রাজা বললেন— সে ভয় নেই। নতুন মহলে রানীকে রাখব, মহল ঘিরে গড় কাটাব, গড়ের দুয়ারে পাহারা বসাব, ছোটোরানী আসতে পাবে না। সে মহলে বড়োরানী থাকবেন, বড়োরানীর বোবাকালা দাই থাকবে, আর বড়োরানীর পোষা ছেলে তুই থাকবি।
বানর বললে— মহারাজ, যাই তবে মাকে আনি।
রাজা বললেন— যাও মন্ত্রী, মহল সাজাও গে।
মন্ত্রী লক্ষ লক্ষ লোক লাগিয়ে একদিনে বড়োরানীর নতুন মহল সাজালেন।
দুওরানী ভাঙা ঘর ছেড়ে, ছেঁড়া কাঁথা ছেড়ে, সোনার শাড়ি পরে নতুন মহলে এলেন। সোনার পালঙ্কে বসলেন, সোনার থালে ভাত খেলেন, দীন-দুঃখীকে দান দিলেন, রাজ্যে জয় জয় হল; রাগে ছোটোরানীর সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল।
ডাকিনী ব্রাহ্মণী— ছোটোরানীর ‘মনের কথা’, প্রাণের বন্ধু। ছোটোরানী বলে পাঠালেন— মনের কথাকে আসতে বল, কথা আছে।
রানী ডেকেছেন— ডাকিনী বুড়ি তাড়াতাড়ি চলে এল।
রানী বললেন— এস ভাই, মনের কথা, কেমন আছ? কাছে বোসো।
ডাকিনী ব্রাহ্মণী ছোটোরানীর পাশে বসে বললে— কেন ভাই, ডেকেছ কেন? মুখখানি ভার-ভার, চোখের কোণে জল, হয়েছে কী?
রানী বললেন— হয়েছে আমার মাথা আর মুণ্ডু! সতীন আবার ঘরে ঢুকেছে, সে সোনার শাড়ি পরেছে, নতুন মহল পেয়েছে, রাজার প্রেয়সী রানী হয়েছে! ভিখারিনী দুওরানী এত দিনে সুওরানীর রানী হয়ে রাজমহল জুড়ে বসেছে! বামুন সই, দেখে অঙ্গ জ্বলে গেল, আমায় বিষ দে খেয়ে মরি, সতীনের এ অাদর প্রাণ সয় না।
ব্রাহ্মণী বললে— ছি! ছি! সই। ও কথা কি মুখে আনে! কোন্ দুঃখে বিষ খাবে? দুওরানী আজ রানী হয়েছে, কাল ভিখারিনী হবে, তুমি যেমন সুওরানী তেমনি থাকবে।
সুওরানী বললেন— না-ভাই, বাঁচতে আর সাধ নাই। আজ বাদে কাল দুওরানীর ছেলে হবে, সে ছেলে রাজা হবে! লোকে বলবে আহা, দুওরানী রত্নগর্ভা, রাজার মা হল! আর দেখনা, পোড়ামুখী সুওরানী মহারাজার সুওরানী হল, তবু রাজার কোলে দিতে ছেলে পেলে না! ছি! ছি! অমন অভাগীর মুখ দেখেনা, নাম করলে সারাদিন উপোস যায়! ভাই, এ গঞ্জনা প্রাণে সবে না। তুই বিষ দে, হয় আমি খাই, নয়তো সতীনকে খাওয়াই।
ব্রাহ্মণী বললে— চুপ কর রানী, কে কোন্ দিকে শুনতে পাবে। ভাবনা কী? চুপি চুপি বিষ এনে দেব, দুওরানীকে খেতে দিও। এখন বিদায় দাও, বিষের সন্ধানে যাই।
রানী বললেন— যাও ভাই। কিন্তু দেখো, বিষ যেন আসল হয়, খেতে-না-খেতে বড়োরানী ঘুরে পড়বে।
ডাকিনী বললে— ভয় নেই গো, ভয় নেই! আজ বাদে কাল বড়োরানীকে বিষ খাওয়াব, জন্মের মতো মা হবার সাধ ঘোচাব, তুমি নির্ভয়ে থাক।
ডাকিনী বিষের সন্ধানে গেল। বনে বনে খুঁজে খুঁজে ভরসন্ধ্যাবেলা ঝোপের আড়ালে ঘুমন্ত সাপকে মন্ত্রে বশ করে, তার মুখ থেকে কালকূট বিষ এনে দিল।
ছোটোরানী সেই বিষে মুগের নাড়ু, ক্ষীরের ছাচ, মতিচুর মেঠাই গড়ালেন। একখানা থালা সাজিয়ে ডাকিনী ব্রাহ্মণীকে বললেন— ভাই এক কাজ কর্, এই বিষের নাড়ু, বড়োরানীকে বেচে আয়।
ব্রাহ্মণী থালা হাতে বড়োরানীর নতুন মহলে গেল।
বড়োরানী বললেন— আয় লো আয়, এতদিন কোথায় ছিলি? দুওরানী বলে কি ভুলে থাকতে হয়?
ডাকিনী বললে— সে কী গো! তোমাদের খাই, তোমাদের পরি, তোমাদের কি ভুলতে পারি? এই দেখ, তোমার জন্যে যতন করে মুগের নাড়ু, ক্ষীরের ছাচ, মতিচুর মেঠাই এনেছি।
রানী দেখলেন, বুড়ি ব্রাহ্মণী বড়ো যত্ন করে, থালা সাজিয়ে সামগ্রী এনেছে। খুশি হয়ে তার দুহাতে দুমুঠো মোহর দিয়ে বিদায় করলেন, ব্রাহ্মণী হাসতে হাসতে চলে গেল।
রানী ক্ষীরের ছাচ ভেঙে খেলেন, জিবের স্বাদ গেল। মুগের নাড়ু মুখে দিলেন, গলা কাঠ হল। মতিচুর মেঠাই খেলেন, বুক যেন জ্বলে গেল। বানরকে ডেকে বললেন— ব্রাহ্মণী আমায় কী খাওয়ালে! গা-কেমন করছে, বুঝি আর বাঁচব না।
বানর বললে— চল্ মা, খাটে শুবি, অসুখ সারবে।
রানী উঠে দাঁড়ালেন, সাপের বিষ মাথায় উঠল। রানী চোখে আঁধার দেখলেন, মাথা টলে গেল, সোনার প্রতিমা শানের উপর ঘুরে পড়লেন।
বানর রানীর মাথা কোলে নিলে, হাত ধরে নাড়ি দেখলে, চোখের পাতা খুলে চোখ দেখলে— রানী অজ্ঞান, অসাড়!
বানর সোনার প্রতিমা বড়োরানীকে সোনার খাটে শুইয়ে দিয়ে ওষুধের সন্ধানে বনে ছুটে গেল। বন থেকে কে জানে কী লতাপাতা, কোন গাছের কী শিকড় এনে নতুন শিলে বেটে বড়োরানীকে খাওয়াতে লাগল।
রাজবাড়িতে খবর গেল— বড়োরানী বিষ খেয়েছেন। রাজা উঠতে-পড়তে রানীর মহলে এলেন। রাজমন্ত্রী ছুটতে ছুটতে সঙ্গে এলেন। রাজবৈদ্য মন্তর আওড়াতে আওড়াতে তারপর এলেন। তারপর রাজার লোক-লস্কর, দাসী-বাঁদী যে যেখানে ছিল হাজির হল।
বানর বললে— মহারাজ, এত লোক কেন এনেছ? আমি মাকে ওষুধ দিয়েছি, মা আমার ভালো আছেন, একটু ঘুমোতে দাও। এত লোককে যেত বল।
রাজা বিষের নাড়ু পরখ করিয়ে রাজবৈদ্যকে বিদায় করলেন। রাজ্যের ভার দিয়ে রাজমন্ত্রীকে বিদায় করলেন। বড়োরানীর মহলে নিজে রইলেন।
তিন দিন, তিন রাত বড়োরানী অজ্ঞান। চার দিনে জ্ঞান হল, বড়োরানী চোখ মেলে চাইলেন।
বানর রাজাকে এসে খবর দিলে— মহারাজ, বড়োরানী সেরে উঠেছেন, তোমার একটি রাজচক্রবর্তী ছেলে হয়েছে।
রাজ বানরকে হীরেব হার খুলে দিয়ে বললেন— চল বানর, বড়োরানীকে আর বড়োরানীর ছেলেকে দেখে আসি।