আজগর গলা নামিয়ে হু-হু করে। ডানে বামে মাথা নাড়ে। কোনও কথা বলে না।
জরিনা বোঝে, আজগর মদ গিলেছে! কিন্তু কখন? ঘুম থেকে উঠে। পেল কোথায়। যদি এখন সেকথা সে জানতে চায়ও না। আজগর মাঝে মধ্যে কর্মকার পট্টির পিছনের দোকান থেকে সালসার ছোটো বোতল আনে, সে জানে। সন্ধ্যায় খাওয়ার আগে গলায় ঢালে, রাত্রেও। কিন্তু আজ এই জিনিস আনল কখন আর পেল কোথায়? জরিনা তা জানতে না-চেয়ে শুধু কান্নার কারণ জানতে চায়। বড়ো অদ্ভূত এই কান্না। অন্ধকার চরাচরে মিশে যাচ্ছে কান্নার সুর।
জরিনা গলা নামিয়ে জানতে চায়, কান্দো কেন? হইল কী?
আজগর আবারও হু-হু করে। দুদিকে মাথা নাড়ে। প্রায় মাসখানেক আগে সেদিন পয়লা আজগরের কান্নার কারণ জানতে পারে জরিনা।
০৪. লঞ্চঘাট থেকে নদীর কূল ধরে
লঞ্চঘাট থেকে নদীর কূল ধরে নাগের বাজারের দিকে এগোলে, মাঝামাঝি জায়গায় হাফেজ আর লালির রুটির দোকান। লালি হাফিজের বউ। সেখানে রুটি কিনতে এসেছে জরিনা। আজগর সঙ্গে আসেনি। আজগর যে আসবে না, জরিনা জানত। দুপুরের পর থেকে জরিনার সঙ্গে ওই সমস্ত করে, তারপর লোকটা লম্বা ঘুম দিল। জরিনা বেশিক্ষণ ঘুমায় পর থেকে অথবা জরিনার ঘুম আসেনি। সে উঠে সুকুমার আর ঝিলিককে খুঁজেছে। তখন জরিনার আসলে কোনও কাজ ছিল না। সে জানে, অমন সব করার পরে আজগর প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমাবে। তাছাড়া সুকুমারের সঙ্গে ওই ঝগড়ার আজগরের মনটা খারাপ। একেবার ঘুমে তলিয়ে গেলে, উঠে যদি মনটা ভালো হয়, একটু ফুরফুরা আজগরকে দেখতে তখন তারও ভালো লাগবে। শুধু শুধু মেজাজ করে তার সঙ্গে কথা বলবে না। সন্ধ্যার দিকে এক কাপ চা খেয়ে তারপর কিছুক্ষণ নদীর কূলে হাওয়া বাতাস খাবে।
কিন্তু তার আগে দীর্ঘ সময় জরিনার। এমন গরমের দিনে বিকালে একটু বাতাস চাললেও পারে। একবার নদীর এপার ওপারের নারকেল গাছের পাতাগুলোয় বাতাসের নাচন দেখেছিল। তখন জরিনার মনে হয়েছিল, এই যে বাতাস চালাল, এবার দুনিয়াদারি ঠান্ডা হবে। কিন্তু কোথায় কী? একটু বাদেই আর নেই। একটা নারকেল গাছের পাতাও কাঁপল না। অল্প অল্প হলেও একটাও মেঘনিশ গাছের থেকে ঝরে পড়ল না পাতা। নদীর পানিতে কোনও তরঙ্গ বয়ে গেল না। বরং, দুপুরের শেষ দিকে তাপ যেন আরও বাড়ল। বিকাল পর্যন্ত সেই তাপ। তার ভিতরে আজগর ওই ঝুপড়ি ভেঁস ভেঁস করে ঘুমায়। এদিকে জরিনা কাপড়-চোপড় একটু গুছিয়ে পরে, চুলটা একটু গুছিয়ে এক প্যাঁচে খোঁপা করে লঞ্চঘাটের পন্টুনের ওপর আসে। মনে আশা, এই নদীর কূল ধরে ডাক বাংলো ঘাট দিয়ে ঢুকে পুরো কোর্ট চত্বর আর ক্লাব আর আশেপাশে সুকুমার আর ঝিলিককে খুঁজে আসবে।
জরিনা জানে, বিকালে কোর্ট চত্বর ফাঁকা। অফিস আদালতে তখন মানুষের আর কাজ কী? তবে ডিসি অফিসে আলো জ্বলে, সেখানে বড়ো বড়ো সাহেবরা কত পদের মিটিং করে। সেই সোজা কোর্ট মসজিদ রোডের দোকানে তখন মানুষ, আরও এগোলে কাজী নজরুল ইসলাম রোড কি কাপুড়ে পট্টিতেও মানুষজন তখন গিজগিজ। ওই কাজী নজরুল ইসলাম রোডে পড়ে বাঁয়ের হাতায় আবার মেইন রোড। ওটাই রাহাতের মোড়, লঞ্চঘাটের একেবারে লাগোয়া। জরিনা এই পথটুকু ঘুরে আসবে ঠিক করে। রাহাতের মোড় থেকে হোটেলের পাশের গলি ধরে আবার যাবে নদীর কূলে। যাওয়ার আগে ওই ভাতের হোটেল। এমনকি একবার লঞ্চঘাটে আলতাফের ভাতের হোটেলেও যেতে পারে। কিন্তু আলতাফের চোখ বড়ো খারাপ, শালার কথাও খারাপ। মাছের মাথা খাইয়ে যাতি কয়! তাকে বলেছে, একদিন আসতে, হোটেলের দোতলায় নিয়ে পাশে বসিয়ে কাতলার মাথা খাওয়াবে। শালা, কাতলার মাথা খাওয়াবে না সস্তা মেইড মাছের তা জানে কেডা?
থাক, আজগরকে ঘুমন্ত রেখে আগে লঞ্চঘাটের পন্টুনে এসে জরিনা দেখে, সব লঞ্চ ছেড়ে গেছে, শুধু ঢাকার লঞ্চখানা বাঁধা। আর যেসব লঞ্চ ফিরে আসবে, সেগুলোও আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা। কদম আলি পন্টুনের এক কোনায় বসে বড়ালিতে গুলসা টেংরা ধরছে। এই ভাটির গোনে টেংরা বাঁধবেই। আগে জরিনার এসব ভালোই হিসেব থাকত। আজকাল কখন কোন গোন যায়, কী হয় না হয়, ওপার চরগার মাঠে জোগার গোনে মাছ ওঠে কি ওঠে না–সেসব কোনও কিছুই তার মাথায় থাকে না। অথবা, এসব জরিনা মাথায় রাখার প্রয়োজনবোধও করে না। দরকার কী? তবু, ওই কদম আলির কাছে থেকে বড়শি নিয়ে একদিন দুইদিন কি সেও বড়শি বায়নি। এখনও চাইলে বাইতে পারে। বড়শি চাইলেই কদম আলি বলবে, যা ওইদিক, ওপাশে দেখে উপরের দিক আর একটা বড়শি আছে। আইসে বা। তয় মাছ নিয়ে বাজারে যাতি পারবি না, আমারে দিয়ে যাবি। তোগে চাউল চুলো নেই, মাছ দিয়ে করবিডা কী?
হুঁ, সারাবেলা বড়শি বাইয়ে, মাছ দিয়ে যাও ওনারে! জরিনা ভাবে। কিন্তু কদম আলির কথাও তো সত্যি, জরিনার চাল-চুলো নেই। চাল-চুলো নেই আজগরেরও। কদম আলির সংসার আছে। সে কি আর তাদের মতন। ঘাটের কেয়ারটেকার। সরকারি চাকরি। পুরোন বাজারে বাসা তার। লঞ্চ না থাকলে, যাত্রী না আসলে এই সময়ে তার কাজ কী? তখন পন্টুনে বসে বড়শি বায়। এমনকি নদীর একেবারে কুলে শ্যাওড়া গাছ, গোলপাতা গাছের তলায়ও টেংরা ধরে। কখনও এক সঙ্গে দুটো বড়শিতে মাছ ধরে কদম। তখনও জরিনা পাশে গিয়ে দাঁড়ালে বলে, কী মাছ ধরবি? তারপর জানায় কোথায় আরও বড়শি আছে।