সুকুমার চোখ খোলে। সত্যি রাস্তাঘাটে ঘুমানো মানুষ, চোখ খোলামাত্রই যেন জাগরণে। আর, সেই জাগরণে ঝিলিককে কিছু বুঝতে না-দিরে সুকুমার তাকে টেনে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে। ঠোঁটে ঠোঁটে খুঁজতে চায়। কিন্তু ঝিলিক দাঁড়িয়ে থাকায়, তারপক্ষে ঘাড় তোলা যেন সহজ। সে বলে, এই দিনে দুপুরে! এই সময়! এই জায়গায়? তোমার আর আক্কেল হল না।
কেন আগে যেন দিনে দুপুরে কোনও দিন কিছু করিনি। মনে আছে, আমারে রূপসার পড়ে দিনের বেলা ভজাইলে?
কেডা ভজাইল তোমারে? আমি? আমার আর খাইয়ে কাজ নেই।
তালি কি আমি ভজাইলাম?
হইচে। এহোনও কতা কইয়ে না। ওঠো। খিদেয় জীবন যায়। কয়ডা সাগুদানা আইনে দিয়ে এইরাম কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোইয়ে রইছো?
তা কী করব। কোর্টের সামনে গেইলাম, মানুষজন নেই, সুকুমার উঠতে উঠতে বলে, তালি ঘুমাইয়ে থাকপো না তো করব কী?
সেই জন্যি এই বেলা পর্যন্ত!
আজগর ভাইর কী অবস্থা?
ঘুমোচ্ছে। আমরা দুইটে মানুষ কী খাইচি না খাইচি, কোথায় গেইচি না গেইচি, তোমারে জরিনাদিও খুঁজদি গেইচে। পারোও। মানুষের নাওয়া খাওয়া লাগে না!
হইচে। উঠতিচি। তোমার গলা কোমল না মাইজে বউ।
কথাটা খুবই কোমল গলায় বলল সুকুমার। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওই কথা বলেই সে ঝিলিককে জড়িয়ে ধরে, গালে আলত চুমু দেয়। ঝিলিক তাতে অবাক হল না তেমন, এমন কাজ সুযোগ পেলে সুকুমার করে। কিন্তু এখন কেন? সে বলে, হইচে, চলো।
তুমি যাও। আমি আসতিচি। সে পেচ্ছাপ করে আসবে সেই ইঙ্গিত করল।
নীচে নেমে ঝিলিক হোটেলের দরজার দিকে যায়, সুকুমার পিছনে। আজগরের ঝুপড়ি পর্যন্ত যেতে হল না ঝিলিককে। তার আগেই নদীর কূলে জরিনার সঙ্গে দেখা। জরিনা ঝিলিককে দেখেই জানতে চায়, পাইচো তোমার নাগররে? আমি এই সারা বাড়ি খুঁইজে আসলাম, সে চান্দু কোনও জায়গায় নেই।
পাইচি। ওই আলতাফ মিয়ার হোটেলের দোতলায় প্যান্ট পইরে সে ঘুমোইয়ে রইচে। এদিক তুমিও তো গেইচো কোম সমায় না, বাপুরে বাপুরে তোমরা সব পারোও এক-একজন। আমি এই জ্বরের মানুষটার মাথার ধারে বইসে রইচি তো রইচি। কেউ যদি আসে।
জরিনার মনে হল, গেরস্ত ঘরের বউ ঝিলিক। তারমতো এমন এখানে ওখানে বেরিয়ে বেড়ানো পদের না। তাছাড়া, এখনও এই যেখানে রাত সেখানে কাত শিখতে পারেনি। থাকুক সুকুমারের সাথে কিছুদিন, সব এক সময় শিখে যাবে। তবু সে যেন ঝিলিককে বুঝ দিতে বলল, হয় এট্টু দেরি হইয়ে গেইচে আমার আসতি। কিছু মনে কইরে না। তা সে বাবু যে আসতিচে না?
আসপেনে। এই আইসে গেল।
সুকুমার এলে তারা কোথায় যাবে তাই নিয়ে আলোচনা করে। ঝিলিক জানায়, একটু আগে আলতাফ তাদের খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। একথা শুনে সুকুমার একটু বিস্ময়ে চোখ বড়ো করে ঝিলিকের দিকে তাকায়। ওদিকে জরিনা বলে, মাগনা খাওয়াবে? টাহা নেবে না? ঝিলিক এর উত্তরে বলে, দেবেহানে মাগনা।
জরিনা বলে, ওই শগুন খাওয়াবেনে মাগনা?
এসব কথায় কোনও সমাধান হয় না। যদি বৃষ্টি এখন নেই। চাইলে তারা হেঁটে নাগের বাজারে হাফেজের হোটেলে যেতে পারে। তবে, ঝিলিকের মনে হয়, এত খিদেয় এতটা পথ যাওয়া যাবে লাগবে না। তাছাড়া, আলতাফ তো বলেছে, দাম কম নেবে। সে কথা তাদের বলে সে। ঝিলিকের এ কথায় সুকুমার এট্টু অবাক হয়। কয়দিন আগেও যে ঝিলিক হিন্দু হোটেল ছাড়া খেতে চাইত না, সে এখন যাবে আলতাফের হোটেলে!
তারা আলতাফের হোটেলে খেতে যায়। খেতে খেতে জরিনা বলে, সুকুমার ভাই, এইভাবে সারা দিন পেরায় ঘুমাইয়া কাটাইলা?
এর উত্তরে অবশ্য সুকুমার বলেছে, এই বাদলায় কার কী করার আছে? এর ভিতরে সুকুমার জানতে চেয়েছে আজগর অবস্থা এখন কেমন। একটু আগে আজগরকে দেখে সুকুমারের মনে। হয়েছে, এই দুইদিনে লোকটা শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। কয়দিনে সেরে উঠবে পারবে একমাত্র ভগবান জানে। এইভাবে হাফেজের আর আলতাফের হোটেলে বাকি খাওয়া!
কিন্তু জরিনা কেন কথাটা বলেছে, তা সুকুমার কিছুটা হলেও বুঝতে পারলেও কারই-বা কী করার আছে। তবু এ ফাঁকে সুকুমার ভেবেছে, যদি আকাশ এমনই ধরা থাকে, তাহলে বল আর তাস নিয়ে চলে যাবে রেল স্টেশনে। ওখানে হয়তো খেলা দেখাতে পারবে। যদি পারে তাহলে, আলতাফের ধারের কিছুটা হলেও শোধ হবে। কিন্তু এই ভাবনার কিছুই সে ঝিলিককে বলল না, জরিনার কথারও কোনও উত্তর দিল না। বরং, ঝিলিকের কাছে জানতে চাইল, ঝিলিক আবার মোড়েলগঞ্জ যাবে কি না?
এ সবই এখন, আজকের এই দিনে কিছুটা হলেও অপ্রয়োজনীয় কথা। কারণ, আবহাওয়ার ভাবগতিক ভালো না হলে কোনওতায় কিছু আসবে যাবে না। আবার, যদি আজগরের শরীর ভালো না-হয়, তাহলে জরিনাকেও তাদের টেনে যেতে হবে।
খাওয়া প্রায় শেষ হতে সুকুমার জানতে চায়, আচ্ছা, বান্দর দুটোরে কিচু খাতি দেয়া হইছে?
জরিনা জানাল, সে সেই কলা কিনে দেয়ার পরে একবার বিস্কুট খাইয়েছে। আর লালির কাছ থেকে এসেছিল দুইখানা বাসি রুটি। সেইসব খেয়ে ছাউনির তলে এখনও ঝিমাচ্ছে। ওই দুটোও অবাক আজ অনেকদিন বাদে তাদের কেন কোর্ট চত্বরে নেওয়া হল না, আর ওই ট্রেজারির পাশে কুল গাছটার নীচে কেন আজ তাদের বেঁধে রাখা হল না।
এরপর বিকেলের অনেকখানিক কেটে গেলে, জরিনা আর ঝিলিক বসে থাকে আজগরের মাথার কাছে। এর আগে, আলতাফের হোটেল থেকে ফুটিয়ে আনা সাগুদানা আর ভাতের মাড় খাওয়ায় আজগরকে। আজগর আবার ঘুমিয়ে যায়। তারা দুজন নিজেদের সুখ-দুখের কথা কয়। তারপর কী মনে করে চলে যায় লঞ্চের ঘাটের পন্টুনে। কদম আলি নেই। কিন্তু একটু আগেই জরিনা তাকে দেখেছিল নদীর কূলে কিছু শ্যাওড়া গাছ আর কলা গাছের নীচে কেঁচো খুঁজতে। মানুষটা গেল কোথায়। এখন তার বড়শিতে মাছ ধরার সময়। জরিনা জানে, কদম আলির বড়শি কোথায় থাকে। বড়শি খুঁজতে গিয়ে তারপাশে একটা আঁচায় কেঁচেও পেল। তারপর জরিনা আর ঝিলিক পন্টুনে বসে মাছ ধরতে শুরু করে।