রানী বললেন— ওরে, রাজা আজ শুনলেন ছেলে হবে, কাল শুনবেন মিছে কথা। আজ রাজা গলায় দিতে হার দিলেন কাল যে মাথা নিতে হুকুম দেবেন। হায় হায়, কী করলি? একমুঠো খেতে পাই, একপাশে পড়ে থাকি, তবু বছর গেলে রাজার দেখা পাই, তুই আমার তাও ঘোচালি? ওরে তুই কী সর্বনাশ করলি? মিছে খবর কেন রটালি? এ জঞ্জাল কেন ঘটালি?
বানর বললে— মা তোর ভয় কী, ভাবিস কেন? এ দশমাস চুপ করে থাক্, সবাই জানুক— বড়োরানীর ছেলে হবে। তারপর রাজা যখন ছেলে দেখবেন তখন তোর কোলে সোনারচাঁদ ছেলে দেব, তুই রাজাকে দেখাস। এখন চল, বেলা হল, খিদে পেয়েছে।
রানী বললেন— চল্ বাছা চল্। বাটি পুরে জল রেখেছি, গাছের ফল এনেছি, খাবি চল্।
রানী ভাঙা পিঁড়েয় বানরকে খাওয়াতে বসলেন।
আর রাজা ছোটোরানীর ঘরে গেলেন।
ছোটে রানী কুস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সোনার পলিঙ্কে বসে বসে ভাবছেন, এমন সময় রাজ এসে খবর দিলেন— আরে শুনেছ ছোটোরানী, বড়োরানীর ছেলে হবে! বড়ো ভাবনা ছিল রাজসিংহাসন কাকে দেব, এতদিনে ভাবনা ঘুচল। যদি ছেলে হয় তাকে রাজা করব, আর যদি মেয়ে হয়, তবে তার বিয়ে দিয়ে জামাইকে রাজ্য দেব। রানী, বড়ো ভাবনা ছিল, এতদিনে নিশ্চিন্ত হলুম।
রানী বললেন— পারিনে বাপু, আপনার জ্বালায় বাঁচিনে, পরের ভাবনা!
রাজা বললেন— সে কী রানী? এমন সুখের দিনে এমন কথা বলতে হয়? রাজপুত্র কোলে পাব, রাজ সিংহাসনে রাজা করব, এ কথা শুনে মুখ-ভার করে? রানী, রাজবাড়িতে সবার মুখে হাসি, তুমি কেন অকল্যাণ কর?
রানী বললেন— আর পারিনে! কার ছেলে রাজা হবে, কার মেয়ে রাজ্য পাবে, কে রাজসিংহাসনে বসবে, এত ভাবনা ভাবতে পারিনে। নিজের জ্বালায় মরি, পরের ছেলে মোলো বাঁচল তার খবর রাখিনে। বাবারে, সকালবেলা বকে বকে ঘুম হল না, মাথা ধরল, যাই নেয়ে আসি।
রাগভরে ছোটোরানী অাটগাছা চুড়ি, দশগাছা মল্ ঝমঝমিয়ে একদিকে চলে গেলেন।
রাজার বড়ো রাগ হল, রাজকুমারকে ছোটোরানী মর্ বললে। রাজা মুখ আঁধার করে বার-মহলে চলে এলেন। রাজা-রানীতে ঝগড়া হল। রাজা আর ছোটোরানীর মুখ দেখলেন না, বড়োরানীর ঘরেও গেলেন না— ছোটোরানী শুনে যদি বিষ খাওয়ায়, বড়োরানীকে প্রাণে মারে! রাজা বার-মহলে একলা রইলেন।
এক মাস গেল, দুমাস গেল, দুমাস গিয়ে তিন মাস গেল, রাজা-রানীর ভাব হল না। ঝগড়ায় ঝগড়ায় চার মাস কাটল। পাঁচ মাসে দুওরানীর পোষা বানর রাজার সঙ্গে দেখা করলে। রাজা বললেন— কী হে বানর, খবর কী?
বানর বললে— মহারাজ, মায়ের বড়ো দুঃখ! মোটা চালের ভাত মুখে রোচে না, মা আমার না-খেয়ে কাহিল হলেন।
রাজা বললেন— এ কথা তো আমি জানিনে। মন্ত্রীবর, যাও এখনি সরু চালের ভাত, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন, সোনার থালে সোনার বাটিতে বড়োরানীকে পাঠিয়ে দাও। আজ থেকে আমি যা খাই বড়োরানীও তাই খাবেন। যাও মন্ত্রী, বানরকে হাজার মোহর দিয়ে বিদায় কর।
মন্ত্রী বানরকে বিদায় করে রান্নাঘরে গেলেন। অার রানীর বানর মোহরের তোড়া নিয়ে রানীর কাছে এল।
রানী বললেন— আজ আবার কোথা ছিলি? এতখানি বেলা হল নাইতে পেলুম না, রাঁধব কখন, খাব কখন?
বানর বললে— মা আর তোকে রাঁধতে হবে না। রাজবাড়ি থেকে সোনার থালায় সোনার বাটিতে সরু চালের ভাত, পঞ্চাশ ব্যঞ্জন আসবে, তাড়াতাড়ি নেয়ে আয়।
রানী নাইতে গেলেন। বানর একমুঠো মোহর নিয়ে বাজারে গেল। ষোলো থান মোহরে যোলো জন ঘরামি নিলে, ষোলে গাড়ি খড় নিলে, ষোলোশো বাঁশ নিলে। সেই ষোলোশো বাঁশ দিয়ে, যোলো গাড়ি খড় দিয়ে, ষোলোজন ঘরামি খাটিয়ে, চক্ষের নিমেষে দুওরানীর বানর ভাঙাঘর নতুন করলে। শোবার ঘরে নতুন কাঁথা পাতলে, খাবার ঘরে নতুন পিঁড়ি পাতলে, রাজবাড়ির ষোলো বামুনে রানীর ভাত নিয়ে এল; ষোলো মোহর বিদায় পেলে।
দুওরানী নেয়ে এলেন। এসে দেখলেন— ঘর নতুন! ঘরের চাল নতুন! চালের খড় নতুন! মেঝেয় নতুন কাঁথা! অালনায় নতুন শাড়ি! রানী অবাক হলেন। বানরকে বললেন— বাছা, ভাঙা ঘর দেখে ঘাটে গেলুম, এসে দেখি নতুন ঘর! কেমন করে হল?
বানর বলল— মা, রাজামশায় মোহর দিয়েছেন। সেই মোহরে ভাঙা ঘর নতুন করেছি, ছেঁড়া কাঁথা নতুন করেছি, নতুন পিঁড়ে পেতেছি, তুই সোনার থালে গরম ভাত, সোনার বাটিতে তপ্ত দুধ খাবি চল।
রানী খেতে বসলেন। কতদিন পরে সোনার থালায় ভাত খেলেন, সোনার ঘটিতে মুখ ধুলেন, সোনার বাটায় পান খেলেন, তবু মনে সুখ পেলেন না। রানী রাজভোগ খান আর ভাবেন— আজ রাজা সোনার থালে ভাত পাঠালেন, কাল হয়তো মশানে নিয়ে মাথা কাটবেন।
এমনি করে ভয়ে-ভয়ে এক মাস, দুমাস, তিন মাস গেল। বড়োরানীর নতুন ঘর পুরোনো হল, ঘরের চাল ফুটাে হল, চালের খড় উড়ে গেল। বানর রাজার সঙ্গে দেখা করলে।
রাজা বললেন— কী বানর, কী মনে করে?
বানর বললে— মহারাজ, ভয়ে কব না নিৰ্ভয়ে কব?
রাজা বললেন— নিৰ্ভয়ে কও।
বানর বললে—মহারাজ, ভাঙা ঘরে মা আমার বড়ো দুঃখ পান। ঘরের দুয়োর ফাটা, চালে খড় নেই, শীতের হিম ঘরে আসে। মা আমার গায়ে দিতে নেপ পান না, আগুন জ্বালতে কাঠ পান না, সার রাত শীতে কাঁপেন।
রাজা বললেন— তাইতো! তাইতো! একথা বলতে হয়। বানর তোর মাকে রাজবাড়িতে নিয়ে আয়, আমি মহল সাজাতে বলি।
বানর বললে— মহারাজ, মাকে আনতে ভয় হয়, ছোটোরানী বিষ খাওয়াবে।