইংরেজী শিক্ষাপ্রণালীর দোষ।
গুরু। সন্দেহ নাই। আমি যে অনুশীলনতত্ত্ব তোমাকে বুঝাইলাম অর্থাৎ সকল বৃত্তিগুলির সামঞ্জস্যপূর্ব্বক অনুশীলনপূর্ব্বক অনুশীলন করিতে হইবে, এই কথাটি না বুঝাই এ দোষের কারণ।
কাহারও কোন কোন বৃত্তির অনুশীলন কর্ত্তব্য, এরূপ লোক-প্রতীতি আছে, এবং তদনুরূপ কার্য্য হইতেছে। এইরূপ লোক-প্রতীতির ফল আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী। সেই শিক্ষাপ্রণালীতে তিনটি গুরুতর দোষ আছে। এই মনুষ্যতত্ত্বের প্রতি মনোযোগী হইলেই, সেই সকল দোষের আবিষ্কার ও প্রতিকার করা যায়।
শিষ্য। সে সকল দোষ কি?
গুরু। প্রথম, জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলির প্রতিই অধিক মনোযোগ; কার্য্যকারিণী বা চিত্ত রঞ্জিনীর প্রতি প্রায় অমনোযোগ।
এই প্রথার অনুবর্ত্তী হইয়া আধুনিক শিক্ষকেরা শিক্ষালয়ে শিক্ষা দেন বলিয়া, এ দেশে ও ইউরোপে এত অনিষ্ট হইতেছে। এ দেশে বাঙ্গালীরা অমানুষ হইতেছে; তর্ককুশলী, বাগ্মী বা সুলেখক-ইহাই বাঙ্গালীর চরমোৎকর্ষের স্থান হইয়াছে। ইহারই প্রভাবে ইউরোপের কোন প্রদেশের লোক কেবল শিল্পকুশল, অর্থগৃধ্নু, স্বার্থপর হইতেছে; কোন দেশে রণপ্রিয়; পরস্বাপহারী পিশাচ জন্মিতেছে। ইহারই প্রভাবে ইউরোপে এত যুদ্ধ, দুর্ব্বলের উপর এত পীড়ন। শারীরিক বৃত্তি, কার্য্যকারিণী বৃত্তি, মনোরঞ্জিনী বৃত্তি, যতগুলি আছে, সকলগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যযোগ্য যে বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন, তাহাই মঙ্গলকর; সেগুলির অবহেলা, আর বুদ্ধিবৃত্তির অসঙ্গত স্ফূর্ত্তি মঙ্গলদায়ক নহে। আমাদিগের সাধারণ লোকের ধর্ম্মসংক্রান্ত বিশ্বাস এরূপ নহে। হিন্দুর পূজনীয় দেবতাদিগের প্রাধান্য, রূপবান্ চন্দ্রে বা বলবান্ কার্ত্তিকেয়ে নিহিত হয় নাই; বুদ্ধিমান্ বৃহস্পতি বা জ্ঞানী ব্রহ্মায় অর্পিত হয় নাই; রসজ্ঞ গন্ধর্ব্বরাজ বা বাগ্দেবীতে নহে। কেবল সেই সর্ব্বাঙ্গসম্পন্ন-অর্থাৎ সর্ব্বাঙ্গীণ পরিণতিবিশিষ্ট ষড়ৈশ্বর্য্যশালী বিষ্ণুতে নিহিত হইয়াছে। অনুশীলন নীতির স্থূল গ্রন্থি এই যে, সর্ব্বপ্রকার বৃত্তি পরস্পর পরস্পরের সহিত সামঞ্জস্যবিশিষ্ট হইয়া অনুশীলিত হইবে, কেহ কাহাকে ক্ষুণ্ণ করিয়া অসঙ্গত বৃদ্ধি পাইবে না।
শিষ্য। এই গেল একটি দোষ। আর?
গুরু। আধুনিক শিক্ষাপ্রণালীর দ্বিতীয় ভ্রম এই যে, সকলকে এক এক, কি বিশেষ বিশেষ বিষয়ে পরিপক্ক হইতে হইবে-সকলের সকল বিষয় শিখিবার প্রয়োজন নাই। যে পারে, সে সাহিত্য উত্তম করিয়া শিখুক, তাহার বিজ্ঞানে প্রয়োজন নাই। তাহা হইলে মানসিক বৃত্তির সকলগুলির স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি হইল কৈ? সবাই আধখানা করিয়া মানুষ হইল, আস্ত মানুষ পাইব কোথা? যে বিজ্ঞানকুশলী, কিন্তু কাব্যরসাদির আস্বাদনে বঞ্চিত, সে কেবলে আধখানা মানুষ। অথবা যে সৌন্দর্য্যদত্তপ্রাণ, সর্ব্বসৌন্দর্য্যের রসগ্রাহী, কিন্তু জগতের অপূর্ব্ব বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে অজ্ঞ-সেও আধখানা মানুষ। উভয়েই মনুষ্যত্ববিহীন, সুতরাং ধর্ম্মে পতিত। যে ক্ষত্রিয় যুদ্ধবিশারদ-কিন্তু রাজধর্ম্মে অনভিজ্ঞ-অথবা যে ক্ষত্রিয় রাজধর্ম্মে অভিজ্ঞ, কিন্তু রণবিদ্যায় অনভিজ্ঞ, তাহারা যেমন হিন্দুশাস্ত্রানুসারে ধর্ম্মচ্যুত, ইহারাও তেমনি ধর্ম্মচ্যুত-এই প্রকৃত হিন্দুধর্ম্মের মর্ম্ম।
শিষ্য। আপনার ধর্ম্মব্যাখ্যা অনুসারে সকলকেই সকল শিখিতে হইবে।
গুরু। না, ঠিক তা নয়। সকলকেই সকল মনোবৃত্তিগুলি সংকর্ষিত করিতে হইবে।
শিষ্য। তাই হউক-কিন্তু সকলের কি তাহা সাধ্য? সকলের সকল বৃত্তিগুলি তুল্যরূপে তেজস্বিনী নহে। কাহারও বিজ্ঞানানুশীলনী বৃত্তিগুলি অধিক তেজস্বিনী, সাহিত্যানুযায়িনী বৃত্তিগুলি সেরূপ নহে। বিজ্ঞানের অনুশীলন করিলে সে একজন বড় বৈজ্ঞানিক হইতে পারে, কিন্তু সাহিত্যের অনুশীলনে তাহার কোন ফল হইবে না, এ স্থলে সাহিত্যে বিজ্ঞানে তাহার কি তুল্যরূপ মনোযোগ করা উচিত?
গুরু। প্রতিভার বিচারকালে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। সেই কথা ইহার উত্তর। তার পর তৃতীয় দোষ শুন।
জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলি সম্বন্ধে বিশেষ একটি সাধারণ ভ্রম এই যে সংকর্ষণ অর্থাৎ শিক্ষার উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জ্জন, বৃত্তির স্ফূরণ নহে। যদি কোন বৈদ্য, রোগীকে উদর ভরিয়া পথ্য দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়েন, অথচ তাহার ক্ষুধাবৃদ্ধি বা পরিপাকশক্তির প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি না করেন, তবে সেই চিকিৎসক যেরূপ ভ্রান্ত, এই প্রণালীর শিক্ষকেরাও সেইরূপ ভ্রান্ত। যেমন সেই চিকিৎসকের চিকিৎসার ফল অজীর্ণ, রোগবৃদ্ধি,-তেমনি এই জ্ঞানার্জ্জন বাতিকগ্রস্ত শিক্ষকদিগের শিক্ষার ফল মানসিক অজীর্ণ-বৃত্তি সকলের অবনতি। মুখস্থ কর, মনে রাখ, জিজ্ঞাসা করিলে যেন চটপট করিয়া বলিতে পার। তার পর, বুদ্ধি, তীক্ষ্ণ হইল, কি শুষ্ক কাষ্ঠ কোপাইতে কোপাইতে ভোঁতা হইয়া গেল, স্বশক্তি অবলম্বিনী হইল, কি প্রাচীন পুস্তকপ্রণেত এবং সমাজের শাসনকর্ত্তারূপ বৃদ্ধপিতামহীবর্গের আঁচল ধরিয়া চলিল, জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলি বুড়ো খোকার মত কেবল গিলাইয়া দিলে গিলিতে পারে, কি আপনি আহারার্জ্জনে সক্ষম হইল, সে বিষয়ে কেহ ভ্রমেও চিন্তা করেন না। এই সকল শিক্ষিত গর্দ্দভ জ্ঞানের ছালা পিঠে করিয়া নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া বেড়ায়-বিস্মৃতি নামে করুণাময়ী দেবী আসিয়া ভার নামাইয়া লইলে, তাহারা পালে মিশিয়া স্বচ্ছন্দে ঘাস খাইতে থাকে।
শিষ্য। আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতি আপনার এত কোপদৃষ্টি কেন?
গুরু। আমি কেবল আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কথা বলিতেছিলাম না। এখনকার ইংরেজের শিক্ষাও এইরূপ। আমরা যে মহাপ্রভুদিগের অনুকরণ করিয়া, মনুষ্যজন্ম সার্থক করিব মনে করি, তাঁহাদিগেরও বুদ্ধি সঙ্কীর্ণ, জ্ঞান পীড়াদায়ক।
শিষ্য। ইংরেজের বুদ্ধি সঙ্কীর্ণ? আপনি ক্ষুদ্র বাঙ্গালী হইয়া এত বড় কথা বলিতে সাহস করেন? আবার জ্ঞান পীড়াদায়ক?
গুরু। একে একে বাপু। ইংরেজের বুদ্ধি সঙ্কীর্ণ, ক্ষুদ্র বাঙ্গালী হইয়াও বলি। আমি গোস্পদ বলিয়া যে ডোবাকে সমুদ্র বলিব, এমত হইতে পারে না। যে জাতি এক শত কুড়ি বৎসর ধরিয়া ভারতবর্ষের আধিপত্য করিয়া ভারতবাসীদিগের সম্বন্ধে একটা কথাও বুঝিল না, তাঁহাদের অন্য লক্ষ গুণ থাকে স্বীকার করিব, কিন্তু তাঁহাদিগকে প্রশস্তবুদ্ধি বলিতে পারিব না। কথাটার বেশী বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নাই-তিক্ত হইয়া উঠিবে। তবে ইংরেজের অপেক্ষাও সঙ্কীর্ণ পথে বাঙ্গালীর বুদ্ধি চলিতেছে, ইহা আমি না হয় স্বীকার করিলাম। ইংরেজের শিক্ষা অপেক্ষাও আমাদের শিক্ষা যে নিকৃষ্ট, তাহা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি। কিন্তু আমাদের সেই কুশিক্ষার মূল ইউরোপের দৃষ্টান্ত। আমাদের প্রাচীন শিক্ষা হয়ত আরও নিকৃষ্ট ছিল। কিন্তু তাহা বলিয়া বর্ত্তমান শিক্ষাকে ভাল বলিতে পারি না। একটা আপত্তি মিটিল ত?
শিষ্য। জ্ঞান পীড়াদায়ক, এখনও বুঝিতে পারিতেছি না।
গুরু। জ্ঞান স্বাস্থ্যকর, এবং জ্ঞান পীড়াদায়ক। আহার স্বাস্থ্যকর, এবং অজীর্ণ হইলে পীড়াদায়ক। অজীর্ণ জ্ঞান পীড়াদায়ক। অর্থাৎ কতকগুলা কথা জানিয়াছি, কিন্তু যাহা যাহা জানিয়াছি, সে সকলের কি সম্বন্ধ, সকলগুলির সমবায়ে ফল কি, তাহা কিছুই জানি না। গৃহে অনেক আলোক জ্বলিতেছে, কেবল সিঁড়িটুকু অন্ধকার। এই জ্ঞানপীড়াগ্রস্ত ব্যক্তিরা এই জ্ঞান লইয়া কি করিতে হয়, তাহা জানে না। একজন ইংরেজ স্বদেশ হইতে নূতন আসিয়া একখানি বাগান কিনিয়াছিলেন। মালী বাগানের নারিকেল পাড়িয়া আনিয়া উপহার দিল। সাহেব ছোবড়া খাইয়া তাহা অস্বাদু বলিয়া পরিত্যাগ করিলেন। মালী উপদেশ দিল, “সাহেব! ছোবড়া খাইতে নাই-আঁটি খাইতে হয়।” তার পর আঁব আসিল। সাহেব মালীর উপদেশবাক্য স্মরণ করিয়া ছোবড়া ফেলিয়া দিয়া আঁটি খাইলেন। দেখিলেন, এবারও বড় রস পাওয়া গেল না। মালী বলিয়া দিল, “সাহেব! কেবল খোসাখানা ফেলিয়া দিয়া, শাঁসটা ছুরি দিয়া কাটিয়া খাইতে হয়।” সাহেবের সে কথা স্মরণ রহিল। শেষে ওল আসিল। সাহেব, তাহার খোসা ছাড়াইয়া কাটিয়া খাইলেন। শেষ যন্ত্রণায় কাতর হইয়া মালীকে প্রহারপূর্ব্বক আধা কড়িতে বাগান বেচিয়া ফেলিলেন। অনেকের মানসক্ষেত্র এই বাগানের মত ফলে ফুলে পরিপূর্ণ তবে অধিকারীর ভোগে হয় না। তিনি ছোবড়ার জায়গায় আঁটি, আঁটির জায়গায় ছোবড়া খাইয়া বসিয়া থাকেন। এরূপ জ্ঞান বিড়ম্বনা মাত্র।
শিষ্য। তবে কি জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের অনুশীলন জন্য জ্ঞান নিষ্প্রয়োজন?
গুরু। পাগল! অস্ত্রখানা শানাইতে গেলে কি শূন্যের উপর শান দেওয়া যায়? জ্ঞেয় বস্তু ভিন্ন কিসের উপর অনুশীলন করিবে? জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তি সকলের অনুশীলন জন্য জ্ঞানার্জ্জন নিশ্চিত প্রয়োজন। তবে ইহাই বুঝাইতে চাই যে, জ্ঞানার্জ্জন যেরূপ উদ্দেশ্য, বৃত্তির বিকাশও সেইরূপ মুখ্য উদ্দেশ্য। আর ইহাও মনে করিতে হইবে, জ্ঞানার্জ্জনেই জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলি পরিতৃপ্তি। অতএব চরম উদ্দেশ্য জ্ঞানার্জ্জনই বটে। কিন্তু যে অনুশীলনপ্রথা চলিত, তাহাতে পেট বড় না হইতে আহার ঠুসিয়া দেওয়া হইতে থাকে। পাকশক্তির বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি নাই, ক্ষুধা বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি নাই-আধার বৃদ্ধির দিকে দৃষ্টি নাই-ঠুসে গেলা। যেমন কতকগুলি অবোধ মাতা এইরূপ করিয়া শিশুর শারীরিক অবনতি সংসাধিত করিয়া থাকে, তেমন এখনকার পিতা ও শিক্ষকেরা পুত্র ও ছাত্রগণের অবনতি সংসাধিত করেন।
জ্ঞানার্জ্জন ধর্ম্মের একটি প্রধান অংশ। কিন্তু সম্প্রতি তৎসম্বন্ধে এই তিনটি সামাজিক পাপ সর্ব্বদা বর্ত্তমান। ধর্ম্মের প্রকৃত তাৎপর্য্য সমাজে গৃহীত হইলে, এই কুশিক্ষারূপ পাপ সমাজ হইতে দূরীকৃত হইবে।
১০.মনুষ্যে ভক্তি
শিষ্য। সুখ, সকল বৃত্তিগুলির সম্যক্ স্ফূর্ত্তি, পরিণতি, সামঞ্জস্য এবং চরিতার্থ>তা। বৃত্তিগুলির সম্যক্ স্ফূর্ত্তি, পরিণতি এবং সামঞ্জস্য মনুষ্যত্ব। বৃত্তিগুলি, শারীরিকী, জ্ঞানার্জ্জনী, কার্য্যকারিণী এবং চিত্তরঞ্জিনী। ইহার মধ্যে শারীরিকী ও জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তির অনুশীলন প্রথা সম্বন্ধে কিছু উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি। নিকৃষ্টা কার্য্যকারিণী বৃত্তিগুলির অনুশীলন কি, সামঞ্জস্য বুঝিবার সময়ে, ভয়, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদির উদাহরণে বুঝিয়াছি। নিকৃষ্টা কার্য্যকারিণী বৃত্তি সম্বন্ধে, বোধ করি, আপনার আর কোন বিশেষ উপদেশ নাই, তাহাও বুঝিয়াছি। কিন্তু অনুশীলনতত্ত্বের এ সকল ত সামান্য অংশ। অবশিষ্ট যাহা শ্রোতব্য, তাহা শুনিতে ইচ্ছা করি।
গুরু। এক্ষণে যাহাকে কার্য্যকারিণী বৃত্তিগুলির মধ্যে সচরাচর উৎকৃষ্ট বলে, তাদৃশ বৃত্তির কথা বলিব। বৃত্তির মধ্যে যে অর্থে উৎকর্ষ নিকর্ষ নির্দ্দেশ করা যায়, সেই অর্থে এই তিনটি বৃত্তি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ-ভক্তি, প্রীতি, দয়া।
শিষ্য। ভক্তি, প্রীতি, দয়া, এ তিনটি কি একই বৃত্তি নহে? প্রীতি ঈশ্বরে ন্যস্ত হইলেই সে ভক্তি হইল, এবং আর্ত্তে ন্যস্ত হইলেই তাহা দয়া হইল।
গুরু। যদি এরূপ বলিতে চাও, তাহাতে আমার এখন কোন আপত্তি নাই; কিন্তু অনুশীলন জন্য তিনটিকে পৃথক্ বিবেচনা করাই ভাল। বিশেষ, ঈশ্বরে ন্যস্ত যে প্রীতি, সেই ভক্তি, এমন নহে। মনুষ্য-যথা রাজা, গুরু, পিতা, মাতা স্বামী প্রভৃতিও ভক্তির পাত্র। আর ঈশ্বরে ভক্তি না হইয়াও কেবল প্রীতি জন্মিতে পারে। তাই, বাঙ্গালার বৈষ্ণবেরা, শান্ত, দাস্য, সখ্য বাৎসল্য, এবং মধুর, ঈশ্বরের প্রতি এই পঞ্চবিধ অনুরাগ স্বীকার করেন। সে পাঁচটি দেখিবে, এই ভক্তি, প্রীতি, দয়া মাত্র। তবে কোন ভাবটি মিশ্র, কোনটি অমিশ্র, যথা-
শান্ত (সাধারণ ভক্তের যে ভাব) = ভক্তি।
দাস্য (হনুমানাদির যে ভাব) = ভক্তি + দয়া।
সখ্য (শ্রীদামাদির যে ভাব) = প্রীতি।
বাৎসল্য (নন্দ যশোদা) = প্রীতি + দয়া।
মধুর (রাধা) = ভক্তি + প্রীতি + দয়া।
শিষ্য। কৃষ্ণের প্রতি রাধার যে ভাব বাঙ্গালার বৈষ্ণবেরা কল্পনা করেন, তাহার মধ্যে দয়া কোথায়?
গুরু। স্নেহ আছে স্বীকার কর?
শিষ্য। করি, কিন্তু স্নেহ ত প্রীতি।
গুরু। কেবল প্রীতি নহে। প্রীতি ও দয়ার মিশ্রণে স্নেহ। সুতরাং মধুর ভাবের ভিতর দয়াও আছে। ভক্তি, প্রীতি, দয়া, মনুষ্যবৃত্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তন্মধ্যে ভক্তিই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। এই ভক্তি ঈশ্বরে ন্যস্ত হইলেই, অন্য ধর্ম্মাবলম্বীরা সন্তুষ্ট হইলেন, ধর্ম্মের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল। কিন্তু বাঙ্গালার বৈষ্ণবেরা তাহাতেও সন্তুষ্ট নহেন, তাঁহারা চাহেন যে, তিনটি শ্রেষ্ঠ বৃত্তিই ঈশ্বরমুখী হইবে। ইহা এক দিনের কাজ নহে। ক্রমে একটি একটি, দুইটি দুইটি করিয়া শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্যের পর্য্যায়ক্রমে সর্ব্বশেষে সকলগুলিই ঈশ্বরে অর্পণ করিতে শিখিতে হইবে, তখন “রাধা” (যে আরাধনা করে) হইতে পারা যায়।
কিন্তু ঈশ্বরভক্তির কথা এখন থাক। আগে মনুষ্যে ভক্তির কথা বলা যাউক। যিনিই আমাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এবং যাঁহার শ্রেষ্ঠতা হইতে আমরা উপকৃত হই, তিনিই ভক্তির পাত্র। ভক্তির সামাজিক প্রয়োজন এই যে, (১) ভক্তি ভিন্ন নিকৃষ্ট কখন উৎকৃষ্টের অনুগামী হয় না। (২) নিকৃষ্ট উৎকৃষ্টের অনুগামী না হইলে সমাজের ঐক্য থাকে না, বন্ধন থাকে না, উন্নতি ঘটে না।
দেখা যাউক, মনুষ্যমধ্যে কে ভক্তির পাত্র। (১) পিতামাতা ভক্তির পাত্র। তাঁহারা যে আমাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তাহা বুঝাইতে হইবে না। গুরু জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ, আমাদের জ্ঞানদাতা, এজন্য তিনিও ভক্তির পাত্র। গুরু ভিন্ন মনুষ্যের মনুষ্যত্বই অসম্ভব ইহা শারীরিক বৃত্তি আলোচনাকালে বুঝিয়াছি। এজন্য গুরু বিশেষ প্রকারে ভক্তির পাত্র। হিন্দুধর্ম্ম সর্ব্বতত্ত্বদর্শী, এজন্য হিন্দুধর্ম্মের গুরুভক্তির উপর বিশেষ দৃষ্টি। পুরোহিত, অর্থাৎ যিনি ঈশ্বরের নিকট আমাদের মঙ্গল কামনা করেন, সর্ব্বথা আমাদের হিতানুষ্ঠান করেন এবং আমাদের অপেক্ষা ধর্ম্মাত্মা ও পবিত্রস্বভাব, তিনিও ভক্তির পাত্র। যিনি কেবল চাল কলার জন্য পুরোহিত তিনি ভক্তির পাত্র নহেন। স্বামী সকল বিষয়েই স্ত্রীর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, তিনি ভক্তির পাত্র। হিন্দুধর্ম্মে ইহাও বলে যে, স্ত্রীরও স্বামীর ভক্তির পাত্র হওয়া উচিত, কেন না, হিন্দুধর্ম্ম বলে যে, স্ত্রীকে লক্ষ্মীরূপা মনে করিবে। কিন্তু এখানে হিন্দুধর্ম্মের অপেক্ষা কোম্ৎ ধর্ম্মের উক্তি কিছু স্পষ্ট এবং শ্রদ্ধার যোগ্য। যেখানে স্ত্রী স্নেহে, ধর্ম্মে বা পবিত্রতায় শ্রেষ্ঠ, সেখানে তাঁহারও স্বামীর ভক্তির পাত্র হওয়া উচিত বটে। গৃহধর্ম্মে ইঁহারা ভক্তির পাত্র; যাঁহারা ইঁহাদের স্থানীয়, তাঁহারাও সেইরূপ ভক্তির পাত্র। গৃহমধ্যে যাহারা নিম্নস্থ তাহারা যদি ভক্তির পাত্রগণকে যদি ভক্তি না করে, যদি পিতা মাতাকে পুত্র কন্যা বা বধূ ভক্তি না করে, যদি স্বামীকে স্ত্রী ভক্তি না করে, যদি স্ত্রীকে স্বামী ঘৃণা করে, যদি শিক্ষাদাতাকে ছাত্র ঘৃণা করে, তবে সে গৃহে কিছুমাত্র উন্নতি নাই-সে গৃহ নরকবিশেষ। এ কথা কষ্ট পাইয়া বুঝাইতে হইবে না, প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। এই সকল ভক্তির পাত্রের প্রতি সমুচিত ভক্তির উদ্রেক অনুশীলনের একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। হিন্দুধর্ম্মেরও সেই উদ্দেশ্য। বরং অন্যান্য ধর্ম্মের অপেক্ষা এ বিষয়ে হিন্দুধর্ম্মেরই প্রাধান্য আছে। হিন্দুধর্ম্ম যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম, ইহা তদ্বিষয়ে অন্যতর প্রমাণ।
(২) এখন বুঝিয়া দেখ গৃহস্থ পরিবারের যে গঠন, সমাজের সেই গঠন। গৃহের কর্ত্তার ন্যায়, পিতা মাতার ন্যায়, রাজা সেই সমাজের শিরোভাগ। তাঁহার গুণে, তাঁহার দণ্ডে, তাঁহার পালনে সমাজ রক্ষিত হইয়া থাকে। পিতা যেমন সন্তানের ভক্তির পাত্র, রাজাও সেইরূপ প্রজার ভক্তির পাত্র। প্রজার ভক্তিতেই রাজা শক্তিমান্-নহিলে রাজার নিজ বাহুতে বল কত? রাজা বলশূন্য হইলে সমাজ থাকিবে না। অতএব রাজাকে সমাজের পিতার স্বরূপ ভক্তি করিবে। লর্ড রীপণ সম্বন্ধে যে সকল উৎসাহ উৎসাহাদি দেখা গিয়াছে, এইরূপ এবং অন্যান্য সদুপায় দ্বারা রাজভক্তি অনুশীলিত করিবে। যুদ্ধকালে রাজার সহায় হইবে। হিন্দুধর্ম্মে পুনঃ পুনঃ রাজভক্তির প্রশংসা আছে। বিলাতী ধর্ম্মে হউক বা না হউক, বিলাতী সামাজিক নীতিতে রাজভক্তির বড় উচ্চ স্থান ছিল। বিলাতে এখন আর রাজভক্তির স্থান নাই। যেখানে আছে-যথা জর্ম্মানি, ইতালি, সেখানে রাজ্য উন্নিতিশীল।
শিষ্য। সেই ইউরোপীয় রাজভক্তিটা আমার বড় বিস্ময়কর ব্যাপার বলিয়া বোধ হয়। লোকে রামচন্দ্র বা যুধিষ্ঠিরের ন্যায় রাজাকে যে ভক্তি করিবে, ইহা বুঝিতে পারি, আকবর বা অশোকের উপর ভক্তিও না হয় বুঝিলাম, কিন্তু দ্বিতীয় চার্লস্ বা পঞ্চদশ লুইর মত রাজার উপরে যে রাজভক্তি হয়, ইহার পর মনুষ্যের অধঃপতনের আর গুরুতর চিহ্ন কি হইতে পারে?
গুরু। যে মনুষ্য রাজা, সেই মনুষ্যকে ভক্তি করা এক বস্তু, রাজাকে ভক্তি করা স্বতন্ত্র বস্তু। যে দেশে একজন রাজা নাই-যে রাজ্য সাধারণতন্ত্র, সেইখানকার কথা মনে করিলেই বুঝিতে পারিবে যে, রাজভক্তি কোন মনুষ্যবিশেষের প্রতি ভক্তি নহে। আমেরিকার কংগ্রেসের বা ব্রিটিশ পার্লিয়ামেণ্টের কোন সভ্যবিশেষ ভক্তির পাত্র না হইতে পারেন, কিন্তু কংগ্রেস ও পার্লিয়ামেণ্ট ভক্তির পাত্র তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই। সেইরূপ চার্লস্ ষ্টুয়ার্ট বা লুই কাপে ভক্তির পাত্র না হইতে পারেন, কিন্তু তত্তৎসময়ে ইংলন্ড বা ফ্রান্সের রাজা তত্তৎ প্রদেশীয়দিগের ভক্তির পাত্র।
শিষ্য। তবে কি একটা দ্বিতীয় ফিলিপ বা একটা ঔরঙ্গজেবের ন্যায় নরাধমের বিপক্ষে বিদ্রোহ পাপের মধ্যে গণ্য হইবে?
গুরু। কদাপি না। রাজা যতক্ষণ প্রজাপালক, ততক্ষণ তিনি রাজা। যখন তিনি প্রজাপীড়ক হইলেন, তখন তিনি আর রাজা নহেন, আর ভক্তির পাত্র নহেন। এরূপ রাজাকে ভক্তি করা দূরে থাক, যাহাতে সে রাজা সুশাসন করিতে বাধ্য হয়, তাহা দেশবাসীদিগের কর্ত্তব্য। কেন না, রাজার স্বেচ্ছাচারিতা সমাজের অমঙ্গল। কিন্তু সে সকল কথা ভক্তিতত্ত্বে উঠিতেছে না, প্রীতিতত্ত্বের অন্তর্গত। আর একটা কথা বলিয়া রাজভক্তি সমাপ্ত করি। রাজা যেমন ভক্তির পাত্র, তাঁহার প্রতিনিধিস্বরূপ রাজপুরুষগণও যথাযোগ্য সম্মানের পাত্র। কিন্তু তাঁহারা যতক্ষণ আপন আপন রাজকার্য্যে নিযুক্ত থাকেন, এবং ধর্ম্মতঃ সেই কার্য্য নির্ব্বাহ করেন, ততক্ষণই তাঁহারা সম্মানের পাত্র। তারপর তাঁহারা সাধারণ মনুষ্য।
রাজপুরুষে যথাযোগ্য ভক্তি ভাল, কিন্তু বেশী মাত্রায় কিছুই ভাল নহে-কেন না, বেশী মাত্রা অসামঞ্জস্যের কারণ। রাজা সমাজের প্রতিনিধি এবং রাজপুরুষেরা সমাজের ভৃত্য-এ কথা কাহারও বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। আমাদের দেশীয় লোক এ কথা বিস্মৃত হইয়া, রাজপুরুষের অপরিমিত তোষামোদ করিয়া থাকেন।
(৩) রাজার অপেক্ষাও, যাঁহারা সমাজের শিক্ষক, তাঁহারা ভক্তির পাত্র। গৃহস্থ গুরুর কথা, গৃহস্থিত ভক্তির পাত্রদিগের সঙ্গে বলিয়াছি, কিন্তু এই গুরুগণ, কেবল গার্হস্থ্য গুরু নহেন, সামাজিক গুরু। যাঁহারা বিদ্যা বুদ্ধি বলে, পরিশ্রমের সহিত সমাজের শিক্ষায় নিযুক্ত, তাঁহারাই সমাজের প্রকৃত নেতা, তাঁহারাই যথার্থ রাজা। অতএব ধর্ম্মবেত্তা, বিজ্ঞানবেত্তা, নীতিবেত্তা, দার্শনিক, পুরাণবেত্তা, সাহিত্যকার, কবি প্রভৃতির প্রতি যথোচিত ভক্তির অনুশীলন কর্ত্তব্য। পৃথিবীর যাহা কিছু উন্নতি হইয়াছে, তাহা ইঁহাদিগের দ্বারা হইয়াছে। ইঁহারা পৃথিবীকে যে পথে চালান, সেই পথে পৃথিবী চলে। ইঁহারা রাজাদিগেরও গুরু। রাজগণ ইঁহাদিগের নিকট শিক্ষা লাভ করিয়া তবে সমাজশাসনে সক্ষম হয়েন। এই হিসাবে, ভারতবর্ষ ভারতীয় ঋষিদিগের সৃষ্টি-এই জন্য ব্যাস, বাল্মীকি, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, কপিল, গৌতম-সমস্ত ভারতবর্ষের পূজ্যবাদ পিতৃগণস্বরূপ। ইউরোপেও গলিলীও, নিউটন, কান্ত্, কোম্ৎ, দান্তে, শেক্ষপীয়র প্রভৃতি সেই স্থানে।
শিষ্য। আপনার কথার তাৎপর্য্য কি এইরূপ বুঝিতে হইবে যে, যাঁহা দ্বারা আমি যে পরিমাণে উপকৃত, তাঁহার প্রতি সেই পরিমাণে ভক্তিযুক্ত হইব?
গুরু। তাহা নহে। ভক্তি কৃতজ্ঞতা নহে। অনেক সময়ে নিকৃষ্টের নিকটও কৃতজ্ঞ হইতে হয়। ভক্তি ভক্তি পরের জন্য নহে, আপনার উন্নতির জন্য। যাহার ভক্তি নাই, তাহার চরিত্রের উন্নতি নাই। এই লোকশিক্ষকদিগের প্রতি যে ভক্তির কথা বলিলাম, তাহাই উদাহরণ স্বরূপ লইয়া বুঝিয়া দেখ। তুমি কোন লেখকের প্রণীত গ্রন্থ পড়িতেছ। যদি সে লেখকের প্রতি তোমার ভক্তি না থাকে, তবে সে গ্রন্থের দ্বারা তোমার কোন উপকার হইবে না। তাঁহার প্রদত্ত উপদেশে তোমার চরিত্র কোনরূপ শাসিত হইবে না। তাহার মর্ম্মার্থ তুমি গ্রহণ করিতে পারিবে না। গ্রন্থকারের সঙ্গে সহৃদয়তা না থাকিলে, তাঁহার উক্তির তাৎপর্য্য বুঝা যায় না। অতএব জগতের শিক্ষকদিগের উপর ভক্তি না থাকিলে শিক্ষা নাই। সেই শিক্ষাই সকল উন্নতির মূল; অতএব সে ভক্তি ভিন্ন উন্নতিও নাই। ইঁহাদের প্রতি সমুচিত ভক্তি অনুশীলন পরম ধর্ম্ম।
শিষ্য। কৈ, এ ধর্ম্ম ত আপনার প্রশংসিত হিন্দুধর্ম্মে শিখায় না?
গুরু। এটা অতি মূর্খের মত কথা। বরং হিন্দুধর্ম্মে ইহা যে পরিমাণে শিখায়, এমন আর কোন ধর্ম্মেই শিখায় নাই। হিন্দুধর্ম্মে ব্রাহ্মণগণ সকলের পূজ্য। তাঁহারা যে বর্ণশ্রেষ্ঠ এবং আপামর সাধারণের বিশেষ ভক্তির পাত্র, তাহার কারণ এই যে, ব্রাহ্মণেরাই ভারতবর্ষে সামাজিক শিক্ষক ছিলেন। তাঁহারা ধর্ম্মবেত্তা, তাঁহারাই নীতিবেত্তা, তাঁহারাই বিজ্ঞানবেত্তা, তাঁহারাই পুরাণবেত্তা, তাঁহারাই দার্শনিক, তাঁহারাই সাহিত্যপ্রণেতা, তাঁহারাই কবি। তাই অনন্তজ্ঞানী হিন্দুধর্ম্মের উপদেশগণ তাঁহাদিগকে লোকের অশেষ ভক্তির পাত্র বলিয়া নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন। সমাজ ব্রাহ্মণকে এত ভক্তি করিত বলিয়াই, ভারতবর্ষ অল্পকালে এত উন্নত হইয়াছিল। সমাজ শিক্ষাদাতাদিগের সম্পূর্ণ বশবর্ত্তী হইয়াছিল বলিয়াই সহজে উন্নতি লাভ করিয়াছিল।
শিষ্য। আধুনিক মত এই যে, ভণ্ড ব্রাহ্মণেরা আপনাদিগের চাল কালার পাকা বন্দোবস্ত করিবার জন্য এই দুর্জ্জয় ব্রহ্মভক্তি ভারতবর্ষে প্রচার করিয়াছে।
গুরু। তুমি যে ফলের নাম করিলে, যাঁহারা তাহা অধিক পরিমাণে ভোজন করিয়া থাকেন, এ কথাটা তাঁহাদিগের বুদ্ধি হইতেই উদ্ভুত হইয়াছে। দেখ, বিধি বিধান ব্যবস্থা সকলই ব্রাহ্মণের হাতেই ছিল। নিজ হস্তে সে শক্তি থাকিতেও তাঁহারা আপনাদের উপজীবিকা সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা করিয়াছেন? তাঁহারা রাজ্যের অধিকারী হইবেন না, বাণিজ্যের অধিকারী হইবেন না, কৃষিকার্য্যের পর্য্যন্ত অধিকারী নহেন। এক ভিন্ন কোন প্রকার উপজীবিকার অধিকারী নহেন। যে একটি উপজীবিকা ব্রাহ্মণেরা বাছিয়া বাছিয়া আপনাদিগের জন্য রাখিলেন, সেটি কি? যাহার পর দুঃখের উপজীবিকা আর নাই, যাহার পর দারিদ্র্য আর কিছুতেই নাই-ভিক্ষা। এমন নিঃস্বার্থ উন্নতচিত্ত মনুষ্যশ্রেণী ভূমণ্ডলে আর কোথাও জন্মগ্রহণ করেন নাই। তাঁহারা বাহাদুরির জন্য বা পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য, বাছিয়া বাছিয়া ভিক্ষাবৃত্তিটি উপজীবিকা বলিয়া গ্রহণ করেন নাই। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, ঐশ্বর্য্যসম্পদে মন গেলে জ্ঞানোপার্জ্জনে বিঘ্ন ঘটে, সমাজের শিক্ষাদানে বিঘ্ন ঘটে। একমন, একধ্যান হইয়া লোকশিক্ষা দিবেন বলিয়াই সর্ব্বত্যাগী হইয়াছিলেন। যথার্থ নিষ্কাম ধর্ম্ম যাহাদের হাড়ে হাড়ে প্রবেশ করিয়াছে, তাহারাই পরহিতব্রত সঙ্কল্প করিয়া এরূপ সর্ব্বত্যাগী হইতে পারে। তাঁহারা যে আপনাদিগের প্রতি লোকের অচলা ভক্তি আদিষ্ট করিয়াছিলেন, তাহাও স্বার্থের জন্য নহে। তাঁহারা বুঝিয়াছিলেন যে, সমাজশিক্ষকদিগের উপর ভক্তি ভিন্ন উন্নতি নাই, সে জন্য ব্রাহ্মণভক্তি প্রচার করিয়াছিলেন। এই সকল করিয়া তাঁহারা যে সমাজ ও যে সভ্যতার সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহা আজিও জগতে অতুল্য, ইউরোপ আজিও তাহা আদর্শস্বরূপ গ্রহণ করিতে পারে। ইউরোপে আজিও যুদ্ধটা সামাজিক প্রয়োজন মধ্যে। কেবল ব্রাহ্মণেরাই এই ভয়ঙ্কর দুঃখ-সকল দুঃখের উপর শ্রেষ্ঠ দুঃখ–সকল সামাজিক উৎপাতের উপর বড় উৎপাত-সমাজ হইতে উঠাইয়া দিতে পারিয়াছিলেন। সমাজ ব্রাহ্মণ্য নীতি অবলম্বন করিলে যুদ্ধের আর প্রয়োজন থাকে না। তাঁহাদের কীর্ত্তি অক্ষয়। পৃথিবীতে যত জাতি উৎপন্ন হইয়াছে, প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণদিগের মত প্রতিভাশালী, ক্ষমতাশালী, জ্ঞানী ও ধার্ম্মিক কোন জাতিই নহে। প্রাচীন এথেন্স বা রোম, মধ্যকালের ইতালি, আধুনিক জার্ম্মানি বা ইংলণ্ডবাসী-কেহই তেমন প্রতিভাশালী বা ক্ষমতাশালী ছিলেন না; রোমক ধর্ম্মযাজক, বৌদ্ধ ভিক্ষু বা অপর কোন সম্প্রদায়ের লোক তেমন জ্ঞানী বা ধার্ম্মিক ছিল না।
শিষ্য। তা যাক। এখন দেখি ত ব্রাহ্মণেরা লুচিও ভাজেন, রুটীও বেচেন, কালী খাড়া করিয়া কসাইয়ের ব্যবসাও চালান। তাঁহাদিগকে ভক্তি করিতে হইবে?
গুরু। কদাপি না। যে গুণের জন্য ভক্তি করিব, সে গুণ যাহার নাই, তাহাকে ভক্তি করিব কেন? সেখানে ভক্তি অধর্ম্ম। এইটুকু না বুঝাই, ভারতবর্ষের অবনতির একটি গুরুতর কারণ। যে গুণে ব্রাহ্মণ ভক্তির পাত্র ছিলেন, সে গুণ যখন গেল, তখন আর ব্রাহ্মণকে কেন ভক্তি করিতে লাগিলাম? কেন আর ব্রাহ্মণের বশীভূত রহিলাম? তাহাতেই কুশিক্ষা হইতে লাগিল, কুপথে যাইতে লাগিলাম। এখন ফিরিতে হইবে।
শিষ্য। অর্থাৎ ব্রাহ্মণকে আর ভক্তি করা হইবে না।
গুরু। ঠিক তাহা নহে। যে ব্রাহ্মণের গুণ আছে, অর্থাৎ যিনি ধার্ম্মিক, বিদ্বান্, নিষ্কাম, লোকের শিক্ষক, তাঁহাকে ভক্তি করিব; যিনি তাহা নহেন, তাঁহাকে ভক্তি করিব না। তৎপরিবর্ত্তে যে শূদ্র ব্রাহ্মণের গুণযুক্ত, অর্থাৎ যিনি ধার্ম্মিক, বিদ্বান্, নিষ্কাম, লোকের শিক্ষক, তাঁহাকেও ব্রাহ্মণের মত ভক্তি করিব।
শিষ্য। অর্থাৎ বৈদ্য কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্মণ শিষ্য; ইহা আপনি সঙ্গত মনে করেন?
গুরু। কেন করিব না? ঐ মহাত্মা সুব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ গুণসকলে ভূষিত ছিলেন। তিনি সকল ব্রাহ্মণের ভক্তির যোগ্য পাত্র।
শিষ্য। আপনার এরূপ হিন্দুয়ানিতে কোন হিন্দু মত দিবে না।
গুরু। না দিক, কিন্তু ইহাই ধর্ম্মের যথার্থ মর্ম্ম। মহাভারতের বনপর্ব্বে মার্কণ্ডেয়সমস্যাপর্ব্বাধ্যায়ে ২১৫ অধ্যায়ে ঋষিবাক্য এইরূপ আছে;-“পাতিত্যজনক কুক্রিয়াসক্ত, দাম্ভিক, ব্রাহ্মণ প্রাজ্ঞ হইলেও শূদ্রসদৃশ হয়, আর যে শূদ্র সত্য, দম ও ধর্ম্মে সতত অনুরক্ত, তাহাকে আমি ব্রাহ্মণ বিবেচনা করি। কারণ, ব্যবহারেই ব্রাহ্মণ হয়।” পুনশ্চ বনপর্ব্বে অজগর-পর্ব্বাধ্যায়ে ১৮০ অধ্যায়ে রাজর্ষি নহুষ বলিতেছেন, “বেদমূলক সত্য দান ক্ষমা অনৃশংস্য অহিংসা ও করুণা শূদ্রেও লক্ষিত হইতেছে। যদ্যপি শূদ্রেও সত্যাদি ব্রাহ্মণধর্ম্ম লক্ষিত হইল, তবে শূদ্রও ব্রাহ্মণ হইতে পারে।” তদুত্তরে যুধিষ্ঠির বলিতেছেন,-“অনেক শূদ্রে ব্রাহ্মণলক্ষণ ও অনেক দ্বিজাতিতেও শূদ্রলক্ষণ লক্ষিত হইয়া থাকে; অতএব শূদ্রবংশ্য হইলেই যে শূদ্র হয়, এবং ব্রাহ্মণবংশ্য হইলেই যে ব্রাহ্মণ হয়, এরূপ নহে। কিন্তু যে সকল ব্যক্তিতে বৈদিক ব্যবহার লক্ষিত হয়, তাহারাই ব্রাহ্মণ, এবং যে সকল ব্যক্তিতে লক্ষিত না হয়, তাহারাই শূদ্র।” এরূপ কথা আরও অনেক আছে। পুনশ্চ বৃদ্ধগৌতম-সংহিতায় ২১ অধ্যায়ে,
ক্ষান্তং দান্তং জিতক্রোধং জিতাত্মানং জিতেন্দ্রিয়ম্।
তমেব ব্রাহ্মণং মন্যে শেষাঃ শূদ্রা ইতি স্মৃতাঃ ||
অগ্নিহোত্রব্রতপরান্ স্বাধ্যায়নিরতান্ শুচীন্।
উপবাসরতান্ দান্তাংস্তান্ দেবা ব্রাহ্মণান্ বিদুঃ ||
ন জাতিঃ পূজ্যতে রাজন্ গুণাঃ কল্যাণকারকাঃ।
চণ্ডালমপি বিত্ত্বস্থং তং দেবা ব্রাহ্মণং বিদুঃ ||
ক্ষমাবান্ দমশীল, জিতক্রোধ এবং জিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়কেই ব্রাহ্মণ বলিতে হইবে; আর সকলে শূদ্র। যাঁহারা অগ্নিহোত্রব্রতপর, স্বাধ্যায়নিরত, শুচি, উপবাসরত, দান্ত দেবতারা তাঁহাদিগকেই ব্রাহ্মণ বলিয়া জানেন। হে রাজন্! জাতি পূজ্য নহে, গুণই কল্যাণকারক। চণ্ডালও বিত্তস্থ হইলে দেবতারা তাহাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া জানেন।
শিষ্য। যাক। এক্ষণে বুঝিতেছি, মনুষ্যমধ্যে তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি ভক্তি অনুশীলনীয়, (১) গৃহস্থিত গুরুজন, (২) রাজা, এবং (৩) সমাজ-শিক্ষক। আর কেহ?
গুরু। (৪) যে ব্যক্তি ধার্ম্মিক বা যে জ্ঞানী, সে এই তিন শ্রেণীর মধ্যে না আসিলেও ভক্তির পাত্র। ধার্ম্মিক, নীচজাতীয় হইলেও ভক্তির পাত্র।
(৫) আর কতকগুলি লোক আছেন, তাঁহারা কেবল ব্যক্তিবিশেষের ভক্তির পাত্র, বা অবস্থাবিশেষের ভক্তির পাত্র। এ ভক্তিকে আজ্ঞাকারিতা বা সম্মান বলিলেও চলে। যে কোন কার্য্যনির্ব্বাহার্থে অপর ব্যক্তির আজ্ঞাকারিতা স্বীকার করে, সেই অপর ব্যক্তি তাহার ভক্তির, নিতান্ত পক্ষে, তাহার সম্মানের পাত্র হওয়া উচিত। ইংরেজীতে ইহার একটি বেশ নাম আছে-Subordination । এই নামে আগে Official Subordination মনে পড়ে। এ দেশে সে সামগ্রীর অভাব নাই-কিন্তু যাহা আছে, তাহা বড় ভাল জিনিস নহে। ভক্তি নাই, ভয় আছে। ভক্তি মনুষ্যের শ্রেষ্ঠ বৃত্তি, ভয় একটা সর্ব্বনিকৃষ্ট বৃত্তির মধ্যে। ভয়ের মত মানসিক অবনতির গুরুতর কারণ অল্পই আছে। উপরওয়ালার আজ্ঞা পালন করিবে, তাঁহাকে সম্মান করিবে, পার ভক্তি করিবে, কিন্তু কদাচ ভয় করিবে না। কিন্তু Official Subordination ভিন্ন অন্য এক জাতীয় আজ্ঞাকারিতা প্রয়োজনীয়। সেটা আমাদের দেশের পক্ষে বড় গুরুতর কথা। ধর্ম্ম কর্ম্ম অনেকই সমাজের মঙ্গলার্থ। সে সকল কাজ সচরাচর, পাঁচ জনে মিলিয়া করিতে হয়-একজনে হয় না। যাহা পাঁচ জনে মিলিয়া করিতে হয়, তাহাতে ঐক্য চাই। ঐক্য জন্য ইহাই প্রয়োজনীয় যে, এক জন নায়ক হইবে, আর অপরকে তাহার এবং পর্য্যায়ক্রমে অন্যান্যের বশবর্ত্তী হইয়া কাজ করিতে হইবে। এখানেও Subordination প্রয়োজনীয়। কাজেই ইহা একটি গুরুতর ধর্ম্ম। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের সমাজে এ সামগ্রী নাই। যে কাজ দশ জনে মিলিয়া মিশিয়া করিতে হইবে, তাহাতে সকলেই স্ব স্ব প্রধান হইতে চাহে, কেহ কাহারও আজ্ঞা স্বীকার না করায় সব বৃথা হয়। এমন অনেক সময় হয় যে, নিকৃষ্ট ব্যক্তি নেতা, শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি অধীন হয়। এ স্থানে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কর্ত্তব্য যে, নিকৃষ্টকে শ্রেষ্ঠ মনে করিয়া তাহার আজ্ঞা বহন করেন-নহিলে কার্য্যোদ্ধার হইবে না। কিন্তু আমাদের দেশের লোক কোন মতেই তাহা স্বীকার করেন না। তাই আমাদের সামাজিক উন্নতি এত অল্প।
(৬) আর ইহাও ভক্তিতত্ত্বের অন্তর্গত কথা যে, যাহার যে বিষয়ে নৈপুণ্য আছে, সে বিষয়ে তাহাকে সম্মান করিতে হইবে। বয়োজ্যেষ্ঠকেও কেবল বয়োজ্যেষ্ঠ বলিয়া সম্মান করিবে।
(৭) সমাজকে ভক্তি করিবে। ইহা স্মরণ রাখিবে যে, মনুষ্যের যত গুণ আছে, সবই সমাজে আছে। সমাজ আমাদের শিক্ষাদাতা, দণ্ডপ্রণেতা, ভরণপোষণ এবং রক্ষাকর্ত্তা। সমাজই রাজা, সমাজই শিক্ষক। ভক্তিভাবে সমাজের উপকারে যত্নবান্ হইবে। এই তত্ত্বের সম্প্রসারণ করিয়া ওগুস্ত কোম্ৎ “মানবদেবীর” পূজার বিধান করিয়াছেন। সুতরাং এ বিষয়ে আর বেশী বলিবার প্রয়োজন নাই।
এখন ভক্তির অভাবে, আমাদের দেশে কি অমঙ্গল ও বিশৃঙ্খলা ঘটিতেছে দেখ। হিন্দুর মধ্যে ভক্তির কিছুই অভাব ছিল না। ভক্তি, হিন্দুধর্ম্মের ও হিন্দুশাস্ত্রের একটি প্রধান উপাদান। কিন্তু এখন শিক্ষিত ও অর্দ্ধশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভক্তি একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। পাশ্চাত্ত্য সাম্যবাদের প্রকৃত ধর্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া, তাঁহারা এই বিকৃত তাৎপর্য্য বুঝিয়া লইয়াছেন যে, মনুষ্যে মনুষ্যে বুঝি সর্ব্বত্র সর্ব্বথাই সমান-কেহ কাহাকে ভক্তি করিবার প্রয়োজন করে না। ভক্তি, যাহা মনুষ্যের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বৃত্তি, তাহা হীনতার চিহ্ন বলিয়া তাঁহাদের বোধ হইয়াছে। পিতা এখন “My dear father”-অথবা বুড়ো বেটা। মাতা, বাপের পরিবার। বড় ভাই, জ্ঞাতি মাত্র। শিক্ষক, মাষ্টার বেটা। পুরোহিত চালকলা-লোলুপ ভণ্ড। যে স্বামী দেবতা ছিলেন,-তিনি এখন কেবল প্রিয় বন্ধু মাত্র-কেহ বা ভৃত্যও মনে করেন। স্ত্রীকে আর আমরা লক্ষ্মীস্বরূপা মনে করিতে পারি না-কেন না, লক্ষ্মীই আর মানি না। এই গেল গৃহের ভিতর। গৃহের বাহিরে অনেকে রাজাকে শত্রু মনে করিয়া থাকেন। রাজপুরুষ, অত্যাচারকারী রাক্ষস। সমাজশিক্ষকেরা, কেবল আমাদের সমালোচনশক্তির পরিচয় দিবার স্থল-গালি ও বিদ্রূপের স্থান। ধার্ম্মিক বা জ্ঞানী বলিয়া কাহাকেও মানি না। যদি মানি, তবে ধার্ম্মিককে “গোবেচারা” বলিয়া দয়া করি-জ্ঞানীকে শিক্ষা দিবার জন্য ব্যস্ত হই। কেহ কাহারও অপেক্ষা নিকৃষ্ট বলিয়া স্বীকার করিব না, সেই জন্য কেহ কাহারও অনুবর্ত্তী হইয়া চলিব না; কাজেই ঐক্যের সহিত কোন সামাজিক মঙ্গল সাধিত করিতে পারি না। নৈপুণ্যের আদর করিব না; বৃদ্ধের বহুদর্শিতা লইয়া ব্যঙ্গ করি। সমাজের ভয়ে জড়সড় থাকি, কিন্তু সমাজকে ভক্তি করি না। তাই গৃহ নরক হইয়া উঠিতেছে, রাজনৈতিক ভেদ ঘটিতেছে, শিক্ষা অনিষ্টকারী হইতেছে, সমাজ অনুন্নত ও বিশৃঙ্খল রহিয়াছে; আপনাদিগের চিত্ত অপরিশুদ্ধ ও আত্মাদরে ভরিয়া রহিয়াছে।
শিষ্য। উন্নতির জন্য ভক্তির যে এত প্রয়োজন, তাহা আমি কখনও মনে করি নাই।
গুরু। তাই আমি ভক্তিকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ বৃত্তি বলিতেছিলাম। এ শুধু মনুষ্যভক্তির কথাই বলিয়াছি। আগামী দিবস ঈশ্বরভক্তির কথা শুনিও। ভক্তির শ্রেষ্ঠতা আরও বিশেষরূপে বুঝিতে পারিবে।
১১.ঈশ্বরে ভক্তি
শিষ্য। আজ, ঈশ্বরে ভক্তি সম্বন্ধে কিছু উপদেশের প্রার্থনা করি।
গুরু। যাহা কিছু তুমি আমার নিকট শুনিয়াছ, আর যাহা কিছু শুনিবে, তাহাই ঈশ্বরভক্তিসম্বন্ধীয় উপদেশ; কেবল বলিবার এবং বুঝিবার গোল আছে। “ভক্তি” কথাটা হিন্দুধর্ম্মে বড় গুরুতর অর্থবাচক, এবং হিন্দুধর্ম্মে ইহা বড় প্রসিদ্ধ। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মবেত্তারা ইহা নানা প্রকারে বুঝাইয়াছেন এবং খৃষ্টাদি আর্য্যেতর ধর্ম্মবেত্তারাও ভক্তিবাদী। সকলের উক্তির সংশ্লেষ এবং অত্যুন্নত ভক্তদিগের চরিত্রের বিশ্লেষ দ্বারা, আমি ভক্তির যে স্বরূপ স্থির করিয়াছি, তাহা এক কথায় বলিতেছি, মনোযোগপূর্ব্বক শ্রবণ কর এবং যত্নপূর্ব্বক স্মরণ রাখিও। নহিলে আমার সকল পরিশ্রম বিফল হইবে।
শিষ্য। আজ্ঞা করুন।
গুরু। যখন মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরমুখী বা ঈশ্বরানুবর্ত্তিনী হয়, সেই অবস্থাই ভক্তি।
শিষ্য। বুঝিলাম না।
গুরু। অর্থাৎ যখন জ্ঞানার্জ্জনী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরানুসন্ধান করে, কার্য্যকারিণী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরে অর্পিত হয়, চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরের সৌন্দর্য্যই উপভোগ করে, এবং শারীরিকী বৃত্তিগুলি ঈশ্বরের কার্য্যসাধনে বা ঈশ্বরের আজ্ঞাপালনে নিযুক্ত হয়, সেই অবস্থাকেই ভক্তি বলি। যাহার জ্ঞান ঈশ্বরে, কর্ম্ম ঈশ্বরে, আনন্দ ঈশ্বরে এবং শরীরার্পণ ঈশ্বরে, তাহারই ঈশ্বরে ভক্তি হইয়াছে। অথবা-ঈশ্বরসম্বন্ধিনী ভক্তির উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি ও পরিণতি হইয়াছে।
শিষ্য। এ কথার প্রতি আমার প্রথম আপত্তি এই যে, আপনি এ পর্য্যন্ত ভক্তি অন্যান্য বৃত্তির মধ্যে একটি বৃত্তি বলিয়া বুঝাইয়া আসিয়াছেন, কিন্তু এখন সকল বৃত্তির সমষ্টিকে ভক্তি বলিতেছেন।
গুরু। তাহা নহে। ভক্তি একই বৃত্তি। আমার কথার তাৎপর্য্য এই যে, যখন সকল বৃত্তিগুলিই এই এক ভক্তিবৃত্তির অনুগামী হইবে, তখনই ভক্তির উপযুক্ত স্ফূর্ত্তি হইল। এই কথার দ্বারা, বৃত্তিমধ্যে ভক্তির যে শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলিয়াছিলাম, তাহাই সমর্থিত হইল। ভক্তি ঈশ্বরার্পিতা হইলে, আর সকল বৃত্তিগুলি উহার অধীন হইবে, উহার প্রদর্শিত পথে যাইবে, ইহাই আমার কথার স্থূল তাৎপর্য্য। এমন তাৎপর্য্য নহে যে, সকল বৃত্তির সমষ্টি ভক্তি।
শিষ্য। কিন্তু তাহা হইলে সামঞ্জস্য কোথা গেল? আপনি বলিয়াছেন যে, সকল বৃত্তিগুলির সমুচিত স্ফূর্ত্তিই মনুষ্যত্ব। সেই সমুচিত স্ফূর্ত্তির এই অর্থ করিয়াছেন যে, কোন বৃত্তির সমধিক স্ফূর্ত্তির দ্বারা অন্য বৃত্তির সমুচিত স্ফূর্ত্তির অবরোধ না হয়। কিন্তু সকল বৃত্তিই যদি এই এক ভক্তিবৃত্তির অধীন হইল, ভক্তিই যদি অন্য বৃত্তিগুলিকে শাসিত করিতে লাগিল, তবে পরস্পরের সামঞ্জস্য কোথায় রহিল?
গুরু। ভক্তির অনুবর্ত্তিতা কোন বৃত্তিরই চরম স্ফূর্ত্তির বিঘ্ন করে না। মনুষ্যের বৃত্তি মাত্রেরই যে কিছু উদ্দেশ্য হইতে পারে, তন্মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা ঈশ্বরই মহৎ। ঈশ্বর যে বৃত্তির উদ্দেশ্য,-অনন্ত মঙ্গল, অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত ধর্ম্ম, অনন্ত সৌন্দর্য্য, অনন্ত শক্তি, অনন্তই যে বৃত্তির উদ্দেশ্য,-তাহার আবার অবরোধ কোথায়? ভক্তিশাসিতাবস্থাই সকল বৃত্তির যথার্থ সামঞ্জস্য।
শিষ্য। তবে আপনি যে মনুষ্যত্বতত্ত্ব এবং অনুশীলনধর্ম্ম আমাকে শিখাইতেছেন, তাহার স্থূল তাৎপর্য্য কি এই যে, ঈশ্বরে ভক্তিই পূর্ণ মনুষ্যত্ব, এবং অনুশীলনের একমাত্র উদ্দেশ্য সেই ঈশ্বরে ভক্তি?
গুরু। অনুশীলনধর্ম্মের মর্ম্মে এই কথা আছে বটে যে, সকল বৃত্তির ঈশ্বরে সমর্পণ ব্যতীত মনুষ্যত্ব নাই। ইহাই প্রকৃত কৃষ্ণার্পণ, ইহাই প্রকৃত নিষ্কাম ধর্ম্ম। ইহাই স্থায়ী সুখ। ইহারই নামান্তর চিত্তশুদ্ধি। ইহারই লক্ষণ “ভক্তি, প্রীতি, শান্তি”। ইহাই ধর্ম্ম-ইহা ভিন্ন ধর্ম্মান্তর নাই। আমি ইহাই শিখাইতেছি। কিন্তু তুমি এমন মনে করিও না যে, এই কথা বুঝিলেই তুমি অনুশীলনধর্ম্ম বুঝিলে।
শিষ্য। আমি যে এখনও কিছু বুঝি নাই, তাহা আমি স্বয়ং স্বীকার করিতেছি। অনুশীলনধর্ম্মে এই তত্ত্বের প্রকৃত স্থান কি, তাহা এখনও বুঝিতে পারি নাই। আপনি বৃত্তি যে ভাবে বুঝাইয়াছেন, তাহাতে শারীরিক বল, অর্থাৎ মাংসপেশীর বল একটা Faculty না হউক, একটা বৃত্তি বটে। অনুশীলনধর্ম্মের বিধানানুসারে, ইহার সমুচিত অনুশীলন চাই। মনে করুন, রোগ দারিদ্র্য আলস্য বা তাদৃশ অন্য কোন কারণে কোন ব্যক্তির এই বৃত্তির সমুচিত স্ফূর্ত্তি হয় নাই। তাহার কি ঈশ্বরভক্তি ঘটিতে পারে না?
গুরু। আমি বলিয়াছি যে, যে অবস্থায় মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরানুবর্ত্তী হয়, তাহাই ভক্তি। ঐ ব্যক্তির শারীরিক বল বেশী থাক, অল্প থাক, যতটুকু আছে, তাহা যদি ঈশ্বরানুবর্ত্তী হয়, অর্থাৎ ঈশ্বরানুমত কার্য্যে নিযুক্ত হয়-আর অন্য বৃত্তিগুলিও সেইরূপ হয়, তবে তাহার ঈশ্বরে ভক্তি হইয়াছে। তবে অনুশীলনের অভাবে, ঐ ভক্তির কার্য্যকারিতার সেই পরিমাণে ত্রুটি ঘটিবে। এক জন দস্যু একজন ভাল মানুষকে পীড়িত করিতেছে। মনে কর, দুই ব্যক্তি তাহা দেখিল, মনে কর, দুই জনেই ঈশ্বরে ভক্তিযুক্ত, কিন্তু এক জন বলবান্, অপর দুর্ব্বল। যে বলবান্, সে ভাল মানুষকে দস্যুহস্ত হইতে মুক্ত করিল, কিন্তু যে দুর্ব্বল, সে চেষ্টা করিয়াও পারিল না। এই পরিমাণে, বৃত্তিবিশেষের অনুশীলনের অভাবে, দুর্ব্বল ব্যক্তির মনুষ্যত্বের অসম্পূর্ণতা বলা যাইতে পারে, কিন্তু ভক্তির ত্রুটি বলা যায় না। বৃত্তি সকলের সমুচিত স্ফূর্ত্তি ব্যতীত মনুষ্যত্ব নাই; এবং সেই বৃত্তিগুলি ভক্তির অনুগামী না হইলেও মনুষ্যত্ব নাই। উভয়ের সমাবেশেই সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব। ইহাতে বৃত্তিগুলির স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হইতেছে, অথচ ভক্তির প্রাধান্য বজায় থাকিতেছে। তাই বলিতেছিলাম যে বৃত্তিগুলির ঈশ্বরসমর্পণ, এই কথা বুঝিলেই মনুষ্যত্ব বুঝিলে না। তাহার সঙ্গে এটুকুও বুঝা চাই।
শিষ্য। এখন আরও আপত্তি আছে। যে উপদেশ অনুসারে কার্য্য হইতে পারে না, তাহা উপদেশই নহে। সকল বৃত্তিগুলিই কি ঈশ্বরগামী করা যায়? ক্রোধ একটা বৃত্তি, ক্রোধ কি ঈশ্বরগামী করা যায়?
গুরু। জগতে অতুল সেই মহাক্রোধগীতি তোমার কি স্মরণ হয়?
ক্রোধং প্রভো সংহর সংহরেতি,
যাবৎ গিরঃ খে মরুতাং চরন্তি।
তাবৎ স বহ্নির্ভবনেত্রজন্মা
ভস্মাবশেষং মদনঞ্চকার ||
এই ক্রোধ মহাপবিত্র ক্রোধ-কেন না, যোগভঙ্গকারী কুপ্রবৃত্তি ইহার দ্বারা বিনষ্ট হইল। ইহা স্বয়ং ঈশ্বরের ক্রোধ। অন্য এক নীচ বৃত্তি যে ব্যাসদেব ঈশ্বরানুবর্ত্তী হইয়াছিল, তাহার এক অতি চমৎকার উদাহরণ মহাভারতে আছে। কিন্তু তুমি ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষ। আমি তোমাকে তাহা বুঝাইতে পারিব না।
শিষ্য। আরও আপত্তি আছে-
গুরু। থাকাই সম্ভব। “যখন মনুষ্যের সকল বৃত্তিগুলিই ঈশ্বরমুখী বা ঈশ্বরানুবর্ত্তী হয়, সেই অবস্থাই ভক্তি।” এ কথাটা এত গুরুতর, ইহার ভিতর এমন সকল গুরুতর তত্ত্ব নিহিত আছে যে, ইহা তুমি যে একবার শুনিয়াই বুঝিতে পারিবে, এমন সম্ভাবনা কিছু মাত্র নাই। অনেক সন্দেহ উপস্থিত হইবে, অনেক গোলমাল ঠেকিবে, অনেক ছিদ্র দেখিবে, হয়ত পরিশেষে ইহাকে অর্থশূন্য প্রলাপ বোধ হইবে। কিন্তু তাহা হইলেও সহসা নিরাশ হইও না। দিন দিন, মাস মাস, বৎসর বৎসর এই তত্ত্বের চিন্তা করিও। কার্য্যক্ষেত্রে ইহাকে ব্যবহৃত করিবার চেষ্টা করিও। ইন্ধনপুষ্ট অগ্নির ন্যায় ইহা ক্রমশঃ তোমার চক্ষে পরিস্ফুট হইতে থাকিবে। যদি তাহা হয়, তাহা হইলে তোমার জীবন সার্থক হইল বিবেচনা করিবে। মনুষ্যের শিক্ষণীয় এমন গুরুতর তত্ত্ব আর নাই। এক জন মনুষ্যের সমস্ত জীবন সৎশিক্ষায় নিযুক্ত করিয়া, সে যদি শেষে এই তত্ত্বে আসিয়া উপস্থিত হয়, তবেই তাহার জীবন সার্থক জানিবে।
শিষ্য। যাহা এরূপ দুষ্প্রাপ্য, তাহা আপনিই বা কোথায় পাইলেন?
গুরু। অতি তরুণ অবস্থা হইতেই আমার মনে এই প্রশ্ন উদিত হইত, “এ জীবন লইয়া কি করিব?” “লইয়া কি করিতে হয়?” সমস্ত জীবন ইহারই উত্তর খুঁজিয়াছি। উত্তর খুঁজিতে খুঁজিতে জীবন প্রায় কাটিয়া গিয়াছে। অনেক প্রকার লোক-প্রচলিত উত্তর পাইয়াছি, তাহার সত্যাসত্য নিরূপণ জন্য অনেক ভোগ ভুগিয়াছি, অনেক কষ্ট পাইয়াছি। যথাসাধ্য পড়িয়াছি, অনেক লিখিয়াছি, অনেক লোকের সঙ্গে কথোপকথন করিয়াছি, এবং কার্য্যক্ষেত্রে মিলিত হইয়াছি। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, দেশী, বিদেশী শাস্ত্র যথাসাধ্য অধ্যয়ন করিয়াছি। জীবনের সার্থকতা সম্পাদন জন্য প্রাণপাত করিয়া পরিশ্রম করিয়াছি। এই পরিশ্রম, এই কষ্ট ভোগের ফলে এইটুকু শিখিয়াছি যে, সকল বৃত্তির ঈশ্বরানুবর্ত্তিতাই ভক্তি, এবং সেই ভক্তি ব্যতীত মনুষ্যত্ব নাই। “জীবন লইয়া কি করিব।” এ প্রশ্নের এই উত্তর পাইয়াছি। ইহাই যথার্থ উত্তর, আর সকল উত্তর অযথার্থ। লোকের সমস্ত জীবনের পরিশ্রমের এই শেষ ফল; এই এক মাত্র সুফল। তুমি জিজ্ঞাসা করিতেছিলে, আমি এ তত্ত্ব কোথায় পাইলাম। সমস্ত জীবন ধরিয়া, আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়া এত দিনে পাইয়াছি। তুমি এক দিনে ইহার কি বুঝিবে?
শিষ্য। আপনার কথাতে আমি ইহাই বুঝিতেছি যে, ভক্তির লক্ষণ সম্বন্ধে আমাকে যে উপদেশ দিলেন, ইহা আপনার নিজের মত। আর্য্য ঋষিরা এ তত্ত্ব অনবগত ছিলেন।
গুরু। মূর্খ! আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির এমন কি শক্তি থাকিবার সম্ভাবনা যে, যাহা আর্য্য ঋষিগণ জানিতেন না-আমি তাহা আবিষ্কৃত করিতে পারি। আমি যাহা বলিতেছিলাম, তাহার তাৎপর্য্য এই যে, সমস্ত জীবন চেষ্টা করিয়া তাঁহাদিগের শিক্ষার মর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছি। তবে, আমি যে ভাষায় তোমাকে ভক্তি বুঝাইলাম, সে ভাষায়, সে কথায় তাঁহারা ভক্তিতত্ত্ব বুঝান নাই। তোমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর লোক-ঊনবিংশ শতাব্দীর ভাষাতেই তোমাদিগকে বুঝাইতে হয়। ভাষার প্রভেদ হইতেছে বটে, কিন্তু সত্য নিত্য। ভক্তি শাণ্ডিল্যের সময়ে যাহা ছিল, তাহাই আছে। ভক্তির যথার্থ স্বরূপ যাহা, তাহা আর্য্য ঋষিদিগের উপদেশমধ্যে প্রাপ্তব্য তবে যেমন সমুদ্রনিহিত রত্নের যথার্থ স্বরূপ, ডুব দিয়া না দেখিলে দেখিতে পাওয়া যায় না, তেমনি অগাধ হিন্দুশাস্ত্রের ভিতরে ডুব না দিলে, তদন্তর্নিহিত চিনিতে পারা যায় না।
শিষ্য। আমার ইচ্ছা আপনার নিকট তাঁহাদের কৃত ভক্তিব্যাখ্যা শুনি।
গুরু। শুনা নিতান্তই আবশ্যক; কেন না, ভক্তি হিন্দুরই জিনিস। খৃষ্টধর্ম্মে ভক্তিবাদ আছে বটে, কিন্তু হিন্দুরই নিকট ভক্তির যথা যথার্থ পরিণামপ্রাপ্তি হইয়াছে। কিন্তু তাঁহাদিগের কৃত ভক্তিব্যাখ্যা সবিস্তারে বলিবার বা শুনিবার আমার বা তোমার অবকাশ হইবে না। আর আমাদিগের মুখ্য উদ্দেশ্য অনুশীলনধর্ম্ম বুঝা, তাহার জন্য সেরূপ সবিস্তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই; স্থূল কথা তোমাকে বলিয়া যাইব।
শিষ্য। আগে বলুন, ভক্তিবাদ কি চিরকালই হিন্দুধর্ম্মের অংশ?
গুরু। না, তাহা নহে। বৈদিক ধর্ম্মে ভক্তি নাই। বেদের ধর্ম্মের পরিচয়, বোধ হয়, তুমি কিছু জান। সাধারণ উপাসকের সহিত সচরাচর উপাস্য দেবের যে সম্বন্ধ দেখা যায়, বৈদিক ধর্ম্মে উপাস্য উপাসকের সেই সম্বন্ধ ছিল। ‘হে ঠাকুর! আমার প্রদত্ত সেই সোমরস পান কর! হবি ভোজন কর, আর আমাকে ধন দাও, সম্পদ্ দাও, পুত্র দাও, গোরু দাও, শস্য দাও, আমার শত্রুকে পরাস্ত কর।’ বড় জোর বলিলেন, ‘আমার পাপ ধ্বংস কর।’ দেবগণকে এইরূপ অভিপ্রায়ে প্রসন্ন করিবার জন্য বৈদিকেরা যজ্ঞাদি করিতেন। এইরূপ কাম্য বস্তুর উদ্দেশ্যে যজ্ঞাদি করাকে কাম্য কর্ম্ম বলে। কাম্যাদি কর্ম্মাত্মক যে উপাসনা, তাহার সাধারণ নাম কর্ম্ম। বৈদিক কালের শেষভাগে এইরূপ কর্ম্মাত্মক ধর্ম্মের অতিশয় প্রাদুর্ভব হইয়াছিল। যাগ যজ্ঞের দৌরাত্ম্যে ধর্ম্মের প্রকৃত মর্ম্ম বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। এমন অবস্থায় উচ্চ শ্রেণীর প্রতিভাশালী ব্যক্তিগণ দেখিতে পাইলেন যে, এই কর্ম্মাত্মক ধর্ম্ম বৃথাধর্ম্ম। তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই বুঝিয়াছিলেন যে, বৈদিক দেবদেবীর কল্পনায় এই জগতের অস্তিত্ব বুঝা যায় না; ভিতরে ইহার অনন্ত অজ্ঞেয় কারণ আছে। তাঁহারা সেই কারণের অনুসন্ধানে তৎপর হইলেন।
এই সকল কারণে কর্ম্মের উপর অনেকে বীতশ্রদ্ধ হইলেন। তাঁহারা ত্রিবিধ বিপ্লব উপস্থিত করিলেন-সেই বিপ্লবের ফলে আশিয়া প্রদেশ অদ্যাপি শাসিত। এক দল চার্ব্বাক,-তাঁহারা বলিলেন, কর্ম্মকাণ্ড সকলই মিথ্যা-খাও দাও, নেচে বেড়াও। দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের সৃষ্টিকর্ত্তা ও নেতা শাক্যসিংহ-তিনি বলিলেন, কর্ম্মফল মানি বটে, কিন্তু কর্ম্ম হইতেই দুঃখ। কর্ম্ম হইতে পুনর্জ্জন্ম, অতএব কর্ম্মের ধ্বংস কর, তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া চিত্তসংযমপূর্ব্বক অষ্টাঙ্গ ধর্ম্মপথে গিয়া নির্ব্বাণ লাভ কর। তৃতীয় বিপ্লব দার্শনিকদিগের দ্বারা উপস্থিত হইয়াছিল। তাঁহারা প্রায় ব্রহ্মবাদী।। তাঁহারা দেখিলেন যে, জগতের যে অনন্ত কারণভূত চৈতন্যের অনুসন্ধানে তাঁহারা প্রবৃত্ত, তাহা অতিশয় দুর্জ্ঞেয়। সেই ব্রহ্ম জানিতে পারিলে-সেই জগতের অন্তরাত্মা বা পরমাত্মার সঙ্গে আমাদের কি সম্বন্ধ, এবং জগতের সঙ্গেই বা তাঁহার বা আমাদের কি সম্বন্ধ, তাহা জানিতে পারিলে, বুঝা যাইতে পারে যে, এ জীবন লইয়া কি করিতে হইবে। সেটা জানা কঠিন-তাহা জানাই ধর্ম্ম। অতএব জ্ঞানই ধর্ম্ম-জ্ঞানেই নিঃশ্রেয়স। বেদের যে অংশকে উপনিষদ্ বলা যায়, তাহা এই প্রথম জ্ঞানবাদীদিগের কীর্ত্তি। ব্রহ্মনিরূপণ এবং আত্মজ্ঞানই উপনিষদ্ সকলের উদ্দেশ্য। তার পর ছয় দর্শনে সেই জ্ঞানবাদ আরও বিবর্দ্ধিত ও প্রচারিত হইয়াছে। কপিলের সাংখ্যে ব্রহ্ম পরিত্যক্ত হইলেও সে দর্শনশাস্ত্র জ্ঞানবাদাত্মক। দর্শনের মধ্যে কেবল পূর্ব্বমীমাংসা কর্ম্মবাদী-আর সকলেই জ্ঞানবাদী।
শিষ্য। জ্ঞানবাদ বড় অসম্পূর্ণ বলিয়া আমার বোধ হয়। জ্ঞানে ঈশ্বরকে জানিতে পারি বটে, কিন্তু জ্ঞানে কি ঈশ্বরকে পাওয়া যায়? জানিলেই কি পাওয়া যায়? ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার একত্ম, মনে করুন বুঝিতে পারিলাম-বুঝিতে পারিলেই কি ঈশ্বরে মিলিত হইলাম? দুইকে এক করিয়া মিলাইয়া দিবে কে?
গুরু। এই ছিদ্রেই ভক্তিবাদের সৃষ্টি ভক্তিবাদী বলিলেন, জ্ঞানে ঈশ্বর জানিতে পারি বটে, কিন্তু জানিতে পারিলেই কি তাঁহাকে পাইলাম? অনেক জিনিস আমরা জানিয়াছি-জানিয়াছি বলিয়া কি তাহা পাইয়াছি? আমরা যাহাকে দ্বেষ করি, তাহাকেও ত জানি, কিন্তু তাহার সঙ্গে কি আমরা মিলিত হইয়াছি? আমরা যদি ঈশ্বরের প্রতি দ্বেষ করি, তবে কি তাঁহাকে পাইব? বল যাহার প্রতি আমাদের অনুরাগ আছে, তাহাকে পাইবার সম্ভাবনা। যে শরীরী, তাহাকে কেবল অনুরাগে না পাইলে না পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু যিনি অশরীরী তিনি কেবল অন্তঃকরণের দ্বারাই প্রাপ্য। অতএব তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ থাকিলেই আমরা তাঁহাকে পাইব। সেই প্রকারের অনুরাগের নাম ভক্তি। শাণ্ডিল্যসূত্রের দ্বিতীয় সূত্র এই-“সা (ভক্তিঃ) পরানুরক্তিরীশ্বরে।”
শিষ্য। ভক্তিবাদের উৎপত্তির এই ইতিবৃত্ত শুনিয়া আমি বিশেষ আপ্যায়িত হইলাম। ইহা না শুনিলে ভক্তিবাদ ভাল করিয়া বুঝিতে পারিতাম না। শুনিয়া আর একটা কথা মনে উদয় হইতেছে। সাহেবেরা এবং দয়ানন্দ সরস্বতী প্রভৃতি এদেশীয় পণ্ডিতেরা বৈদিক ধর্ম্মকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম বলিয়া থাকেন, এবং পৌরাণিক বা আধুনিক হিন্দুধর্ম্মকে নিকৃষ্ট বলিয়া থাকেন। কিন্তু এখন দেখিতেছি, এ কথা অতিশয় অযথার্থ। ভক্তিশূন্য যে ধর্ম্ম, তাহা অসম্পূর্ণ বা নিকৃষ্ট ধর্ম্ম-অতএব বেদে যখন ভক্তি নাই, তখন বৈদিক ধর্ম্মই নিকৃষ্ট, পৌরাণিক বা আধুনিক বৈষ্ণবাদি ধর্ম্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম। যাঁহারা এ সকল ধর্ম্মের লোপ করিয়া বৈদিক ধর্ম্মের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেন, তাঁহাদিগকে ভ্রান্ত বিবেচনা করি।
গুরু। কথা যথার্থ। তবে ইহাও বলিতে হয় যে, বেদে যে ভক্তিবাদ কোথাও নাই, ইহাও ঠিক নহে। শাণ্ডিল্যসূত্রের টীকাকার স্বপ্নেশ্বর ছান্দোগ্য উপনিষদ্ হইতে একটি বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহাতে ভক্তি শব্দ ব্যবহৃত না থাকিলেও ভক্তিবাদের সার মর্ম্ম তাহাতে আছে। বচনটি এই আত্মৈবেদং সর্বমিতি। স বা এষ এব পশ্যন্নেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দঃ স স্বরাড়্ ভবতীতি।”
ইহার অর্থ এই যে, আত্মা এই সকলই (অর্থাৎ পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছে)। যে ইহা দেখিয়া, ইহা ভাবিয়া, ইহা জানিয়া, আত্মায় রত হয়, আত্মাতে ক্রীড়াশীল হয়, আত্মাই যাহার মিথুন (সহচর), আত্মাই যাহার আনন্দ, সে স্বরাজ (আপনার রাজা বা আপনার দ্বারা রঞ্জিত) হয়। ইহা যথার্থ ভক্তিবাদ।
১২.ভক্তি – ভগবদ্গীতা-স্থূল উদ্দেশ্য
গুরু। শ্রীমদ্ভগদ্গীতাই ভক্তিতত্ত্বের প্রধান গ্রন্থ। কিন্তু গীতোক্ত ভক্তিতত্ত্ব তোমাকে বুঝাইবার আগে ঐতিহাসিক প্রথাক্রমে বেদে যতটুকু ভক্তিতত্ত্ব আছে, তাহা তোমাকে শুনান ভাল। বেদে এ কথা প্রায় নাই, ছান্দোগ্য উপনিষদে কিছু আছে, ইহা বলিয়াছি। যাহা আছে, তাহার সহিত শাণ্ডিল্য মহর্ষির নাম সংযুক্ত।
শিষ্য। যিনি ভক্তিসূত্রের প্রণেতা?
গুরু। প্রথমে তোমাকে আমার বলা কর্ত্তব্য যে, দুই জন শাণ্ডিল্য ছিলেন, বোধ হয়। এক জন উপনিষদযুক্ত এই ঋষি। আর এক জন শাণ্ডিল্য-সূত্রের প্রণেতা। প্রথমোক্ত শাণ্ডিল্য প্রাচীন ঋষি, দ্বিতীয় শাণ্ডিল্য অপেক্ষাকৃত আধুনিক পণ্ডিত। ভক্তিসূত্রের ৩১ সূত্রে প্রাচীন শাণ্ডিল্যের নাম উদ্ধৃত হইয়াছে।
শিষ্য। অথবা এমন হইতে পারে যে, আধুনিক সূত্রকার প্রাচীন ঋষির নামে আপনার গ্রন্থখানি চালাইয়াছেন। এক্ষণে প্রাচীন ঋষি শাণ্ডিল্যের মতই ব্যাখ্যা করুন।
গুরু। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই প্রাচীন ঋষিপ্রণীত কোন গ্রন্থ বর্ত্তমান নাই। বেদান্তসূত্রের শঙ্করাচার্য্য যে ভাষ্য করিয়াছেন, তন্মধ্যে সূত্রবিশেষের ভাষ্যের ভাবার্থ হইতে কোলব্রুক সাহেব এইরূপ অনুমান করেন, পঞ্চরাত্রের প্রণেতা এই প্রাচীন ঋষি শাণ্ডিল্য। তাহা হইতেও পারে, না হইতেও পারে; পঞ্চরাত্রে ভাগবত ধর্ম্ম কথিত হইয়াছে বটে, কিন্তু এইরূপ সামান্য মূলের উপর নির্ভর করিয়া স্থির করা যায় না যে, শাণ্ডিল্যই পঞ্চরাত্রের প্রণেতা। ফলে প্রাচীন ঋষি শাণ্ডিল্য যে ভক্তিধর্ম্মের এক জন প্রবর্ত্তক, তাহা বিবেচনা করিবার অনেক কারণ আছে। কথিত ভাষ্যে জ্ঞানবাদী শঙ্কর, ভক্তিবাদী শাণ্ডিল্যের নিন্দা করিয়া বলিতেছেন-
“বেদপ্রতিষেধশ্চ ভবতি। চতুর্ষু বেদেষু পরং শ্রেয়োহলব্ধ্বা শাণ্ডিল্য ইদং শাস্ত্রমধিগতবান্। ইত্যাদি বেদনিন্দাদর্শনাৎ। তস্মাদসঙ্গতা এষা কল্পনা ইতি সিদ্ধঃ।”
অর্থাৎ, “ইহাতে বেদের বিপ্রতিষেধ হইতেছে। চতুর্ব্বেদে পরং শ্রেয়ঃ লাভ না করিয়া শাণ্ডিল্য এই শাস্ত্র অধিগমন করিয়াছিলেন। এই সকল বেদনিন্দা দর্শন করায় সিদ্ধ হইতেছে যে, এ সকল কল্পনা অসঙ্গত।”
শিষ্য। কিন্তু এই প্রাচীন ঋষি শাণ্ডিল্য ভক্তিবাদে কত দূর অগ্রসর হইয়াছিলেন, তাহা জানিবার কিছু উপায় আছে কি?
গুরু। কিছু আছে। ছান্দোগ্য উপনিষদের তৃতীয় প্রপাঠকের চতুর্দ্দশ অধ্যায় হইতে একটু পড়িতেছি, শ্রবণ কর।-
“সর্ব্বকর্ম্মা সর্ব্বকামঃ সর্ব্বগন্ধাঃ সর্ব্বরসঃ সর্ব্বমিদমভ্যাত্তোহবাক্যনাদর এষ ম আত্মান্তর্হৃদয় এতদ্ব্রহ্মৈতমিতঃ প্রেত্যাভিসম্ভাবিতাস্মীতি যস্য স্যাদগ্ধা ন বিচিকিৎসাস্তীতি হ স্মাহ শাণ্ডিল্যঃ শাণ্ডিল্যঃ।”
অর্থাৎ, “সর্ব্বকর্ম্মা, সর্ব্বকাম, সর্ব্বগন্ধা, সর্ব্বরস এই জগতে পরিব্যাপ্ত বাক্যবিহীন, এবং আপ্তকাম হেতু আদরের অপেক্ষা করেন না, এই আমার আত্মা হৃদয়ের মধ্যে, ইনিই ব্রহ্ম। এই লোক হইতে অপসৃতা হইয়া, ইঁহাকেই সুস্পষ্ট অনুভব করিয়া থাকি। যাঁহার ইহাতে শ্রদ্ধা থাকে, তাঁহার ইহাতে সংশয় থাকে না। ইহা শাণ্ডিল্য বলিয়াছেন।”
এ কথা বড় অধিক দূর গেল না। এ সকল উপনিষদের জ্ঞানবাদীরাও বলিয়া থাকেন। “শ্রদ্ধা” কথা ভক্তিবাচক নহে বটে, তবে শ্রদ্ধা থাকিলে সংশয় থাকে না, এ সকল ভক্তির বটে। কিন্তু আসল কথাটা বেদান্তসারে পাওয়া যায়। বেদান্তসারকর্ত্তা সদানন্দাচার্য্য উপাসনা শব্দের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন-“উপাসনানি সগুণব্রহ্মবিষয়কমানব্যাপাররুপাণি শাণ্ডিল্যবিদ্যাদীনি।”
এখন একটু অনুধাবন করিয়া বুঝ। হিন্দুধর্ম্মে ঈশ্বরের দ্বিবিধ কল্পনা আছে-অথবা ঈশ্বরকে হিন্দুরা দুই রকমে বুঝিয়া থাকে। ঈশ্বর নির্গুণ এবং ঈশ্বর সগুণ। তোমাদের ইংরেজিতে যাহাকে “Absolute” বা “Unconditioned” বলে, তাহাই নির্গুণ। যিনি নির্গুণ, তাঁহার কোন উপাসনা হইতে পারে না; যিনি নির্গুণ, তাঁহার কোন গুণানুবাদ করা যাইতে পারে না; যিনি নির্গুণ, যাহার কোন “Conditions of Existence” নাই বা বলা যাইতে পারে না – তাঁহাকে কি বলিয়া ডাকিব? কি বলিয়া তাঁহার চিন্তা করিব? অতএব কেবল সগুণ ঈশ্বরেরই উপাসনা হইতে পারে। নির্গুণবাদে উপাসনা নাই। সগুণ বা ভক্তিবাদী অর্থাৎ শাণ্ডিল্যাদিই উপাসনা করিতে পারেন। অতএব বেদান্তসারের এই কথা হইতে দুইটি বিষয় সিদ্ধ বলিয়া মনে করিতে পারি। প্রথম, সগুণবাদের প্রথম প্রবর্ত্তক শাণ্ডিল্য, ও উপাসনারও প্রথম প্রবর্ত্তক শাণ্ডিল্য। আর ভক্তি সগুণবাদেরই অনুসারিণী।
শিষ্য। তবে কি উপনিষদ্ সমুদায় নির্গুণবাদী?
গুরু। ঈশ্বরবাদীর মধ্যে কেহ প্রকৃত নির্গুণবাদী আছে কি না, সন্দেহ। যে প্রকৃত নির্গুণবাদী, তাহাকে নাস্তিক বলিলেও হয়। তবে, জ্ঞানবাদীরা মায়া নামে ঈশ্বরের একটি শক্তি কল্পনা করেন। সেই মায়াই এই জগৎসৃষ্টির কারণ। সেই মায়ার জন্যই আমরা ঈশ্বরকে জানিতে পারি না। মায়া হইতে বিমুক্ত হইতে পারিলেই ব্রহ্মজ্ঞান জন্মে এবং ব্রহ্মে লীন হইতে পারা যায়। অতএব ঈশ্বর তাঁহাদের কাছে কেবল জ্ঞেয়। সেই জ্ঞান ঠিক “জানা” নহে। সাধন ভিন্ন সেই জ্ঞান জন্মিতে পারে না। শম, দম, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান এবং শ্রদ্ধা, এই ছয় সাধনা। ঈশ্ববিষয়ক শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসন ব্যতিরেকে অন্য বিষয় হইতে অন্তরিন্দ্রিয়ের নিগ্রহই শম। তাহা হইতে বাহ্যেন্দ্রিয়ের নিগ্রহ দম। তদতিরিক্ত বিষয় হইতে নিবর্ত্তিত বাহ্যেন্দ্রিয়ের দমন, অথবা বিধিপূর্ব্বক বিহিত কর্ম্মের পরিত্যাগই উপরতি। শীতোষ্ণাদি সহন, তিতিক্ষা। মনের একাগ্রতা, সমাধান। গুরুবাক্যাদিতে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা। সর্ব্বত্র এইরূপ সাধন কথিত হইয়াছে, এমত নহে। কিন্তু ধ্যান ধারণা তপস্যাদি প্রায়ই জ্ঞানবাদীর পক্ষে বিহিত। অতএব জ্ঞানবাদীরও উপাসনা আছে। উহা অনুশীলন বটে। আমি তোমাকে বুঝাইয়াছি যে, উপাসনাও অনুশীলন। তোমাকে বুঝাইয়াছি যে, উপাসনাও অনুশীন। অতএব জ্ঞানবাদীরও উপাসনা আছে। উহা অনুশীলন বটে। আমি অতএব জ্ঞানবাদীর ঈদৃশ অনুশীলনকে তুমি উপাসনা বলিতে পার। কিন্তু সে উপাসনা যে অসম্পূর্ণ, তাহাও পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ করিলে বুঝিতে পারিবে। যথার্থ উপাসনা ভক্তি-প